Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya separation-last-part

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২১)

Reading Time: 5 minutes

‘সুরমা…তোর সাথে আমার একটু কথা আছে।’

‘কী কথা? খুব জরুরি কিছু নাকি? এমনভাবে বলছিস! কথা থাকলে কথা বলে ফ্যাল!’

‘তুই কি কোথাও বেরুচ্ছিস? আমার একটু সময় লাগবে কথাগুলো বলতে।’

‘হ্যাঁ বেরুচ্ছিলাম। একটা জরুরি নোট আনতে এক ফ্রেণ্ডের বাসায় যাবো। একটু দেরি হতে পারে।’

‘সেই ফ্রেণ্ডটা কি বিপ্লব? বিপ্লব আজকাল কমার্সের নোট বানাতে শুরু করেছে নাকি?’

সুরমা ঘষ ঘষ করে ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষছিল। আমার কথা শুনে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সন্দেহ। খুব ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে মুখের রঙ। সন্দেহ রূপ নিচ্ছে অন্যকিছুতে। আমি অবাক চোখে সুরমার এই অনুভূতির রূপান্তর দেখছি। সুরমা এত রাতারাতি বদলে গেল কীভাবে? নাকি ও বরাবরই এমন ছিল? আমিই শুরুতে বুঝতে পারিনি। হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল একটি মেয়ের মাঝে এত চাতুর্য এত সন্দেহ… এ তো আমার ধারণারও বাইরে ছিল!

চোখেমুখ শক্ত করে বিদ্রুপের ভাষায় সুরমা বললো, ‘ওহ! তাহলে গোয়েন্দাগিরি করছিস আমার পেছনে? সেদিন তাহলে মার্কেটে না, গোয়েন্দাগিরি করতেই গিয়েছিলি! নাকি গোয়েন্দা লাগিয়েছিস পেছনে? যা খুশি লাগা। তোকে সব কথা বলতে আমি বাধ্য নই বুঝলি?’

আমি প্রাণপনে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। সুরমা আমার মামাত বোন। সেই মামার মেয়ে, যার দয়া দাক্ষিণ্যের কাছে আজ আমি আর নয়ন আকণ্ঠ ডুবে আছি। জেনেবুঝে আমি সুরমার কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারি না। তারপরেও সুরমা যে ব্যবহারটা করছে আর যেভাবে শ্লেষ ছুঁড়ে মারছে, তাতে আত্মসম্মান থাকলে কেউ আর ওকে ঘাঁটাতে যেত না।

আমিও যেতাম না। বড়মামার প্রতি কৃতজ্ঞতার নাগপাশকে একপাশে সরিয়ে রেখে হলেও আমি সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকতাম। কিন্তু আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, আমার হাত ধরেই সুরমা আর সুমনের সম্পর্কটা জন্মলাভ করেছিল। আমি মাঝখানে না এলে সুরমা হয়ত কোনোদিনই সুমনের নাগাল পেত না। অন্তত এত সহজে নিশ্চয়ই পেত না।

সুমনের সামনে ছিল ঝকমকে ভবিষ্যতের হাতছানি। মুখে স্বীকার না করলেও কলেজে আমাদের ক্লাসের অনেক মেয়েই মনে মনে সুমনকে পছন্দ করতো। টিচারদের চোখেমুখে ঠিকরে বেরুতো সুমনের প্রতি তাদের আস্থার গল্প। সেই সুমন আজ শুধুমাত্র আমার ছোট একটা ভুলের জন্যই এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। কাজেই সুরমার এসব আজেবাজে কথায় কান দিলে আমার চলবে না। যে নষ্ট খেলা সে শুরু করেছে, সেটা থেকে তাকে সরাতে হবে।

সুরমার শ্লেষমেশানো ব্যঙ্গোক্তিকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দিয়ে বললাম, ‘গোয়েন্দা লাগানোর জন্য বা নিজে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন সুরমা। আমার হাতে নষ্ট করার মতো এত অফুরান সময় নেই। তুই এখন নতুন কোন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিস, সেটা শুধু আমি কেন… তোর পরিচিতরা সবাই জানে!’

আমার কথাকে আমলে না এনে সুরমা বললো, ‘আমার ক’জন পরিচিতকে তুই চিনিস? এমনভাবে বলছিস যে! ভালোয় ভালোয় বললেই হয় যে, সুমনের কাছ থেকে শুনেছিস। খামাখা এত ত্যানা প্যাচাচ্ছিস কেন? তোর সুমন এর চেয়ে আর বেশি কী পারবে? পারেই খালি মেয়েমানুষের মতো ছোঁক ছোঁক করতে! ভেড়ুয়া একটা!’

আমার মাথায় একদম আগুন ধরে গেল! খুবই আপত্তিকর কথাবার্তা বলছে সুরমা। আমার সুমন…এই কথার মানে কী? এতদিন ধরে এই সুমনের সঙ্গে ফস্টিনস্টি রঙ তামাশা করলো সে, আর ছুঁড়ে ফেলার সময় সেই সুমন হয়ে গেল আরেকজনের সম্পত্তি?

আর সুমন মেয়েমানুষের মতো ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়? বাহ! এটাও তো ভারী নতুন কথা!


আরো পড়ুন:  খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-২০)


মেজাজ সামলে রাখা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ছে। তবু যথাসম্ভব ধীরস্থিরভাবে সুরমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুরমা, দ্যাখ…শুধু শুধু হাবিজাবি কথা বলে আমরা দুজনই দুজনের সময় নষ্ট করছি। দয়া করে আমাকে ঠিক করে বল, কেন সুমনের সাথে এমন করছিস? সুমন কি এখন কেয়ার করছে না তোকে? ও যদি তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি…আমি নিজে সুমনকে ছাড়বো না।

কিন্তু আমার কাছে তো এমনটা মনে হচ্ছে না! সুমন এখনো তোকে ফেরানোর জন্য আকুল হয়ে আছে। ছেলেটার অবস্থা কী হয়েছে দেখেছিস একবার? সুরমা…আমার দিকটা একটু চিন্তা কর! আমি নিজে তোদের এই সম্পর্কের সাথে জড়িত ছিলাম। এখন সেই সম্পর্কের এমন পরিণতি হলে আমার কেমন লাগে বল? তুই কি একটুও বিষয়টা চিন্তা করছিস না?’

সুরমা বুঝি সামান্য একটু নরম হলো এই কথায়। আগের চেয়ে গলার ঝাঁঝ খানিকটা কমে এলো। অপেক্ষাকৃত নরম গলায় বললো, ‘নীরা, আমি এই কথা তোকে আগেই বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুই অযথা বেশি সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাবি দেখে কিছু জানাইনি।

আসলে সুমনের স্বভাবটা কেমন যেন মেয়েলী। একজন পুরুষ মানুষের এমন মিনমিনে স্বভাব হবে কেন? আর সবকিছুতেই এত পজেসিভনেস! বাপরে বাপ! বিয়ের আগেই এই…পরে না জানি কী হবে! কোথায় গেলাম, কার সাথে কথা বললাম, ফোন ধরতে এত দেরি হলো কেন…হাজারটা প্রশ্ন। আর সব কথার মধ্যে এক প্যানপ্যানানি তো আছেই…তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না! আরে! ভালোবাসা কি খাঁচায় রেখে দেওয়া পাখি নাকি যে সবসময় চোখের সামনে বন্দি করে রাখতে হবে?

দ্যাখ নীরা…আমার সাফ সাফ কথা। আমি এত প্যানপ্যানে লোকের সাথে সারাজীবন কাটাতে পারবো না! আমার জীবনটা আমি আর দশজন মেয়ের মতো করে কাটাতে চাই না। জীবনে যদি এ্যাডভঞ্চার না থাকে তাহলে কীসের মজা? বিয়ের পরে কি তাহলে বন্ধুবান্ধব বিসর্জন দিয়ে শুধু ঘর সংসার করেই জীবন কাটাতে হবে? উঁহু! সেটা আমি পারবো না!’

‘তাহলে কী পারবি…নিত্যনতুন ছেলেছোকরা জুটিয়ে নতুন নতুন স্বাদ নিতে? ছিঃ সুরমা তোর লজ্জা লাগে না? আর শেষমেষ বিপ্লব! তুই ভালোমত চিনিস বিপ্লবকে? একটা ধড়িবাজ বাজে ছেলে। দুনিয়ার নোংরা কিছু বন্ধুবান্ধব আছে। মেয়েদের দিকে বাজে চোখে তাকায়…বাপের টাকায় ফূর্তি করে বেড়ায়! কী দেখে বিপ্লবে মজলি বল তো? ওর চকমকে পোষাক নাকি ধূর্ত চালবাজমার্কা কথাবার্তা শুনে?’

‘বিপ্লব যেমনই হোক, সুমনের মতো প্যানপ্যানে না। ওর মধ্যে পৌরুষ আছে বুঝেছিস? অবশ্য তুই তো গুডি গার্ল, এসব তোর বোঝার কথা না! শোন খামাখা আমাকে ঘাঁটাতে আসিস না! আমি তোদের মতো গুডি গার্ল না। আমি কী করছি, কেন করছি…ভালোভাবেই জানি। আমার পথ আটকাতে আসলে ভালো হবে না। আমাদের বাসায় থাকতে এসেছিস, ভালো কথা। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের যেকোন কাজেই নাক গলাবি! আমার ভালোটা আমাকেই বুঝতে দে!’

সুরমা আর একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

দুই মামী রান্নাঘরে হিমশিম খাচ্ছিল। বড়মামা স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। ছোটমামাও অফিসে গেছে। সুনেত্রা নয়ন সুজন… কেউওই বাসায় নেই। সুরমার এই ঔদ্ধত্য বেহায়াপনা কেউই দেখতে পারলো না, জানতেও পারলো না। শুধু আমি হয়ে রইলাম নীরব সাক্ষী। একসময় মনে হলো, জানিয়ে দেওয়াটা আমার কর্তব্য। পরক্ষণেই মত পাল্টালাম। যে নিজে পা ভাঙার জন্য গর্তে পা দিয়ে বসে আছে, তাকে আমি কীভাবে বাঁচাবো?

আমাদের দোতলার ঘরের জানালার কাছে এসে দেখি, রাস্তার মোড়ে বিপ্লব দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে বুকখোলা শার্ট। মাথার চুলে কাকের বাসা, সেটাকে একটু পর পর হাত দিয়ে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে সিগারেট। মোটরসাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে আমাদের ঘরের দিকেই তাকিয়ে আছে বিপ্লব।

আমি জানালার কাছে গিয়ে দাড়াতেই বিপ্লব আমাকে হাত ইশারা করলো। একবার ইচ্ছে হলো সরে আসি। কিন্তু কীসের এক অব্যক্ত জেদে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। বিপ্লবের হাত ইশারা কিংবা ইঙ্গিত কোনোকিছুকেই পাত্তা না দিয়ে পরবর্তী অংশ দেখার রোখ চেপে গেল আমার মধ্যে।

একটু পরেই সুরমা হেলেদুলে ওর দিকে এগিয়ে গেল।

দুজনের মধ্যে কিছু একটা কথাবার্তা হলো। বিপ্লব আর সুরমা দুজনকে মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকাতে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, আমাকে নিয়েই হয়ত কথাবার্তা চলছে এখন। দুজনকে একটু হাসাহাসিও করতে দেখলাম। তারপর হোণ্ডাতে বিপ্লবের পেছনে বসে ওরা সাঁই করে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

আমার চোখদুটো অদম্য রাগে জ্বলতে লাগলো। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে গেলাম আমি। হাজার চিন্তা করেও যুতসই কিছুই বের করতে পারলাম না।

সেদিন রাতে আমি অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা ফোন পেলাম। রিসিভ করতেই বিপ্লবের গা জ্বলানো আওয়াজটা ভেসে এলো ওপাশ থেকে।

‘কী…কেমন দেখলে আমাদের? কিউট না? তুমি কি মনে করছিলা, বিপ্লব এত সহজেই সবকিছু ভুলে যাবে? পাঁই পাঁই হিসাব চুকানো বাকি আছে এখনো! আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া… হা হা হা!’

ঘৃণায় গা রি রি করে উঠলো আমার। হিসহিস করে বললাম, ‘তোমার পাঙ্গা আমার সাথে, সুরমাকে ঘুরাচ্ছ কেন?’

‘না ঘুরাচ্ছি না তো! সেই তো ‘আয় আয় তু তু’ করে ডাকতেই আমার কাছে ছুটে এলো! হা হা…এত আদর করে ধরা দিলো, একটু সোহাগ না করে ফিরিয়ে দিব? আর তুমি না দেখলাম, ওর সাথে ক্লাসের গুডবয়কে জোট বেঁধে দিলা। আহারে, জিন্দেগীতে প্রথম একটা ঘটকালি করলা! সেটাও সাকসেসফুল করতে পারলা না! হিহ হিহ হি… আর এমন মোক্ষম সুযোগ আমি ছাড়ব কুন দুঃখে? হারামজাদা সুমনের বাচ্চা…স্কুল থেইকাই আমার পেছনে লাগছে। আমি ভালো না…বাজে কথা বলি! এহহ! এই দ্যাখ শালা…তোর পেয়ারের গুলগুলিরে উঠায় নিছি! এইবার কী করবি কর! হিহ হি…’

আমি আর একটা কথাও শুনতে পারলাম না। খট করে ফোনটা কেটে দিলাম। নাম্বারটাকে ব্লক করে দিলাম সাথে সাথে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো। ইস! এই কলটা রেকর্ড করে রাখা দরকার ছিল! একটা শেষ চেষ্টা করা যেত সুরমাকে ফেরানোর।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>