| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৪০-৪৩)

আনুমানিক পঠনকাল: 24 মিনিট

(৪০)

ঠিক করলাম আগামি বৃহস্পতিবার সুমনদের বাসায় যাবো।

বৃহস্পতিবার আমাদের দুটো ক্লাস ছিল। দুজন টিচারই ক্লাস দুটো পরে নিবেন বলে জানিয়েছেন। দাবীদাওয়া সংক্রান্ত কিছু ব্যাপারে মেডিক্যাল কলেজ প্রশাসনের সাথে টিচার ও কর্মচারীদের একটা ধর্মঘট চলছে। সেটার জের পোহাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। মাঝে মাঝে দু’একটা ক্লাস এভাবে অটোমেটিক্যালি বাদ যাচ্ছে।

অন্যসময় বিরক্ত লাগলেও এখন আমার জন্য বিষয়টা শাপেবর হয়েছে। ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুর বাসায় যেতে হলে অপরাধবোধে ভুগতাম। কারণ শুধু নিজের জন্য তো নয়, আমাকে বড় হতে হবে আমার ভাইটার জন্যও। এমনিতেই বাসার হাজার ঝামেলাতে অনেক ক্লাস মিস গেছে। সেগুলো পুষিয়ে নিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বুধবার বিকেল থেকেই বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি শুরু হলো। সুমন যতই অভয়বাণী শোনাক, আমার মন তো কিছুতেই শান্ত হতে চাইছে না। জীবনে অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। এমন কিছু সম্পর্কের সাথে নিজেকে জুড়তে পেরেছি, যেগুলো ভাগ্য সহায় না থাকলে কখনোই সম্ভব হতো না। তবু এখনো নতুন নতুন সম্পর্ক গড়তে ভয় পাই আমি। না জানি, সেই সম্পর্ককে মজবুত করে তুলতে কত আলগা সুতোর বাঁধন জুড়তে হবে! এত কিছু রসদ কি সবসময় মজুত থাকবে আমার কাছে?

আমার এই অস্থিরতা সুনেত্রারও নজর এড়ালো না। কেমন যেন অদ্ভুত একটা চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগলো। সুরমা আবার কাল থেকে ধম মেরে আছে। আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, সুরমা বুঝি আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না!

বৃহস্পতিবার সকালে শাড়ি নিয়ে বেশ বিপদে পড়লাম। আমি শাড়ি পরতে পারি না। হুজুগের মাথায় হুট করে শাড়ি পরার কথা বলে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন তো মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। মেয়েরা জীবনের প্রথম শাড়িটা পরে নিজের মায়ের। আমার মা কখনোই নিজের কোনো শাড়ি আমাকে পরার জন্য দেয়নি। স্কুলের ছোটোখাট ফাংশনে বান্ধবীরা কত স্টাইল করে শাড়ি পরে সেজেগুজে গিয়েছে! আমি গিয়েছি আটপৌরে সালোয়ার কামিজ পরে। আমার সেই ক্ষ্যাতমার্কা সাজপোষাক নিয়ে বান্ধবীরা টিপ্পনি কাটতেও ভুল করতো না কখনো।

‘কীরে নীরা, আজকেও কি ক্লাস করবি নাকি? মাথায় কয় ছটাক তেল ঢেলেছিস? শ্যাম্পু ট্যাম্পু লাগাস না কখনো?

আমি এসব টিকা টিপ্পনিকে পাত্তা দিতাম না। চুপচাপ বান্ধবীদের সাজপোষাক দেখতাম। একে অন্যের খোঁপায় লাল জবা গুঁজে দিতে দিতে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতো একেকজন। তারুণ্যের প্রথম উচ্ছ্বাসের সেই জোয়ার দেখতে দেখতে আমিও যে কখনো কখনো আপ্লুত হতাম না তা নয়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। মাকে পিকনিক কিংবা ফাংশনের কথা বলারও সাহস হতো না কখনো। বললেই মা এমন কিছু শক্ত শক্ত কথা শুনিয়ে দিত যে, আর যেতেই ইচ্ছে করতো না কোথাও।

আজ চিন্তা করতে বসলে একটা কথা ভেবে দুঃখের মধ্যেও হাসি পায় আমার। মা এমন কাঠখোট্টার মতো আচরণ করতো বলেই বোধহয় আমিও পড়ালেখাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি। জীবনে আর অন্য কোনো শখ আহলাদ কিংবা বিলাসিতার দিকে হাত বাড়ানোর ইচ্ছা হয়নি। অবশ্য সেই সুযোগও পাইনি।

আমি শাড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে ক্যাবলাকান্তের মতো বসে রইলাম।

আরো একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। শাড়ি তো কেনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শাড়ির সাথে যে ব্লাউজ আর পেটিকোট নামক দুটো বস্তু লাগে সেই ব্যাপারটা মাথাতেও আসেনি! আসবে কীভাবে? শাড়ি কখনো পরলে না এসব বিষয় জানবো আমি!

কিন্তু এখন কী করা যায়? শাড়ি পরার প্ল্যান কি বাতিল করে দিব? এত সময় নিয়ে ঘুরেফিরে শাড়ি কেনা হলো! আর তাছাড়া এটাই আমাকে দেওয়া সুমনের প্রথম উপহার। সেই উপহারের আজকেই সদ্গতি হওয়ার কথা। সে নিশ্চয়ই আমাকে শাড়ি পরিহিতা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। এদিকে আমি যদি সেই সালোয়ার কামিজ পরেই ড্যাং ড্যাং করতে করতে রওয়ানা দিই, তাহলে আবারো আরেকটা দাগা খাবে বেচারা!

বসে বসে চিন্তা করছি। সুনেত্রা ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আমাকে দেখছিল। শেষমেষ বলেই ফেললো, ‘নীরাপু কি শাড়ি পরবা আজকে? কোনো স্পেশাল অকেশন নাকি?’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁরে পরতে তো চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার তো ব্লাউজ পেটিকোটই নাই! কী দিয়ে পরবো?’

সুনেত্রা কাছে এসে শাড়িটা দেখলো। তারপর বললো, ‘মা’র কাছ থেকে কিছু একটা নিয়ে ম্যানেজ করে ফেলো। এটা কোনো ব্যাপার? আমি তো স্কুলের ফাংশানে মাঝে মাঝে কামিজের ওপরে শাড়ি পরে ফেলি। শাড়ি খুব সুইট পোষাক। নানাভাবে পরে ফেলা যায়। জানো, এখন কুচি দেওয়া রেডিমেড শাড়িও পাওয়া যায়। যারা শাড়ি পরার ব্যাপারে আনাড়ি তাদের জন্য!’

আমি মনে মনে বললাম, ‘আমি এতকিছু জানলে তো হয়েই যেত!’

মুখে কিছু বললাম না। সুনেত্রা হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ও একসাথে অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে। তাও আবার স্বাভাবিক সহজ গলায়। আসলে সাজগোজ আর জামাকাপড়ের গল্পের কাছে সব মেয়েই কুপোকাত। যতই কেরিয়ার সচেতন সিরিয়াস মুডের মেয়ে হোক না কেন, এসব গল্প সব মেয়েকেই কিছু সময়ের জন্য হলেও উচাটন করে ফেলে। সুনেত্রার এই স্বাভাবিক কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগলো। মেয়েটা দিনকে দিন যেরকম অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিলো তাতে ভয় পাচ্ছিলাম কবে আবার একে নিয়ে নতুন কিচ্ছা শুরু হয়!

অগত্যা শাড়ি হাতে করে বড়মামীরই দ্বারস্থ হলাম। বড়মামী শাড়িটা উল্টেপাল্টে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর মায়ের শাড়ি নাকি নীরা?’

আমি হুঁ টাইপ সংক্ষিপ্ত কিছু একটা বলে দিয়ে সাথে সাথে ভিন্ন প্রসঙ্গ উঠালাম। ‘ইয়ে মামী, আমার কাছে তো ব্লাউজ পেটিকোট কিছুই নেই! এদিকে দেখো না…আজ আবার কলেজে ফাংশন। সবাই শাড়ি পরে যাবে। তোমার কাছে কি ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট হবে? থাকলে দাও না প্লিজ! আর আমাকে শাড়িটা পরিয়েও দিতে হবে তোমার!’

বড়মামী একগাল হেসে বললো, ‘ব্লাউজ পেটিকোট তো আছেই রে নীরা! কিন্তু সেই ব্লাউজে তোর মতো দুইজনকে ঢোকানো যাবে! আমার সাইজ কি তোর হয় নাকিরে বোকা! তুই এক কাজ কর। সুরমার তো কিছু শাড়ি ব্লাউজ আছে। ওর সাইজ তোর হয়ে যাবে।’

আমি তবু ইতঃস্তত করছি দেখে বড়মামী বললো, ‘আচ্ছা আমিই বের করে দিচ্ছি চল! সুরমার কি আর দিনদুনিয়ার হুঁশ আছেরে মা!’

বড়মামী আবার সুরমাকে নিয়ে হা হুঁতাশ শুরু করতে যাচ্ছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে বললাম, ‘চলো চলো…বের করে দাও আমাকে। দেরি হয়ে গেলে আমাকে অডিটেরিয়ামেই ঢুকতে দিবে না!’

সুরমার ব্লাউজ পেটিকোট দিয়ে অবশেষে আমার শাড়ি পরার বাসনা পূরণ হলো। একটু আফসোশ হলো মনে মনে। আজকে অন্ততঃ নিজের সবকিছু নিয়ে সুমনের বাসায় যাওয়া উচিত ছিল। এখানেও চুপিসারে সুরমা এসে ঢুকে গেল। যতই মন থেকে ব্যাপারটা মুছতে চাই, ততই কেন যে বার বার সামনে এসে দাঁড়ায় বুঝতে পারি না!

জীবনে কোনোদিন কাজল আর হাল্কা লিপস্টিক ছাড়া সাজগোজের চৌদ্দগুষ্ঠি মাড়াইনি। আজ সেই আমিই ঘষে ঘষে চোখেমুখে এটা সেটা মাখলাম। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলাম। সর্বনাশ! এ কী করেছি! নিজেকে তো চেনাই যায় না!

তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে ভালো করে ফেশওয়াশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করলাম। তারপর খুব হাল্কা প্রসাধন নিলাম। মুখে অল্প একটু ফেসপাউডার বুলিয়ে নিয়ে সেই চিরাচরিত কাজল আর হাল্কা লিপস্টিকই লাগিয়ে নিলাম। ব্যস! যথেষ্ট! সবকিছু সবার জন্য নয়। আমাকে দেখে মনে হচ্ছিলো বুঝি আলগা পেখম লাগিয়ে ময়ুর সাজতে চাইছি।

বাসা থেকে ধুকপুকে বুকে বের হলাম। কারো মুখোমুখি হতে খুব লজ্জা লাগছিল। কেন কে জানে!

সুমন কলেজ কম্পাউণ্ডেই অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই মুগ্ধ চোখে তাকালো। পরিমিত হেসে বললো, ‘স্নিগ্ধ লাগছে!’

ঘড়িতে বাজে সবে সাড়ে দশটা। এত চটজলদি সুমনদের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল একটু ঘোরাঘুরি করতে। সুমনকে বলতেই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। বুঝলাম সে নিজেও ঘুরতে চাচ্ছে। কোথায় যাওয়া যায় ভেবেচিন্তে স্থানীয় একটা পার্কের দিকে রওয়ানা দিলাম।

কিন্তু গিয়েই মনে হলো ঠিক হয়নি কাজটা। পার্কের যত্রতত্র নেশাখোরদের ফেলে যাওয়া ফেনসিডিলের বোতল মুখ উপুড় করে পড়ে আছে। কোনো কোনো গাছের আড়ালে জড়াজড়ি করে কপোত কপোতীরা বসে আছে। সেদিকে তাকিয়ে সুমন আমার দিকে চোখাচোখি করতেই ফিক করে হেসে ফেললাম। পার্কের শেষ মাথায় পৌঁছে পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে এলাম। শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীটার একটা মোহনা এসে মিলেছে এখানে। কয়েকটা সিমেন্টের বেঞ্চি পাতা আছে জায়গাটাতে। এই সাত সকালেই কয়েকজন ঝাল মুড়ি আর ফুচকা ওয়ালা দাঁড়িয়ে পড়েছে। সুমন ঝালমুড়ি খাওয়ার ওস্তাদ। সেদিন শাড়ি কিনতে গিয়েও ব্যাপারটা টের পেয়েছি। এক ফাঁকে ফুরুৎ করে রিক্সা থেকে নেমে ঝালমুড়ি কিনে নিয়েছিল। আজকেও দু’ঠোঙ্গা কিনে এনে আমাকে সাধতে লাগলো।

আমার এখন ঝালমুড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া যত্ন করে লিপস্টিক লাগিয়েছি। সেটাকে নষ্ট করতেও সায় দিচ্ছিলো না মন।


আরো পড়ুন: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৩৫-৩৯)


উদাসী মন নিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী শান্ত এখন নদী! কোথাও এতটুকু তরঙ্গের মাতামাতি নেই। তাড়াহুড়া নেই গন্তব্যে পৌঁছানোর। আচ্ছা নদী কি জানে তার গন্তব্য কোথায়? মানুষই কি জানে?

ভাবুক মনে কত শত প্রশ্ন এসে খাবি খেয়ে যাচ্ছে অবিরাম! শান্ত পানির বয়ে চলা দেখতে ভালো লাগছিল। নিজের জীবনের আসন্ন অধ্যায় নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগছিল। একটু ভয় ভয়ও যে লাগছিল না তা নয়। তবে সেই ভয়ের মাঝেও অজানা শিহরণ এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছিলো।

সুমন আমাকে ভাবুক মুখে বসে থাকতে দেখে নিজেও চুপ করে বসে ছিল। সে জানে মাঝে মাঝে আমি ভাবের দুনিয়ায় বিচরণ করে বেড়াই। কিন্তু হঠাৎ ফোনের দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলো। ‘আরে চলো চলো! সাড়ে বারোটা বাজতে চললো। আর বেশি দেরি করে গিয়ে কি মাকে বিপদে ফেলবে নাকি?’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তার মানে? বিপদে ফেলবো কেন?’

‘বাহ! এত দেরি করে গেলে মা তোমাকে কী খাওয়াবে? আমাদের বাসাতে তো এক তরকারীর বেশি রান্নাবান্না হয় না! মা খুব বেশি বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না কোনোকিছুতেই। আর আমরাও এটাতেই অভ্যস্ত। তোমাকে নিশ্চয়ই এক তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ালে তুমি খুশি হবে না!’

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি আরো অনেক কিছুতেই অভ্যস্ত সুমন। আমাকে নিয়ে মোটেও ভাবতে হবে না তোমার!’

সুমনদের বাসায় যেতে যেতে প্রায় একটাই বেজে গেল। এতটা দেরি করার মোটেও ইচ্ছা ছিল না। কেন যে এত দেরি করে ফেললাম!

ওদের বাসাটা শহরের মাঝামাঝিই। সুমনের দাদার পৈতৃক বাড়ি যা সুমনের বাবার ভাগে পড়েছিল। ছোট্ট ছিমছাম একটা দোতলা বাসা। চারপাশে অনেক গাছগাছালি। সজনে গাছ থেকে দেখলাম সজনে ডাঁটা ঝুলে আছে। আমি এই গাছে এর আগে কখনো ফল ধরে থাকতে দেখিনি। জিনিসটা যে এত হাস্যকর দেখায় জানা ছিল না আমার। মনে হচ্ছে চিকন কিছু কাঠি টিংটিং করে ঝুলে আছে। এছাড়া আম জাম লিচু সব ফলের গাছই দেখলাম। বাসার সামনে সারি সারি গোলাপ গাছে বাহারি রঙের গোলাপ ফুটে আছে। চারপাশে স্নিগ্ধ রুচিময়তা। আমার মনটা কেমন একটা প্রশান্তিতে ভরে গেল!

সুমনের আম্মাই দরজা খুলে দিলেন।

আমার সাথে চকিত দৃষ্টি বিনিময় হতেই হাত তুলে সালাম দিলাম। তিনিও মৃদুস্বরে সালামের জবাব দিলেন। কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটে উঠলো না মুখেচোখে। যেন বুঝতেই পারছিলেন ছেলে নিয়ে এসেছে যখন, নিজেই পরিচয় করিয়ে দিবে। আমি মুগ্ধ চোখে উনাকে দেখছিলাম। বছর পঞ্চান্নর একজন সুশ্রী নারী। শরীরের টান টান গাঁথুনি দেখে বয়স অনায়াসেই দশ বারো বছর কমিয়ে বলা যায়। পরনে ঘি রঙের একটা তাঁতের শাড়ি। সাথে সবুজ রঙের ব্লাউজ। আঁচলটা মার্জিতভাবে সামনে টেনে আনা। আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে একটুও অবাক হলেন না। স্মিতমুখে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন, ‘ভেতরে এসো!’

ভেতরে ঢুকেও আরেকবার মোহিত হলাম। সিগ্ধ রুচিময় অন্দরসজ্জা। বাইরের ঘরের দেওয়ালের পুরোটা জুড়ে একটা আলমারি। সেটাকে দেওয়ালের সাথেই কায়দামত জুড়ে দেওয়া। তাতে সারি সারি বই। কিছুতেই সেদিক থেকে চোখ সরানো যায় না। আমিও সরাতে পারছিলাম না। উনি সেটা লক্ষ করে প্রথম প্রশ্নটা করলেন, ‘বই পড়তে খুব ভালোবাসো নাকি?’ বলেই একটু লাজুকমুখে বলে উঠলেন… ‘এহ হে, তখন থেকে তুমি করেই বলছি। সুমনের সাথে এসেছো যখন, নিশ্চয়ই ওর বন্ধুই হবে!’

আমি চুপ করে থাকলাম। সুমন মুখ খোলার আগেই ভদ্রমহিলা আবার বললেন, ‘আমি কিন্তু জানি তোমার কথা!’

আমি তো আমিই, সুমনও দেখলাম হাঁ করে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এবারে তিনি একটু শব্দ করেই হেসে উঠলেন। ছেলেকেও চমকে দিতে পেরেছেন বলেই হয়ত হাসির দমকটা খুব প্রাণবন্ত দেখালো। হাসিমুখেই বললেন, ‘মায়ের কাছে ছেলের ছোটখাট কোনো জিনিসও গোপন থাকে না। আর এটা তো অনেক বড় ব্যাপার, তাই না?’

সুমনদের বাসায় সেদিন প্রায় বিকেল পর্যন্ত থাকলাম। সুমনের বোনের সাথেও পরিচয় হলো। সে চোখ গোল গোল করে আমাকে দেখছিল। হাঁ করে আমার কথা গিলছিল। এত মজা লাগছিল দেখতে! দুপুরের খাবার আয়োজনে বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু পরিবেশনার আন্তরিকতায় কোনো কমতি খুঁজে পাইনি। সুমনের মা কথা তেমন বেশি একটা বলেন না, এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম। তাই খুব বেশি একটা হোঁচট খাইনি। উনি আমাকে দেখেই প্রগলভ হয়ে যাবেন, এমনটা মোটেও আশা করিনি আমি। তবে ছোটখাট কিছু গল্পে উনার ভেতরের আন্তরিকতার ছোঁয়াটা ঠিকই আমাকে স্পর্শ করে যাচ্ছিলো।

সুমনের মা বিকেলে চা খেয়ে যাওয়ার জন্য বার দুয়েক বলেছিলেন। আমি না বলার পরে উনি অহেতুক আর চাপাচাপি করেননি। ফিরে আসার সময় আমাকে আড়ালে ডেকে হাসিমুখে একটা মজার কথা বলেছিলেন,

‘বুঝলে নীরা, এরপর থেকে সুমনের পছন্দে আর শাড়ি কিনো না কিন্তু! ছেলেটা আমার কমলা রঙ দেখলেই পাগল হয়ে যায়!’

শাড়ি কেনার পর্বটাও নিশ্চয়ই উনি জানতেন না। বুঝতে পারলাম, এটাও তিনি সঠিকভাবেই অনুমান করে নিয়েছেন।

ফিরে আসার পথে উনি মন জুড়েই পড়ে রইলেন।

কিছু মানুষের কাছাকাছি গেলে মনের মধ্যে সুপ্ত একটা ইচ্ছে জাগে… আমি যদি তার প্রিয় কেউ হতে পারতাম!

(৪১)

চোখের পলকেই চারটি বছর পার হয়ে গেল।

এই চার বছরে অনেকগুলো উল্লেখ করার মতো ঘটনা ঘটলো। কোনটা রেখে কোনটা যে বলি! অবশ্য নিজের জীবনের গল্প যখন বলতে বসেছি, কোনো ঘটনাকেই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। বলছি ধীরে ধীরে।

সুরমার কথা দিয়েই শুরু করি। সুরমার দুই বছরের সাজা হয়েছে। সাজা যে হবেই এমন ইঙ্গিত উকিলসাহেব আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। আলামত সমেত হাতেনাতে ধৃত আসামী, সাজা না হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তবু যুক্তির পাহাড় দাঁড় করিয়েএবং অনেকগুলো টাকা জরিমানাসমেত গচ্ছা দিয়ে শেষমেষ দুই বছরের জেল পর্যন্ত পার পাওয়া গেছে।

দুই বছরের জেলের শাস্তি ভোগ করে এক বছর আগে বাসায় ফিরেছে সুরমা। সুরমার জেলে যাওয়া থেকে শুরু করে ফিরে আসা অব্দি সময়টা আমাদের কেমন কেটেছে, সেই গল্প আমার করতে ইচ্ছে করে না। দুর্বিষহ দিনগুলোর স্মৃতি আমরা কেউই বেশিদিন মনে রাখতে চাই না। মনের গোপন কুঠুরিতে সেগুলোকে তড়িঘড়ি করে বসিয়ে রেখেই অন্য স্মৃতির আলয় সাজাতে বসি। তবু অদ্ভুত মানবমন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদেরকে বারে বারে সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলোর কাছেই নিয়ে যায়।

সুরমার জেলজীবনের সেই সময়টাতে বাসাটা ঠিক যেন একটা ভুতুড়ে আস্তানায় পরিণত হয়েছিল। দমবন্ধকর সেই বাসায় দিনশেষে ফিরে আসতে মন চাইতো না। ইচ্ছে করতো ক্লাস ওয়ার্ড ল্যাব এসব নিয়েই দিনরাত পড়ে থাকি। সুমনের সাথে কাটানো সময়টুকুকে মনে হতো অক্সিজেন প্রবাহকারী কিছু মুহূর্ত। আমি প্রাণ খুলে শ্বাস নিতাম ওটুকু সময়েই।

সুরমা যে বছর জেলে গেল, বড়মামাও সেই বছরেই স্কুল থেকে রিটায়ারমেন্টে গেল। আগেও স্কুল থেকে ফিরে মনমরা হয়ে বসে থাকতো সারাদিন। কিন্তু তবুও সারাদিনে করার মতো কিছু একটা কাজ ছিল মামার। রিটায়ার করার পর থেকে বড়মামার সেই কাজটুকুও নাই হয়ে গেল। তার মুখের দিকে আর যেন তাকিয়ে থাকা যায় না। বিষণ্নতাকে ছাপিয়ে অন্যরকম একটা ভীতি এসে ভর করতো মনে। গাল দুটো বসে যাওয়া, মাথার সামনের অংশের চুল উঠে গিয়ে কেমন আউলাঝাউলা একটা বেশ, দুইচোখে নিশিতে পাওয়া মানুষের দৃষ্টি…কতদিন যে বড়মামাকে দেখে ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠেছি। নিজের অজান্তেই বার বার ঢোঁক গিলেছি!

আগে বড়মামা কত প্রাণবন্ত সজীব একজন মানুষ ছিল। সবার খোঁজখবর নেওয়া থেকে শুরু করে কার কীসের প্রয়োজন পড়েছে সবকিছুই তার নখদর্পণে ছিল। অথচ সেই বড়মামাই সুরমা ধরা পড়ার পর থেকে আস্তে আস্তে একেবারে ভিন্ন একজন মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। খাওয়াদাওয়া ঘুম গোসল…কোনোকিছুরই ঠিক নেই তার।

আগে নানীর ঔষধ খাওয়ার টাইমটেবিল বড়মামার মুখস্থ থাকতো সবসময়। নানীর ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। দরজার গায়ে কাগজে ঔষধ খাওয়ার সময় সেঁটে রাখা হতো। এখন বড়মামার নিজেরই প্রেসার আর ডায়াবেটিসের ঔষধ খেতে হয়। সেই ঔষধ একদিন খেলে আরেকদিন খাওয়ার কথা মনে থাকে না। অবস্থা বেগতিক দেখে আমিই বড়মামা আর নানীকে সময়মত ঔষধ খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলাম।

নানী এই চার বছরে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। বড়মামার দুরবস্থা দেখে মা হয়ে তার ভালো থাকার কথাও নয়। আগে কখনো নানীকে কান্নাকাটি করতে দেখিনি। কিন্তু এখন প্রায়ই দেখি, নানী বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদে। আমি কাছে গিয়ে আদর করি। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলি, ‘কেঁদো না নানী। তুমি কাঁদলে আমার একদম ভালো লাগে না। কেমন জানি দমবন্ধ হয়ে যায় আমার!’

নানী সাথে সাথে চোখ মুছে জোর করে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘কাঁদি নারে বুবু! বুড়া মানুষের চোখ দিয়ে সারাদিন এমনিই পানি পড়ে!’

আমার ভাই নয়ন গতবছর খুব বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে।

নয়নের এইচএসসির পরে ওকে খুব অস্থিরতায় ভুগতে দেখতাম। জিজ্ঞেস করলে বলতো, কিছু নাকি ভালো লাগে না। ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ারও তোড়জোড় দেখতাম না বিশেষ। বিষয়টাতে খুব অবাক হচ্ছিলাম মনে মনে। কারণ পড়ালেখাতে ওর মধ্যে কোনোরকম অমনোযোগিতা দেখিনি কখনো। এইচএসসিতেও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু কীসে পড়ার ইচ্ছা জিজ্ঞেস করলে সন্তোষজনক কিছু বলতে পারতো না।

একদিন কলেজ থেকে ফিরে খুব উত্তেজিত হয়ে আমাকে একটা পেপারকাটিং দেখালো। দেখলাম নিউজপেপারের আধাপাতা জোড়া বিশাল বিজ্ঞাপন। মেরিন একাডেমিতে জয়েন করার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ভাষা খুবই আকর্ষণীয় এবং একইসাথে চটকদার। সাথে জুড়ে দিয়েছে আকর্ষণীয় সব মনকাড়া ছবি। স্মার্ট মেরিন অফিসারদের জাহাজের পাশে তোলা দারুণ দারুণ সব ছবি। পেছনে উত্তাল সাগরের হাতছানি। বিজ্ঞাপনে লেখা, ‘সি দ্য ওয়ার্ল্ড!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এটা কেন দেখাচ্ছিস নয়ন?’

নয়ন কাঁচুমাচু হয়ে যা বললো তাতে আমার মাথায় মোটামুটি বাজ ভেঙে পড়লো। ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে উঠলো। অদ্ভুত শূন্যতায় ভরে গেল চারপাশ। নয়ন মেরিন একাডেমিতে জয়েন করতে চায়। তার কিছু বন্ধুও নাকি ফর্ম ফিলাপ করে ফেলেছে। সেও ফর্ম ফিলাপ করতে চায়। আমার অনুমতিটুকু পেলেই করে ফেলবে। আমি বুঝতে পারলাম, অনুমতি না দিয়ে আমার আর কোনোই উপায় নেই। মেরিনে যাওয়ার এই ইচ্ছা তার আজকে থেকে হয়নি। যেদিন থেকে ওর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি দেখছি, সেদিন থেকেই কিছু একটা আন্দাজ করেছিলাম আমি।

আমার ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। তবু নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখলাম। কারণ একটা জিনিস আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, আমি মন খারাপ করে অনুমতি দিলেও নয়ন কিছুতেই সেটা করবে না। আবার অনুমতি না দিলে ওকেও ওর ভালোলাগার জায়গা থেকে সরিয়ে রাখা হবে। সেটাও আমি কিছুতেই করতে চাই না। তাই মনের ভাব মনেই চেপে রেখে বললাম, ‘কিন্তু, মেরিনে তো শুনেছি অনেক কষ্ট করতে হয়। ম্যালা নাকি খাটাখাটুনির ব্যাপার আছে। তুমি পারবি ওসব? শেষে মাঝরাস্তায় ছেড়ে দিবি না তো?’

নয়ন বুঝতে পারলো আমার অমত নেই। আর বুঝতে পেরেই ওর বত্রিশপাটি দাঁত বাইরে বেরিয়ে এলো। একগাল হেসে বললো, ‘সেটা নিয়ে তুই একদম ভাববি না আপা। আমি একেবারে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তোর সামনে এসে দাঁড়াবো দেখিস!’

আমি আর পারলাম না। দু’চোখের কোল পানিতে ভরে এলো। আর লুকোছাপা করেও লাভ হবে না কিছু। ভাঙা মন নিয়ে ভাঙা গলায় বললাম, ‘আমাকে ছেড়ে থাকতে তোর অসুবিধা হবে না নয়ন? ছোটবেলায় আমি পাশে না ঘুমালে ঘুমাতে পারতি না… মনে আছে? নানীবাড়িতে এসে আমাকে ছেড়ে ঘুমাতে শিখলি। এখন বুঝি আমাকে ছেড়ে বাঁচতে শিখতে চাইছিস নয়ন?’

আমি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললাম। নয়ন ভ্যাবাচ্যাকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘এ্যাই নীরাপু…তুই এমন করলে আমি জীবনেও মেরিনে যাবো না!’

আমি সাথে সাথে চোখ মুছে হাসিমুখে বললাম, ‘খবরদার এই কথা বলবি না! তুই নিজের শখের কথা আমাকে বলেছিস…আর আমি সেটাকে সত্যি হতে বাধা হয়ে দাঁড়াব? এতদিনে এই চিনলি তোর নীরাপুকে?’

গত বছরের ডিসেম্বরে নয়ন মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হয়ে গেল।

এসএসসি এইচএসসির রেজাল্ট ভালো ছিল। আর বড় হওয়ার তীব্র ইচ্ছাটা আমাদের দুই ভাইবোনেরই রক্ত আর মজ্জাতে মিশে গিয়েছিল। কাজেই ভর্তি পরীক্ষাতে যে খুব ভালো করবে নয়ন, এটা একরকম আমার জানাই ছিল। আমার সেই জানাটা ভুল প্রমাণিত হলো না। খুব ভালো নাম্বার পেয়ে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রথম ধাপটা পার করে ফেললো নয়ন।

ও চলে যাওয়ার দিন ভাইবোনে খুব গলা জড়াজড়ি করে কাঁদলাম। আমার মনের মধ্যে তীব্র একটা ইচ্ছা কাজ করছিল। নয়নকে সুমনের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলার ইচ্ছা। সুমনের সাথে ওকে একদিন আলাপও করিয়ে দিয়েছিলাম আমি। নয়নকে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাস দেখাতে নিয়ে যাওয়ার বাহানায় ওকে সুমনের সাথে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ছোটভাইয়ের কাছে লজ্জায় বেশিকিছু বলতে পারিনি।

এখন তো দূরে দূরেই থাকবে নয়ন। হয়ত আমাদের বিয়েতেও আসতে পারবে না। আমার ভবিষ্যত জীবনের এত বড় একটা খবর ওর কাছে অজানাই থেকে যাবে অনেকদিন।

চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে দুই ভাইবোন সবার চোখের আড়ালে বসে কথাবার্তা বলছিলাম। উঠে পড়ার পর নয়ন একটু ইতঃস্তত করে বললো, ‘নীরাপু, সুমন ভাইয়া খুব ভালো ছেলে। তুই অনেক ভালো থাকবি! আমিও ভালো থাকবো। মন খারাপ করবি না একদম!’

আমি চমকে তাকালাম নয়নের দিকে। একটা সত্যকে সেদিন আরেকবার উপলব্ধি করলাম আমি। দুঃখকষ্ট আর ব্যথা বেদনাকে নিত্য সঙ্গী করে যারা বড় হয়, তাদের একটা তৃতীয় নয়ন থাকে। অন্যরা সাদাচোখে যা দেখতে পায় না, তারা দিব্যি সেটাকে পরিষ্কার দেখে ফেলে।

নয়ন চলে যাওয়ার পরে বেশ কিছুদিন পাগল পাগল দিন কাটলো আমার। কোনো কাজে মন বসে না। সারাক্ষণ ইচ্ছে করে বসে বসে কাঁদি।

ততদিনে সুরমা জেলের শাস্তিভোগ করে আবার ফিরে এসেছে। বাসাটাতে সবে আবার একটু স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে শুরু করেছে। তাই নিজের মনের এই উচাটন অবস্থাকে আমি খুব একটা প্রশ্রয় দিলাম না। বাসার সবাই বুঝতে পারছিল যে, আমার মন খারাপ। তারা সহানুভূতির ছলে এটা সেটা বলে আমার মন ভালো করে দেওয়ার একটা ছেলেমানুষী চেষ্টা চালাতো। ওদের চেষ্টার আন্তরিকতাটা আমার নজর এড়াতো না। তাই বুঝতে পারলেও মুখে কিছু বলতাম না।

সুরমা অবশেষে নিজেকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে।

এটা দেখে বাসার অন্য সবার সাথে আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছি। বড়মামা ওর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ওকে আবার কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন বছরের দীর্ঘ বিরতি শেষে সুরমা আবার তার লক্ষ্যপথে ফিরে আসতে পেরেছে।

প্রতিদিন কলেজ থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে দুপুরের পর ওকে যখন পড়ার টেবিলে বসতে দেখি, মনটা আপনা থেকেই তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। সাজসজ্জা চলনবলনেও অনেকটা পরিশীলিত এখন। আগের মতো ধুপধাপ পা ফেলে চলে না। ধুমধাম যা খুশি তাই বলে ফেলে না। আরেকজনের ইমোশনকেও গুরুত্ব দিতে শিখেছে।

আমার সাথে নিজের অতীত ব্যবহারের কথা মনে করে কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছে সুরমা। আমি মন থেকেই ক্ষমা করেছি সুরমাকে। তাছাড়া আমার প্রতি ও যতটা অবিচার করেছে, তার চেয়ে ঢের বেশি অবিচার করেছে নিজের সাথে। নিজেকে ক্ষমা করে দিয়ে সামনে এগুনোটাই এখন সুরমার জন্য বেশি জরুরি।

এবার আমার নিজের কথা বলি।

আমি ইন্টার্নিশীপ করছি। সুমনও পাশ করে টুকটাক প্র্যাক্টিস শুরু করেছে। সামনে বিসিএস দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। আমার ইন্টার্নিশিপ শুরুর পর থেকেই কেমন একটা ভয় কাজ করতে দেখি সুমনের মধ্যে। মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মামারা কি তোমার বিয়ে নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে? বাসায় আমাদের কথাটা জানিয়েছো?’

আমার খুব মজা লাগে সুমনের এই ভয়মেশানো অবস্থাটা দেখতে। বেচারা চাপে আছে। চাকরিবাকরি কিছু একটা না জোটানো পর্যন্ত তো আর বিয়ের জন্য পাত্রীর বাসায় আবেদন করা যায় না! তাই বেচারা বেশ আদাজল খেয়ে চাকরিপ্রাপ্তির চেষ্টায় আছে।

এরমধ্যেই একদিন সুমনই একটা খবর দিলো।

খবরটা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে। শোনামাত্রই বুকের ভেতরে অজানা একটা হিম প্রবাহ বয়ে গেল। সুমন একদিন বেশ ক্যাজুয়ালিই বললো, ‘নীরা জানো, সেই যে বিপ্লব ছিল না…আমাদের সাথে পড়তো? ওর খবর জানো কিছু?’

আমি যথাসম্ভব নিজের অনুভূতিকে আড়াল করে বললাম, ‘কেন ওর কী খবর জানবো? কী হয়েছে বিপ্লবের? ও তো শুনেছিলাম পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে!’

‘হ্যাঁ ধরা পড়ে তিন বছর জেল খেটেখুটে আবার বেরও হয়ে এসেছে বাপের ব্যাটা! শুনতে পাচ্ছি পুলিশ নাকি এখন একটু চোখে চোখে রাখছে ওকে। তাই আসল রঙ এখনো দেখাতে পারছে না। কিন্তু জাত কাউয়ার কালো রঙ কি চাইলেই লুকানো যায়? কয়দিন লুকিয়ে রাখবে? দেখো আবার ভেল্কি দেখাতে শুরু করলো বলে!’

অজানা এক ভয়ে আমার সর্বাংগ কেঁপে উঠলো।

বিপ্লবের সেই হুমকি আমার এখনো কানে ভাসে। ‘এর শোধ আমি তো তুলবোই সুন্দরী। এর মূল্য তোমাকে চুকাতেই হবে!’

সুমন এসব কথার কিছুই জানে না। বিপ্লবকে ধরিয়ে দেওয়ার পেছনে আমার সংশ্লিষ্টতার বিন্দুবিসর্গও ওকে জানাইনি আমি। আমার জীবনতরী এখন বিপ্লবের ত্রিসীমানা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার এত ভয় লাগছে কেন?

আমার কেন মনে হচ্ছে, শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনসমুদ্রে আবার একটা ভয়ংকর ঝড় উঠতে যাচ্ছে?

(৪২)

বিপ্লব ফিরে আসার খবর জানতে পারার পর থেকে কোনোকিছুই আর ভালো লাগছিল না আমার।

পেটের মধ্যে সারাক্ষণই কেমন গুড়গুড় করতে থাকে। কোনো কাজেই বেশিক্ষণ মন বসাতে পারি না। ঘুমের মধ্যেও যেন বিপ্লবের সেই কথাগুলো শুনতে পাই। ‘এর পরিণাম তোমাকে ভুগতে হবে…!’

কী ক্ষতি করতে চায় বিপ্লব আমার? যদিও পুলিশ এখন ওর কার্যকলাপের দিকে কড়া নজর রাখছে, কিন্তু বিপ্লবের মতো ছেলের কি মতিগতির ঠিক আছে কোনো? এদিকে এমনই এক পরিস্থিতি, নিজের মনের এই অবস্থার কথা কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছি না! এক সুরমা ছিল যাকে হয়ত বললেও বলতে পারতাম। কিন্তু সে নিজেই এখন হাজার ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করে এসে সবে একটু শান্তির দেখা পেয়েছে। ওকে আর এসবের মধ্যে জড়াতে চাইছি না।

এই বাসার বিপদাপদ বুঝি কিছুতেই ফুরাতে চায় না। এক কূল গড়তে না গড়তেই আরেক কূলে ধ্বস নামে। সবার কথাই তো কমবেশি বলেছি। কিন্তু সুনেত্রার কথা তো বলাই হয়নি!

সুনেত্রা এইচএসসিতে গড়পড়তা রেজাল্ট করার পরে স্থানীয় একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। বাসার সবাই মেনে নিয়েছিল ওর ব্যাপারটা। একটা সময় মনে হতো, সুনেত্রা বুঝি খুব বড় কিছু একটা হবে। স্কুলের সেই সময়টাতে ওর মধ্যে যেরকম ডেডিকেশন দেখেছিলাম, তাতে এমনটা মনে না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। সময়মত খাওয়া, পড়া, ঘুম…ওর প্রতিটা কাজই ছিল ঘড়ি ধরে করা। কখনো মামা মামী কাউকেই দেখিনি সুনেত্রাকে পড়ার ব্যাপারে কিছু বলতে। ও ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে নিজের দায়িত্বে নিজের কাজগুলো করে যেত। সত্যি মুগ্ধ হয়ে যেতাম সুনেত্রার দায়িত্ববোধ দেখে!

সেই সুনেত্রাকেই সুরমার ধরা পড়ার পর থেকে খুব ধীরে ধীরে ভিন্ন এক মানুষে পরিণত হয়ে যেতে দেখেছি। পড়া, খাওয়া ঘুম…কোনোকিছুতেই বিন্দুমাত্র সময়জ্ঞান নেই। কেমন যেন ইচ্ছেটাও বেমালুম মরে গেছে। ওকে নিয়ে অন্যরকম একটা ভয়ও পেতে শুরু করেছিলাম একসময়। আশেপাশে কত যে সুইসাইডের কথা শুনি! কোনোভাবে সেই ভয়টা কাটানো গেলেও পুরনো সেই সুনেত্রাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সে তখন কোথায় যেন হারিয়েই গেছে।

লেখাপড়াতে আগের সেই সুনেত্রা ফিরে না এলেও হাসিখুশি মিতভাষী সেই মিষ্টি মেয়েটি ফিরে এলেই বাসার সবাই খুশি হয়ে যেত। এখন আর আকাশচুম্বী কোনো প্রত্যাশা নেই কারো। শুধু যে মন ও মননে তার বাস, সেটাকে সুস্থ সবল দেখতে পেলেই কারো আর কোনোই অভিযোগ থাকত না।

কিন্তু গোলমালটা দেখা দিলো সেখানেই।

সুনেত্রা আর কিছুতেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে দেখি, বিছানায় কেমন অদ্ভুত ভাবে চিত হয়ে শুয়ে আছে সুরমা। দুই পা বিছানার পাশ ঘেঁষে থাকা দেওয়ালের ওপরে তুলে দিয়ে হাত দুটো সটান দু’দিকে ছড়িয়ে রেখেছে। সুরমার মুখটা ঘরের দরজার দিক থেকে পেছন ফিরে রাখা। তাই মুখটা দেখা যাচ্ছিলো না। কিন্তু আমি খুব জোরে জোরে ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

আচমকা ঘরে ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে আমার ভেতরটা কেমন শিরশিরিয়ে উঠলো! ঘরে আর কেউ নেই। সুরমা সম্ভবত এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি। আমি ধড়মড় করে ডাক দিলাম, ‘সুনেত্রা এ্যাই সুনেত্রা, এমনভাবে শুয়ে আছিস কেন? কী হয়েছে?’

সুনেত্রা একইভাবে শুয়ে থেকে খুবই অদ্ভুতভাবে মাথাটা আমার দিকে ঘোরালো। ঠিক যেমন হরর মুভিতে দেখা যায়, সেইভাবে! আমি মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করে দিলাম। সুনেত্রা মাথাটা ঘুরিয়ে হিসহিসে গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন নীরাপু? এইভাবে শুয়ে থাকা কি বারণ নাকি? এগুলো কি মাথাখারাপের লক্ষণ? আমার এক বান্ধবী বলেছিল, এমন পা উঁচিয়ে শুয়ে থাকলে নাকি তাড়াতাড়ি পোয়াতি হওয়া যায়! ঠিক নাকি নীরাপু? তুমি তো আবার ডাক্তার! এসব ভালো বলতে পারবা!

তাই বলে আবার মনে করো না যে, আমি আকাম ঘটায়ে ফেলছি! হি হি হি…আসলে আমার বান্ধবী তো আকামের ডিব্বা! দিনরাত আকাম কুকাম করে। অবশ্য লাইসেন্স পাইছে, হি হি হি…বুঝলা না তো? মানে বিয়ে হইছে! কাজেই এখন এমন যখন তখন পা উঁচিয়ে শুয়ে থাকে যাতে পোয়াতি হতে পারে! হি হি হি…আমি প্র্যাক্টিস করছি বুঝলা না?

আমার গা মাথা সব একেবারে ঘেমে উঠলো।

এসব কী বলছে সুনেত্রা? এগুলো কি ও নিজেই বলছে…নাকি ওর হয়ে অন্য কেউ বলছে? বেশ দীর্ঘদিন সুনেত্রার সাথে বলতে গেলে কোনো কথাবার্তাই হয় না আমার। যখন ইচ্ছে হয় কথা বলে, এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। নয়তো একেবারে চুপ। যেন ধ্যানে বসেছে! আর আজ এসব কী শুনলাম ওর মুখ থেকে?

আমি কোনোমতে ঢোঁক গিলে বললাম, ‘ছি সুনেত্রা…লক্ষী আপু আমার। পা দুটোকে ঠিক করে নাও। কখন কে ঘরে এসে ঢুকে! দেখতে খারাপ দেখায় না বল?’

সুনেত্রা তৎক্ষণাৎ সুবোধ বালিকার মতো পা দুটোকে নীচে নামিয়ে আনলো। তারপর একেবারে শান্ত মুখে বিছানা থেকে নেমে খুব মনোযোগ দিয়ে কী একটা যেন খুঁজতে লাগলো। এতক্ষণ যে কিছু একটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমাদের, সেটা যেন তার আর মনেই রইলো না! আমি যে সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটাও যেন সে আর দেখতে পাচ্ছে না!

আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।

সুনেত্রাকে অতি শিগগিরই সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সমস্যা হলো এই যে, সাইকোলজিস্টের নাম শুনলেই সবাই কেমন যেন আঁতকে ওঠে। মনে করে, সাইকোলজিস্ট মানেই হচ্ছে পাগলের ডাক্তার। কিন্তু এটা কেন যে মানুষ বোঝে না, শরীরের যেমন অসুখবিসুখ হয় মনেরও তেমনি যখন তখন অসুখ হতে পারে। শরীরের অসুখের উপসর্গ সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু মনের অসুখের উপসর্গ বোঝা বড়ই কঠিন। মাঝে মাঝে কোনোরকম উপসর্গ ছাড়াই মনের অসুখ ডালপালা ছড়াতে থাকে। এই ডালপালা ছেঁটে সাময়িকভাবে হয়ত ভালো থাকা যায়। কিন্তু অসুখের মূলে প্রবেশ করতে না পারলে ধীরে ধীরে একসময় পুরো মানুষটিই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।

সুনেত্রাকে মাঝে মাঝে এলোমেলো খাপছাড়া কিংবা হতাশাজনক দু’একটা কথা বলতে শুনেছি ঠিকই। কিন্তু এতটা মাত্রাছাড়া আচরণ করতে কখনো দেখিনি। হয়ত ওর মনের মন্দ থাকাটাকে গুরুত্ব না দিতে দিতে আজ এতদূর চলে এসেছে পরিস্থিতি!

বড়মামা আর মামী এমনিতেই অনেক ঝড়ঝাপ্টা সয়েছে এতদিন। দুজনেই নানাদিকে বিপর্যস্ত। প্রথমেই তাদেরকে এসব জানালে একেবারে হাতপা ছেড়ে দিবে। আমি ভাবতে বসলাম কী করা যায়।

আমার কলেজের এক বান্ধবীর কথা মনে পড়লো। শুনেছি সাইকোলজি থেকে পাশ করেছে। অভিজ্ঞতা না থাকলেও হয়ত কিছু একটা বলতে পারবে ওকে দেখে। কিন্তু সুনেত্রা তো যেরকম মুডি মেয়ে! কিছু বুঝতে পারলে হয়ত দেখাই করতে চাইবে না।

আমি নাম্বার জোগাড় করে আমার সেই সাইকোলজিস্ট বন্ধু সানজিদাকে ফোন দিলাম। মোটামুটি গুছিয়ে বললাম সবকিছু। সানজিদা বললো ও আমাদের বাসায় এসে সুনেত্রাকে দেখবে।

বাকিটা সময় ভয়ে ভয়েই কাটলো আমার। তবে এরপরে আর তেমন কিছু হলো না। সুনেত্রা এমনিতে যেমন চুপচাপ থাকে সেরকমই থাকলো।

আমার মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে এই ঘটনাটার পর থেকে। এই বাসার ঝড় ঝঞ্ঝাট কি এভাবে লেগেই থাকবে? এদিকে যা বুঝতে পারি, বড়মামার এখন খুব হাত টানাটানিও চলছে। সুরমার দুই বছরের জেলের পাশাপাশি বেশ কিছু টাকা জরিমানাও দিতে হয়েছে। সেই টাকার পরিমাণটা বড়মামার জন্য নেহায়েত কম না। প্রভিডেণ্ট ফাণ্ডের টাকা তুলে জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এসব কথা নানীর কাছ থেকে শুনেছি।

নানী দুঃখ করে বলছিল, ‘সন্তান বড় সাধনার ধন রে বুবু! দুনিয়ায় কত স্বামী স্ত্রী একটা সন্তানের জন্য হাহাকার করে মরে! আল্লাহ কত জনকে আবার না চাইতেই দেয়! সেই সন্তানরে বড় করার জন্য কত দিনরাতের সাধনা করা লাগে! মনের মধ্যে কত আশা…সন্তান বড় হইলে কাঁধের জোর বাড়বে! সেই সন্তানই যখন কাঁধটারেই ভেঙে খান খান করে দেয়…তখন বাপ-মায়ের কেমন লাগে বল দেখি বুবু?’

আমার বুকের ভেতরে কষ্টের নদী কুল কুল করে বইতে থাকে। নানী কেন যে এভাবে বলে!

সানজিদা পরদিনই চলে এলো। অবশ্য সুনেত্রা বাসায় আছে এটা জেনে নিয়েই এসেছে।

ঘরে আমরা তিনজনই ছিলাম। সুরমাকে আমি কিছুই বলিনি এই ব্যাপারে। পরে দরকার মনে করলে বলবো। সাইকোলজিস্টের ব্যাপারটা আপাতত কিছুতেই সামনে আনা যাবে না। এই শব্দটা শুনলেই অন্যরকম কিছু মনে করে বসে সবাই।

সানজিদার সাথে খুবই প্রাণোচ্ছল সময় কাটলো সবার। সুরমার সাথেও সানজিদার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম সুরমার ব্যাপারে ও আবার কিছু জিজ্ঞেস করে বসে কী না। কিন্তু আমার সব ভ্রান্তধারণা একেবারে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। সানজিদা নিজের প্রফেশনালিজমকে বেশ ভালভাবেই রপ্ত করতে পেরেছে। ও একেবারেই সহজ স্বাভাবিক ভাবে গল্প করলো আমাদের সাথে। সুরমা আর আমার সঙ্গে কলেজের দিনগুলোর গল্প এমনভাবে করছিল, মনে হচ্ছিলো যেন গতকালই কলেজে দেখা হয়েছে আমাদের। মাঝের বছরগুলো বেমালুম লাপাত্তা হয়ে গেছে!

সুনেত্রা কী করে…রুম থেকে চলেই যায় কী না, এটা নিয়েও আশঙ্কা ছিল মনে। সানজিদা সেই পরিস্থিতি তৈরিই হতে দিলো না! এমনভাবে সুনেত্রার সাথেও আলাপ জুড়লো যে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! সুনেত্রাকে কাছে টেনে ‘আপু’ ‘আপু’ করে এত মিষ্টি আলাপ জুড়ে বসলো যে, সুনেত্রার মতো মেয়েও হাসিমুখে একগাদা কথা বলে ফেললো। তারপর গল্প করতে করতেই আমাকে আর সুরমাকে শুনিয়ে বললো, ‘এ্যাই তোরা আমার জন্য একটু মজা করে নাস্তার আয়োজন কর। আমি একটু সুনেত্রার সাথে তোদের ছাদে ঘুরতে যাবো। দুজন মিলে রান্নাঘরে ঢুকবি। খবরদার আজেবাজে নাস্তা দিলে আমি কিন্তু খুব মাইন্ড করবো!’

সুরমা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, আমি একরকম ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে ওকে টেনেই নিয়ে গেলাম রান্নাঘরে। এই শেষের কথায় সুরমাও কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল। রেখেঢেকে আসল কথা বলতেই হলো আমাকে। শুনে কেমন একটু বিমর্ষ হয়ে গেল সুরমা। বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, ‘সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী তাই নারে? কতগুলো মানুষের জীবন আমার জন্য একেবারে এলোমেলো হয়ে গেল!’

এসব কথার উত্তর হয় না কোনো। আমিও তাই চুপ করে গেলাম।

ছাদে ঘোরার নাম করে দুজনে বেশ দীর্ঘ সময় পার করলো ওপরে। ফিরে যখন এলো, তখন দেখি সুনেত্রার মুখচোখ বেশ উজ্জ্বল। সানজিদা তো বরাবরই হাসিখুশিই ছিল। আরো অনেকটা সময় সবার সাথে গল্পগুজব করে সন্ধার পরে চলে গেল সানজিদা।

রাতে ওর ফোন পেলাম। রিসিভ করতেই বললো, ‘ফোন নিয়ে বাইরে বের হয়ে আয়। আশেপাশে যাতে সুনেত্রা না থাকে।’ আমি সানজিদার কথামতো কাজ করলাম। সানজিদা দীর্ঘসময় ফোনে কথা বললো। আমি মন দিয়ে ওর প্রতিটা কথা শুনলাম।

যা বললো তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, সুরমার পুলিশের কাছে ধরা পড়া এবং জেলে যাওয়ার বিষয়টা খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছে সুনেত্রার মধ্যে। সুনেত্রার আত্মসম্মানবোধ এই বিষয়টাতে ভীষণভাবে আহত হয়েছে। কারণ সুনেত্রার জীবন এবং সেই জীবনের কাছে প্রত্যাশাগুলো ছিল অন্যরকম। সে বড় কিছু হতে চাইতো ছোটবেলা থেকেই। চাইতো মাথা উঁচু করে বাঁচতে। সুরমার জেলে যাওয়ার পর থেকে ও বুঝতে পেরেছিল, আশেপাশে কেউই এখন ওদের পরিবারকে সেইরকম সম্মানের চোখে দেখবে না আর। হয়ত ভালো কোনো ছেলেও ওর দিকে ফিরে চাইবে না। কারণ তার বোন একজন জেলখাটা আসামী, ড্রাগের সাপ্লায়ার।

সুনেত্রার পড়াশুনার প্রতিও একটা অভক্তি চলে আসে। ওর মনে হতে থাকে, পড়াশুনা করে কী হবে! এসব করলেই কি ও ভালো কোনো জীবনযাপন করতে পারবে? তার কাছে এমনও মনে হতে থাকে, একজন পতিতার মেয়ে ভালো হলেও তাকে যেমন পতিতালয়েই কাটাতে হয় ঠিক তেমনি একজন ড্রাগ সাপ্লায়ারের বোন হাজার ভালো ছাত্রী হলেও তাকে অসম্মানের জীবনই কাটাতে হবে। এ থেকে এই জীবনে মুক্তি পাওয়া যাবে না!

এসব চিন্তাধারা থেকে পড়ালেখা না করে খুব সাধারণ একটা কেরিয়ার বেছে নিতে হয়েছে সুনেত্রাকে। এটার পরিণামও ভালো হয়নি। ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্নগুলোকে যখন মিথ্যায় ডুবে যেতে দেখেছে, তখন সে আরো একবার হোঁচট খেয়েছে। আর সেটা থেকেই নানারকম মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে ওর জীবনে।

আমি স্তব্ধ হয়ে সানজিদার কথাগুলো শুনলাম। কী ভয়ংকর কার্যবিধি মনের! আমরা ওপরে ওপরে বুঝতেও পারি না…অথচ মন ভেতরে ভেতরে কী ভয়ানক ভাবেই না ক্ষতিগ্রস্ত হয়!

জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কী করা যায় সানজিদা? আমি তো এসব কথা মামা-মামীকে বলতে চাচ্ছিলাম না!’

সানজিদা বললো, ‘বলতে না চাইলেও বলাই ভালো হবে। আর সুনেত্রাকে একজন পেশাদার কনসালট্যান্টের কাছে নিয়মিত চেকাপের মধ্যে রাখতে হবে। ওর মনের এই অস্থিতিশীলতাকে খুব ধীরে ধীরে স্থিতিশীল করতে হবে। কিছুতেই তাড়াহুড়া করা যাবে না। চাপ দিয়ে কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।’

আমি হাবুডুবু খেতে লাগলাম। সানজিদার কাছেই সমাধান চাইলাম। ‘পেশাদার সাইকোলজিস্ট কার কাছে নিয়ে যাবো? তুই কাকে সাজেস্ট করিস?’

‘সাজেস্ট একজনকে করতে চাচ্ছি। কিন্তু উনার চার্জ একটু হাই। চার্জ হাই হলে কী হবে, উনার এফিসিয়েন্সির ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারিস।’

আমি একটু সময় চিন্তা করে বললাম, ‘তুই নাম্বার দে উনার। আমি ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো!’

সানজিদা ফোন রাখার আগে বলল, ‘আমি কয়েকবার তোর কথা ওকে বলেছি নীরা। বলেছি, তোমার খুব কাছেই এমন একজন আছে যাকে দেখে তোমার সব ভুল ধারণাই পাল্টে যাবে। ও শুনেছে চুপচাপ কিন্তু মেনে নিয়েছে বলে মনে হলো না। একবার বলেও ফেললো…সবাই কি নীরা আপা হতে পারে? নীরা আপা এক্সেপশনাল!’

আমি ফোন রেখে ভাবতে বসলাম কী করা যায়। বড়মামা আর মামীকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো আশা করছি। কিন্তু টাকার কথাটা বলা যাবে না। বাবার কাছ থেকে যে টাকাটা পেয়েছি, সেটাতে এখন অব্দি হাত দিইনি। মনে মনে ঠিক করলাম, সুনেত্রার চিকিৎসার খরচটা আমিই বহন করবো। তবু ওকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতেই হবে।

এসব ডামাডোলের মধ্যে সুমনের সাথে কিছুদিন দেখা সাক্ষাত করা হয়নি। একদিন ফোন দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, ফুল ডাক্তার হতে না হতেই আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে দিয়েছো নাকি? না জানি ফুল ডাক্তার হলে কী করবা?’

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘ফুল ডাক্তার হলে তোমাকে পাত্তা দিব সেই আশা একেবারে করবা না বুঝলা?’

সুমন কপট রাগ দেখায়ে বললো, ‘আচ্ছা? বটে! বেশ তাহলে আগেভাগেই বিয়ে করে ফেলবো দাঁড়াও! চলো কালকেই বিয়ে করে ফেলি!’

‘মানে? বিয়ে করে খাওয়াবে কী? ভালোবাসার শরবত আর প্রেমের চপ কাটলেট? ও দিয়েই পেট ভরবে?

‘জি না। ভাত মাছ মাংশই খাওয়াবো ম্যাডাম! চাকরি পেয়েছি একটা। ছোটখাটো…কিন্তু বেতন একেবারে খারাপ না।’

আমি খুব জোরে একটা চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘সত্যিই? এই খবর এতক্ষণে? এত ভনিতার পর?’

(৪৩)

সুমনের চাকরি পাওয়া উপলক্ষে পরদিন সেলিব্রেট করলাম।

এবারে আর দুজন মিলে সেলিব্রেশন না। সুমন ওর ডেন্টাল কলেজের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। আমিও আমার কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম। আইডিয়াটা সুমনেরই। বন্ধু বান্ধবদের কাছে নিজেদের সম্পর্কের একটা অফিসিয়াল ঘোষণাপ্রদান আর কী!

তা সেই ঘোষণা বেশ সাড়ম্বরেই দেওয়া হলো। শহরের সবচেয়ে ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া যাকে বলে! সুমন ভালোই খরচ করলো। আমি কিছু বলে ওকে আশাহত করতে গেলাম না। হয়ত এতে কষ্ট পেতে পারে। আর এখনই ওর খরচপাতির দিকে আমার শ্যেনদৃষ্টি লাগিয়ে রাখাটা কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে আমার কাছে। কিছু ব্যাপারে স্পেস দিলে আখেরে সম্পর্কে স্পেস কমে। ওর কিছু ব্যাপারে নিজস্বতা থাকবে না তা কী করে হয়?

আমাদের নিজেদের বাসাতে যখন খানিকটা সুখ অবশিষ্ট ছিল, তখন মাকে দেখতাম প্রায়ই এই খরচ করা না করা নিয়ে বাবার সাথে খ্যাচ খ্যাচ করতো। বাবা উদার হাতে খরচ করতে পারতো না। বড় মাছ কিনে আনতো পিছ করে। আস্ত বড়মাছ বাবাকে কখনো কিনতে দেখেছি বলে মনেও পড়ে না। মা ভয়ানক বিদ্রুপমেশানো গলায় বলতো,

‘তুমি তো বড়লোকের ঘরেই জন্মেছো বলে জানি! এরকম চিমটি কেটে বাজার করার অভ্যাসটা কোথায় পেয়েছো?

সেসব কথা নিয়ে বাবা আবার পাল্টা কিছু কথা শোনাতো। যে যে যার যার অবস্থানে থেকে শুধু কথাই শুনিয়ে যেত! তা থেকে বাড়তো ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে বিদ্বেষ। ধীরে ধীরে ভেঙে গেল আস্ত একটা সম্পর্কই।

কিছুদিন ধরে শুধু মা-বাবা আর আমাদের সেই বাসাটার কথা মনে পড়ছে।

গতকাল ফোনে সুমন বলছিল, খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে করে ফেলতে চায়। অহেতুক সময় নষ্ট করার নাকি মানে হয় না কোনো। আমারও মন থেকে অসম্মতি নেই। জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্তেও মা-বাবা বিহীন একা একা পথ চলবো, এটা কোনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করিনি। বাবা তো চলেই গেল একরাশ ভুল বোঝার দায়ভার কাঁধে নিয়ে। মাকে মাঝে মাঝে দেখতে ইচ্ছে করে আমার। যদিও সেই ইচ্ছের কথা নিজের কাছেও স্বীকার করতে মন চায় না। যে মা নিজের ছেলেমেয়েদেরকে ভুলে গিয়ে এভাবে নতুন জীবন নিয়ে মেতে থাকতে পারে, তার তো মা ডাকটা শোনার মতোও যোগ্যতা ছিল না কোনোদিন। আমি আর নয়ন তাকে তার সেই যোগ্যতার বাইরের সম্মানে ভূষিত করেছি। এমনই দুর্ভাগ্য তার…সেই সম্মানের মূল্যটুকুও বুঝতে পারলো না!

যতই রাগ দুঃখ অভিমান পুষে রাখি না কেন, গর্ভধারিনীকে ভুলতে পারা যে অসম্ভব! তাই মাঝে মাঝে অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মায়ের মুখটা মনে পড়ে। খুব দুর্লভ কিছু সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি মনের কোণে ভুস করে ভেসে ওঠে। আমার বিয়ে হবে, অথচ আমার মা-বাবা কেউ সেখানে থাকবে না! এতই ভাগ্যহীনা আমি!

মামা-মামী আর নানীকে কীভাবে বিষয়টা বলব তা নিয়ে অবশ্য একটু লজ্জার মধ্যে পড়েছি। যদিও আমার বুদ্ধিমতী নানী সুমন যেদিন বাসায় এসেছিল, সেদিনই কিছু একটা আন্দাজ করেছে। ইতিমধ্যেই কয়েকবার জিজ্ঞেসও করে ফেলেছে, ‘ছোড়াডা কে রে বুবু? দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। আমার মত আছে। আলহামদুলিল্লাহ পড়ে দিলাম!’

আমি একটু হেঁয়ালি করে একবার বলেছিলাম, ‘তোমার মত আছে মানে? বুঝলাম না তো বিষয়টা!’

‘ওরে বুবু! বেশিদিন ঘুরাস না ছেমড়ারে! কোনদিন উল্টা রাস্তা গুনবো কে জানে!’

আমি লজ্জায় আর কিছু বলিনি। নানী যা বোঝার বুঝে গিয়েছে বুঝতে পেরেছি। এখন নানীই আমার বাকি মুশকিল আসান করে দিবে এই আশায় আছি। নইলে মামা মামীদেরকে বেশিকিছু বলতে যাওয়া আমার কম্মো নয়।

চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বন্ধু বান্ধবরা মিলে ভালোই লেগপুলিং করলো আমার আর সুমনের। সুমনের মুখে কেন যেন হাসিই ধরছে না! একেবারে একান ওকান। সেটা দেখেও নানারকম টিকাটিপ্পনি ভাসতে লাগলো। ‘কীরে তুই যে একেবারে গলে গলে পড়ছিস! এতদিন খবরই নাই! আজ একেবারে বিয়ের খাওয়াদাওয়া খাওয়াচ্ছিস! ভালো ভালো…কবুল বলে ঝুলে পড়। আমরাও ধীরে ধীরে তোদের রাস্তা ধরি!’

আমার বন্ধুদের সাথে সুমনের তেমন একটা পরিচয় নেই। তাই প্রথমে একটু ইতঃস্তত ভাব থাকলেও সেটা কেটে যেতে সময় লাগলো না। কয়েকজন সমবয়সী তরুণ এক জায়গায় হলে আড্ডা জমে উঠতে সময় লাগে না। আড্ডা হলো খুব, খাওয়াদাওয়া হলো জম্মেশ। সেইসাথে প্রচুর শুভকামনাও ঝুলিতে জমা হলো। সবাইকে বিদায় করে দিয়ে আমরা দুজন কাছেরই একটা পার্কের নিরিবিলিতে গিয়ে একটু বসলাম।

সুমনের ভাবসাব আজ একটু বেশিই তরল। আমি একটু ভয় পেলাম। এ্যাফেয়ারের এই এতগুলো দিনে সুমন কখনো নিজের সীমালঙ্ঘন করেনি। কিন্তু আজ কেন যেন ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না। আমি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে পরিবেশটা ভালোমত যাচাই করে নিয়ে বললাম, ‘আশেপাশে কিন্তু আরো অনেকে বসে আছে, দেখেছো?’

‘হুম দেখেছি! কেন বললা এই কথা?’ সুমন এক হাতে আমার হাতের পাঁচ আঙ্গুল নিয়ে খেলছে।

‘না বললাম এই জন্য যে, কারো কারো দু’এক পেগ পেটে পড়তেই নেশা চড়ে যায়। কিন্তু তুমি তো বিয়ের ঘোষণা দিতে না দিতেই কেমন যেন নেশায় চুর হয়ে গেলে!’

সুমন হাসলো। হাসতে হাসতে ঘোরলাগা চোখে বললো, ‘হুমমম…আর কত! এবার তো আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না! চলো গোপনে বিয়ে করে ফেলি! পরে বাসায় জানিয়ে দিলেই হবে!’

‘ওরে নেশা এত চড়েছে! ঘোষণা দেওয়া হয়ে গেছে, বাসায় সবকিছু ঠিকঠাক, চাকরিও একটা পেয়ে গেছো…আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা! সেটারও তর সইছে না! হলো কী তোমার? আর গোপনে বিয়ে করব কেন? আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে যেখানে প্রকাশ্যেই বিয়ে করা যাচ্ছে!’

‘আরে বুঝলা না? গোপনে বিয়ে তো ম্যাটার না! ম্যাটার হচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলেই ইয়ে মানে…তারপর আমরা কোথাও চাইলে রুমটুম ভাড়া করেও তো সময় কাটাতে পারবো! মানে একটা লাইসেন্স হাতে চলে আসা আর কী!’

আমি চোখ পাকালাম। ‘ওরে বাবা! তলে তলে এত! তুমি বললেই আমি সুড়সুড় করে তোমার কুমতলবে সাড়া দিব এত সোজা সরল বালিকা তুমি আমাকে কবে থেকে ভাবতে শিখলা?’

‘ওহ আচ্ছা বিয়ের পরেও তোমাকে ধরা যাবে না বলছো? তুমি কি ‘সাতকাহন’এর দীপাবলী হওয়ার জন্য সাধনা করছো নাকি?’

সুমন সিরিয়াস মুখে প্রশ্নটা করেছে। আমার কেন জানি না খুব হাসি পাচ্ছে। সুমনের মধ্যে কেমন একটা মরিয়াপনা দেখতে পাচ্ছি আজকে। আজ মনে হচ্ছে ভালোই ভালোই কেটে পড়াটাই সুবুদ্ধির পরিচয় হবে।

আমাকে হাসতে দেখে সুমন পুর্ণেন্দু পত্রী আওড়ালো।
‘তোমার মধ্যে অনন্তকাল বসবাসের ইচ্ছে
তোমার মধ্যেই জমিজমা ঘরবাড়ি, আপাতত একতলা
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?’

‘হাসছি তোমার পুলক দেখে! ভয় নেই, দীপাবলী হতে চাইবো না কখনোই। আমার কাছে ঘর বাঁধাটাই সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। দীপাবলীর স্বপ্ন কী ছিল ভুলে গেছি। ম্যালাদিন আগে ‘সাতকাহন’ পড়েছি। এখন আর একদম মনে নাই।

আমরা দুজন এরপর দীপাবলীর গল্প নিয়ে মশগুল হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম, সুমন খুব রিসেন্টলি বইটা পড়েছে। তাই গল্পের চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে। আমরা দুজনে যখন বিভোর হয়ে গল্প করছি, তখন এক টোকাই এসে সামনে দাঁড়ালো। সুমন মুখ তুলে হাসিমুখে বললো, ‘কীরে কী চাই? তুইও কি আলোচনায় অংশ নিতে চাস নাকি?’

টোকাই এই রসিকতার ধার দিয়ে না হেঁটে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সোজা এক দৌঁড় লাগালো। আমরা দুজনেই বিস্মিত বাকরুদ্ধ হয়ে হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। সুমনই প্রথম মুখ খুললো।

‘যাব্বাবাহ! এই পিচ্চি দেখি তোমাকে প্রেমপত্র দিতে এসেছিল! কী লিখছে ব্যাটা দেখো দেখি! আজকাল দেখি সব স্থান কাল পাত্র থেকে প্রেমপত্র পাচ্ছো! কী যে কপালে আছে আমার কে জানে!

‘আহ ফালতু রসিকতা ছাড়ো তো! দেখি কী দিলো!’ বলতে বলতেই কাগজটার ভাঁজ খুলে পড়ে ফেললাম। আর পড়তেই আমার সর্বাংগ বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে গেল। মাথার ভেতরটা এক লহমায় কেমন জানি শূন্য হয়ে গেল। সুমন আমার ভাব দেখে তাড়াতাড়ি কাগজটা নিতে চাইলো আমার হাত থেকে। আমি সাথে সাথে ছিঁড়ে মুঠো পাকিয়ে এক ঢিলে দূরে ছুঁড়ে মারলাম। সুমন হাঁ হয়ে গেল আমার কাণ্ড দেখে। কিছু বলার আগেই বললাম,

‘চিন্তা করো, এই বয়সের বাচ্চাকাচ্চা! কী এদের চিন্তাভাবনা! বাজে কিছু কথাবার্তা লিখে নিয়ে এসেছিল!’

‘এ্যাঁ বলো কী? ছিঁড়ে ফেললা কেন? এই পিচ্চিকে তো ধরা দরকার ছিল!’

‘আরে দূর! কী ধরবা? ওর সাথে লাগতে যাবা তুমি? বাদ দাও। চলো চলে যাই এখান থেকে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে!’

সুমন আর কী কী যেন বলতে যাচ্ছিলো, আমি হিড়হিড় করে ওর হাত ধরে টানতে লাগলাম। আর এক মুহূর্তও এখানে বসে থাকা যাবে না! শয়তানটা আশেপাশেই আছে! কত বড় শয়তান! ঠিকই নজর লাগিয়ে রেখেছে আমার দিকে! আমরা যে এখানে এইসময় আসবো এটা তো আগে থেকে ঠিক হয়ে ছিল না! তার মানে শয়তানটা আমার পিছে লেগে আছে। আমার চলাফেরা সবকিছুর দিকে গোপনে লক্ষ রাখছে। মতলবটা কী ওর?

পিচ্চিটা যখন কাগজটা দিয়ে গেল, ভাবতেই পারিনি ওটা বিপ্লব পাঠিয়েছে! ভেতরের লেখাগুলো পড়ে আত্মা থেকে প্রাণপাখী উড়ে গেল আমার!

‘মনে আছে সুন্দরী? সব কড়ায়গণ্ডায় শোধ হবে! ফূর্তি করছো…করে নাও! এই তো আর মোটে কয়েকটা দিন!’

গায়ের রক্ত পানি হয়ে গেছে আমার। তারমানে বিপ্লব এত সহজে আমাকে ছাড়বে না। কিন্তু কী পরিকল্পনা বিপ্লবের? সুমনের কোনো ক্ষতি করতে চায় কি? ঠিক তাই হবে! নিশ্চয়ই শয়তানটা সুমনের ক্ষতি করে আমার ওপরে প্রতিশোধ নিবে। যখন বুঝতে পেরেছে যে, আমি কিছুতেই ওর হাতে ধরা দিইনি…উলটো ওকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছি তখন আমার সুখের উৎস সুমনের ওপরেই ও চরম প্রতিশোধ নিবে!

ভয়ে হাতপা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। সুমন অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। বারকয়েক জিজ্ঞেসও করেছে, ‘কী হয়েছে বলো না? এমন কেন করছো? কী লেখা ছিল সেই কাগজে? বেশি খারাপ কিছু? তাহলে তো ছেলেটাকে ধরতে হতো!’

ইস! আজকে আর একটু হলেই সুমনের কাছে ধরা পড়ে যেতাম! ধরা পড়লে কী বলতাম আমি জানি না! এভাবে কতদিন লুকিয়ে রাখতে পারবো সেটাও জানি না।

সেদিন আর কোথাও গেলাম না। সোজা বাসায় চলে এলাম। সুমনের জন্য টেনশন হচ্ছে, কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। সাবধানও করা হলো না!

বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করলাম। কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু সেটা কী?

একটু পরে সুনেত্রা ঘরে ঢুকলো। সানজিদা আমাদের বাসায় আসার পর থেকে দেখছি সুনেত্রা বেশ হাসিখুশি আছে। আমাকে একবার সানজিদার ব্যাপারে এটা ওটা জিজ্ঞেসও করেছে। আজকেও দেখছি স্বাভাবিক আছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।

তখন সানজিদার কথা মনে পড়ে গেল আমার। সানজিদা বলেছিল,‘মাঝে মাঝে ওকে স্বাভাবিক মনে হলেও ওর কিন্তু সুস্থ হতে সময় লাগবে। পুরো ব্যাপারটাই সাময়িক। তাই দেরি না করে ওর চিকিৎসাটা দ্রুত শুরু করতে হবে। দেরি করলে পরিস্থিতি দিনকে দিন আরো খারাপের দিকে যাবে।’

সুনেত্রাকে কনসালটেন্টের কাছে নিয়ে যেতে রাজি করানোটা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। সানজিদা বলছিল, এটা ওর ওপরে ছেড়ে দিতে। কনসালটেন্টকে দেখানোর ব্যাপারে সুনেত্রাকে সানজিদাই রাজি করাবে।

আমি সুনেত্রার দিকে তাকিয়ে পাল্টা হাসিমুখে বললাম, ‘কীরে ক্লাস শেষ হলো?’

‘ক্লাস আগেই শেষ হয়েছে নীরাপু। একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম বান্ধবীরা মিলে।’

আমি একটু ইতঃস্তত করে বললাম, ‘তোকে একদিন সানজিদার বাসায় নিয়ে যাবো। যাবি আমার সাথে?’

সুনেত্রা একটু যেন অবাক হলো। সুরমাকে ছেড়ে ওকে কেন নিয়ে যেতে চাইছি ব্যাপারটা ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। তবু হ্যাঁ বোধক জবাবই দিলো।

বড়মামা আর মামীকে যা বলার আমিই বলবো। আপাতত খরচাপাতি নিয়ে কোনো কথাই বলব না। ওটা ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার। এখন তো নয়নকেও কোনো টাকা পয়সা দিতে হয় না আমার। বাবার টাকাটা আছে, টিউশনীর টাকাও থাকবে। কাজেই সুনেত্রার চিকিৎসাখরচ ঠিক সামলে যাবে।

এসব ভাবতে ভাবতে আমার মাথা থেকেও সাময়িক সময়ের জন্য বিপ্লবের ভাবনাটা সরে গেল। সব চিন্তা ভুলে আমিও অন্যকিছুতে মগ্ন হতে যাচ্ছি এমন সময়ে সুমনের ফোন পেলাম। থমথমে মুখে বললো, ‘তুমি কি ফেসবুকে বিপ্লবের সাথে এ্যাড আছো?’

আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, ‘নাতো! কেন কী হয়েছে?’

‘আমি তোমাকে একটা ছবি পাঠাচ্ছি মেসেঞ্জারে। ছবিটা দেখে বলো দেখি, এর অর্থ কী?’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত