Categories
সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

তিনটি গল্প
ইফতারি জার্নালে অনেক গভীর কথাবার্তা হলো, কিছু জ্ঞান চর্চাও হলো। আজ না হয় একটু হাল্কা ভাবেই লিখি। মানেই গল্প বলি আপনাদের। গল্প মৌলিক নয়। জগতের কয়টি গল্পইবা মৌলিক হয়। যাহোক, আজ তিনটি গল্প পাঠ করা যাক। জেন বুদ্ধদের এই গল্প তিনটি আপনাদের জন্য অনুবাদ করে দিলাম —
গল্প ১
বুদ্ধ তার শিষ্যদের সঙ্গে এক সকালে বসে আছেন।
একজন লোক এলো।
জিজ্ঞেস করলো, ‘ভগবান বলে কারো অস্তিত্ব আছে?’
‘তিনি আছেন’, বুদ্ধ বললেন, মৃদু হাস্যে।
দুপুরের দিকে আরেক লোক এলো। এবার সেই লোকটি বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো একই প্রশ্ন, ‘ভগবান বলে কিছু কি আছে?’
বুদ্ধ বললেন, ‘না, তার কোন অস্তিত্ব নেই।’
সেই লোকটি চলে গেলো। দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো প্রায়।
আবার আরেকজন এসে সেই একই প্রশ্ন, ‘ভগবান আছেন?’
বুদ্ধ এবার উত্তর দিলেন, ‘সেটা তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
লোকটি চলে গেলো। বুদ্ধের শিষ্যদের একজন এবার খানিকটা উত্তেজিত হলেন। তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন, এটা তো অসম্ভব কথা প্রভূ! আপনি কেমন করে একই প্রশ্নের এমন ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিলেন!’
বুদ্ধ হাসলেন।
বললেন, ‘ওরা তো সবাই ভিন্ন ভিন্ন লোক। প্রথম জন আমি যা বললাম তাই বিশ্বাস করবে। দ্বিতীয় জন আমি যা বললাম তা ভুল প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে। আর তৃতীয় জন কেবল সেটাই বিশ্বাস করবেন যা তার বিশ্বাস করার কথা। ’
আরো পড়ুন: সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান
গল্প ২
কিতোর বয়স যখন ১২ তখন তাকে শিক্ষকের কাছে পাঠানো হলো। বারো বছর ধরে সে জ্ঞানার্জন করলো। ২৪ বছর বয়সে সে তার শিক্ষাকাল সমাপ্ত করে ঘরে ফিরে এলো। সে তখন বেশ গর্বিত।
তার বাবা তাকে বললো, ‘তুমি তো অনেক কিছু শিখে এলে। তুমি তো খুব শিক্ষত। এখন আমাকে বলো আমরা দেখি না এমন জিনিসকে কিভাবে মানবো? কেমন করো বুঝবো যে সর্বক্ষমতাধারী ভগবান সব জায়গায় আছেন।’
তরুণ কিতো তখন নানা ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া শুরু করলো। নানা রকমের বাণী আওড়াতে লাগলো। বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এই তো বড় জটিল সব কথা বলছো বাবা। ভগবানের অস্তিত্ব আছে এটি বোঝানোর সহজতর কোন উপায় কি নেই?’
‘না, বাবা। আমি যা জানি তাই বললাম। আমি একজন শিক্ষিত লোক। আমাকে নিজের শিক্ষা ও বিদ্যা ব্যবহার করে সব কিছু ব্যখা করতে বলা হয়েছে। ঐশ^রিক জ্ঞানও বোঝাতে হলে উদ্ধৃতি লাগবেই।’
‘নাহ, তোমার পেছনে আমি অহেতুক অর্থ অপচয় করেছি। খামাখায় তোমাকে আমি আশ্রমে শিক্ষা নিতে পাঠিয়েছিলাম। এসো আমার সাথে।’
তিনি পুত্রকে হাতে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। রান্না ঘরে গেলেন তারা। তিনি সেখানে একটা বড় পাত্র নিলেন। তারমধ্যে লবণ মেশালেন। তারপর তারা একসাথে বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাটি করলেন।
ফিরে এসে তিনি পুত্রকে বললেন, ‘পানির মধ্যে যে লবণটুকু আমি মিশিয়েছিলাম, সেটা নিয়ে আসো।’
কিন্তু পুত্র কিতো সে লবণ তো আনতে পারলো না। কারণ লবণ তো পানিতে মিশে গেছে।
বাবা বললেন, ‘তাহলে তুমি তো লবণটুকু এখন দেখতে পাচ্ছো না। লবণ অদৃশ্য হয়ে গেছে। এবার এক কাজ করো এই পাত্রের উপর দিকের একটু পানি চেখে দেখো।’
পুত্র চেখে দেখে জানালো এর স্বাদ নোনতা। পিতা বললেন, ‘এবার পাত্রের মাছামাছি জায়গা থেকে একটু পানি পান করো।’
পুত্র তাই করলো।
‘এবার পাত্রের তলার পানি চেখে দেখো।’
পুত্র যথাবিহিত সে পানি চেখেও দেখলো নোনতা পানি। পাত্ররে উপরের, মাঝের এবং তলার পানি একই রকম নোনতা।
বাবা বললেন, ‘তুমি এতো বছর ব্যয় করলে পড়ালেখায়। কিন্তু সহজ করে বুঝতে পারলে না অদৃশ্য ঈশ্বর কেমন করে সবখানে একই সাথে থাকতে পারে! এই একপাত্র পানি আর লবণ দিয়ে আমি একজন কৃষককেও ব্যাপারটা বোঝাতে পারি। এতো তত্ত্ব কথা আর জ্ঞানের জটিলতা লাগে না মহাপ্রভূকে বুঝতে। আর সেই জ্ঞান ভুলে যাওয়াই ভালো যে জ্ঞান বিভাজন আনে।’
পুত্র কিতো মাথা নিচু করে নিজের নখ কামড়াতে লাগলো।
গল্প ৩
সাধু তেৎসুগেন একটা স্বপ্ন বা ইচ্ছা ছিলো। তিনি চেয়েছিলেন জাপানী ভাষায় সকল পবিত্র গ্রন্থগুলো একত্রে প্রকাশ করবেন। নিজের এই স্বপ্নপূরণের জন্যে তার অনেক টাকা লাগবে। তিনি সাধু সন্ত মানুষ। অতো টাকা পাবেন কোথায়। তাই টাকার সংগ্রহের জন্য পথে নামলেন। বহু জায়গা ঘুরে তিনি টাকা সংগ্রহও করে ফেললেন।
যখন পর্যাপ্ত টাকা হাতে এলো তিনি ফিরে এলেন নিজের মাটিতে। কিন্তু এসে দেখেন উজি নদীতে বান নেমেছে আর বন্যায় ভেসে গেছে চারপাশের লোকালয়। বন্যার্ত মানুষেরা ভয়ঙ্কর দূর্দশায় পড়ে গেছে। তেৎসুগেন তার সংগ্রহীত সব টাকা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। গৃহহীন ঘর তুললো, খাদ্যহীন খাবার পেলো।
তারপর তিনি আবার বেরিয়ে পড়লেন। দুয়ারে দুয়ারে সাহায্য ভিক্ষা চাইতে লাগলেন। তিনি তার গ্রন্থ প্রকাশের স্বপ্ন পূরণের জন্য আবার টাকা যোগাড় করতে লাগলেন। মানুষ চাইলে কী না-পারে। তিনি জাপানের এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে ঘুরে ঘুরে ঠিকই পর্যাপ্ত টাকা পেয়ে গেলেন। আবার ফিরে এলেন নিজের ঘরে। তিনি তখন ক্লান্ত, খানিকটা বিধ্বস্তও।
কিন্তু ঠিক সেই সময় পুরো ইদো সা¤্রাজ্যে কলেরার মহামারি নেমে এলো। দেশ তখন মৃত্যুপুরী। অসুস্থ্য মানুষ চিকিৎসা পায় না, সেবা পায় না, খাদ্য পায় না। সন্ত তেৎসুগেন আবার তার টাকা বিলিয়ে দিলেন। অসুস্থ, আর্ত, অসহায় পরিবারদের তিনি অর্থ সাহায্য দিলেন। তার বইটি এবারও প্রকাশ করা হলো না।
কিন্তু সাধু তেৎসুগেন বিচলিত হলেন না। আবার তিনি পথে নামলেন টাকা সংগ্রহের আশায়। দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন তিনি।
অবশেষে বিশ বছরের চেষ্টায় তিনি পবিত্র গ্রন্থের সাত হাজার কপি ছাপতে সক্ষম হলেন।
জ্ঞানীরা বলেন যে, সবাই দেখেছে সাধু তেৎসুগেন পবিত্র গ্রন্থসমূদের একটি মাত্র সংস্করণ করেছেন। কিন্তু আসলে তিনি তিনবার পবিত্র ধর্মগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, তবে প্রথম দু’বারের পবিত্র গ্রন্থগুলো বইয়ের পাতায় নেই, রয়েছে মানুষের মনে।

জন্ম ২৭ মার্চ, ময়মনসিংহ। এমফিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা লেখালেখি।