| 27 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

দেশের কথা

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট
আজ ২৪ আগষ্ট কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


আমার পিতামহ ছিলেন স্কুল-শিক্ষক। নোয়াখালি জেলার দত্তপাড়া ইশকুলের ভূগোল পড়াতেন। স্বাধীনতা মানে দেশভাগের পর আমার দাদু-ঠাকুর্মাদের এধারে চলে আসতে হয়েছিল। আমার জন্ম স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর।
ছোটোবেলায় দাদুর কাছেই পড়তাম। ভূগোলটা খুব ভালো পড়াতেন। ম্যাপ আঁকার নিয়মটা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের ম্যাপ আঁকার সময় বলতেন ইংল্যান্ডের ম্যাপ আমেরিকার ম্যাপ আমি একটানে আঁইক্যা দিতে পারি। বহুবছরের অইভ্যাস। ভারতের ম্যাপও নিমেষে মধ্যেই আঁইক্যা দিতে পারতাম, ব্লাকবোর্ডে কত আঁকছি, ফরটিসেভেনের পর তো সেই অভ্যাসেই কাম হয় না। ইন্ডিয়ার শরীরের থিক্যা যে মাংসগুলি খুবলাইয়া লইল সেই খবলাইয়া লওয়া মাংস বাদ দিয়ে বাকিটা আঁকতে হয়। নখের আঁচড়ের দাগগুলি ঠিকমতো আঁকতে পারি না এখনও।
বাংলাদেশের হাইকমিশনের ওয়েটিং রুমের দেওয়ালের ম্যাপটার সামনে দাঁড়িয়ে দাদুর কথা মনে পড়ল। দাদুর কাছ থেকে শোনা হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলিকে খুঁজতে লাগলাম। এই তো চাঁদপুর। ওই তো মতলব, মতলবের দই-এর কথা খুব শুনতাম যতবার যত ভালো দই এনেছি, গাঙ্গুরাম, জলযোগ, যেখান থেকেই হোক, মতলবের দইয়ের কাছে নাকি কিছু নয়। ছোটোবেলায় দাদুর হাত ধরে বিয়ে বাড়িটারি নেমতন্ন খেতে যেতাম। ওখানে খাঁটি নোয়াখালি ভাষায় কথাবার্তা হত। কোনো সবজিতেই দেশের বাড়ির সবজির স্বাদ পেতেন না ওঁরা, কোনো মাছেই না, আর শেষ পাতে দই এলে সমবেত আপশোষ শুনতাম মতলব, হায় মতলব। গোয়ালন্দ দেখলাম। ওখান থেকেই স্টিমারে করে চাঁদপুর নামতে হত। চাঁদপুর থেকে কীভাবে যেন দত্তপাড়া যেতে হত। আমি দত্তপাড়া গ্রাম নামটা ওখানে খুঁজে পেলাম না। লক্ষ্মীপুর খুঁজে পেলাম। ওটাতে আমার মামার বাড়ি। দেশ ভাগের পরও আমার মায়ের বাবা-মা ওখানেই থাকতেন। আমার মায়ের বাবা, দাদামশাই মাঝে মাঝে আসতেন। ওঁকে আমরা বলতাম পাকিস্তানি দাদু। একটা পোঁটলার ভিতর থেকে বার করা একটা রোল করা জিনিসের প্রতি আমার প্রতীক্ষা থাকত। ওটা হল আমসত্ত্ব। আমসত্ত্বের সারা গায়ে ফুটে থাকতো একটা নকশা। যে পাটির উপর আমের রস মাখিয়ে আমসত্ত্ব তৈরী করা হত, সেই শীতল পাটির নকসাটা ফুটে উঠত শুকনো আমসত্ত্বের সারা গায়ে। এই আমসত্ত্ব বয়ে আনত দেশের বাড়ির ছাপ। আমার মা ছাপা পাটিটার গায়ে হাত বুলোত, ফেলে আসা গ্রামটার গায়েই হাত বুলোত বোধহয়।
আমার দাদু আর দাদামশাই গল্প করতেন। ওরা বলত দেশের বাড়ির গল্প– আমরা বলতাম ওসব পাকিস্তানের গল্প। ওদের গল্পের মধ্যে জিন্না-গান্ধী থাকত, শরৎ বোস-ফজলুল হক থাকত, গোলাম সরওয়ারের নাম করতে গিয়ে ওরা মুখ বিকৃত করত। সেই নাকি নোয়াখালির দাঙ্গার নেতৃত্বে ছিল। ওদের কথার মধ্যে থাকত মতিচুর খই, ‘মূলার অম্বল’,‘টাটকিনি মাছ’, ‘মতলবের দই’। ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে হারিযে যাওয়া কথাগুলো খুঁজছিলাম।
বাংলাদেশ হাইকমিশনে যেতে হয়েছিল একটা ভিসার ব্যাপারে। জলের আর্সেনিক নিয়ে একটা সেমিনারে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই ব্যাপারেই যেতে হয়েছিল হাইকমিশনে। ভিসা সহজেই পেয়ে গেলাম। ট্রেনে বনগাঁ গিয়ে বর্ডার পেরিয়ে বেনাপোল থেকে বাসে খুলনা যাওয়া খুবই সহজ। সেরকমই ঠিক করলাম। আমার দাদু অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন, ঠাকুরমা এখনও আছেন। নব্বই বছর বয়েস, শয্যাশায়ী, ঠাকুমা একসময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন। এখনকার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। গত দু’মাস ধরে পায়খানা পেচ্ছাপ বিছানাতেই। যখন-তখন অবস্থা। এই অবস্থাতেই আমাকে যেতে হবে। যাওয়াটা মিস করতে চাই না। মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনাম থেকেও লোক আসবে। আর্সেনিক সমস্যা ওরা কীভাবে মোকাবিলা করছে শোনা যাবে। ঠাকুরমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলাম–ঠাকুমা, বাংলাদেশে যাচ্ছি, বক্তৃতা দিতে, দেশের বাড়ি, দেশের বাড়ি। ঠাকুমা মুখটা কাছে নিয়ে গেলাম। মনে হল যেন বলছে–জব্বর। জব্বর।
জব্বর নামটা একটু চেনা চেনা। জব্বর আলী। দাদু জব্বর আলী নামটা তুলে গালমন্দ করতেন, যতদূর মনে পড়ে, ঠাকুরমা মৃদু প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করলে দাদু রেগে যেতেন। দাদু ঠাকুরমার মধ্যে যখন পিওর নোয়াখালি ভাষায় ঝগড়াঝাটি হত, আমরা ভাইবোনেরা বেশ উপভোগ করতাম। দাদু ঠাকুরমা ঝগড়ার মধ্যে জব্বর আলী নামটা প্রায়ই শুনতাম মনে হচ্ছে। কিন্তু ঠাকুরমা কী বলতে চাইছে? জব্বর আলীকে কিছু খবর দিতে চাইছে, নাকি জব্বর আলীর খবর আনতে বলছে, নাকি অন্য কোনও ব্যাপার?
আমার বাবার বয়স এখন চুয়াত্তর। বাবার কাছ থেকেই বাংলাদেশের গল্প খুব একটা শুনিনি।
আমার বাবা যদিও দত্তপাড়া স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেছিলেন, আর আই.এস.সি ঢাকা থেকে। বি.এস.সি পড়তে কলকাতা চলে এসেছিলেন। হোস্টেলে থেকে পড়তে হত। চাকরি জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে। বদলির চাকরি ছিল। কলকাতা বাড়ি ভাড়া করে আমরা থাকতাম, বাবা বাইরে বাইরে ঘুরতেন। বাবার কাছে রূপসা, মধুমতী, মেঘনা, ডাকাতিয়া নদীর কথা যত শুনেছি, তারচেয়ে বেশি শুনেছি শতদ্রু ঝিলম, তুঙ্গভদ্রা, বেত্রবতীর কথা। মেঘতাবুরু, ছত্তিশগড় বাদাম-পাহাড় যত শুনেছি ঢাকা ময়মনসিংহ তত শুনিনি। তবে বাবার কাছে দত্তপাড়া ইশকুলের ফুটবল মাঠ, অঙ্কের টিচার গোলাম মুস্তাফা, বহুরূপী আনার আলী, এদের কথা কিছু কিছু শুনেছি। মনে হয়, দেশভাগের ব্যথা আমার বাবার বুকে ততটা বাজেনি। কারণ বোধহয় স্বপ্নই ছিল গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসার, আর শহরেই যাদি আসবেন, তো ঢাকা কেন, কলকাতা। যখন দেশভাগ হল, বাবার তখন একুশ বছর বয়েস। রিপন কলেজের হোস্টেলে থাকনে। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাস, বাবা অবাক হয়ে দেখলেন একটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা অবস্থায় আমার দাদু হোস্টেলের দরজা ধাক্কা দিচ্ছেন, রাত দশটার সময়।
বাবা জানতেন দেশে দাঙ্গা চলছে। গান্ধীজি নোয়াখালি যাবেন, কাগজে পড়েছেন, খুবই চিন্তায় ছিলেন আমার বাবা। কলকাতার অবস্থাও খুব সুবিধের নয়। আগস্ট মাসে কলকাতার দাঙ্গা জেল চলছে তখনও। দাদুকে দেখে বাবা জিজ্ঞাস করেছিলেন–আপনে একা আসছেন, মা কোই? দাদু নাকি তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বলেছিলেন–তর মারে আনতে পারলাম না, আমারে তুই মাইর‌্যা ফালা। আমার ঠাকুরমা পরে এসেছিলেন। দিন দশেক পরে। একজন মুসলমান পরিবারের আশ্রয় পেয়েছিলেন। তবে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন জানে ঠাকুরমাকে মুসলমানেরা কেড়ে রেখে দিয়েছিল, সাতদিন ধরে অত্যাচারিতা হবার পর কোনে রকমে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন। আমার ঠাকুরমার বয়স তখন ৩৮ বছর ছিল। খুব বেশি বয়স নয়। আজকাল এই বয়সে অনেক মেয়ে বিয়ে করে।
আমার বাবা জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বেশ একটা উঁচু পদ পর্যন্ত উঠেছিলেন। রিটায়ার করার সময় ডেপুটি ডাইরেক্টর ছিলেন। দমদম পার্কে আমাদের দোতলা বাড়ি, বাড়িতে জুঁই লতিয়েছে, একটা লোমওলা কুকুরও আছে, প্যাপিলন জাতের। আমার মা যখন বেঁচেছিলেন, কচুরলতি, কচুর শাক, ইলিশ মাছের পাতুরি, থোড়ঘন্ট–এসব খেতাম। এখন হয় না। আমার স্ত্রী এলাহাবাদের মেয়ে। ওরা প্রবাসী বাঙালি। ও পালক-পনির ভালোবাসে। চানা মশালা ভালোবাসে। মাঝে মধ্যে শখ করে রান্না করে। এমনিতে আমাদের বাড়িতে রান্নার লোক আছে। ও কচুরলতি-টতির ঝামেলায় যায় না।
আমার বাবার ঘরে একটা আলাদা টিভি আছে। একা থাকেন, মা মারা গেছেন বছর তিনেক হয়ে গেল। মা খুব বাংলাদেশ টিভি দেখতেন। বলতেন, মন্ত্রীরা বক্তৃতা দিয়ে যায়। তখন দেখায়, মন্ত্রীরা কত জায়গায় যায়, লক্ষ্মীপুরে যায় না ক্যান, তাইলে লক্ষ্মীপুরটা একবার দেখতাম। এখন বাবা ওই ঘরে সারাদিন একা থাকেন। বাংলাদেশ টিভি দেখেন কিনা না কে জানে, যদি দত্তাপাড়া স্কুলটা, স্কুলের মাঠটা একবার দেখা যায়…।
আমি বাবাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম–জব্বর আলী কে গো বাবা?
বাবা বললেন, জব্বার আলী আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকত। শুনেছি সেই এখন আমাদের ঘরবাড়ি দখল করে আছে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ঠাকুরমা তাহলে জব্বরের কথা কেন বলেন। তবে কি বলতে চাইছে ভিটে-বাড়িটা জব্বর কতটা দখল করে রেখেছে সেটাই দেখতে আসতে?
দাদুর একটা স্যুটকেস ছিল। দাদু মারা গেছেন, বছর পঁচিশ হয়ে গেল। ওই স্যুটকেস কিছু কাগজপত্র ছিল। একটা খাতা, ডায়েরি, টুকরো কাগজ, চিঠিপত্র, সবই একটা পলিথিন পেপারে মুড়ে আমার কাচের আলমারিটার একটা তাকে রেখে দিয়েছিলাম। তখন একটু খুঁজেছিলাম, ভাল করে পড়িনি, এখন আমার মনে হল বাংলাদেশে যাবার আগে কাগজপত্রগুলো একটু দেখি।
দেখি একটা খাতা। খাতায় লেখা-বাস্তুহারা কাব্য। হে বরেণ্য কবি নবীচন্দ্র সেন, আপনার আর্শীরবাদ ভিক্ষা করিয়া এই কাব্য শুরু করিতেছি। এই কাব্যে থাকিবে কি রূপে জন্মভূমি হইতে পলাইয়া আসিতে হইল, সেই দুঃখের বিবরণ।
প্রথম সর্গ, সন ১৯৪৬
জিগির তুলেছে জিন্না চাই পাকিস্তান।
এইবার দেশ বুঝি হবে খান খান।
আসিল ক্রিপস সাহেব ভারত মাটিতে।
আলাপ আলোচনা হল স্বাধীনতা দিতে।
জিন্না কহে পাকিস্তান, নচেত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
তারপরই পালটে গেল আমাদের গ্রাম।
দাদুর একটু আধটু কাব্যরোগ ছিল জানতাম।
ক্লাস সিক্সে যখন স্কুল ম্যাগাজিনে আমার একটা কবিতা বেরুল, দাদু খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্র এই প্রতিভা আসে। তখন খাতা খুলে বলেছিলেন, তবে শোন। কী পড়েছিলেন মনে নেই। এখন মনে হচ্ছে বোধ এই অংশটাই শুনিয়েছিলেন সেদিন–উপরে ব্র্যাকেটে লেখা-এই অংশ অমিত্রাক্ষর ছন্দে বিরচিত।
পড়তে থাকি :
সন্ধি যবে করে কেহ অন্যায়ের সনে
মনুষ্যত্ব তখনি শেষ। ভাবি দেখ মনে
স্বার্থবুদ্ধি বেতাইল মুসলিম লিগ।
মনে পড়ে ১৯৪৬ অক্টোবর দশে
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজা চন্দ্র আকাশে
সহসা প্রকম্পিত দত্তপাড়া গ্রাম
এ সময়ে আমি প্রমাদ গনিলাম
নারায়ে তাকবীর ও আল্লাহ আকবর
আওয়াজ করিয়া আসে গোলাম সারওয়ার।
গ্রাম হল অবরুদ্ধ কান্দে হিন্দুগণ
লুণ্ঠণ অগ্নিযোগ এবং নারীহরণ
করিল কাহারা? যাহারা ছিল প্রতিবেশী
সামান্য স্বার্থবুদ্ধি হয় সর্বনাশী।
এ সময়ে জব্বার মোর ঘরেতে আসিল
পরিবার তরে মোরে লুঙিখানি দিন।
কহিল এখনি যান, বসেক নৌকায়
দেরি করিলে প্রাণে বাঁচা হবে দায়।
আমার পত্নীরে তারা বোরখা পড়াইল
কিন্তু তাহাকে মোর সঙ্গে নাহি দিল।
সঙ্গে লয়ে যাও বলে ক্রন্দিল সে নারী
কিন্তু তারও আগে মোর নৌকা দিল ছাড়ি।
এ রকমভাবে অনেকটাই পড়ে বোঝা যাচ্ছে, আমার দাদু ঠাকুরমার জন্য নৌকা থেকে লাফ দিয়ে সাঁতরে পাড়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নৌকার অন্যরা বলেছিল কর্তা অস্থির হবেন না। এখন গ্রামের অবস্থা খারাপ। আমরা আপনার নুন খেয়েছি, আপনার কাছে আমাদের ছেলেরা পড়াশোনা করেছে, আপনার জান না বাঁচালে আমাদের গুনা হবে।
আফজাল কহে, ‘স্যার, আপনে একটু শুনহ
আপনের জান না বাঁচাইলে হইবে গুনাহ।
ক্ষতি কিছু করিব না, ইহাই ঈমান।
কিন্তু স্যার, এইবার রাজ করিবে মোছলমান।
দাদু কিন্তু বেশি লিখেননি। ধৈর্য শেষে হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়। কলকাতায় রিপন হোস্টেলে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত রয়েছে।
দাদুর ওই খাতায় এরপর নানারকম ঠিকানা, অম্বল অ্যাসিডে-বিসম্যাগ ট্যাবলেট, হার্টের অসুবিধায় অর্জুন মাদার টিংচার, বিধান রায় রুগি দেখেন প্রতি সোম ও বুধবার সকাল দশটা হইতে, ডাক্তার নলিনীরঞ্জন কোনায় ও ডাক্তার অমল রায় চৌধুরির ঠিকানা–এইসব, আর নানা রকম মন্তব্য। যেমন–দেশভাগ না হইলে কি ইলেকট্রিকের আলো দেখিতাম?
গান্ধীজি কি দেশভাগ রোধ করিতে আর একবার অনশনে বাসিতে পারিতেন না?
পাঞ্জাবে জন বিনিময় হইল, বাংলায় হইল না, নেহেরু কী জবাব দিবেন?
রামচন্দ্র সীতার অগ্নিপরীক্ষা করিয়াছিলেন, আমি কী পরীক্ষা করিব? খোকার মা দশদিন মোছলমান ঘরে ছিল। জব্বার কি ছাড়িয়া দিয়াছে?
একগোছা চিঠি। এখানেও জব্বার। চিঠিগুলি এরকম–
৬ই বৈশাখ ১৩৫৭
পরম পূজনীয় ঠাকুর ভাই,
আপনে আমার সাতকুটি আদাব মানিবেন। আমার পূর্ব চিঠির জবাব না পাইয়া চিন্তা যুক্ত আছি। এই পত্রপাট মাত্র আপনাদের কোশল সংবাদ জানাইয়া সুকি করিবেন। আজ দিন কতেক হয় আমনের বাস্তু ঘর মেরামত করিয়াছি। এবং আলকেত্রা দিয়াছি। সবাই বলে আলকেত্রা দিলে উলি পোকা উপরে উঠিবে না। এই সব করি দেখিয়া অনেকে বলে তোর কী সাথ্য? কেন করস? কিন্তু চোক্ষের সামনে উলিপোকা ঘর নষ্ট করিবে কি রূপে দেখিব। আপনার গাছে সুপারী পাকিয়াছিল। সুপারী বেচিয়া ৩৫ টাকা মসজিদে দিয়াছি। পুকুরে জাল ফেলিয়া সমস্ত মাছ কাদের মিঞা লৈয়া গেছে। আর বোদ হয় আমনের ঘরবাড়ি রাখা যাইবে না, অন্যলোকে দখল করিবে কেন, আপনি আমাকেই লিখাপড়ি করিয়া দেন। আমনের ঘর কখান সমেত ভিটা আর দুইকানি জমি আমি কিনিয়া লইব। ইচ্ছা করিলে আমি দখল করিয়া নিতে পারিতাম, কিন্তু পাকিস্তান হইয়াছে বৈলা হিন্দুর সম্পত্তি লুট করিয়া খাওয়া ইমানদারীর কাজ নহে। খোদার ফজলে আমি টাকা দিয়াই নিব। আমি সাকুল্যে দশ হাজার দিব। স্বীকার যাইতেছি, উহা বাজার দরের কিছু কম। কিন্তু আপনি খোঁজ নিয়া দেখিবেন সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর ৩ কানি জমি, পুকুর ও ভিটাবাড়ি দশ হাজারে নুরুল মিঞা কিনিয়াছে। আপনের উপর আমার দাবি আছে। আমি আপনের এবং আপনের পরিবাররে জানে বাঁচাইয়াছিলাম আশা করি ইহা মিত্যু পৈয্যন্ত ভুলিবেন না। আর বিশেষ কি, মঙ্গলদানে সুকি করিবেন। ইতি
জব্বার আলী
পু: এতদিন হিন্দু যাহা আজ্ঞা দিয়াছে মোছলমানে পালন করিয়াছে। এখন মোছলমানের কথা হিন্দুর শুনিতে হইবে।
আর একটা চিঠি :-
মান্যবর মাস্টার মহাশয়, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৭
বহুকষ্টে আপনার কলিকাতার বাসার ঠিকানা যোগাড় করিয়াছি। আমার এই পত্র পাই নিচ্চই খুব অবাক হইতেছেন। আমনেরা চলিয়া যাইবার পর গ্রাম খাঁ খাঁ করিতেছে। ইশকুলে নিয়ম মত ঘন্টা বাজে ঠিকই কিন্তু ক্লাস হয় না। ভালো কথা, লোক মুখে শুনিলাম জব্বার আলী আমনের ভিটাবাড়ি কিনতে চায়। সে নাকি দশ হাজার টাকা দিবে বলিয়াছে। ছ্যার, সুজুগ পাইয়া সে আমনের ঠকাইয়া জমি নিতে চায়। এই হালাল জমি হইবে না। সে কি তাহা বুজে না? আমি ১৫০০০ টাকা দর দিলাম। এই টাকা জব্বার দিতে পারিবে না। আপনি রাজি হইলে পত্রপাঠ জানাইবেন। আমি কলকাতা গিয়া সিকি টাকা বায়না করিয়া আসিব। দেরি করিলে জানিবেন আপনার জমিতে জব্বার হাল দিবে। আপনার নতুন দেশে কিরূপ আছেন? মঙ্গলদানে সুকি করিবেন। আমার শতকুটি আদাব জানিবেন।
ইতি
আবদুল মমিন।
পু: দুই দেশ যদি আবার এক হয় ইনসাল্লা, আমনে যদি ফিরিয়া আসেন, আমি জমি ফিরত দিব জবান দিলাম।
এরকম গোটা বিশেক চিঠি। সবই ১৩৫৭ থেকে ১৩৬০ এর মধ্যে লেখা। জব্বার বলছে, আবদুলকে দিও না, আমায় দাও, প্রচ্ছন্ন হুমকিও রয়েছে আবার আব্দুল বলেছে জব্বারকে নয়, আমাকে দাও, আমি বেশি দাম দেব। যদিও আব্দুলের অফার করা দামও বাজার দরের তুলনায় বেশ কম। শেষের দিকে চিঠিগুলি পড়লে সম্পত্তি বেহাত হওয়ার ইতিবৃত্ত জানা যায়। জব্বার লিখেছে–কর্ত্তা, কয়দিন আগে একটি বুগ পোষ্ট করিয়াছি। ইহাতে সরকারি নোটিশ ছিল। আমনের চৌকিদারি টেক্স, খাজনা ব্যাবাক বাকি পড়িয়াছে দেখিয়া সরকার নিলামের নুটিশ দিয়েছে…।
আবদুলের চিঠিতে জানা যায় নিলামে জব্বারই কিনে নিয়েছে।
…ছ্যার, আপনি আমার কথা শুনিলেন না। জব্বার মিঞা নিলামের দিন গুণ্ডা লাগাইয়া কাহাকেও আসিতে দিল না। নিজের লোকই নিলামের সময় ছিল। কেউই জব্বারের চেয়ে বেশি ডাকিল না। সবই শট্করা ছিল। আর কী করিব। আমাকে জমি দিলেন না, এই আফসোস মিত্যু পৈর্যন্ত রহেবে। ইতি আব্দুল।
চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে আমি অবাক হয়ে লক্ষ(লক্ষ্য) করি যে সব চিঠিরই হাতের লেখা এক। চিঠি লিখছে জব্বার কিম্বা আব্দুল, পরস্পরের বিরোধী পক্ষ, ভিন্ন স্বার্থ। কিন্তু হাতের লেখা এক কী করে হয়? খুব ভালো করে লক্ষ করলাম, কয়েকটি বিশেষ অক্ষর মেলালাম। একই লোকের লেখা মনে হল। বেশ রহস্য রহস্য ব্যাপার। বাবাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাস করে বিশেষ লাভ হল না। আব্দুলকে চিনতে পারল না। তবে জব্বারকে ভালোই চেনে। ভালো স্বাস্থ্য। দাদুর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটোই। জলপড়া দিত। অনেক লোক আসতে ওই ‘পানিপড়া’ নিতে।
দাদুর ওই খাতাতে আরও কিছু মন্তব্য পড়া গেল, যেমন–
জব্বার ভাবিয়াছে কী? সে কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করিতে চায়?
আবদুল বাড়লোক হইতে পারে, টাকা বেশি দিতে চায়, কিন্তু এক লক্ষ টাকার অধিক মূল্যের সম্পত্তি মাত্র পনেরো হাজার, ভাবিতেছে খুব বেশি দিতেছে? আবদুলকে দিব না। দিলে সে আমাদের সব গাছ করিয়া(কাটিয়া) নৌকা বানাইবে। সে নৌকার ব্যাপারি।
জব্বার বারংবার ওই কাহিনি বলিয়া কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা দিতে চায়।
যাবার আগে ওই জব্বার এবং আবদুলের কয়েকটি চিঠি যত্ন করে খামে ভরে ব্যাগে পুরলাম। বাবাকে বললাম, সময় করতে পারলে আমাদের জন্মভিটেটা একবার দেশে আসব। বাবা বললেন, পারিস তো দত্তপাড়া হাইস্কুরের একটা ছবি তুলে আনিস। যাবার আগে ঠাকুরমাকে বললাম, যাচ্ছি। ঠাকুরমা আমার হাতটা চেপে ধরলেন, ঠোঁটটা খুলে গেলে, কিছু বলতে চান, মুখের কাছে কান নিলাম, পাউডারের গন্ধের সঙ্গে স্মিত শব্দ জব্বর। জব্বর।
বাংলাদেশে স্বাগত। বর্ডারের ওপাশে বাংলা লেখা। থ্রিল হল। বরং বাংলাতেই বলি উত্তেজনা। খুলনা থেকে গাড়ি এসেছিল, লোক এসেছিল রিসিভ করতে, মানে স্বাগত জানাতে। গাড়িতে ক্যাসেটে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলের গান, হোটেলে কুচো মাছের চচ্চড়ি খেলাম, যশোরে মধুসুইটস এ অপূর্ব স্বাদ। রাস্তাগুলি দারুন গাছে ছাওয়া। সত্যিই শ্যামল, খুলনার ভৈরব নদী দেখলাম, নদীতে স্টিমার, ডিস্ট্রিক্ট মাজিস্ট্রেটের বাংলোটিও দেখলাম, নদীর পাড়ে যেখানে বঙ্কিমচন্দ্র থাকতেন। যে গাছের তলায় বঙ্কিমচন্দ্র বসতে ভালোবাসতেন সেখানে একটি বেদী, কবিতা লেখা বেশ থ্রিল, মানে উত্তেজনা নয়, হিল্লোল সারাশরীরে হিল্লোল।
সেমিনার শেষ হল। বাংলাদেশের মাটির উপরের জলভাণ্ডার এত বেশি যে, যদি ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়। তবে মাটির তলায় জল কম ব্যবহার করলেই চলে। ও ব্যাপারে এখন আর যাচ্ছি না। ওই সেমিনারে একজন বাংলাদেশী(দেশি) বিশেষজ্ঞ ছিলেন, যার বাড়ি নোয়াখালি জেলার বেগমপুরে। বাংলাদেশী আতিথেয়তার তুলনা মেলা ভার। ভদ্রলোকের নাম আব্দুল ফজল। আমার চেয়ে বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসি। আমার পূর্বপুরুষের বাসস্থান নেয়াখালি জেলা শুনে উনি জোরাজোরি করলেন–ওঁর সঙ্গে যেতে হবে, বেগমপুরে ওর বাড়িতে দু’বেলা দাওয়াত নিয়ে তারপর শিকড়ের সন্ধানে যাওয়া যাবে। বাবার কাছ থেকে জেনেছিলাম, আমাদের গ্রামে যেতে হলে চাঁদপুর থেকে স্টিমারে হরিহরপুরে নেমে পায়ে হেঁটে ৮ মাইল দূরে দত্তপাড়া গ্রাম। হরিহরপুর থেকে নৌকাতেও যাওয়া যেত। দত্তপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদীটি বয়ে গছে তার দয়াবতী, আর ফেরত নেয়নি। আর একভাবে যাওয়া যেত–চাঁদপুর থেকে ট্রেনে সোনাইমুড়ি নেমে হাঁটা পথে চার মাইল। আব্দুল ফজল সাহেব বললেন–ওইসব বহুদিন আগেকার কথা। এখন চাঁদপুর থেকে রামগতি পর্যন্ত বাস চলে। দত্তপাড়া পাশ দিইে সে রাস্তা। দত্তপাড়া আর সেই গ্রাম নাই। তাছাড়া দত্তপাড়া এখন আর নেয়াখালি জেলার মধ্যেই নাই। নতুন জেলা। লক্ষ্মীপুর। দত্তপাড়া লক্ষ্মীপুর জেলার মধ্যেই পড়েছে। ইস। মা বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। মায়ের গ্রামের নামে জেলা, মায়ের নিশ্চয়ই এখন ডিএম বসেন, আর মায়ের গ্রামের আন্ডারেই বাবার গ্রাম।
খুলনা থেকে সকালে রওনা দিয়ে বিকেলে আব্দুল ফজলের বাড়ি পৌঁছলাম। বেগমগঞ্জ। আতিথেয়তার কথা এখন থাক। শুধু শুঁটকি মাছের অপূর্ব ভর্তাটির কথা আর একবার মনে করি। ওঁর স্ত্রীর নাম মুক্তা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের খুব ফ্যান। সৌমিত্রের অভিনয় করা অনেক ছবির ভিডিয়ো) ক্যাসেট আছে।
আব্দুল ফজলকে পরদিন সকালেই চলে যেতে হল চট্টগ্রামে। টেলিফোনে খবর এল ওঁর বড়দা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আব্দুল ফজল বলল–সরি, আপনার শিকড়ের সন্ধানের সাক্ষী থাকতে পারলাম না। উনি ওঁর গাড়িটা আমাকে দিলেন। ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিলেন–দত্তপাড়া হয়ে যেন চাঁদপুর পৌঁছে দেয় আমাকে। চাঁদপুর থেকে আমি ঢাকা যাব। রিকন্ডিশনড করা গাড়ি টয়াটো। টেপে যথারীতি বাংলা গান। রিমেক। ইন্দ্রনীল আর শ্রীকান্ত আচার্যের গান। ড্রাইভারের নাম ভাস্কর। বয়েস বছর পঁচিশ। প্রথমে ভেবেছিলাম হিন্দু। কথায় কথায় যখন বলল–দুর্নীতিটা যদি একটু কমানো যায়, ইনসাল্লা, বাংলাদেশেরে রুখন যাইব না। তখন বুঝলাম ছেলেটা মুসলমান।
মসৃণ রাস্তায়, রাস্তায় জঞ্জাল পড়ে নেই, জাতটা বেশ পরিচ্ছন্নতা শিখেছে। গঞ্জের ধারের ভ্যাট নিয়মিন পরিস্কার হয়। বাসগুলির মান–দুরন্ত, দুর্বার, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, বজ্রমানিক। পেট্রলপাম্পের নাম তরলসোনা, চায়ের ছোটো দোকানের নাম বিনোদন, পাটের গুদামের নাম সুবর্ণতন্তু। গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা দেখলাম। সমস্ত সাইনবোর্ড বাংলায়, গাড়ির নম্বর বাংলায়। আমার বেশ থ্রিল, মানে গর্ব হয়।
ড্রাইভারটির বলল, এই রাস্তায় মুনির চৌধুরীর বাড়ি। রাজাকারে মারছিল। আর এই বাড়িতে গান্ধীজি ছিলেন তিন দিন। ড্রাইভারটিও নাট্যকার মুনির চৌধুরীর নাম জানে? ১৯৭১ সালে খুন করা হয়েছিল মুনির চৌধুরীকে। গান্ধীজির কথাও জানে? নোয়াখালির দাঙ্গার পর গান্ধীজি এসেছিলেন ‘৪৭-এর জানুয়ারি মাসে। একটু পরেই রাস্তার ধারে একটা পোস্ট, লেখা–দয়াবতী সেই ১ কিলোমিটার।
এবার আমার গায়ে সত্যিই থ্রিল। থ্রিল কাঁটা ফুটে উঠছে। এই সেই নদী, নদী বেয়ে নাইয়র আসত। ব্রিজের গোড়ায় এসে ড্রাইভারকে বলি একটু আস্তে ভাই। নদীর ঘোলা জলে বয়ে যাওয়া একটা ছই ঢাকা নৌকা দেখলাম, ভিতরে লাল শাড়ি পরা আবহমান বউ।
ব্রিজটা পেরিয়ে ড্রাইভার দত্তপাড়া গ্রামটির কথা জিজ্ঞেস করে জানে–সামনেই বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। একটু পরেই দেখলাম। বাঁদিকের পিচ রাস্তাটা গত জন্মের দিকে চলে গেছে। একটু পরই দত্তপাড়া হাইস্কুল। স্থাপিত ১৮৯০, মাঠের এক কোণে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। স্কুলের ঘণ্টা বেজে উঠল যেন তোপধ্বনি। স্কুলের প্রাচীরে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত, সূর্য সেন, জসীমউদ্দীন, প্রীতিলতা এবং ঢাকার শহীদ মিনারের ছবি। এই স্কুলেই আমার পিতামহ তারাপদ চক্রবর্তী শিক্ষক ছিলেন। সেটা কি মনে রেখেছে? স্কুলের ছবি নিলাম। বাবা এলে কি একবার স্কুল মাঠে হাঁটতেন?
গাড়ি নিয়ে সামনে এগোই। বাড়ির দেওয়ালে রাজনৈতিক লিখন। নবিনুর সাইকেল মেরামতির সামনে কয়েকটা কম বয়েসি ছেলে, পাশেই হেকিমি দাওয়াখানা হেকিম–সৈয়দ ইদ্রিস্ আহাসান। ওখানে বেঞ্চিতে বসে আছেন কয়েকজন বৃদ্ধ, সাদা দাড়ি, সাদা চুল দেখে একজন বুড়ো লোককে দেখলাম। যতই বুড়ো হোক না কেন, আমার দাদুর সমবয়েসি হতেই পারে না। দাদু বেঁচে থাকলে দাদুর সয়েস একশোর বেশি হত।
আমি সমবেত বৃদ্ধদের মধ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিই, আপনার কি কেউ তারাপদ চক্রবর্তী কে চিনতেন, কিম্বা তাঁর ছেলে ত্রিদিব চক্রবর্তীকে?
তখন একটা রোগা মতো বুড়ো, লম্বা চুল, গোঁফদাড়ি নেই, লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আমনে কোনানতোন আইছেন? কে আঁপনে? আমি বলি–আমি তারাপদ চক্রবর্তীর নাতি।
হাঁচানি, ও আল্লা, খোয়াব নি দেখি? লাঠি ফেলে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন ওই বুড়ো। আমি এগিয়ে যাই ওঁর দু’হাত ধরি।
বুড়োটা বলেন, ইয়াঁন ক্যাম্বাই আইলেন?
আমি বলি–বাংলাদেশে অন্য কাজে এসেছিলাম, তখন ভাবলাম পূর্বপুরুষের ভিটা…খোব বালা কইচ্চেন, খোব বালা কইচ্চেন। আমনের ভিটায় অখন জব্বর মিঞার এতিমখানা হইছে। আঁঞি বেবাব দেখামু। ছ্যারের বুঝি ইন্তেকাল হই গেছে গৈ? আঁঞি হেতেনের ছাত্র। ক্লাস এইট পৈয্যন্ত পইচ্ছিলাম আরি।
আমি মাথা নাড়ি।
–কবে?
–বছর কুড়ি আগে।
–আহারে। ঠারাইন আছে কি?
–আমার ঠাকুরমা?
–হু! হু!
খুব উৎসাহে জিজ্ঞাস করেন ওই বুড়ো। পরনে লুঙি, গায়ে গেঞ্জি। কথা বলবার ধরন মেয়েলি মেয়েলি। গলাটিও সরু। আমি বলি, হ্যাঁ, ঠাকুরমা আছে।
হাঁচানি? খুশি হল ওই বুড়ো।
আর একজন বুড়ো মানুষ, অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। ওঁর গায়ে লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি। লুঙি। মাথায় টুপি। বলল–আমিও তারাপদ স্যারের ছাত্র। বড়ো বালা ভূগুল ফড়াইতেন এক্কোই টানে ম্যাপ আঁকতে ফাইত্তেন।
ওঁরা চা খাওয়ালেন আমাকে। গোঁফদাড়িহীন বুড়োটি হাঁপানিতে কষ্ট পাচ্ছেন। উনি ওষুধপত্র নিয়ে আমার সঙ্গে চল্লেন গাড়িতে।
আর একটু সামনে গেলেই গঞ্জ এলাকা শেষ। বাঁশের বেড়ার বাড়ি। টিনের ছাউনি, বাড়ির চারিদিকে সুপুরি গাছের আর নারকোল গাছের সারি। পাকা বাড়িও আছে।
জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওই ভদ্রলোকের নাম ফজল আলি। বাড়িতে নীচু স্কুলের বাচ্চাদের পড়াতেন। আঁঞি ভাইচ্চার সংসারে থাকি। বিয়াশাদি করি নঁ।
একটা লাজুক হাসি দিল ওই বুড়ো, আবার একটা কাল্পনিক আঁচলের খুট দিয়ে হাসিটা ঢাকল।
…ফজল আলি একজায়গায় গাড়িটা থামাতে বলল। একটা প্রাচীন বাড়ি। বাড়ির অনেকটা থুবড়ে পড়েছে, দরজা জানালা একটাও নেই। অশ্বত্থ গাছ উঠেছে। ফজল বললেন, চৌধুরী বাড়ি। ছয়জন খুন হইছিল। সেইরাত্রেই আমনের ঠাকুরদারে আমরা সেইভ করি। গাড়িগা ইয়ানো থাউক। আঁয়ার লগে আইয়েন। আমনেরে বেবাক দেখাইয়ুম।
চৌধুরী বাড়ির ভাঙা ইট ছোঁয়া হাওয়া আমার জিন্স-এর শার্ট এ ঢুকছে। চৌধুরীদের ওই ভাঙা বাড়ির চারিপাশে কয়েকটি টিনের চালের বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে ওদের জমিতেই ওইসব পারবর্তীকালে তৈরি হয়েছে।
পিচরাস্তা থেকে একটা মাটির রাস্তা চলে গেছে। একটা বিশাল বটগাছ। দাদু যে বটগাছের দোলনা চড়ার কথা বলতেন, এটাই সেই বটবৃক্ষ? একটা বাড়ির কাছে এসে ফজল আলি বললেন, আঁয়ার বাসা। ইয়ানো আঁঞি থাকি। ভাইচ্চার সংসার। একডু পায়ের ধূলা দেওয়ন লাগব। বেশি নঁ, হাঁচ মিনিড।
উঠানে মুরগির ঘুরছে। একটা কোঠাবাড়ি আর একটা টিনের। টিনের বাড়িতে ফজল আলি থাকেন।
অল্প একডু বয়োন, আণ্ডা ভাজা আর চা খান।
আমি আপত্তি করি না।
ফজল আলি বললেন–আমনেরে কোনোদিন পামু ভাবি নাই। আমনের যখন পাইছি, একখান জিনিস দিমু, ঠাইরাইনেরই জিনিস, ঠাইরাইনেরে দিয়া দিয়েন।
–কী জিনিস?
–একখানা চিডি। পুরো লেখা হয় নাই।
–কাকে লেখা চিঠি?
–জব্বার আলিরে।
–আপনি কী করে পেলেন?
–আমি তো লিখাইয়া জন। অন্যের চিডি লিখি। পাকিস্তান হওনের পরে হিঁদুরা ইন্ডিয়ায় গেলগিয়া, তারপর চিডি লেখনের লোক কইম্যা গেল। আঁঞি পোসড আপিসে বই, চিডি লিখতাম। ইয়ার আগে অইন্যের চিডি লিখতাম। মাইনষের ঘরেও আঁয়ারে ডাইকত। বিবিরা বোরখাপড়ি বয়ান কইত, বাপের বাড়ি চিডি লিখাইত। আঁয়ার মইধ্যে মাইয়া মাইয়া ভাব আছে দেহি বিবিরা পরানের কথা কইতে পারত। জব্বার আলির অন্দরে ডাক পড়ছিল আমার। জব্বারের দুই বিবি। বাপের বাড়ি ইদের চিডি দিব। একফাঁকে ঠাইরিন আইল বোরখা পিন্ধ্যা। কইল আমি চক্কতি বাড়ির মইধ্যের হিস্যার বড়ো বউ। ঠাইরিন বড়ো সুন্দরী আছিল। বোরখার মইধ্যে রই, আঁয়ারে কয় একখান চিডি লিখি দ্যান।
বোরখায় কেন? আমি জিজ্ঞাসা করি। সে আর এক কিস্সা। বোরখা না পইল্লে ঠাইরেনের বিপদ হইত। ডায়মন মিঞার ফৌজ আই গেল, ডায়মন মিঞা হইল গৈ গোলাম সারোয়ারের অইন্য নাম। পিছে পিছে কাসেমের ফৌজ। জব্বার, মিঞা ছ্যাররে নৌকা তো বসাই ছিল, ঠাইরিনরে রাখাল বোরখা পিন্ধ্যাই অন্দরে।
একটা চিনের সুটকেস খুলে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া ভাঁজ করা কাগজ আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, চিডিডা শ্যাষ কইরেতে পারেন নঁ ঠাইরিনে। শ্যাষ হওঅনের আগেই এক বিবি আসি পড়ল।
চিঠিটা খুলেই বিস্ময়ে দেখি সেই হাতের লেখা। যে হাতের লেখায় জব্বার চিঠি লিখত আমার দাদুকে। আবদুল চিঠি লিখত, সেই হাতের লেখাতেই লেখা–পরানের জব্বর ভাই,
আমনে মোছলমান। আমি হিন্দুর ঘরের বউ হইয়া আমনেরে চিঠি লিখিতেছি ইহা যেন কেহ না জানে। আমনেরে চিঠি না লিখি আর আইমি পারিলাম না। শুধু মিত্যু পৈয্যন্তই নয়, জন্মে জন্মে আপনেরে আমি মনে রাখিব। আমনে আমারে জীবন দিলেন, আমি আমনেরে কী দিব? ভালবাসা ছাড়া দিবার কিছু নাই।
আমি যখন এই বাড়ির বধু হইয়া আসিলাম তখন আমার মাত্র চোদ্দ বছর বয়স। আমি আমনেরে দুর হইতে দেখিতাম…
আর নেই।
চিডিখান আঁঞি কী করুম। ঠাইরেনের চিঠি ঠাইরেনেনেই দিয়েন।
আমি বললাম, আপনি ওটা জব্বারকে দিয়ে দিলেন না কেন?
ক্যামনে দিউম? আঁঞি কেবল লিখনেরি মালিক। তাছাড়া চিডি ত শ্যাষ হয় নঁ। আধা কথায় চিডি হয়নি? আধা খাওয়া খাওয়া নঁ, আধা চিডি চিডি নঁ।
ঠাইরেনে ত আঁয়ারে কয় নাই চিডিডা দিয়েন। বরং জব্বরের বড় বিবি আইয়া পড়ল, ঠাইরিন চুপ হই গেল। ইয়ার পরে আর লিখনের ফুসরৎ পাই নঁ। কয়দিন পর জব্বার ভাই ঠাইরিনরে ইনডিয়া পাঠাই দিলেন, আর চিডিগা আঁয়ার কাছে পড়ি রইল।
আমি জিজ্ঞাসা করি, জব্বার আলী কি বেঁচে আছেন এখনও?
ফজল আলি মাথা নাড়লেন। বললেন, আছে।
আমি বলি–আবদুল মমিন নামে কাউকে চিনতেন?
ফজল মাথা নাড়লেন। জিজ্ঞাসা করলেন, আমনে নাম জানলেন কেমবাই। আমি বলেছি–চিঠি দেখেছি।
ফজল হেসে উঠলেন। একটু যেন হাঁপানির টান উঠেছিল ওঁর। শ্বাস টেনে বললেন, ওই চিডি আমিই লিখতাম। জব্বার যেই চিডি লিখতো হেই চিডিও আঁয়ারই হাতের লিখা। জব্বার, আব্দুল কেউ তো লিখা জানে না, আমিই লিখইন্যা। জব্বার কী লেখছে আবদুল জানে না, আব্দুল কী লেখছে জব্বার জানে না। শুধু আমিই জানইন্যা। বেবাক কথা আমার প্যাটে।
আমি এবার বুঝলাম দু’জনের একরকম হাতের লেখার রহস্য।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম–আবদুল বেঁচে আছেন?
–না, ইন্তেকাল হইছে গিয়া। আজ আমনের একখানা কথা কই। আব্দুলের ইচ্ছা ছিল আমনের জমি কিনে। আব্দুলের আরজ ছিল পাকিস্তান যেন ভেঙে যায়। পাকিস্তান আঙলে তারাপদ স্যার আবার আইবে, তখন পুরা জমিন ছাড়ব। নিজেও থাকবে পড়শি হইয়া ঠাইরিনরে দেখবে, ঠাইরিন বাড়ো সুন্দরী ছিলেন, যেন হুর পরী।
ফজল আলীকে বলি–এবার আমার ভিটে দেখতে নিয়ে চলুন।
সুপুরির সারি। পুকুরে নারকেল গাছ ফেলে ঘাট তৈরি হয়েছে। কলাগাছ ঘণ হয়ে আছে হাঁটা দশ মিনিটের পথ। এই পথে কি গান্ধীজি হেঁটেছিলেন, নোয়াখালিতে?
ফজল বলল, দ্যাখেন চিতাখোলা, আমনের পরিবারের শ্মশান। দেখলাম ওখানে একটা পাকুড় গাছ। একটা বাঁশঝাড়। কয়েকটা ঘুঘু পাখি। একটা সরু খাল। বাঁশের সাঁকো দিয়ে পার হলে খালের জলে কচুরিপানা ভাসে।
ফজল বলল, ওউ দ্যাখেন আমনেগো ভিটা।
দেখি একটা টিনের চাল দেওয়া লম্বা বাড়ি। বাড়ির সামনে লেখা এসওএস, ব্র্যাকেটে লেখা সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সার্ভিস।
কিছু প্রশ্ন করার আগেই ফজল আলি বলল, জব্বার সাহেবের দুই ছেলে। এনজিও দিয়েছে। এইটা এতিম খান(এতিমখানা)। আমি দেখি একটা নিমগাছ, আমগাছের গায়ে লেখা সাপোর্টেড বই ব্র্যাকেটে একটা এনজিও’র নাম। একটা হালফ্যাশনের টিউবওয়েল, লেখা ডোনেটেড বাই রোটারি ক্লাব অফ বাংলাদেশ। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে দোলনায় দুলছে। একটা প্রাচীন আমগাছ। একটা পুকুর। ঘাট বাঁধানো। দাদু বঁড়শি ফেলতেন? ঠাকুরমা কলসি কাঁখে যায়…
জিজ্ঞাস করলাম, জব্বার কোথায় থাকে? ফজল একটু দূরে একটা ঘর দেখাল পাকাঘর। ফজল বলল, ছ্যারের আমলের ঘরবাড়ি আর নাই, শুধু গাছ আছে।
মাটিও তো আছে। আমি হঠাৎ নীচু হয়ে এক খাবলা মাটি খামচে নিয়ে রুমালে বাঁধি। আর একটা পুরান আমগাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে নি। ফজল বলল, জব্বর আছিল খোন্দকার। কত মুরিদ আছিল তাঁর, পানি পড়া, লবণ পড়া…। আমনেগো গাছে জব্বরের পোষা জিনপরী ঝুলত।
পাকিস্তান হওয়নের পর জব্বার মাতব্বর হইল। নীলামে আমনেগো জমি লইয়া কেরাদানি আস্তানা বানাইছিল।
জব্বারের নিজের বাড়িটা নেই?
আছে। দুই বিবি। এক সংসার হেইখানে থাকে, এক সংসার এইহানে। পেলায় এনজিও দিছে।
আমাদের প্রাচীন ভিটার দিকে অসহায় তাকাই। জুবুথুবু হয়ে বসে আছে জব্বার মিঞা। বারান্দায় কাবাশরীফের ছবি। দুলদুল ঘোড়ার ছবি। জব্বারের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফজল আলি বললেন–তারাপদ ঠাউরের নাতি আইছে, ইনডিয়ার থোন, তারাপদ ছ্যারের নাতি। দু-তিনবার বলতে হল। জব্বারের চোখের তারা নড়ে উঠল দ্রুত। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি হাতটা ধরলাম।
অনেকক্ষণ হাতটা ধরেছিলেন। উনি আমাদের জমির দখলদার। কিন্তু ওর হাতের চাপ ও কবজির স্থাপনের ভাষায় আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস আমি বুঝতে পারছি। ওর চামড়া ফুড়ে বের হওয়া নীল শিরাটি মাঠ চিরে যাওয়া নদীটির মতো, যে রাস্তার গল্পকথা শুনেছিলাম আমার পিতামহর কাছে।
আমার হাতটা ছেড়ে একটা মোড়ার দিকে ইঙ্গিত করলেন জব্বার আলি। ওর মুখের মাংস কুঁচকে ঝুলে রয়েছে। থুতনিতে সাদা দাড়ি।
আমনেগর সাত পুরুষের ভিটা…বলতে গিয়ে গলাটা ভেঙে গেল জব্বরের, নাকি ওর গলাটা একরকম ভেঙেই গেছে বৃদ্ধ বয়সে।
ফজল আলিকে বয়স জিজ্ঞেস করি। ফজল বলে, সঠিক কইতে পাইলাম না। একশ’ হয় নাই বোধ হয়।
কার যেন নাম ধরে ডাকেন। একটি মেয়ে এল, বেশ স্মার্ট দেখতে।
জব্বার আলি মেয়েটিকে বললেন, তারাপদ ঠাউরের নাতি। আজ আমার মেহমান। মেয়েটি জব্বারের নাতনি। ব্যস্ত হয়ে পড়ল কী হলঅ দাদু, এরকম করেন কেন? আমার দিকে তাকিয়ে বলুন–একটু পরপরই জব্বারের মুখ থেকে কেমন এটা শব্দ হতে লাগল।
মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে গেল। সুরেলা গলায় বলল, উঃ আবার কী হইল নানাভাই এরকম করলে চলে?
আমার দিকে তাকিয়ে বলল–বড্ড সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেছেন আজকাল।
মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হল। ওর বছর কুড়ি বয়েস হবে। ছোটো নাতনি। এই এনজিও’র সঙ্গে যুক্ত আছে। নাম সপ্তপর্ণী। ওকে পাতা বলে ডাকে। মেয়েটি ওর দাদুকে ধরে নিয়ে ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিল। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল জব্বার আছি।
আমি ওঁর বিছানায় সামনে দাঁড়ালাম।
–কর্তা?
–উঁহু।
–নাই?
–না।
— কবে?
–ঠাইরিন।
–আছে।
–ভালানি?
–শোয়া।
–কতা কয়?
–পারে না।
চম্পা কলির মতো রং আছিল ঠাইরিনের। একটা লাজুক হাসি ফুটে উঠল জব্বারের মুখে। আমি পকেট থেকে চিঠিটা বার করলাম। ঠাকুরমার লেখা চিঠিটা। চিঠিটার বৃত্তান্ত বললাম। তারপর পড়ে শোনালাম।
জব্বার হাত বাড়ালেন।
আমি চিঠিটা দিলাম।
জব্বার চিঠিটা বালিশের তলায় রাখলেন।
আমি বললাম রেখে দিলেন ওটা?
জব্বার বললেন–রাখলাম।
ক-দিন রাখবেন?
মিত্যু পৈর্যন্ত।
দুপুরে খেতে হল। জব্বারের পুত্রবধূর সঙ্গে কথাবার্তা হল। উনি নাকি ওঁর শ্বশুরের কাছে আমার ঠাকুরদাদার কথা শুনেছেন। একজোড়া খড়ম নাকি বহুদিন বাড়িতে ছিল, ওটা আমার দাদুর খড়ম। খোঁজা হল, কিন্তু পাওয়া গেল না।
আমার তাড়া ছিল। চাঁদপুর যেতে হবে। চাঁদপুর থেকে ঢাকা। ওঁরা বলেছিল দু’দিন থেকে যেতে।
ওঁরা আমাকে একটা আমসত্ব দিল। রোল করা আমাদের বাড়ির গাছের আমের আমসত্ব।
আমসত্বের গায়ে শীতল পাটির ছাপ নেই। পাটিতে শুকোন হয়নি। রেকাবিতে। আমসত্বের গায়ে ফুটে উঠেছে একটা ছোটো চাঁদ, তারা আর কতকগুলি অক্ষর। অক্ষর সাজানো লেখা–সোনার বাংলা।
জব্বারের কাছে থেকে বিদায় নিতে গেলাম। বেশ স্মার্টলি। ভাবলাম, কোনো সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা বলব না।
বললাম–চলি, খুব ভালো লাগাল।
জব্বার হাতের ইশারায় আবার বসতে বললেন। বসলাম।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। ঘুঘু ডাকছে। বেলা একটা। বললেন–ঠাইরিন ক-দিন আছিল আমার ঘরে। হেই কয়দিন নিরামিষ্য ছালুন হইছিল।
ঠাইরিন থাকতো বোরখা পড়ি।
ঠাইরিনকে আমার ঘরে না রাখলে বিপদ হইত। ডায়মন মিঞার লোকেরা বড়ো খাইচ্চত।
কত্তারে কইলাম আমনে যান। আমি লুঙি দিলাম। টুপি দিলাম। মাথায় আছিল টিক্কি। কাডি দিলাম। কর্তা ভাবল মোছলমানের অইত্যাচার। না হইলে জানে বাঁচত না।
লোকে জানে জব্বরের দুই বিবি। তিন বিবি হয় কেমনে? যদি ডায়মন মিঞার লোক জানে, খারাপ হইব। এক ছোটো বিবিরে বাপের বাড়ি পাঠাইলাম।
একদিন একরাত আমার ঘরে বড় আর ঠাইরিন।
ঠাইরিনরে কইলাম বোরখা খুলেন। বড়ো গম। ঠাইরিন বোরখা খুলি বসি রইল।
ঘরে ল্যাম্পের আলো। দেখলাম ঠাইরিনের চোখে পানি। গাল বাই পড়ে। আমি চোখের পানি মুছাইতে পারি নঁ।
ফরের দিন বেয়ানে পাশের গ্রামের ভৌমিকরা ইন্ডিয়া গেল। ঠাইরিনরে ফাডাই দিলাম বুইজেননি। আঁঞি কোনো গুণা করি নঁ।
জব্বার চুপ হয়ে গেলেন আবার।
আমি বলি–এবার চলি?
জব্বার বললেন, যাওয়ন নাই। আবার আইয়েন।
আমি উঠি।
জব্বার আবার বললেন, ঠাইরিনরে কইয়েন আরি।
কী কমু?
জব্বর কিছু বলল না আর। ওর চোখের শূন্য দৃষ্টিতে অনেক কথা ছিল।
ফিরলাম। ঠাকুরমাকে বললাম, জব্বার আলিকে দেখলাম। বেঁচে আছে। ভালো আছে।
মৃদু হাসলেন ঠাকুরমা।
কিছু বলার চেষ্টা করছেন ঠাকুরমা। মনে হল বলছেন–কী আনলি?
আমি স্থির তাকিয়ে থাকি কনকচাঁপা ঠাইরিনের দিকে। ঠাকুরমাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এনেছি। অনেক কথায় রূপালি কুয়াশা এনেছি সারা গায়ে মেয়ে।
ঠাকুমা, তুমি পড়ে নাও।
পড়তে থাকো, আমার শরীর থেকে পড়। মিত্যু পৈর্যন্ত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত