| 26 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

একজন পার্বতী দাস বাউল ও বাউল আর্কাইভ

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

কঠিন কথা সহজে বলে ফেলার নাম যদি হয় কবিতা, জটিল দেহ, এবং অতল সত্যকে ছুঁয়ে ফেলার নাম তবে বাউল। সহজ শব্দে গভীর দর্শনকে তুলে ধরেন বাউল গানের লোকশিল্পীরা। কিন্তু শিকড় বিস্মৃত মানুষ তবু সেসবের খোঁজ রাখে না। বিশ্ব জুড়ে যেখানেই বাউল নিয়ে চর্চা হয়ে চলেছে বা এই বাংলাতেই বাউল দর্শনের যা সম্পদ তা একত্রিত করে শান্তিনিকেতনেই বাউল আর্কাইভ গড়তে চলেছেন পার্বতী দাস বাউল। বাংলার নিজস্ব ঘরানার এই শিল্প-দর্শনকে যিনি ৪২ টি দেশে পৌঁছে দিয়েছেন।

বাষট্টি বছরের এই দীর্ঘ জটার বাউল পার্বতী জানান, “আমার গুরু সনাতন দাস বাউল একজন মহান সঙ্গীতশিল্পী। কখনোই স্বীকৃতি বা খ্যাতির জন্য তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তবে বাউল আর্কাইভ গড়ে তোলা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। আমি কেবল গুরুর স্বপ্নপূরণ করতে চাই। বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য যেখানেই বাউলের লেখা বা বাউল সংক্রান্ত যা কিছু রয়েছে তা এক জায়গায় করতে চাই।” এই আর্কাইভ ভবিষ্যতের নানান কাজের জন্য উপকারী হবে এবং অষ্টম শতাব্দীর এই গভীর ঐতিহ্যও রক্ষিত হবে বলেই তিনি মনে করেন।

কোচবিহার জেলায় আধুনিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন পার্বতী, বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় তিনি ট্রেনে এক বাউলের গান শোনেন। সেই গান শুনে তাঁর মনে হয় অন্য কোনও দেশে চলে গিয়েছেন তিনি, এবং বলাবাহুল্য নিজেকেও সেই দেশেরই বাসিন্দা করে তুলতে বাউলদের সঙ্গেই পাড়ি দেন তিনি। “আমাদের শরীর এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের একদম ছোট্ট একটা অংশ। সেই কারণেই আমাদের নিজেদের ভেতরেই আমাদের সত্যের সন্ধান করতে হবে। আমাদের পরিবেশ এবং চারপাশে অহরহ যা ঘটে চলেছে তা থেকে কত কী শেখার আছে।” -বলেন বাউল গুরু পার্বতী।

৪০ জন শিষ্য রয়েছেন পার্বতী বাউলের আশ্রমে, সেখানে তাঁরা ‘সাধনা’রই অংশ হিসেবে জৈব চাষেরও অনুশীলন করেন। শিষ্যদের কীভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে পার্বতী জানান, বাউল আসলে শেখানো যায় না। বাউল এমন এক শৃঙ্খলা যাকে ভালোবেসে গ্রহণ করতে হয়। শিল্পের প্রতি জিজ্ঞাসু মন আর নিষ্ঠা না থাকলে বাউল হওয়া যায় না। পার্বতী বলেন, “বাউল কোনও জীবিকা নয়, বাউল এক দর্শন। এ জিনিস বোঝার জন্য গভীর হতে হয়, মনস্তত্বের গহনে যেতে হয়।”

তিরুবনন্তপুরমের রবি গোপালান নায়ারকে বিয়ে করেছিলেন পার্বতী। তবে এই সম্পর্ককে ‘বিয়ে’র প্রাতিষ্ঠানিকতায় দেখতে তিনি রাজি নন। “আমাদের সংস্কৃতিতে, আমরা একে অপরকে বিয়ে করি না, আমরা একসঙ্গে ভগবান কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে করি এবং যতদিন আমরা বাঁচব ততদিন পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করি”- বলেন পার্বতী। আসলে জীবনসঙ্গী নয়, বাউলের দুনিয়ায় সকল প্রেমিক প্রেমিকাই সফরসঙ্গী।

তাঁর দীর্ঘ পচিঁশ বছরের বাউল চর্চায় পার্বতী দেখেছেন প্রচুর মহিলা রয়েছে যারা বাউল গান ও আদর্শে দীক্ষিত। কিন্তু তাঁদের এই ভূমিকা কোথাও কোনওভাবেই রেকর্ড করা নেই। পার্বতীর কথায়, “অনেক নারীই রয়েছেন এই বাউলসঙ্গীতের দুনিয়ায়। কিন্তু তাঁরা কেউই খুব একটা নিজের নাম প্রকাশ্যে আনার জন্য ব্যাকুল নন ততটা। তাই আমি মনে করি মহিলাদের এই বিষয়ে আরও উৎসাহিত করা আবশ্যক। মহিলাদের পারফর্মিং আর্টসের আন্তর্জাতিক উৎসব ‘তাঁতিধাত্রী’ উৎসবের তৃতীয় সংস্করণ শীঘ্রই কলকাতায় আয়োজন করতে চলেছেন পার্বতী।

হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কত্থক এবং ভিজ্যুয়াল আর্টসে প্রশিক্ষিত পার্বতী দাস বাউল মনে করেন যে “লালন শাহ ফকির কে গীত” এর মতো অনুবাদের বই লালন সাঁইয়ের গান ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাউল সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম। যে মানুষ বাউলকে উপলব্ধি করতে চায় সে অবশ্যই বাউল গান শেখার চেষ্টা করবে।

পার্বতী মনে করেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে নতুন প্রজন্ম বাউল গান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবু, মনে রাখতে হবে বাউল যেহেতু শুধুই গান নয় তাই এটি শিখতে হলে নিবিড় শৃঙ্খলা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ‘সাধনা’ ছাড়া বাউলদর্শন বোঝা সম্ভব নয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত