| 26 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আগুন হাতে প্রেমের কবি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

স্বদেশ, স্বজন আর কালসংকট তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়। ক্ষমতাদম্ভের বিরুদ্ধে গর্জন স্বভাবসিদ্ধ আচরণ। লিখছেন অভীক মজুমদার।


তাঁর প্রথমযুগের কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল, ‘গ্রহচ্যুত’ কিংবা ‘রানুর জন্য’ অথবা ‘লখিন্দর’। লক্ষ করতে হবে, শেষ দিকের কাব্যগ্রন্থের নাম ‘অথচ, ভারতবর্ষ তাদের’ কিংবা ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’। মাঝখানে বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। প্রতীকী ভাবে বলা চলে, এ যেন তাঁর ব্যক্তিভুবন থেকে বিশ্বভুবনের দিকে মহাপরিক্রমণ। নদীর মতো অভিযাত্রা। তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২.৯.১৯২০ – ১১.৭.১৯৮৫)। মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর শতবর্ষের সূচনা হল। স্বদেশ, স্বজন আর কালসংকট তাঁর প্রধান কাব্যবিষয়, অনুভূতি আর ভালোবাসা তাঁর অক্ষয় সম্বল, ক্ষমতাদম্ভের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা যাঁর স্বভাবসিদ্ধ আচরণ। তাঁর কবিতা বিশুদ্ধ ভাবলোক থেকে পা-রাখে রুক্ষ বাস্তবতায়, নৃশংস বীভৎসতায়। বিক্ষুব্ধ, রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি আর্তনাদ করেন। সূক্ষ্ম অনুভব তখন বিধ্বস্ত। সৌন্দর্যকল্পনা আর মনোরম স্বপ্ন তখন ছিন্নভিন্ন। সেই উন্মাদ আর্তনাদ দিয়েই কবি মোকাবিলা করেন দুঃশাসনের। সে সব চরাচরপ্লাবী চিৎকার সাবেক, কেতাবি তুলাযন্ত্রে ‘কবিতা’ হয়ে উঠল কি না, সে সব তুল্যমূল্য বিচারের তোয়াক্কা করেননি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এক বুক ভালোবাসা নিয়ে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন। জীবনযাপনেও কোনও আপস করেননি প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে। তাঁর শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। যখন পিশাচসময় গিলে খেতে উদ্যত দেশঘর, স্বাধীনতা, মানবপৃথিবী। ‘হত্যা, আত্মহত্যা, অনাহারে মৃত্যু / অনাহারে মৃত্যু, অনাহারে—/ আমার স্বদেশ রক্তবমি করছে, আমার স্বদেশ / রক্তবমি করছে।… আমার স্বদেশ।’ (স্বদেশ/৩)

একটি চিঠিতে কবি শঙ্খ ঘোষকে জানিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তিনি কবিতায় খোঁজেন ‘চেতনাকে তোলপাড় করার মত’ শক্তি। আরও লিখেছিলেন, ‘চেতনা ছাড়িয়ে অবচেতনা অথবা সুচেতনার রাজ্যে’ পৌঁছে দিতে পারার সামর্থ্য তিনি খোঁজেন কবিতার উচ্চারণে।

এক দিকে রক্তস্নাত সময়ের ধারাভাষ্য আর অন্য দিকে ‘চেতনা ছাড়িয়ে অবচেতনা’-র সন্ধান— বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাকে দ্যুতিময়, বহুমাত্রিক করে তুলেছে। বিশেষ সময়তারিখের ঘটনা নিপীড়ন— তাঁর কবিতার পুনরাবৃত্ত প্রসঙ্গ, সন্দেহ নেই। কিন্তু, কালের পুনরাবর্তনে তারা বারংবার জ্যান্ত হয়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় শতবার্ষিকীর প্রেক্ষাপটেও তিনি সাম্প্রতিক। কাব্যগ্রন্থগুলি তাদের নাম যেন নিশানের মতো তুলে ধরে। সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা টের পাওয়া যায়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, অসম থেকে গুজরাট যেন বর্তমানের ক্ষতচিহ্নবুকে স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়। ‘মানুষের মুখ’ (১৩৭১), ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে’ (১৩৭১), ‘জ্বলুক সহস্র চিতা অহোরাত্র এপাড়ায় ওপাড়ায়’ (১৩৮০), ‘মানুষখেকো বাঘেরা বড়ো লাফায়’ (১৩৮০), ‘ন্যাংটো ছেলে আকাশ দেখছে’ (১৩৮৫)। ‘গাঙুরের জলে ভাসে বেহুলার ভেলা / দেখি তাই, শূন্যবুকে সারারাত জেগে থাকি— / আমার স্বদেশ করে কাগজের নৌকা নিয়ে খেলা।’ (বেহুলার ভেলা)

স্বদেশ, জন্মভূমি, মাতৃভূমি আর পৃথিবী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বারংবার এই মাটিমানুষের ওতপ্রোতে তাঁর কাব্য-অভিযাত্রা নির্ধারণ করেছেন। যে ‘রাজনীতি’ বা ‘রাজনৈতিক’ শব্দটি তাঁর উচ্চারণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে অভ্যস্ত আমরা, সে বিষয়ে শোভন সোমকে একটি চিঠিতে স্পষ্ট বাক্যে জানিয়েছিলেন তিনি— ‘মাত্র পনেরোদিন জেলে ছিলাম। এখনও বিচার হয়নি, হয়তো আবার যেতে হবে।… এখানে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে অমানুষিকতা ঘটে গেল তাতে মানুষ হিসেবে স্থির থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এর মধ্যেই কলকাতার কবি-সাহিত্যিকেরা ভালই আছেন। তাঁরা এভাবে দানবীয় কার্যকলাপগুলি অবলীলাক্রমে মেনে নিলেন (অবশ্য তাঁদের পিঠে সত্যি লাঠি বা বন্দুকের কুঁদো পড়েনি) তা দেখবার মতো। … আপনি জানেন, কলকাতার অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার বনে না।… এর কারণ এই নয় যে আমি রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখি। এর কারণ আমি এখনো মনুষ্যত্বকে কিছু মূল্য দিই।’ চিঠির তারিখ, ২২ জানুয়ারি ১৯৬৮। কিন্তু ২০১৯-এর ভারত প্রসঙ্গে চিঠিটি সমান স্বদেশদর্পণ। এই চিঠির বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর জীবনের সংযোগসূত্রও আমরা সহজেই খুঁজে পাই। মত এবং পথের বহুযোজন দূরত্ব থাকলেও চোখের সামনে যখন তিনি দেখেছিলেন প্রবীর দত্তকে পিটিয়ে হত্যা করছে পুলিশ, আশু মজুমদারকে নির্যাতন করার পর থানায় মেরে ফেলা হচ্ছে, একই কালপর্বে পুলিশি বুলেটে খুন হচ্ছেন সরোজ দত্ত, তখন সব বিরোধ মুলতুবি রাখেন তিনি। নকশালপন্থীদের ওপর এই বীভৎস অত্যাচার বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রবল অভিঘাতে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। পথে নেমে তিনি পরবর্তীকালে নেতৃত্ব দেন ‘বন্দীমুক্তি আন্দোলন’কেও। দেশভাগ, খাদ্য আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, এবং পরবর্তীকালেও রাষ্ট্রক্ষমতার হাতে মানুষের ক্রমাগত নিষ্পেষণ তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল। কিন্তু, কবিতায় তিনি সশস্ত্র ভালোবাসাকেই ব্যবহার করতে চেয়েছেন—

‘প্রেমের ফুল ফুটুক, আগুনের
মতন রং ভালবাসার রক্তজবা
আগুন ছাড়া মিথ্যে ভালবাসা
এসো, আমরা আগুনে হাত রেখে
প্রেমের গান গাই।
আলো আসুক, আলো আসুক, আলো
বুকের মধ্যে মন্ত্র হোক: রক্তজবা।
এসো, আমরা আগুনে হাত রেখে
মন্ত্র করি উচ্চারণ: ‘রক্তজবা’!

এসো, আমরা প্রেমের গান গাই।’

(ফুল ফুটুক, তবেই বসন্ত)

চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন তিনি, প্রসঙ্গত, মহাভারতের অনুষঙ্গে। সেখানে ‘রাজনীতি’ ‘রাজনৈতিকতা’ আর কবির সম্পর্ক অনবদ্য সূক্ষ্মতায় ব্যাখ্যা করেন তিনি। এই দৃপ্তোক্তির সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হয় আর একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ— ‘একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী— এই বিশেষণ আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রাজনৈতিক কর্মী হতে হলে কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ দরকার। এ ধরনের ‘একাত্মতা’ কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই ব্যক্তিগত ভাবে আমার নেই!… বরং ঠিকমতো কর্তব্য করে যাওয়া— সেই চেষ্টাই আমি করছি, এখনও করতে চাই।’ (বিজ্ঞাপন পর্ব)। ফিরে আসি মহাভারতের আলোক-প্রক্ষেপে। ‘একজন রাজনৈতিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ কর্মী এবং দেশ ও সমাজের দিক থেকে নিজের চোখ ফিরিয়ে নেননি এমন একজন কবির দৃষ্টিতে এবং মননে কোথাও পার্থক্য থাকে। কর্মীর দৃষ্টি অনেকটা অর্জুনের মতো, তিনি শুধু একটি পাখির চোখই দেখতে পান। কবির দৃষ্টি যুধিষ্ঠিরের, তিনি শুধু পাখির চোখই দেখেন না, তাঁর চারপাশের মানুষ, গাছপালা, মাঠ, সব কিছুই দেখেন।…’ (সাক্ষাৎকার: ‘শিলাদিত্য’)

এই দৃষ্টিভঙ্গির বশবর্তী হয়ে তিনি অনুবাদ করেন পাঁচটি মহাদেশের কবিতা। নাম দেন, ‘মহাপৃথিবীর কবিতা’ (১৩৮৩)। সেখানেও স্পষ্ট প্রাধান্য পায় প্রান্তিক মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম আর জীবনাস্বাদ। পাশাপাশি সম্পাদনা করেন দাঙ্গাবিরোধী কবিতা সংকলন ‘মানুষের নামে’। সংকলন করেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এমনকী মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিবেদিত বিভিন্ন কবির বাংলা কবিতা। এ সবই হয়তো তাঁর ‘যুধিষ্ঠিরের’ দৃষ্টিসঞ্জাত।

‘ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায় / যদিও তার খিদেয় পুড়ছে গা / ফুটপাতে আজ জেগেছে জ্যোছনা; / চাঁদ হেসে তার কপালে চুমু খায়। / লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা।’ (ফুটপাতের কবিতা)

শতবর্ষে এই কবি আমাদের খুব বড় একটা শিক্ষা দিয়ে যান। সে হল, পরদুঃখে কাতর হওয়ার মন্ত্র। সে হল, বীভৎস নির্যাতনের বিরুদ্ধে জীবনে এবং কাব্যে ক্রমাগত প্রতিরোধ জারি রাখার অনুশীলন। কবি তাঁর সূক্ষ্ম স্নায়ুতন্ত্রী নিয়ে গজদন্ত মিনারে কলমচালনা করবেন না, তিনি থাকবেন স্বদেশবাসীর দুর্দশা আর যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতার সন্নিকটে। লিখবেন, সেই অকথ্য-নির্যাতন বিরোধী কাব্য-উচ্চারণ। সেই উন্মোচন চেতন-অবচেতন তথা অস্তিত্বের সারাৎসার থেকে উঠে আসবে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি নিয়ে। সেখানে মিশে যাবে বাস্তব-পরাবাস্তব-রূপকথা-লোককথা তথা কল্পনাপ্রতিভা। কত দূর গভীর ভালোবাসা স্পন্দিত হচ্ছে সেই সব আর্তনাদের আড়ালে, সে কথা খুঁজে নেওয়াটাই পাঠকের দায়, আমাদের দায়িত্ব। দল নয়, সঙ্ঘ নয়, গোষ্ঠী নয়, মতাদর্শগত কোনও শৃঙ্খল নয়, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এ যেন এক মানবসাধনা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই স্মরণীয় মানবসাধনার কবি। তাঁর ‘হৃৎপিণ্ডের পিদিম’ তাঁকে পথ দেখায়। বাস্তবতা আর বিমূর্ততা তখন চেতনা-অবচেতনা-সুচেতনার শ্বাসাঘাতে হয়ে ওঠে অনির্বচনীয়!

‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজো ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,
প্রার্থনায়, সারা রাত।’

(আশ্চর্য ভাতের গন্ধ)

কৃতজ্ঞতা: এই সময়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত