বেড নাম্বার ১৪২৪ (পর্ব-২)

Reading Time: 3 minutes

বিতস্তা ঘোষাল আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ইরাবতী পরিবার তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে। কিছুদিন আগেই হাসপাতালের দিনগুলো নিয়ে ধারাবাহিক  লিখেছিলেন কেবিন নং ৩০৪। আজ থেকে শুরু করলেন বেড নাম্বার ১৪২৪ নামে এক নতুন লেখা। ডায়েরির মত করে লেখা এই আখ্যান কেবল একজন রুগীর নয়, একজন কবির চোখে দেখাও বটে। আজ তার দ্বিতীয় কিস্তি।


১৯ জুন

এই হাসপাতালে আজ দ্বিতীয় দিন।কাল রাতে ও আজ দুপুরে ধূম জ্বর ।যথারীতি কাঁপুনি।তিনটে কম্বল দিয়েও শীত যাচ্ছিল না।আবার ওষুধ ।আবার স্যালাইন ।এবং তারপর যথারীতি বমি।ঘাম, ও স্নান।
ইতিপূর্বে আমার পাশের দুই পেশেন্টের জন্য আমার চিৎকারে ম্যানেজমেন্ট চলে এসেছে আমার কাছে ।ম্যাডাম, আপনার কী অসুবিধা ইত্যাদি প্রভৃতি। ওনাদের কী করে বোঝাই আমি যেমন রোগী তেমনি বাকি রোগীদের দেখভালের দায়িত্ব ও তাদের ।
অবশ্য বললে কী হবে! ওনারা আমার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে বেশি ভাবিত হয়ে গেলেন।তাতে আমার একটি সুবিধা হল, পাশের বেডের মাসিমা ও আজ সকালে ভরতি হওয়া মাসিমার বেডপ্যান দেওয়ার জন্য তারা চিৎকার করেও যখন কাউকে পাচ্ছেন না, আমার এক ধমকেই মুহূর্তে হাজির সিস্টার ও এটেনডেন্ট তাদের কাছে ।
আজ সকালে ইউ এস জি ছিল।সকালে না খাইয়ে বেলা ১০ টায় নিচে নেবার পর বেলা ১১ টায় বলল ব্লাডার ফুল হয় নি।আপার অ্যাবডোমেন হল, লোয়্যার আবার বেলা ২ টোয়।কী ভয়ংকর অবস্থা ।
ফিরে এসে গলা ভাত, ডাল সেদ্ধ, লাউ সেদ্ধ, দই, চাটনি, আর ঝুড়োপনিরের সেদ্ধ ।
যথারীতি দুচামচ খেয়ে আর খেতে পারলাম না।
ড:টোডির এ্যাসিটেন্ট লেডি ডক্টর এলেন।চেক করলেন।তার সঙ্গে গল্প হল খানিকক্ষণ।আমি বললাম, ম্যাম, তোমাকে দেখেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে।
উনি অবাক হয়ে বললেন, কিভাবে ?
আমি বললাম, কী সুন্দর দেখতে তুমি।জানতো ডাক্তার সুন্দর আর ব্যবহার ভালো -এই দুটো কারণে রোগীর অনেক সমস্যা দূর হয়ে যায় ।আমার ব্যক্তিগত ধারণা অবশ্য এটা।
উনি হাসলেন।কোথায় থাকি, কী করি এসব জানলেন মন দিয়ে ।বললেন, এফ বিতে রিকোয়েস্ট পাঠাবেন।
সকালে যে ম্যাডাম ডক্টর ইউ এস জি করেছিল তাকেও খুব ভালো লেগেছে ।দ্বিতীয় বার গিয়ে তাকে দেখতে পাই নি প্রথমে।পরে দেখে মনটা ভালো হল।
আসলে আমি এমনি।হঠাৎ কাউকে দেখে একনজরে ভালো লেগে যায় ।
আজ প্রিয়াঙ্কার জ্বর।নাক টানছে।চোখ ছলছল।সকালে যখন ডিউটি এল তখন ই বকলাম, এভাবে কেউ আসে? তুমি অসুস্থ হলে কে দেখবে?
প্রিয়াঙ্কা সম্ভবত এর আগে কোনো রোগীর থেকে এমন কথা শোনেনি।সে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলল, এখানে ছুটি পাওয়া দুষ্কর ।কামাই করলেই চাকরী নট।
প্রিয়াঙ্কার বাড়ি ত্রিপুরা ।যৌথ পরিবারের মিষ্টি ত্রিপুরা সুন্দরী।এখানকার অধিকাংশ সিস্টার ই ত্রিপুরার। তুড়া বা তোড়ার বাড়ি, শুল্কার বাড়িও ত্রিপুরার ।আর অনেকেই মনিপুরের।
তুড়া বা প্রিয়াঙ্কা যাও বা বাংলা বলে, বাকিরা হিন্দি বাংলা মিশিয়ে অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে।শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল কলকাতা কখনোই শুধু বাঙালির নয়।এমনকি হাসপাতালে বেশিরভাগ রোগী বাংলা বললেও এরা বাংলা ভালো করে শিখবে না।কারন কলকাতাই বোধহয় একমাত্র শহর যেখানে এভাবেই কাজ চালাতে অভ্যস্ত সকলে।
দুপুর থেকে প্রবল কাঁপুনি দিয়ে আবার জ্বর আসে ।মাথা ব্যথা শুরু হয় ।ওষুধ দিয়ে ভিজিটিং আওয়ারের আগে জ্বর নামানো হয় ।কিন্তু মাথা ব্যথা রয়েই যায়।
পাশের মাসিমা সমানে বাংলায় নানা সমস্যার কথা বলে যান, তারা পাত্তা দেয় না।আমি বাধ্য হয়ে মধ্যস্থতা করি।মাসিমাকে বোঝাই, খেয়ে নিন, নইলে আপনাকে ছাড়বে না বলছে।
মাসিমা বলে, দেখব কী করে আটকায়।বাবু এলেই পালাব।
অবশেষে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হবার আগে তার ছেলে আসে।কয়েক মিনিট কথা বলে।ছেলের বৌ ও আসে।বলে মা, কাল আসব না ।ছেলে আসবে।আপনার ছেলে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে তারপর ফিরবে।
মাসিমা সারাদিন -বুলা এলি- বুলা এলি বলে চেঁচিয়ে যান।বুলাও আসে।বুলা মাসিমার দেখভালের জন্য রাখা পার্মান্টেন্ট কর্মচারী ।মাসিমার ছেলে থাকে বাইরে ।বৌমা চাকরী করেন। মাসিমা বুলার ভরসায় একা।
কত মানুষ এভাবেই একা একা বেঁচে আছেন কোনো
না কোনো বুলার ভরসায়।এরাই কখন রক্তের সম্পর্ক না হয়েও পরম আত্মীয় হয়ে ওঠে ।
আত্মীয় তো সেই যিনি আত্মার অংশ ।
মাসিমা বলে, বুলা বাড়ি গিয়ে টমাটোর চাটনি বানাস তো।এরা আমাকে চাটনি দেয় না।
বুলা হাত ধরে বলে , হ্যাঁ মাসিমা, বানাবো। তারপর পরম স্নেহ নিয়ে বলে, মাসিমা এই টুকু খাবার খেয়ে নাও।
সারাদিন প্রায় কিছুই না খেয়ে থাকা মাসিমা একটা স্যান্ডউউচ খায় বুলার হাতে।
আমার বুকটা হু হু করে ওঠে হঠাৎ ।কেন জানিনা ।

ক্রমশ…

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>