| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

সাপ্তাহিক গীতরঙ্গ: বাংলার লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট
লোকসঙ্গীত বা লোকগীতি একটি প্রাচীন প্রবাহমান শিল্প। অতীতে তার শিকড়, বর্তমান ডালপালার বিস্তর, ভবিষ্যতে অজানিত সম্ভাবনা। পন্ডিতদের মতে প্রতœ প্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে (ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার, আসাম, রংপুর, দিনাজপুর এলাকা) বাস করতো নিগ্রোজাতি। এরপর আসে নব্য প্রস্তর যুগ। আসামের উপত্যাকা অতিক্রম করে আসে অস্টিক জাতীয় জনগোষ্ঠী, তারপর আসে দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়রা। এদের মিলিত স্রোতে ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যাকায় মানবসভ্যতার সূচনা হয়। এরাই লাঙ্গল দিয়ে চাষের প্রবর্তণ করেছে। সৃষ্টি করেছে ভাব, ভালোবাসা। সুখ, দুঃখ ভাগাভাগী করে তারা চলতে শিখেছে। যে হেতু চাষের প্রবর্তন করেছে তারা আবার এই চাষাবাদ নিয়েই হিংসা আত্ম কলহে মেতে উঠেছে প্রতিনিয়ত। আবার একক ভাবে কোন কাজ সমাধা করতে না পারলে দলীয়ভাবে তার সমাধা করেছে।
নেতৃত্বের জন্য তারা মারামারী বা কলহ করেছে ঠিকই কিন্তু কোন উৎসবে তারা এক হয়ে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠেছে একে অপরের সাথে। শাস্ত্রীয় ভাবে না হলেও সঙ্গীতের সাথে ছিলো ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। খুব প্রাচীনকালে ভারত উপমহাদেশের লোকসঙ্গীতের রুপ কেমন ছিলো তা আজ আর নিরুপন করার উপায় নাই। তবে বিভিন্ন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে এটা শ্বাচ্ছন্দেই বলা যায, বিগত সমাজ আজকের ধাচ ধরন অনুযায়ী যখন শ্রেণি বিভক্ত হয়নি বা নানান অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীতে থাকা বিশিষ্ট হয়নি তখন সব এলাকায় লোক সঙ্গীতের রুপ কমবেশী একই রকম ছিলো। তার সুর ছিলো মন্থর, শান্ত, ধীল লয় বিশিষ্ট। সেই সুরে যৌথ জীবনের সংগ্রাম, প্রেম, ভালবাসার আভাস পাওয়া যেত। নিশ্চয়ই তবে সে সংগ্রাম, ভালবাসা আজকের মতো অনেক ক্ষেত্রে উত্থাল সংক্ষুব্ধ, অস্থির, বে-মানান, অ-শালীন প্রকৃতির ছিল না।
আজকাল কৃষি সভ্যতার সংস্কারের মধ্যে যে শান্ত নিরুবিগ্ন অচঞ্চল জীবন যাত্রার আভাস মেলে, ফুটে উঠে আইডেলিক স্বপ্নালুতার ছবি। তারই রস প্রাচীন লোকসঙ্গীতের সাধারণ লক্ষণ ছিলো এ রকম অনুমান করা কঠিন নয়। এ কথায় প্রমাণ স্বরুপে আমাদের দেশের যে কোন অঞ্চলের পুরাতন দোহিতা সুর বাংলার ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, বাউল ও অন্যান্য। দক্ষিণ সমুদ্র দীপের ঘুম পাড়ানিয়া সুরের গান, জাভা বাল্যিশ্যাম-কম্পোজ, ভিয়েতনাম, চীন প্রভৃতি দেশের প্রাচীন লোকসঙ্গীততের সুর ইউরোপীয়দের জীপসী যাযাবরদের কিংবা রুশ মাঝি মাল্লাদের কিংবা স্পেন দেশীয় মুরাদের গান, প্রাচীন মিশরীয় গান। আমেরিকার নিগ্রো স্পিরিচুয়াল এর সুর প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়। মনে হয় এ সব গানের সুরের উৎস এক। পরে অঞ্চল ভেদে, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট ভেদে সুর গুলো বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে।
আজকাল, অনেকে মনে করেন লোকসঙ্গীত হিস্কি দিয়ে যেমন তেমন করে গাইলেই গান হয়ে যায় এবং এ গান গাওয়া খুবই সহজ, আসলে যারা বলেন তারা অজ্ঞতার কারণে বলে থাকেন। আবার কিছু কিছু শিল্পী বা শিল্পীগোষ্ঠী আধুনিকরণের নামে পাশ্চাত্য ঢংয়ে কোমর দুলিয়ে ড্রামের দ্রিমদ্রিম কান ফাটা শব্দে উসৃংখল কিছু মানুষের সস্তা তালি পেয়ে রাতারাতি বড় শিল্পী (স্বঘোষিত) হয়ে উঠছে। তারা লোকসঙ্গীতকে মডার্ণ করে, মডার্ণ নামে চালাতে চাচ্ছে এবং নিজেদের মডার্ণ শিল্পী হিসেবে দাবী করছে। তবে তাদের মনে রাখা দরকার জোড় করে এ গান গাওয়া যায়না। মাটির সাথে না মিশলে এই লোকগান বা লোকসঙ্গীত করা সম্ভব নয়।
লোকসঙ্গীতের শান্ত, গভীর, বিশুদ্ধ স্থির সেই সুর দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ভাওয়াইয়া গানের বাঁধুনিতে রাগের যে আমেজ আছে সে গুলোকে তাচ্ছিল্লভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। লোকসঙ্গীতের উদ্ভবের একবারে গোড়ার কথা বা ইতিহাস লেখা সম্ভব নয় তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় লোকসঙ্গীত হাজার বছরের পুরনো এবং বিশুদ্ধ তাতে কোন সন্দেহ নেই। বড় চন্ডিদাস রচিত “কৃষ্ণ কীর্তন” গ্রন্থে এই সুরের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর লোকসঙ্গীত সমীক্ষাঃ ‘বাংলা আসাম’ গ্রন্থের পল্লী সমাজের সঙ্গীত ও সংঘাত এবং বাংলার লোকসঙ্গীতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের সাধনা প্রবন্ধদ্বয়ে এই বিষয়টি নিয়ে উদ্ধৃতি সহযোগে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
লোকসঙ্গীত প্রবক্তাদের মধ্যে একটি বিষয়ের উপর সুস্পষ্ট মত পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। একদল আছেন যাঁরা মনে করেন লোকসঙ্গীতের পুরাতন সুর গুলোকে তাঁদের পুরাতন সুরেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ তাঁরা সুরের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধবাদী, তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত পল্লীকবি জসিম উদ্দীন। ভারতের লোকসঙ্গীতাজ্ঞরা অনেকেই মনে করেন যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে লোকসঙ্গীতের কথায় ও সুরেও যুগোচিত পরিবর্তন হওয়া উচিত। কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত সে ব্যাপারে আমরা অগ্রসর আপাততঃ হচ্ছিনা।
অনেকে মনে করেন লোকসঙ্গীত কেবল গ্রামের মানুষের গান। এ গান পাঁ ফাটা, মূর্খ, গেঁয়ো মানুষরাই গায় এবং শোনে। এ গানে কিছু তথাকথিত শিল্পী আধুনিকরণের নামে কোমড় দুলিয়ে পাশ্চাত্য বাদ্যের সাথে বিকৃত সুরে, হাত পা নাড়াচাড়া করে গান করছে। তারা মনে করে এমনি ভাবে গাইলেই আধুনিকরণ হয়ে যাবে। ইদানিং আরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু কিছু শিল্পী নামধারী, সঙ্গীতকে আধুনিকরণের নামে লোকসঙ্গীতের ক্ষতি করেই ক্ষ্যান্ত হযনি, লোকসঙ্গীতকে বিপথে প্রবাহিত করছে।
লোকসঙ্গীত প্রতিটি দেশে স্ব স্ব এলাকায় নিজস্ব নিয়ম কানুন, নিজস্ব স্বকীয়তায় প্রচারিত, প্রতিষ্ঠা পেয়ে আসছে। এলাকা ভেদে ভাষার, সুরের, গায়কি ঢং এবং আঞ্চলিকতার ধারা প্রবাহিত। লোকসঙ্গীতের আজ যেমন গীতিকার, সুরকার, শিল্পীদের তালিকা থাকছে কোন এক সময় তাতো ছিলই না বরং একটি গান বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ভাবে গাওয়া হতো। সে সময় কোন ভাবেই লোকসঙ্গীত লিপিবদ্ধ হতো না বা লিপিŸদ্ধ করাও সম্ভব হয়নি।
ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস অনুধাবন করলে দেখা যায় সঙ্গীতের দু’টি ধারা, রাগসঙ্গীত ও লোক সঙ্গীত। অনেকে বিশ্বাস করেন এবং জোড়ালো ভাবে বলেন যে, আমাদের মৌল রাগরাগিণীর গঠনে লোকসঙ্গীতের সুর কাঠামোর বেশকিছু উপাদান আছে। আমরা এখন জানবো সঙ্গীতাজ্ঞরা সঙ্গীতের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৫০০০ সাল থেকে আজ অবদি সঙ্গীত ধারা, বিষয়, নিয়ম, উত্থান, পতন যাবতীয় হিসাব তাঁরা উৎঘাটন করতে পেয়েছেন, আরও ব্যাপকভাবে আলোচনা করলে যা দাড়ায় তা নিম্নরূপ-
আনুমানিক কাল সঙ্গীতের ধারা
খৃস্টপূর্ব
১. ৫০০০-৩০০০ (?) মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাঃ প্রত্নতত্ত্বীয় নিদর্শন
২. ৩০০০-১৫০০ (?) ১৫০০-৫০০ বৈদিক ধারার প্রথম স্তর- ঋগে¦ত সামগান
৩. ৫০০-১০০ খৃস্টাব্দ গান্ধর্বগানের ধারা প্রথম পর্যায়
৪. ১০০-৫০০ খৃস্টাব্দ গান্ধর্বগানের পরিণত পর্যায়
৫. ৫০০-৯০০ খৃস্টাব্দ রাগসঙ্গীতের আদি স্তর
৬. ৯০০-১২০০ খৃস্টাব্দ আঞ্চলিক ভাষার গান রাগ প্রয়োগ (দেশী)
৭. ১২০০-১৫০০ খৃস্টাব্দ রাগসঙ্গীতের পারসিক প্রভাব প্রাচীন ও রাগসঙ্গীত ধ্র“পদের ১ম স্তর
নতুন
৮. ১৫০০-১৬০০ খৃস্টাব্দ
রাগশ্রেণি বিভাগের মেল ধ্রুপদের পরিণত স্তর
৯. ১৬০০-১৯২০ খৃস্টাব্দ মেল, ঠাঁট রাগের শ্রেণি বিভাগ
তাছাড়াও
১. ৯০০-১৪০০ ধর্মীয় সঙ্গীতের প্রথম স্তর
২. ১৪০০-১৮০০ সন্ত সঙ্গীত, কীর্তন, ভজন, শাস্ত্র সঙ্গীত ও অন্যান্য
৩. ১২০০-১৭০০ খেয়ালের প্রাচীন স্তর
৪. ১৭০০-১৮০০ খেয়ালের বিকাশ, টম্পার বিকাশ, ধারাবাহিকতায় খেয়াল বর্তমান পর্যন্ত। ঠুমরির বিকাশ
৫. ১৪০০ ক্রমন্বয়ে বাদ্য সঙ্গীত, বীণার রুপান্তর ও অন্যান্য তার যন্ত্র অবদ্ধ বাদ্যের বিকাশ, সুষীর সানাইর প্রচার
৬. ১৭৫০- ১৮২০ ভারতীয় কণ্যাটক্য সঙ্গীতের স্বর্ণ যুগ
উনবিংশ শতকের পূর্ব থেকে বর্তমান লোকপ্রচলিত সঙ্গীতের ধারার শুরু। অঞ্চল অনুসারে এর তারতম্যও দেখা যায় বিভাগ গুলো মোটমুটি এ রকম ধর্মীয়, কাব্য, নাট্য ও বর্তমান শ্রেণি।
লোকসঙ্গীতের স্তর ভারতীয় দৃষ্টি ভঙ্গি
লোকসঙ্গীতের স্তর দুইটি ১.আদিম (প্রমিটিভ) সঙ্গীত. ২. লৌকিক (ফোক) সঙ্গীত। আমরা লোকসঙ্গীত বুঝতে চাইলে দ্বিতীয়টি বুঝবো।
আদিম সঙ্গীত
যে সঙ্গীত প্রাচীন কালের অর্থাৎ আদি মানব গোষ্ঠীর অন্ধকার যুগে কিছু কিছু এলাকায় বিকশিত হয়ে অনেক দিন পর্যন্ত বজায় ছিল বা আছে। হয়তো বা এমন কিছু আছে বা ছিলো যা আজকে পর্যন্ত পৌছায়নি। আবার যে গুলো পৌছিয়েছে তা সঠিক ভাবে আসেনি, আসলেও আমরা তা জানিনা, তাই আদিম সঙ্গীত।
লৌকিক সঙ্গীত
মানুষ আস্তে আস্তে সভ্য হতে থাকে বা জ্ঞাণ আহরণ করতে থাকে। তারা হাসী, কান্না, প্রেম, ভালবাসা, রাগ, ক্ষোভ, মান অভিমাণ নিয়েই কালাতিপাত করতে করতে আজকের এ যায়গায় পৌছিয়েছে। সেই সময় থেকেই র্অথাৎ সভ্য জগতের সাথে গ্রামীণ সমাজের সঙ্গীত বিশেষ করে কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানষের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে গান সৃষ্টি হতে থাকে। যে গান শত শত বছর ধরে মুখে মুখে রচিত হয়ে মুখে মুখে গড়িয়ে আমাদের সমাজে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির সঙ্গীত রুপে পরিগণিত বা আস্থাভাজন হয়েছে তাই লোকসঙ্গীত।                                                     

                      (বাংলার লোকসংগীত  )

লোকসংগীত সংগীত রাজ্যের একটি অন্যতম ধারা। এতি মূলত বাংলার নিজস্ব সংগীত। গ্রাম, বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ, দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সংগীতে। লোকসংগীতের জন্য খুব বেশি যন্ত্রের ব্যবহার করা হয় না ৷ মূলত কথা আর সুরই গানগুলির প্রধান আকর্ষণ ৷

বাংলার লোকগীতিগুলির মধ্যে যে গানগুলির নাম প্রথমেই করতে হয় সেগুলি হল বাউল, গম্ভীরা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, কীর্তন, গাজন, ভাদুগান ইত্যাদি ৷ এছাড়াও, ঝুমুর গান, ঘেঁটু গান, সারি গান, বারোমাসি, মেয়েলি গীত, চোকচুন্দ্রী, ধামগান, ক্ষণগান, চোরচুন্নি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ৷ বাংলার লোকগীতিগুলির অধিকাংশের সঙ্গেই একটা করে মিষ্টি গল্প জড়িয়ে আছে। 
বাউল গান
বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকসংগীত হল বাউলগান ৷ বাউলগানের মূল বিষয়বস্তু প্রকৃতি ৷ এছাড়াও আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, দর্শন, দেহতত্ত্ব ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাউল গান ৷ এই গানে বৈষ্ণব ও সুফি উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাবই লক্ষণীয়। লালন ফকির বাউল গানের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ৷ লালনের গানগুলিকে লালনগীতি বলা হয় ৷ বাউলরা মুখে মুখে গান বাঁধেন ৷ এর কোনও লিখিত রূপ হয় না ৷ মূলত একতারা বাজিয়ে বাউল গান গাওয়া হয় ৷ এছাড়াও দোতারা, খামক, ডুগডুগি, ঢোল, খোল, করতাল, মঞ্জিরা, ঘুঙুরের ব্যবহারও এই গানে হয়ে থাকে ৷ বাউল গানের জুড়ি মেলা ভার ৷ রবীন্দ্র সংগীতেও বাউল গানের প্রভাব যথেষ্ট ৷ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও নদীয়ায় বাউল গানের বিস্তার বেশি হলেও রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই বাউলদের কমবেশি আনাগোনা রয়েছে ৷ শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কেঁদুলির জয়দেবের মেলা, পাথরচাপুরির দাতাবাবার মেলা, ঝাড়গ্রাম মেলা, পশ্চিম মেদিনীপুরের যুব উৎসব, শক্তিগড়ের মেলা, কল্যাণীর ঘোষপাড়া মেলা ও কলকাতার বাউল-ফকির উৎসবে বাউলগানের আসর বসে ৷ দেশ বিদেশ থেকে বহু মানুষ শুধুমাত্র এই গানের টানে এই মেলাগুলিতে ভিড় জমান ৷
গম্ভীরা
উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে মালদা জেলার অন্যতম জনপ্রিয় লোক সংগীত হল গম্ভীরা ৷ অবশ্য গানের পাশাপাশি এতে নাচের পরিবেশনও হয় ৷ মূলত চৈত্র মাসে চড়ক উৎসবের সময় শিবের মহিমা কীর্তন নাচ ও গানের মাধ্যমে প্রচার করা হয় ৷ প্রাচীন গৌড়িয় জনপদ তৈরির অনেক আগেই গম্ভীরার সৃষ্টি ৷ পণ্ডিতদের মতে গম্ভীরা দু’ধরনের হয় ৷ প্রাথমিক ও Narrative গম্ভীরা ৷ প্রাথমিক গম্ভীরায় দেবদেবীর মহিমা ও মানবজীবনে তার প্রভাব বর্ণিত থাকে ৷ আর মানুষের সামাজিক সমস্যা তুলে ধরা হয় Narrative গম্ভীরায় ৷ একজন বা দুজন শিল্পী গম্ভীরা পরিবেশন করেন ৷ কখনও মুখোশ পরে বিভিন্ন দেবদেবীর সাজে শিল্পীরা গান করে অভিনয় করেন ৷ আবার কখনও দাদু নাতির দুটি কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে সামাজিক সমস্যা বর্ণনা করে নাচ ও গান পরিবেশন করা হয় ৷ গম্ভীরাতে ঢাকের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ৷ এই গান কিছুটা উচ্চ্স্বরে গাওয়া হয় ৷ গানের সুর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একই রকম থাকে ৷
ভাদু
পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও বীরভূম জেলার জনপ্রিয় লোক সংগীত হল ভাদু ৷ অনাথ শিশুকন্যা ভাদুর জীবনকাহিনি নিয়ে ভাদু উৎসব পালিত হয় ৷ উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ভাদু গান ৷ ভাদুর জীবনকাহিনি নিয়ে তাতে আঞ্চলিক সুর দিয়ে এই গান গাওয়া হয় ৷ সাধারণত গ্রাম বাংলার অবিবাহিত মেয়েরাই এই গান গেয়ে থাকেন ৷
ভাটিয়ালি
ভাটিয়ালি হল মূলত মাঝিদের গান ৷ নদীতে নৌকো বাইতে বাইতে বিশেষ মিষ্টি সুরে মাঝিরা ভাটিয়ালি গান গেয়ে থাকেন ৷ ভাটিয়ালি শব্দটি এসেছে ভাটা থেকে ৷ আবার অন্য মতে, এই গান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি অর্থাৎ নদীর নাব্য এলাকায় গাওয়া হত বলে এই গানের আরেক নাম ভাটিয়ালি ৷ এই গানের কথা সাধারণত নৌকা বাওয়া, মাছ ধরা ও নদী সংক্রান্ত হয় ৷ ভাটিয়ালির মূল বিষয়বস্তু প্রকৄতি তত্ত্ব ৷ আব্বাস উদ্দিন, মিরাজ আলি, উকিল মুন্সী, রশিদ উদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তি ভাটিয়ালি গায়ক হিসেবে প্রসিদ্ধ ৷ গায়ক আব্বাস উদ্দিনের আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে অতি জনপ্রিয় ভাটিয়ালি গান ৷ ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে ভাটিয়ালি গানের স্বর্ণযুগ বলা হয় ৷
ভাওয়াইয়া
এপার বাংলার কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও উত্তর দিনাজপুর এবং ওপার বাংলার প্রধানত রংপুর জেলার জনপ্রিয় লোকসংগীত হল ভাওয়াইয়া ৷ এছাডা়ও অসমের ধুবরি ও গোয়ালপাড়াতেও এই গান বহুল প্রচলিত ৷ ভাওয়াইয়া মূলত রাখালদের গান ৷ মাঠে গরু চড়ানোর সময় তারা এই গান গেয়ে থাকে ৷ এই গানের ভাষা সাধারণত রাখালদের কাজ সংক্রান্ত ৷ আর সুর, যেন এক মিঠেকড়া অনুভূতি ৷
কবিগান
মুখে মুখে ছড়া কেটে সুর দিয়ে বিশেষ ভঙ্গীতে কবিগান গাওয়া হয় ৷ কবিগান দুপ্রকার পূর্ববঙ্গীয় ও পশ্চিমবঙ্গীয় ৷ পশ্চিমবঙ্গীয় কবিগান কলকাতার বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করে ৷ এই ধারায় ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত ছিল ৷ অন্যদিকে পূর্ববঙ্গীয় কবিগান মূলত লোকসংস্কৃতি, লোকাচার, সামাজিকতা ও শিক্ষামূলক বিষয়কে ভিত্তি করে বাঁধা হত ৷ ফলে পূর্ববঙ্গীয় কবিগানের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও পশ্চিমবঙ্গীয় কবিগান আজ প্রায় বিলুপ্ত ৷ বর্তমানে যে কবিগান শোনা যায় সংশোধিত রূপ বলে মনে করা হয় ৷ কবিগান শুরু হয় বন্দনা দিয়ে ৷ সাধারণত দুজন ব্যক্তি বা দলের মধ্যে তর্কের মধ্য দিয়ে কবির লড়াই জমে ওঠে ৷ কবিগান শিখতে হলে দীর্ঘদিনের তালিমের প্রয়োজন ৷ বিভিন ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্রপাঠ, বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা ও কাব্যপ্রতিভার পাশাপাশি শিখতে হয় মঞ্চ উপস্থাপনার কৌশলও ৷ পূ্র্বে ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি কবিয়ালদের মতো শিল্পীরা আসরেই গান বাঁধতেন ৷ আবার অনেক কবিয়াল অন্যকে দিয়ে গান বাঁধাতেন ৷ প্রধান শিল্পীদের সঙ্গে যাঁরা গানে সঙ্গ দিতেন তাঁদের বলা হত দোহার ৷ অনেকে তরজা বা খেউড়ের সঙ্গে কবিগানের তুলনা করলেও আসলে তা এক জিনিস নয় ৷ তরজা বা খেউড়ে ব্যক্তিগত কুৎসা, আক্রমণ বা অশ্লীলতার প্রাধান্য অনেক বেশি ৷ আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে কবিগানের উদ্ভব বলে মনে করা হয় ৷ ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি কবিয়াল কবিগানের দিকপাল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
কীর্তন
বাংলায় কীর্তনের প্রচলন হয় মূলত চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে ভক্তি আন্দোলন চলাকালীন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময় ৷ শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার লীলা, ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কই এই গানের প্রধান বিষয়বস্তু ৷ খোল, করতাল সহযোগে কৃষ্ণবন্দনায় মেতে উঠতেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য ৷
শ্যামাসংগীত
দেবী কালীর আরাধনায় গাওয়া হয় শ্যামাসংগীত ৷ দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় শাক্ত কবিরা শ্যামাসংগীতের প্রচলন করেন ৷ এই সংগীত পূর্ণতা পায় সাধক রামপ্রসাদের হাত ধরে ৷ পরবর্তীকালে কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রসিকচন্দ্র রায়, রামচন্দ্র, নীলকান্ত মুখোপাধ্যায় সেই ধারা অব্যাহত রাখেন ৷ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজি নজরুল ইসলামও শ্যামাসংগীত রচনা করেন ৷ শ্যামা সংগীত দুপ্রকারের আধ্যাত্মিক ও পদাবলি (দুর্গাস্তুতি, উমাসংগীত, আগমনী) ৷ দেবী কালীকে মা হিসেবে কল্পনা করে এই গান গাওয়া হয় ৷ ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সময় এই সংগীতের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায় ৷
গাজন
চৈত্রমাসে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় গাজন পরব হয় ৷ গাজন হল ভগবান শিবের মহিমা সংগীত ৷ শিব, পার্বতী সহ বিভিন্ন দেব-দেবীর বেশ ধারণ করে নাচ-গানের মাধ্যমে ভগবানের নাম গান করেন শিল্পীরা ৷ একটা সময় বাংলায় গাজন খুবই জনপ্রিয় থাকলেও বর্তমানে এই লোক সংগীত প্রায় বিলুপ্ত ৷
সারি গান
মাঝি-মাল্লা ও মজুরদের নিজস্ব সৄষ্টি সারিগান ৷ নৌকা প্রতিযোগিতার সময় সাধারণত এই গান গাওয়া হয় ৷ আবার এক নাগাড়ে কাজ করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন ৷ ক্লান্তি দূর করতে ও নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য তাঁরা মুখে মুখে গান বাঁধেন ৷ এই গানের কথা ও সুর তাঁদের একান্তই নিজস্ব ৷
 
ঘেঁটু গান
বাংলাদেশের ময়মনসিং, নেত্রখালি ও কষ্ণগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় লোকসংগীত হল ঘেঁটু গান ৷ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ধারা এই গানের মূল বিষয় ৷ আসরে কোনও বালক বা কিশোরকে মেয়ে সাজিয়ে তার নাকরণ করা হয় ঘেঁটু ৷ ঘেঁটুর সুখ-দুঃখের কথা বর্ণনা করেই গান বাঁধা হয় ৷ সাধারণত শীতকালে এই গানের আসর বসে ৷ আবার বিভিন্ন জায়গায় বর্ষাকালেও এই গান গাওয়া হয় ৷ ঢোল, মঞ্জিরা, খঞ্জনি, বাঁশি, হারমোনিয়াম সহযোগে এই গান গাওয়া হয় ৷ বর্তমানে এই গান প্রায় অবলুপ্তির মুখে ৷
বারোমাসি গান
সারা বছরের সুখ-দুঃখের ঘটনা নিয়ে বাঁধা হয় বারোমাসি গান ৷ বাংলার গ্রামেগঞ্জে এই গান প্রচলিত ৷
মেয়েলি গীত
একান্ত মেয়েলি কথা, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, এমনকি গ্রামের মেয়েদের কান-নাক বিঁধানো নিয়ে মেয়েলি গান বাঁধা হয় ৷ গ্রাম্য মহিলারা একত্রে এই গান করেন ৷
জরি গান
 
মহরমের সময় ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যে শোকের গান করেন তা জরি গান নামে পরিচিত ৷
চোকচুন্দ্রী
মূলত দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকার নিজস্ব গান ৷ বীজ বপনের সময় কৄষকরা এই গান করে থাকেন ৷
ক্ষণ গান
সমসাময়িক বিষয় নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকার একান্ত নিজস্ব গান ৷
হালুয়া হালুয়ানি
কৃষকদের গান ৷ গরু-মোষ, চাষের যন্ত্রপাতি কেনা বেচার সময় এই গান গাওয়া হয় ৷
চোরচুন্নি ও ধাম গান
জলপাইগুড়ির জনপ্রিয় দুটি লোকগীতি হল চোরচুন্নি ও ধামগান ৷ নানা কাল্পনিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক চরিত্র এই গানগুলির কেন্দ্রীয় বিষয় ৷
আলকাপ
আলকাপ মূলত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব লোকসংগীত। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম, মালদহ, বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকটা কবি গানের মতোই বিভিন্ন আসরে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। এইধরনের গানের প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও গান। 
গীতিকা
গীতিকার আরেক নাম গীতিনাট্য ৷ গীতিকা দুপ্রকারের ৷ পূর্ববঙ্গীয় গীতিকা ও নাথ গীতিকা ৷ পূর্ববঙ্গীয় গীতিকা মূলত ময়মনসিংহ জেলার গীতিনাট্য ৷ মহুয়া, মালুয়া, চন্দ্রাবতী, দেওয়ান মদিনা, কঙ্তা ও লীলা, কমলা, দেওয়ান ভাবনা ইত্যাদি পূর্ববঙ্গীয় গীতিকার অন্তর্গত ৷ রাজা গোপীচন্দ্রের বিভিন্ন কথোপকথন গীতিনাট্যের আকারে সুরারোপিত হয়ে গীতিকা গড়ে উঠেছে ৷ মাণিকচন্দ্র রাজারা গান, গোবিন্দচন্দ্রের গীত, ময়নামতির গান, গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, গোপীচন্দ্রের পাঁচালী ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয়েছে গীতিকা ৷

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত