প্রথম উপন্যাসেই আমেরিকা মাতাচ্ছেন মেঘা মজুমদার
প্রথম উপন্যাসেই যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছেন বাঙালি তরুণী মেঘা মজুমদার। ‘আ বার্নিং’ নামের ৩২০ পাতার উপন্যাসটির প্রশংসা এই মুহূর্তে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ বা ‘দ্য নিউইয়র্কার’-এর পাতায়। সেখানকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের বেস্ট সেলার তালিকাতেও উঠে এসেছে এই উপন্যাস।
এমন জনপ্রিয়তায় মেঘা নিজেও ‘থ্রিলড’। সম্প্রতি টুইটারে জানান, যে সময়ে এই উপন্যাস লিখেছেন, তখন ভাবতেও পারেননি যে, যুক্তরাষ্ট্রে কেউ তার বই সম্পর্কে আগ্রহী হবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকায় ‘আ বার্নিং’। রোমাঞ্চিত হওয়ার মতোই বিষয়।
আনন্দবাজার পত্রিকায় এই উপন্যাস ও মেঘাকে নিয়ে প্রকাশ হয়েছে অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ প্রতিবেদন। সেখান থেকে অনেকটাই তুলে ধরা হলো।
কলকাতা শহরের ধুলো-ধোঁয়ায় বেড়ে ওঠা মেঘা নিউইয়র্কের বাসিন্দা। পড়াশোনা করেছেন হার্ভার্ড ও জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। সোশ্যাল অ্যান্থ্রোপোলজির ছাত্রী মেঘা যে লম্বা প্রস্তুতি নিয়েই লিখতে এসেছেন, তা ধরা পড়েছে তার লিখনেই। একইসঙ্গে এক রুদ্ধশ্বাস আখ্যানকে লিখতে চেয়েছেন মেঘা, যার মধ্যে বুদ্ধির চমকও থাকবে। বলাই বাহুল্য, তিনি সফল। মেঘা জানান, নেটফ্লিক্সের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন এক উপন্যাসই লিখতে চেয়েছেন। ওয়েব সিরিজের গতিকে উপন্যাসে ধরতে পারার ব্যাপারে তিনি সফল।
নিউইয়র্ক টাইমস ‘আ বার্নিং’-এর আখ্যান কাঠামোকে তুলনা করেছে জাপানের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার ক্যামেরা টেকনিকের সঙ্গে, “কুরোসাওয়া তার ছবিতে তিনটি ক্যামেরার নজরকে রাখতেন। এর মধ্যে একটি হলো ‘গেরিলা নজর’, যা মূলত আখ্যানকে অন্তর্ঘাতের দিকে নিয়ে যায়।’’
পত্রিকাটি এই গ্রীষ্মে যে চারজন লেখককে উল্লেখযোগ্য বলে বেছে নিয়েছে, ‘আ বার্নিং’-এর লেখক রয়েছেন সেই তালিকায়। প্রশংসা করেছে ঔপন্যাসিকের সাহসিকতার।
দুর্দমনীয় গতির এই উপন্যাসকে প্রকাশনা সংস্থা ‘থ্রিলার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে থ্রিলার বলতে দুই দশক আগেও যা বোঝাত, আজকাল তা আর বোঝায় না। বদলে যাওয়া বিশ্বে অনিবার্যভাবে বদলে গেছে থ্রিলারের সংজ্ঞা। থ্রিলার মানেই যে অপরাধী আর গোয়েন্দার ইঁদুর-বিড়াল দৌড় নয়, সেই প্রমাণ রেখেছেন সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ডের লেখকরা। অপরাধ আর তদন্তকে ছাপিয়ে তা বিস্তৃত হয় সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্বের গভীরে। সেই বদলে যাওয়া ধারণারই একটা বিশেষ উদাহরণ ‘আ বার্নিং’, এমনই বলছেন ‘গুডরিডস’ বা ‘অ্যামাজন’-এর পাঠক রিভিউ।
‘আ বার্নিং’-এর কেন্দ্রে রয়েছে জীবন নামের একটি মেয়ে। কলকাতারই কোনো বস্তির এই বাসিন্দা ধর্মে মুসলমান। জীবন একটি ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করতে দেখে কিছু লোককে। এই ঘটনায় শ’খানেক লোক মারা যায়। আর পুরো ঘটনাটিই ঘটে পুলিশের সামনে। পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটি দেখেছিল মাত্র। জীবন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়— “যদি আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষকে পুলিশ সাহায্য না করে, শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের মৃত্যুদৃশ্য দেখে, তা হলে কি এর মানে এ-ও দাঁড়ায় না যে, সরকারও সন্ত্রাসবাদী?” জীবনের ধারণা ছিল না যে, এই ‘সামান্য’ কারণে তাকে গ্রেপ্তার হতে হবে। পড়তে হবে রাষ্ট্রের রোষে।
‘আ বার্নিং’-এ উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে আরও দুই চরিত্র। ‘পিটি টিচার’ নামে পরিচিত জীবনের স্কুলের শরীরশিক্ষার শিক্ষক চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অন্যজন তৃতীয় লিঙ্গের লাভলি। পিটি টিচার ও লাভলিরও নিজস্ব স্বপ্ন রয়েছে। প্রথম জন এক দক্ষিণপন্থী রাজত্বের প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন আর অন্যজন দেখেন বলিউডে আত্মপ্রতিষ্ঠার।
মূলত তিনটি পৃথক বয়ানের আশ্রয়েই গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস— জীবন, পিটি টিচার ও লাভলি। এর মধ্যে লাভলি এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে। ইংরেজি কিন্তু ভাঙা। পরিচিত সিনট্যাক্সের থেকে দূরের এক ভাষা। জীবন ও পিটি টিচারের বয়ান যদি দুই মেরুর প্রতিনিধিত্ব করে, লাভলির বয়ান তবে এই মেরু দুটির মাঝখানে কোথাও একটা অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে চলে। কুরোসাওয়ার সেই ‘তৃতীয় ক্যামেরা’ এখানে লাভলি। সে-ই ‘গেরিলা নজর’ এই আখ্যানে। বই আর অক্ষরের পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠলেও মেঘা এমন এক পরিসরকে তার লেখায় ধরতে চেয়েছেন, যা কাগজ আর অক্ষরের দুনিয়া থেকে অনেকটাই দূরে। তার চরিত্ররা তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের কেউ নয়। কলকাতা নামের শহরটার এমন কিছু দিককে তিনি তুলে এনেছেন, যা অস্বস্তিকর। অথচ যার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই।
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় বলছেন, জীবন যেন এখানে সাম্প্রতিক ভারতের এক বিপুল জনতার প্রতিনিধিত্ব করে। ক্রমাগত শিকড় থেকে উপড়ে তোলা, একের পর এক আশ্রয় থেকে বিচ্যুত মানুষের মুখপাত্র হয়ে ওঠে সে। এর সঙ্গেই যুক্ত হতে থাকে পুলিশের নির্যাতন, পানীয় জলের জন্য হাহাকার, সীমাহীন দারিদ্রের এক নিরবচ্ছিন্ন আখ্যান।
পিটি টিচার যদি এক সম্ভাব্য রাষ্ট্রের হয়ে বয়ান দেন, লাভলির বয়ানে উঠে আসে এক ভগ্নস্বপ্নের দেশ। এই দুই বয়ানের মাঝখানে রয়েছে জীবন (সে পিটি টিচার আর লাভলির মাঝখানের যোগসূত্রও বটে। কারণ, সে লাভলিকে ইংরেজি পড়ায়।) পিটি টিচারেরও অপ্রাপ্তি রয়েছে। তিনি স্বীকৃতি চান। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস কেবল মাত্র সেই আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরেই পাক খায়। লাভলির দারিদ্র, সমাজে তার প্রান্ত-বহির্ভূত অবস্থান আর জীবনের জীবনে স্থিতির চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা— এই-ই কি আজকের ভারতবর্ষ? সাম্প্রতিক রাজনীতি এখানে যেন এক বিশাল ছায়া ফেলা কোনো অজানা প্রাণী। যার উপস্থিতি একটা দমচাপা পরিস্থিতিকে সর্বদা বজায় রাখে, যার সঙ্গে সহবাস করছে ভারত, সহবাস করছে সে দেশের অগণিত মানুষ। অপ্রাপ্তির এক বিশাল মানচিত্র এই উপন্যসের পরতে পরতে।
করোনার দিনে প্রকাশিত এই উপন্যাস যেন ভারতের উপরে প্রলম্বিত এক অজানা ভয়ের ছায়াকেই তুলে ধরে। রাজনীতিকে অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের ছোটখাটো দুঃখসুখের আখ্যানকে কিছুতেই ছোঁয়া যায় না। রাষ্ট্র তার অতিমাত্রিক অস্তিত্ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকে না কারোরই। জীবন যে নির্দোষ, তা প্রমাণিত হতে পারে পিটি টিচার এবং লাভলির সাক্ষ্যে। ঘটনার আবর্ত কি গড়ায় সেই পর্যন্ত?
এই অতিরাষ্ট্রিকতাকেই লিখতে চেয়েছেন মেঘা তার প্রথম উপন্যাসে। এই আখ্যান কি শুধুমাত্র ভারতের? না কি যে কোনও ভূগোলেই বেড়ে ওঠা রাষ্ট্রিক সন্ত্রাস আর তার চাপে পিষ্ট জনজীবনের? এই মুহূর্তে পাঠকের সামনে এই প্রশ্নটিকেই রাখছে ‘আ বার্নিং’। দহন যে এক প্রতীকী অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে, এই প্রশ্নটিকেই আগুনের গোলার মতো ছুড়ে দিচ্ছে এই রচনা। জীবন বা লাভলির থেকে খুব বেশি দূরে নন আমেরিকায় পুলিশি হেফাজতে নিহত জর্জ ফ্লয়েড— এই প্রসঙ্গও যেন উঠে আসে এই আখ্যানে। ইসলামোফোবিয়ায় তো আক্রান্ত পশ্চিম গোলার্ধও। জীবনের ধর্মীয় আত্মপরিচয় বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় ‘আদার’ হিসেবে দেগে দেওয়া মানুষের অন্তঃস্থলকে। এখানেই লক্ষ্যভেদ করেছেন এই বাঙালি মেয়ে। নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসে কলকাতার আঞ্চলিকতা টপকে এই উপন্যাসকে আন্তর্জাতিক করে তুলতে পেরেছেন।