বেষ্টন

Reading Time: 3 minutes

 

 

 

১.

এত রাতে আগে কোনওদিনই বাড়ি ফিরিনি। লাস্ট ট্রেন থেকে নামতেই বেশ ভয় হল। শীতের রাত। যে-তিনজন এ-ওদিক থেকে নামল, তারা হঠাৎই যেন কোথায় গায়েব। প্ল্যাটফর্ম পেড়িয়ে বাইরে আসতেই ভয়ের ছোঁয়া আরও ঘন। যানবাহনের কোনও চিহ্নই নেই। এত রাতে এতটা পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হবে ভেবে জানুয়ারির শীতেও কপালে চলে এল ঘেমো ভাব। হাতঘড়ি দেখলাম। একটা পাঁচ। মোবাইল দিন দুই হল খারাপ। সারাতে দিয়েছি। বাড়ির লোক অপেক্ষা করতে করতে নিশ্চই এতক্ষণে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে। বাড়ির লোক মানে অবশ্য বাবা, মা। কী ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল! আজকে ফিরব না ভেবে! আমার রোজগারেই চলে গোটা সংসার।

শেষ কয়েক বছরে নিশ্চিন্তি ভাবটা যেন পরিবারের অনেকটাই বেড়ে গেছে। ভেবে লাভ নেই। অগত্যা রাস্তায় পা বাড়ানো। শুনশান। গ্রীষ্মকাল হলে কি এতটা নিশুথি হত! এল ই ডি’র ঝাপসা আলো নিস্তব্ধতা মেখে যেন আর একটু মৃদু। বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি, না না আকারের বাড়ি আর মলের ছায়ারা মিলে মিশে অজানা পরিবেশকে উসকে দিচ্ছে। হাঁটা দ্রুত করার চেষ্টা করি। এ সব থেকে বাঁচতে, সব কিছুকে পিছনে ফেলে দিচ্ছিলাম। এমন সময় নজরে এল। মানে প্রথমে কানে এল, তারপর এক ঝলক পিছনে তাকিয়ে যা বুঝলাম আর কী। ঢলা প্যান্ট, জামায় মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে আমার পিছনেই আসছে। হতেই পারে। প্রথমটায় কিছু ভাবতেই চাইনি। কিন্তু দু’দুটো মোড় ঘোরার পরই একটা কথা ভেবে বুকটা ধক করে উঠল। এ লোকটা তো আসলে আমাকে অনুসরণ করছে।

 

২.

কথাটা ভাবতেই ভয়, উত্তেজনা অনেকগুণ বেড়ে গেল। কায়দা করে পিছন ফিরে তাকালাম। এবং একটু সময় নিয়ে। সঙ্গে কিছু টাকা আর হাত ঘড়িটা আছে। সে রকম বুঝলে ছুটতে শুরু করব। আর একবার তাকাতে একটু অবাকই লাগল। এ হাঁটায় তো বাবার মিল খুঁজে পাচ্ছি। বাবাও অনেকটা এ রকমই পা’টা টেনে হাঁটে। দূর থেকেও বুঝতে পারছি লোকটার চেবানো। আর আমার বাবা পান খায়। বেশ সময় নিয়ে চেবায়। মাথাটা টুপি আর মাফলার দিয়ে প্রায় ঢাকা হলেও অবিকল বাবাকেই মনে হচ্ছে। এক পলক থামি। কী আশ্চর্য! পেছনের বাবার মতো অবিকল লোকটাও দাঁড়িয়ে গেছে। আর ভাবতে পারি না। অন্য একটা রাস্তা ধরে খুব তাড়াতাড়ি আর একটা রাস্তায় চলে যাই। বাড়ির পথটা এতে ঘুর হয়ে গেল। কিন্তু লোকটাকে নিশ্চিত এড়ানো যাবে। এ রাস্তায় পড়তেই অন্যরকম ভয় গ্রাস করে। সার সার দোকানের চালা। তার পরেই একটা মস্ত বড় মোবাইল ফোনের টাওয়ার বসেছে। দূর থেকে দেখছি, আর কেবলি মনে হচ্ছে, চার পা’ ওলা একটা লোহার ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে আছে। অনেক উঁচু থেকে তার দৃষ্টিটা যেন পড়ছে আমারই উপর। আর ঠিক তখনই দৃষ্টিটা চলে গেল আড়াআড়ি। নাঃ! আগের লোকটা নয়। এবার এক ভদ্রমহিলা। এক ঝলকেই অন্যরকম লেগেছে। এতটা দূর থেকেও চিনতে পেরেছি শাড়ির রংটা। অবিকল মায়ের এই রঙের একটা শাড়ি আছে। দ্বিতীয় বারের ট্যারচা দৃষ্টি দিই। এবার ভীষণ, ভীষণ অবাক লাগছে। এত রাতে এ তো অবিকল আমার মা। কী হচ্ছে এটা। মায়ের মতো বাঁধা চুল, ঐ উচ্চতা। ভাবতে পারছি না একদম। ভয় ঠেলে রেখে এবার অবাক হচ্ছি বেশি। প্রায় দৌড়তে দৌড়তেই পিছনে আসা সে ভদ্রমহিলাকে আরও পিছনে রেখে ঘুর পথে আর একটা রাস্তায় চলে আসি। বুঝতে পারছি। শর্টকার্টের পথ এখন লংকার্ট। এ রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে আগের থেকে ভয় বেড়ে গেল শতগুণে।

 

৩.

যে-দিক দিয়ে হাঁটছি তার উল্টো দিকটায় আছে লম্বা পাঁচিল। আর পাঁচিলের ওপারে আছে বহু প্রাচীন কবরখানা। কেন যে মরতে এ পথে এলাম! হাঁটার গতি বাড়িয়েই দিয়েছিলাম। অনুভূতি বশেই পিছনে তাকিয়ে দেখি, আমাকে আবার কেউ অনুসরণ করতে শুরু করেছে। তাকালাম পিছনে। না, এবার আর কারোর সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছি না। অনেকটা লম্বা। সুঠাম চেহারা। জ্যাকেট পড়ে থাকলেও নিচে যে পাঞ্জাবি আছে, তা বুঝতে পারছি। নেমে আসা কুয়াশা ধাঁধা বাড়িয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। তবে মাথায় টুপি থাকলেও চোখে চশমা আছে বোঝা যাচ্ছে। এ রকম মানুষ কি ক্ষতিকারক হতে পারে! রাতের বেলার কবরস্থানের পাশে কারোর অনুসরণ কতটা নিরাপদ! আগের দু’বার ছুটে অন্য রাস্তা ধরেছিলাম। এবারেও কি তাই করব? সত্যিই কি এই লোকটা আমাকেই অনুসরণ করছে? দাঁড়িয়ে পড়ি। না। পেছনের ব্যক্তি দাঁড়ায় না। হেঁটে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমাকে পেরনোর মুহূর্তে লক্ষ করি তার সাথে কারোর মিলকে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে এ চেহারাকেই অনেকবার দেখেছি। আমাকে অতিক্রম করে সে এগিয়ে যায়। খেয়াল হয়, আমি আমার বাড়ির কাছাকাছি। সে বাড়ির ঝুলবারান্দায় অপেক্ষা করছে এই মধ্যরাত্রিতে যারা, তারা আর কেউ নয়, নিশ্চিতভাবে আমার বাবা আর মা। স্বস্তির শ্বাস ফেলে, নির্ভয়ে এবার এগিয়ে যাই…।

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>