পুরুষতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য নারীকে দমন, যাতে পুরুষের আধিপত্য ধরে রাখা যায়। পুরুষতন্ত্র সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না। তার বিশ্বাস, ধর্ম, চিন্তা ও কর্ম সমস্তকিছু জুড়ে আছে পুরুষের প্রতিষ্ঠা, একচ্ছত্র আধিপত্য, মালিকানা ও সম্মান। পুরুষতন্ত্র শুধুমাত্র পুরুষের অধিকারে বিশ্বাস করে এবং নারীর অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে। পুরুষতন্ত্র নারীর শরীর ও মন দুইকেই নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী, কারণ এ ব্যবস্থায় পুরুষ নারীর মালিক। নারী পুরুষের অধীন, পুরুষতন্ত্রের তৈরি নিয়মে নারীর জীবন পরিচালিত হবে- এটাই পুরুষতন্ত্রের মূল কথা।
পুরুষতন্ত্র নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নানারকম টুলস (tools) ব্যবহার করে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, যাতে নারী কোনভাবেই নিজের মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এর মধ্যে বেশিরভাগ টুলই এমন কৌশলে তৈরি যা দেখে আপাতদৃষ্টিতে টেরই পাওয়া যায় না যে এটি আসলে নারীকে দমন, পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছে। আবার সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মীয় কাঠামো ইত্যাদির ওপরও এই টুলসের বৈশিষ্ঠ্য নির্ভর করে।
নারীকে দমিয়ে রাখার স্বার্থে পুরুষতন্ত্রের তৈরি অত্যন্ত কার্যকরী একটা টুল হল পোশাক। এই টুলটি পৃথিবীর সমস্ত দেশে, সব লোকাচারে, সব সমাজে, সব ধর্মীয় ব্যবস্থায় নারীকে অধিনস্ত রাখার কাজে ব্যবহার হয়েছে। তবে এর ধরণ হয়েছে নানারকম।
আমাদের দেশে পোশাক টুলটি অত্যন্ত কার্যকর একটি টুল। এই টুল দিয়ে পুরুষতন্ত্র অত্যন্ত সফলতার সাথে এদেশের মেয়েদের নানাভাবে শায়েস্তা করে চলেছে। অথচ মেয়েরাই বিষয়টি বুঝেছে সবচেয়ে দেরিতে। বেশিরভাগ মেয়ে বোঝেইনি।
জন্মের পর থেকেই পোশাকের বিধিনিষেধ ও রীতিনীতি নারীর ওপরে চাপিয়ে দেয়া হয়। রক্ষণশীল পরিস্থিতিতে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কিছুটা উদারমনা অবস্থা যেখানে, সেখানেও নারী অবরুদ্ধ এই পোশাক রাজনীতির কাছে।
পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য ঠিক করে গোলাপি রঙ, আর পুরুষের জন্য নীল। জন্মের আগে থেকেই পুত্র সন্তান নীল রঙ আর কন্যা গোলাপি রঙের প্রতীক হয়ে ওঠে। গোলাপি একটি কোমল রঙ। এই রঙ প্রতিষ্ঠা করে পুরুষতন্ত্র জন্মের আগেই কন্যার ওপর কোমলতা ও পেলবতা আরোপ করে। এর বাইরে যাবার উপায় নারীর নেই।
এদেশে শিশুরা ইশকুলে যায়। প্রাইমারি ইশকুলে শিশু মেয়েরা ফ্রক স্কার্ট পরে। ক্লাস সিক্সে উঠবার সাথে সাথে তার জন্য নির্ধারণ করা হয় কামিজ সালোয়ার ও সাথে ওড়না যা ক্রসবেল্ট দিয়ে তার বুকের ওপরে টাইট করে আটকে দেয়া হয়। অর্থাৎ স্তন বিকাশের সাথে সাথে তা ঢেকে রাখার কর্তব্যের কথা বয়ঃসন্ধির শুরুতেই তাকে জানিয়ে দেয়া হয়। এরপর বাকি জীবন কন্যার যায় শুধু স্তন ঢেকে রাখার সংগ্রাম করতে করতেই। তার ধ্যান জ্ঞান সবকিছু একনিষ্ঠভাবে তার নিজের শরীরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। তার স্তন, পদযুগল, তার নিতম্ব, পেট পিঠ সমস্ত কিছুই পুরুষতন্ত্রের চোখে যৌনতার প্রতীক। এই দেশে এই যৌনতা আরো তীব্র, উৎকট। তাই নারীর আপাদমস্তক ঢেকে রাখাকেই এই সমাজ তার নিয়ম করে দিয়েছে। তা না হলে এদেশের পুরুষদের স্খলন ঘটে এবং কর্মে সমস্যা হয় বলে প্রচার করে পুরুষতন্ত্র। এক্ষেত্রে লক্ষনীয় যে, নারীর কর্ম নিয়ে এদেশের পুরুষতন্ত্র চিন্তা করে না। চিন্তা করে না বলেই বারো হাত শাড়ি, আড়াই হাত ওড়না পরিয়ে নারীকে তারা কাজে পাঠায়। নারী সারা শরীরে গজ গজ কাপড় বেধে হেঁশেলের ধারে আগুনের পাশে হাড়ি ঠেলে, বাচ্চা পালে, ঘরদোর পরিস্কার করে এবং ওই বেশুমার কাপড়েরর ঘেরাটোপের ভিতরে গরমে সেদ্ধ হতে হতেই বিশ্রামের কাজটিও সেরে ফেলে।
এই বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও নারীর পোশাকে তার কোন প্রভাব পরেনি। নারীকে বিস্তর কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখার নিয়ম করে রেখেছে পুরুষতন্ত্র। এর ওপর চাপিয়ে দিয়েছে বোরখা, হিজাব ও বাড়তি ওড়নার বাহুল্য। এর কারণ হিসেবে পুরুষতন্ত্র যে মোক্ষম অস্ত্রটি ছুড়ে দিয়েছে তার নাম ধর্ম । যুগে যুগে এভাবেই ধর্ম পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছে।
পুরুষতন্ত্র নারীকে উৎপাদনে চায়নি। বহির্জগতে চায়নি। সে চেয়েছে নারী তার দাসী হিসেবে ঘরে থাকবে তার সেবা যত্ন করতে। একই সাথে সন্তান জন্ম দিয়ে বংশধারা বজায় রাখবে। সেই সন্তান লালনের কাজটিও করে যাবে নারী। এর বাইরে নারীর আর কোন ভূমিকা পুরুষতন্ত্র মানে না। কারণ নারীর উৎপাদনে অংশগ্রহণ মানে নারীর অর্থনীতিতে অংশ নেয়া। আর যখনই নারী অর্থনীতিতে তার হিস্যা পাবে, তখনই ভেঙ্গে পড়তে শুরু করবে পুরুষন্ত্রের আদিম কাঠামো। এই ভয় পুরুষতন্ত্রকে ভীত করে। এই ভয়ে ভীত পিতৃতন্ত্র নারীকে বারবার হেঁশেলে ঠেলে, নারী বাইরে আসলেই তার বুক কাঁপে।
হেঁশেলে থাকা নারীকেও সে ভয় পায়। পোষা প্রানীকে মানুষ যখন নিজের আয়ত্বে রাখতে চায়, তখন তার পায়ে শেকল পরায়। পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরে কাপড়ের বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখে। নারী কোন পোশাকটি পরবে, কোনটি পরবে না, তা ঠিক করে দেয় পুরুষ। পুরুষের তৈরি নিয়মে সৃষ্টি হয় এক এক সমাজে নারীর জন্য পোশাক।
এদেশের পুরুষ মনে করে নারীকে ঢেকে রাখা জরুরি। কারণ এ সমাজ যৌনতাকে অবদমন করতে করতে এমন এক বিকৃতির পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, নারীর হাত পা পেট পিঠ থেকে শুরু করে যৌনাঙ্গ সবসময়ই পুরুষকে উত্তেজিত করে বলে মনে করে এই সমাজ। পুরুষও নারীকে একটি আপাদমস্তক যৌনবস্তু ছাড়া আর কিছুই ভাবতে শেখে না শৈশব থেকে। নারীর এই যৌনবস্তু হয়ে থাকার ধারনাটিকে ধরে রাখা পুরুষতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এতে করে এই সমাজে নারীর একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়া যায় এবং আর সমস্তকিছু থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে রাখার মোক্ষম মওকা পাওয়া যায়। আর নারী যখনই এই তত্ত্বকে অস্বীকার করে বহির্জগতে নিজের সমানাধিকারের দাবিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, তখনই পুরুষতন্ত্র তাকে ডাইনী, কুহকিনী ও বেশ্যা হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিজের অবস্থান পাকা করে ফেলে।
নারীকে যৌনবস্ত করে রাখার ধারণাকে শক্তপোক্ত করতে পুরুষ নারীর ওপর আরোপ করে পোশাকের রীতি। নারীকে ঢেকে রাখা মানে একটি যৌনতাকে ঢেকে রাখা। নিজেদের মনের বিকৃতিকে নারীর ওপর চাপিয়ে দেয় পুরুষতন্ত্র, যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ নারীর জন্য পোশাকের বিধিনিষেধ।
এই সমাজ নারীর হাতাকাটা পোশাক মানতে পারে না। এই সমাজ নারীর দুই পা খোলা রাখা মানতে পারে না। এই সমাজ নারী ক্লিভেজের সামান্য প্রকাশ মানতে পারেনা। এমনকি এই সমাজ পোশাকের ভারি স্তরের ওপর দিয়ে নারীর স্তনের স্বাভাবিক প্রকাশকেও মানতে পারে না। তার জন্য তারা আড়াই গজি ওড়নার বন্দোবস্ত করে রেখেছে। সেই ওড়না আবার নারী ঠিকঠাকমত পরছে কি না, সেটিও আগুনচোখে পাহারা দেয় পুরুষতন্ত্র। ওড়না সামান্য সরে গিয়ে স্তনের আভাস দেখা গেলেই হায় হায় করে ওঠে গোটা সমাজ।
এই সমাজ আসলে আস্ত একটি নারীকেই মানতে পারে না। তাই সমাজের একটি বড় অংশে নারী বোরখা হিজাব পরে, নেকাপে মুখও ঢাকে। আর যারা তা পরে না, তাদের জন্য হাত পা ঢেকে চলার রীতি ঘোষণা করে দিয়েছে পিতৃতন্ত্র। অথচ তীব্র গরমের এই দেশে পুরুষ দিব্যি খালি গায়ে ঘোরে। তার জন্য লুঙ্গি আছে, ফতুয়া আছে, পাঞ্জাবী আছে, হাতাকাটা গেঞ্জি আছে, টিশার্ট আছে। প্রতিটি পোশাকই পুরুষের আরাম ও কাজের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সৃষ্টি।
পুরুষতন্ত্র নারীর কাজের সুবিধার কথা ভাবেনি। কারণ পুরুষতন্ত্র চায়ই নাই যে নারী বাইরে গিয়ে কাজ করবে। পুরুষতন্ত্রের মতে, নারীর কাজ পুরুষকে যৌনানন্দ দেয়া আর বাকি সময় যৌনতার মাংসপিন্ডগুলো হেফাজতে রাখা। এক একটি মাংসপিন্ডের মালিক এক একটি পুরুষ। এই মালিকানা পুরুষ শেয়ার করতে চায় না। ঠিক যেরকম নিজের সম্পত্তির ব্যাপারে পুরুষ রক্ষনশীল তেমনি নারীর ব্যাপারেও পুরুষতন্ত্র রক্ষণশীল ও সজাগ।
পুরুষতন্ত্রের চোখ রাঙানী তুচ্ছ করে নারী যখন এই সমাজে কাজের উদ্দেশে বেরিয়ে এসেছে, তখন পুরুষ চিন্তিত হয়েছে। তখন সে নারীর পোশাকের ব্যাপারে আরো বেশি কঠোর হয়ে উঠতে চেয়েছে। পুরুষ চেয়েছে, নারী যে কাজই করুক, নারী থাকবে সেই নির্দিষ্ট পোশােকের ঘেরাটোপে বন্দী। কারণ কাজে বেরোলেও যৌনবস্তুর আখ্যা থেকে পুরুষতন্ত্র নারীকে মুক্তি দেয়নি। তাই মাংসের তালকে তারা বার বার ঢেকে দিতে চেয়েছে শাড়িতে, ওড়নায়, সালোয়ারে, হিজাবে, নেকাবে, বোরখায়।
পশ্চিমা বিশ্বের নারীকেও তার পোশাক নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস পেরিয়ে আসতে হয়েছে। সে আরেক ফরমেটে। নারীর জন্য বিশাল ঘেরের গাউন, তার নিচে তারের বা লোহার তৈরি ফ্রেম বহন করে যেতে হয়েছে নারীকে। সমস্ত ধর্মই নারীর পোশাকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে নিজেদের ইচ্ছা। আদতে নারীকে দমন করতে চেয়েছে সবাই, সবকিছুই। এই দুনিয়াটা পুরুষকে মালিকানা আর নারীকে দাসত্ব দিয়ে সেটাকেই ধরে রাখতে চেয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
নারীর পোশাক পুরুষতন্ত্রের নির্ধারণ। নারীর জন্য এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে! কারণ পোশাক একান্তই নিজের ব্যাক্তিগত ইচ্ছা, পছন্দ ও রুচির বিষয়। নারীকে সামাজিক লোকাচার, ধর্মীয় রীতি ইত্যাদি দেখিয়ে তার শরীরের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে পুরুষতন্ত্র। এই হরণ করা স্বাধীনতা পুরুষতন্ত্র তাকে ফিরিয়ে দেবে না। তাতে পুরুষতন্ত্রের দড়ি আলগা হয়ে যায়। তাই নারীর কাজটি হল, নিজেকে পোশাকের শৃংখল থেকে মুক্তি দেয়া। সে কী পরবে আর কী পরবে না, তা নিজে ঠিক করা এবং পিতৃতন্ত্র ও এই সমাজের মুখে ঝামা ঘষে পছন্দের ও আরামের পোশাকটি পরে স্বচ্ছন্দ্যে বেরিয়ে যাওয়া বাইরের জগতে।