| 28 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস

ভদ্রবাহু এবং কল্পসুত্রঃ আমাদের বাংলার প্রথম দার্শনিক

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আচার্য ভদ্রবাহু, আমাদের বঙ্গদেশের আদি দার্শনিক, অখণ্ড জৈন ধর্মমতের সর্বশেষ আচার্য, যার পরবর্তীতে জৈন ধর্ম, দিগম্বর এবং শ্বেতাম্বর দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়, আচার্য ভদ্রবাহু ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুরু, যদিও এইক্ষেত্রে বিশ্বগুপ্ত চাণক্যকেও চন্দ্রগুপ্তের সাথে একত্রিভবন করা হয়ে থাকে তবে চন্দ্রগুপ্ত ভদ্রবাহুর কারণেই শেষ জীবনে শ্বেতাম্বর জৈন হিসেবে জীবনধারণ করেন। যশোভদ্রের শিষ্য হিসেবে তিনি মহাবীর কর্তৃক সংস্কারকৃত জৈন ধর্মের দুইটি প্রধান ধারা (শ্বেতাম্বর এবং দিগম্বর)এর  একটি অংশের প্রধান পণ্ডিত ছিলেন।

ভদ্রবাহু তার লিপিবদ্ধ কাজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তিনি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সর্বমোট ১৬ টি স্বপ্নের ব্যাখা প্রদান করেছিলেন বলে জানা যায়।

সেই সপ্নের মাঝে ছিল, সূর্যের গ্রহণ, চন্দ্রের বিভাজন সহ বাঁদরের সিংহাসনে আরোহন,তরুণ ষাঁড়দের কাজে অংশগ্রহণ সহ আরও বেশ কিছু,

এর মাঝে চন্দ্র বিভাজনের যে স্বপ্নটি ছিল তার অনুবাদ করেন ভদ্রবাহু এমনভাবে, যে তার পরে জৈন ধর্ম দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও তিনি উদ্ধৃত করেন চন্দ্রগুপ্তের কৃত বিজয়াভিযানের দরুন রাজ্যে ১২ বছরের জন্য দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে এবং এই কারণে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রজ্যের অন্ত ঘটবে, তিনি তার স্বপ্ন অনুবাদ করে প্রায় ১২ হাজার অনুসারী সহ দক্ষিণ ভারতের দিকে যাত্রা করেন।

তার এই  ভবিষ্যত বানীর দরুন চন্দ্রগুপ্ত নিজেও জৈন শ্বেতাম্বর সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করেন ও ভদ্রবাহুর সহিত দক্ষিণ ভারতের দিকে যাত্রা করেন।

তার সম্পর্কে রাধা কুমার মুখার্জি লিখেন

“তিনি ভদ্রবাহু এবং তার শিশ্য চন্দ্রগুপ্ত মুনির কথা সপ্তম শতকের একটি শিলালেখে আমরা সর্বপ্রথম উল্লেখ পাই, “সেরিংপট্টমের নিকটে কাভেরীতে প্রায় ৯০০ খ্রিস্টাব্দের দুটি শিলালিপি ভদ্রবাহু এবং চন্দ্রগুপ্ত মুনিপতির পদচিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত চন্দ্রগিরি নামে একটি পাহাড়ের চূড়ার কথা বর্ণনা করে। ১১২৯-এর একটি শ্রাবণবেলাগোলা শিলালিপিতে ভদ্রবাবু” শ্রুতকেবলি “এবং চন্দ্রগুপ্তের উল্লেখ রয়েছে যে তার অসামান্য প্রভাবের দরুন  বন দেবদেবীদের তারা উপাস্য হয়ে উথেছিলেন,  ১১৬৩ এর ক্ষেত্রে তাদের জুটির অনুরুপ একটি জুটির বর্ণনা রয়েছে এবং ১৪৪৩ সালের তৃতীয় শিলালিপিতে যতীন্দ্র ভদ্রাবাহু এবং তাঁর শিষ্য চন্দ্রগুপ্তের কথা বলা হয়েছে, যার তপস্যা ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে।“

তার লিখিত আচারাঙ্গ সুত্রে তিনি প্রতি ধরণের অঙ্গের ক্ষেত্রে জৈনগণ কিরূপ আচরণ করবেন তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন, তার মতে একজন জৈনর পাঁচটি বিষয়কে পালন করে চলা উচিত,

আচারাঙ্গ সুত্র মতে সেই পাঁচটি বিষয় হচ্ছে,অহিংসা,সত্য,অস্ত্যেয়,ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ এবং ভদ্রবাহু তার লেখনিতে কল্প এবং আচারাঙ্গ সুত্রের মাঝেএই বিষয়টি শিক্ষাদান করেন, এর পরেও জৈনগণ মনে করতেন যে সমগ্র মহাবিশ্বে শত শত ধরণের অদৃশ্য আণুবীক্ষণিক জীব বসবাস করেন যাদেরকে কোনরকম ভাবেই কষ্টের অধীন করা যাবে না।

জৈন ধর্মের দুইটি ধারার মাঝে আমরা দুই ধরণের ভদ্রবাহুর খোঁজ পাই, যেমন শ্বেতাম্বর ধারা মতে ভদ্রবাহুর জন্ম হয়েছিল ৪৩৩ থেকে  ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত, দিগম্বর ধারা মতে তার দেহাবসান হয়েছিল ৩৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আধুনিক ইতিহাসকারগণের মতে ভদ্রবাহুর জন্ম ৩২২ খ্রিস্টপুর্বে এবং মৃত্যু ২৪৩ খ্রিস্টপূর্বে। এছাড়াও ভদ্রবাহুর হাত দিয়ে জৈন ধর্মের প্রধান তিনটি ধর্মীয় গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয়েছিল বলে জানা যায়, এর সাথে সাথে তিনি নিরুক্তি সমূহকেও পুনঃলিপিবদ্ধ এবং জৈন ধর্মের ১২ টি প্রধান বইয়ের মাঝে ১০ টি বইতে টীকা সংকলনের কাজও সম্পাদনা করেন, ধারণা করা হয় যে ১২ বছরের দুর্ভিক্ষের সমাপ্তির পরে ভদ্রবাহু নেপালে গিয়ে বসবাস করেন এবং অন্যান্য ইতিহাসকারের মতে তিনি মহীশুরে নিজের শেষজীবন অতিবাহিত করেন।

ভদ্রবাহুর একটি বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি প্রবাবিলিটি বা সম্ভাব্যতার ধারণার জন্মদানে ভুমিকা রেখেছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রে, এই বিষয়ে পিসি মহলানবিশ বলেন।ভদ্রবাহুর পাণ্ডুলিপিগুলিতে আমরা সিদ্ববাদের ধারণায় সম্ভাবনার একটি প্রাচীন ব্যাখ্যা পাই। মহালানোবিস এটিকে সাতটি অভিজ্ঞতামূলক বিবৃতিতে বিভক্ত করেছেন:

(১) হতে পারে, এটি হয়; (২) হতে পারে, তা নয়; (৩) হতে পারে, এটি এবং তা নয়; (৪) হতে পারে, এটি অবর্ণনীয়; (৫) হতে পারে, এটি এখনও অবর্ণনীয়; (৬) হতে পারে, এটি নয় এবং এটি অবর্ণনীয়ও; (৭) এটি হতে পারে এবং এটিও নয় এবং এটি অবর্ণনীয়। 

ভদ্রবাহু তার শেষ জীবনে সাল্লেখানা বা আত্নবলিদানের রীতি অনুসরণ করেন, তার এই রীতি অনুযায়ী তিনি সর্বপ্রকার ঐহিক বিষয়কে পরিত্যাগ করে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন, এবং উপবাসের দ্বারা নিজের প্রানদান করেন বা দেহ ত্যাগ করেন।

ভদ্রবাহু দিগম্বর জৈনগণের ক্ষেত্রে এখনও একজন গুরু হিসেবে পরিচিত, এবং জৈন ধর্মের ন্যায় অতি অহিংস একটি ধর্মের সর্বশেষ অবিভক্ত ধর্মাচার্য হিসেবে আসীন থাকেন।   

রেফারেন্সঃ

  1. ১এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ভদ্রবাহু
  2. ২ https://www.sacred-texts.com/jai/sbe22/sbe2281.htm
  3. ৩ Dundas, Paul (2002) [1992], The Jains (Second ed.), Routledge, ISBN 0-415-26605-X
  4. Mookerji, Radha Kumud (1988) [first published in 1966], Chandragupta Maurya and his times (4th ed.), Motilal Banarsidass, ISBN 81-208-0433-3
  5. Sangave, Vilas Adinath (1981), The Sacred Sravana-Belagola: A Socio-religious study (First ed.), Bharatiya Jnanpith
  6. Sangave, Vilas Adinath (2001), Facets of Jainology: Selected Research Papers on Jain Society, Religion, and Culture, Popular Prakashan, ISBN 978-81-7154-839-2
  7. Shah, Natubhai (2004) [First published in 1998], Jainism: The World of Conquerors, I, Motilal Banarsidass, ISBN 978-81-208-1938-2
  8. Wiley, Kristi L (16 July 2009), The a to Z of Jainism, p. 51, ISBN 9780810868212
  9. Vidyabhusana, Satis Chandra (2006) [1920], A History of Indian Logic: Ancient, Mediaeval and Modern Schools, Motilal Banarsidass, ISBN 81-208-0565-8

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত