বিপ্লবীদের চিঠি
কত না চিঠি ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিযুগের। কোনও চিঠিতে দেশের জন্য বিপ্লবীদের প্রাণদানের নিঃস্বার্থ আকুতি, কোথাও নিছকই আবেগ, অনুভূতি, হৃদয়ের গহিনে থাকা না–বলা কথা। সেই সব চিঠি নিয়ে লিখলেন বিশিষ্ট গবেষক শুভেন্দু মজুমদার।
‘কারাগারের ভিতরে পড়েছিল জ্যোৎস্না/বাইরে হাওয়া, বিষম হাওয়া,/ সেই হাওয়ায় নশ্বরতার গন্ধ/ তবু ফাঁসির আগে দীনেশ গুপ্ত চিঠি লিখেছিল তার বৌদিকে:/ আমি অমর, আমাকে মারিবার সাধ্য কাহারো নাই!’ এরকমই কত না চিঠি ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিযুগের। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান— কোনও চিঠিতে সেই বিপ্লবীদের দেশমায়ের প্রতি প্রাণদানের নিঃস্বার্থ আকুতি, আবার কোথাও বা নিছকই আবেগ, অনুভূতি, হৃদয়ের গহিনে থাকা না–বলা কথার অক্ষরমালা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর যখন বিপ্লবী অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্ত পালিয়ে যাচ্ছেন, তখন অনন্ত সিংহ ব্রিটিশের হাতে ধরা না পড়ার জন্য উন্মাদের ছদ্মবেশ ধরলেন। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ফেণীর কাছে বারাহিপুর গ্রামে কয়েকজন বাচ্চা ছেলে তাঁকে তাড়া করে। নিরুপায় অনন্ত সিংহ আশ্রয় নিলেন একটি বাড়িতে। সেখানে এক কিশোরী অনন্ত সিংহকে সেবা, শুশ্রূষা করে, খাবার খাইয়ে নিরাপত্তা দিল। এরপর পেরিয়ে যায় বহু বছর। সেটা সত্তরের দশক। অনন্ত কাটাচ্ছেন জেল–জীবন। ওই ঘটনার উল্লেখ করে ‘চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ’র প্রথম খণ্ডে তিনি লিখলেন, ‘এই মধুর স্মৃতি আমার জীবনে একটি অপূর্ব সঞ্চয়।...সেদিনের হে অনামী, অখ্যাত, সামান্য বালিকা! তোমার মমতাপূর্ণ দরদী হৃদয়ের প্রতি সেই দিনই আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছি।... যদি কোনওদিন এই সামান্য ঘটনা তোমার মনে পরে, তবে জানবে উন্মাদ বেশে যে ক্ষণিকের অতিথি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল সে আর কেউ নয়,— ভারতের মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক— অনন্ত সিংহ।’ মেয়েটির নাম ছিল ঊষারানি নন্দী। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অনন্ত সিংহের এই লেখাটি ঊষারানির হাতে গিয়ে পড়ে। তখন ঊষারানি প্রৌঢ়া। তিনি অনন্ত সিংহকে নিজের পরিচয় দিয়ে একটি চিঠি লেখেন। দেখাও করতে যান তাঁর সঙ্গে। দীর্ঘ ছত্রিশ বছর পরে। ১৯৭৫ সালে। ঊষারানির লেখা চিঠিটা একটি ঐতিহাসিক চিঠি। বিপ্লবীদের চিঠি নিয়ে লিখতে বসলে এটাকে অস্বীকার করা যায় না। বিপ্লবী না হয়েও ঊষারানি যেন অজান্তেই বিপ্লবের ভাগীদার হয়ে গেছেন।
আর একজন ভগিনী নিবেদিতা। প্রত্যক্ষ বিপ্লবে যুক্ত না থেকেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীদের আপনজন। তাঁর কয়েকটি চিঠি পড়লে বোঝা যায় যে, বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে নিবেদিতার যোগ কতটা আত্মিক ছিল। একটি চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ফাঁসি সম্পর্কে তিনি র্যাডক্লিফ দম্পতিকে লিখছেন, ‘তোমরা কি জানো, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ফাঁসির আগে তাঁকে আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বৃদ্ধ শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়কে ডেকে পাঠানো হয়েছিল? ভাল কথা! ওই কাজটা তাঁকে করতে হয়েছিল গরাদের বাইরে দাঁড়িয়ে। পাঁচ থেকে ছয়জন ইউরোপীয় ও ভারতীয় ওয়ার্ডার ও কারারক্ষী তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সে সব শুনছিল। কানাইলাল দত্তের সম্পর্কেও অনুরূপ করার আবেদন তাঁকে করা হয়েছিল।... শাস্ত্রীমশাই নাকি বলেছিলেন, কানাইকে দেখলাম সে পায়চারি করছে— যেন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ। বহুযুগ তপস্যা করলে তবে যদি কেউ তাকে আশীর্ব্বাদ করার যোগ্যতা লাভ করতে পারে।’ নিবেদিতার মনে বিপ্লবীদের প্রতি কী অফুরন্ত ভালবাসা আর গভীর প্রত্যয় ছিল তা এই চিঠিতেই বোঝা যায়। র্যাডক্লিফ দম্পতিকে লেখা নিবেদিতার আর একটি চিঠিতে ধরা পড়েছে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তাঁর ঘৃণা এবং তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা। এখানে তিনি চারুচন্দ্র বসুর উল্লেখ করেছেন। যিনি আলিপুর বোমা মামলায় সরকার পক্ষের কৌঁসুলি আশুতোষ বিশ্বাসকে গুলি করে মেরেছিলেন। নিবেদিতা লিখেছিলেন, চারুর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পরও প্রতিদিন ইংরেজ পুলিশ সেলে ঢুকে চারুকে ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে চারু। এভাবেই তার কাছ থেকে আশুতোষ খুনের মূল চক্রীর নাম জানতে চাইছে পুলিশ। এর বিরুদ্ধে ঝলসে উঠেছিল নিবেদিতার কলম। কিন্তু আশ্চর্য, চারুর অবদানকে স্বীকৃতি জানালেও বারীন, উল্লাসকর, হেমচন্দ্র, উপেন্দ্রনাথ প্রমুখ বোমা মামলার অন্য অভিযুক্তরা কেউই তাঁদের স্মৃতিচারণায় নিবেদিতার কথা উল্লেখ করেননি!
বিবেকানন্দ যে তাঁর মনশ্চক্ষে ব্রিটিশ শাসনের ভয়াবহতা বহু আগেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা শিকাগোর বাসিন্দা মিস মেরি হেলকে ৩০ অক্টোবর ১৮৯৯–তে রিজলি ম্যানর থেকে লেখা একটি চিঠিই উজ্জ্বল প্রমাণ। সেখানে স্বামীজি লিখছেন, ‘ভারতবর্ষে কয়েক বছর ধরে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। ব্রিটিশ সৈন্য আমাদের পুরুষদের খুন করছে। মেয়েদের মর্যাদা নষ্ট করছে। বিনিময়ে আমাদের পয়সায় জাহাজে চড়ে দেশে ফিরছে পেনসন ভোগ করতে। ভয়াবহ নৈরাশ্যে আমরা ডুবে আছি। কোথায় সেই ভগবান? ... ধর এই চিঠিখানিই যদি তুমি প্রকাশ করে দাও —ভারতের নতুন কানুনের জোরে ইংরেজ সরকার আমাকে এখান থেকে সোজা ভারতে টেনে নিয়ে যাবে এবং বিনা বিচারে আমাকে হত্যা করবে।’
তবে অগ্নিযুগের সব থেকে বিস্ময়কর এবং আকর্ষণীয় চিঠির রচয়িতা অবশ্যই অরবিন্দ ঘোষ। শুধু লেখনীর গুণে বা বিষয় প্রাচুর্যে নয়। অরবিন্দ ঘোষের সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা চিঠি আজও গবেষকদের ভাবনায় আচ্ছন্ন করে। অরবিন্দের লেখা চিঠিপত্রের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মতিলাল রায়কে লেখা চিঠি। কে এই মতিলাল রায়? ১৯১০–এর ফেব্রুয়ারি মাসে রাতারাতি কলকাতা থেকে চন্দননগর চলে যান অরবিন্দ ঘোষ। আশ্রয় পান মতিলাল রায়ের বাড়িতে। যদিও মতিলালের সঙ্গে তাঁর তখনও কোনও পরিচয়ই ছিল না। চন্দননগরে যাঁর কাছে আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল অরবিন্দর, যে কোনও কারণেই হোক তিনি অরবিন্দকে আশ্রয় দিতে রাজি হন না। তখন আশ্রয়হীন অবস্থায় নৌকায় বসে থাকেন অরবিন্দ। ঠিক তখনই এই মতিলাল নিজের থেকে অরবিন্দকে ডেকে নিয়ে যান তাঁর বাড়িতে। আশ্রয় দেন। এক মাসেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন চন্দননগরে। তবে শুধু মতিলালের বাড়িতেই নয়। চন্দননগরে আরও তিন–চারটি গোপন ডেরায় ঘুরে ফিরে থাকতেন অরবিন্দ ঘোষ। এই সময়েই মতিলালের সঙ্গে অরবিন্দের একটা দৃঢ় রসায়ন গড়ে ওঠে। অরবিন্দ সরাসরি কাউকে কোনওদিন দীক্ষা দেননি। সেই সৌভাগ্য হয়েছিল একমাত্র মতিলাল রায়ের। একসময় অরবিন্দ ঘোষ মতিলালকে প্রস্তাব দেন যে, মতিলাল যেন পন্ডিচেরি চলে যান এবং শ্রীমা, অরবিন্দের সঙ্গে যোগসাধনা করেন। যদিও সেই প্রস্তাব গ্রহণ করা মতিলালের পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রথমে বিপ্লবী চিন্তাভাবনা থেকেই অরবিন্দকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মতিলাল। পরবর্তীতে দেখা গেল, অরবিন্দের আধ্যাত্মিক দর্শনের সঙ্গেও মিলেমিশে গেলেন তিনি। ১৯১০–এর এপ্রিলে অরবিন্দ চন্দননগর থেকে পন্ডিচেরি চলে যান। আর মে মাসে অরবিন্দ একটি চিঠি পাঠান মতিলালকে। সেই চিঠি খুলে মতিলাল দেখেন সেখানে একটি কাগজের মধ্যে পেন্সিল দিয়ে তিনটি মন্ত্র লেখা। এই তিনটি মন্ত্রই হল মতিলালের দীক্ষা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যেদিন এই চিঠি মতিলাল পান, সে দিনটা ছিল অক্ষয়তৃতীয়া। এই ঘটনার স্মরণে মতিলাল ১৯২৩ সাল থেকে চন্দননগরে অক্ষয়তৃতীয়া উৎসবের সূচনা করেন।
অরবিন্দ ঘোষের চিঠির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার করতেন। অনেকেই মনে করেন, পন্ডিচেরিতে যাওয়ার ফলে বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে অরবিন্দ ঘোষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সব থেকে বড় কথা, বাংলা ছেড়ে যাওয়ার পর ৪/৫ বছর সাধারণ মানুষ অরবিন্দের কোনও খোঁজই পাননি। কিন্তু পন্ডিচেরিতে গিয়ে এই মতিলাল রায়ের মাধ্যমেই তিনি বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের খুঁটিনাটি খোঁজখবর রাখতেন। আসলে পন্ডিচেরি থেকে কলকাতায় চিঠি আসা–যাওয়ায় অনেকগুলি মাধ্যম ছিল অরবিন্দর। প্রায় তিন– চারটি হাত ঘুরে এই চিঠি যাতায়াত করত পন্ডিচেরি থেকে কলকাতা বা কলকাতা থেকে পন্ডিচেরি। কোনও চিঠিতেই কিন্তু অরবিন্দ আসল নাম লিখতেন না। লিখতেন ‘কালী’। অনেক সময় দেখা গেছে তিনি নিজের নাম ‘কে’ বলেও উল্লেখ করেছেন। মতিলাল–অরবিন্দ কথোপকথনের এরকম ২৬টা চিঠির খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়াও অরবিন্দের লেখা বেশ কিছু ‘কোডেড লেটার’ মানে সাঙ্কেতিক চিঠি নষ্ট হয়ে গেছে। কীভাবে? ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে চন্দননগরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। মতিলাল রায়ের বাড়িতেও তল্লাশি হয়। তখনই অরবিন্দ ঘোষের লেখা একগুচ্ছ সাঙ্কেতিক চিঠি নষ্ট করে দেওয়া হয়।
সাঙ্কেতিক চিঠি এক অদ্ভুত জিনিস। ‘কোড’ বহুভাবে ব্যবহার করা হত। যেমন, ধরা যাক, লেখা হবে British। কিন্তু সঙ্কেতে লেখা হচ্ছে csjujti। কীভাবে ঘটছে ব্যাপারটা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে British–এর প্রত্যেকটি অ্যালফাবেটের ঠিক পরেরটি লেখা হয়েছে। B না লিখে C, R না লিখে S, I না লিখে J, T না লিখে U, I না লিখে J, S না লিখে T, এবং H না লিখে I। এটা যেমন একটা করে অক্ষর ছেড়ে লেখা, ঠিক তেমনই দুটো বা তিনটে করে অক্ষর ছেড়ে লেখাও দেখা গেছে চিঠিপত্রের মধ্যে। অনেক সময় আবার ‘কোড’ হিসেবে ১,২,৩,৪ –এর মতো সংখ্যাও ব্যবহার করা হয়েছে। অরবিন্দ ঘোষের চিঠিতে কখনওই কোনও তারিখের উল্লেখ পাওয়া যেত না। মতিলালকে লেখা তাঁর প্রত্যেকটি চিঠিতে মতিলালের নামের জায়গায় ‘এম’ শব্দ ব্যবহার করতেন।
পন্ডিচেরিতে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকটা বছর ভীষণই অর্থকষ্টে কাটিয়েছিলেন অরবিন্দ। খিদে মেটানোর জন্য সামান্য ভাত জোগাড় করাটাই তখন তাঁর কাছে দুরূহ হয়ে উঠেছিল। তখন নিয়মিতভাবে মতিলাল রায় তাঁকে অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। তাতেও মাঝে মাঝে অরবিন্দ মতিলালকে টাকার জন্য রীতিমতো তাগাদা দিতেন। এমনও চিঠি আছে যেখানে অরবিন্দ লিখছেন ‘আমার তহবিলে মাত্র ৫০টি পয়সা রয়েছে’। এরকমই একটা সময় মতিলাল চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে অরবিন্দর জন্য অর্থসাহায্য চান। তখন চিত্তরঞ্জন বলেন, অরবিন্দ যদি তাঁর ‘সাগরসঙ্গীত’ কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেন তবে তিনি তাঁকে ১০০০ টাকা দেবেন। এর পেছনে চিত্তরঞ্জনের একটা সূক্ষ্ম আইনি বুদ্ধি কাজ করেছিল। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, বই অনুবাদ বাবদ টাকা দিলে কখনওই ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীকে সরাসরি সাহায্য করার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করতে পারবে না। এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান অরবিন্দ। মিত্রাক্ষরে এবং অমিত্রাক্ষরে দু’প্রস্থ অনুবাদও করে দেন। এই বইয়ের অনুবাদকে কেন্দ্র করেও প্রিয় ‘এম’কে সাঙ্কেতিক চিঠি লিখেছেন অরবিন্দ। একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন—‘সি আর দাশকে আমি একটা চিঠি এর সাথে পাঠাচ্ছি। তিনি পান্ডুলিপি পেয়েছেন কিনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমায় জানাও। ঐ সঙ্গে অবশ্যই প্রচলিত ফরমুলা অনুযায়ী তুমি তোমার পশ্চিম ভারতীয় বন্ধুটির ঠিকানা আমাকে পাঠাও যা তুমি তোমার শেষ চিঠিতে দাওনি। প্রকাশনার সর্বশেষ পর্যায়ে যদি কোন অসুবিধার সন্মুখীন হই তবে তোমার ঐ বন্ধুটি কতখানি সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে বলে তুমি আশা করো অনুগ্রহ করে জানিও।...’ এই যে ‘প্রচলিত ফরমুলা’ এটাই হল কোড। ‘পশ্চিম ভারতীয় বন্ধু’ আসলে কোনও বিপ্লবী। তাঁর নাম উল্লেখ করলে তিনি যদি ধরা পড়ে যান, তাই এই ‘প্রচলিত ফরমুলা’ শব্দটির অবতারণা। তা ছাড়া ‘প্রকাশনার সর্বশেষ পর্যায়ে যদি কোন অসুবিধার সন্মুখীন হই’ লাইনটিও সাঙ্কেতিক বলে মনে হয়। এখানে ‘প্রকাশনা’ শব্দটি দিয়ে খুব সম্ভবত অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন অরবিন্দ।
অন্য একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘প্রুফগুলি পাঠাচ্ছি। নারায়ণের বেড়ানোর খরচ বাবদ তোমার পাঠানো ৫০ টাকা যথাযথভাবে পৌঁছেছে এবং সে ঠিকঠাক তা খরচ করেছে। সে কথা দিয়েছে ঐ টাকা ফেরৎ দেবে, কিন্তু কখন সে সেটা করতে পারবে আমি জানি না।’ এটিও একটি সাঙ্কেতিক চিঠি। এখানে নারায়ণ কে? তাঁকে বেড়ানোর জন্য কেনই বা মতিলাল ৫০ টাকা দিতে যাবেন? তখন অরবিন্দের যাঁরা অনুগামী বা পার্শ্বচর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে নারায়ণ নামের কেউ ছিলেন না। আসলে নায়ারণও সম্ভবত একটা কোড। অরবিন্দ নিজের পরিচয় দিতেন কালী বলে। তা হলে যিনি কালী তিনিই কি নারায়ণ? মনে হয় অরবিন্দই গোপনে পন্ডিচেরি থেকে মাদ্রাজ বা অন্য কোথাও কোনও বিপ্লবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেই জন্যই ৫০ টাকা দিয়েছিলেন মতিলাল রায়। আসলে এই লেখাগুলির কোনও ব্যাখ্যা তো নেই। পাঠককে কেবলমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হবে। এরপরেই আর একটি জায়গায় অরবিন্দ লিখছেন—‘এবারে আমি বইগুলি পাঠানোর ব্যাপারে তোমায় কিছু লিখছি না। কারণ,ওটা একটা দীর্ঘ ব্যাপার। প্রুফগুলি পাঠানোর ব্যাপারে বিলম্ব হবে, যা কিনা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে।’ এই চিঠিটা পড়লে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই লোকে ভাবছে যে, চিত্তরঞ্জন দাশের বই এবং তার প্রুফের কথাই লিখেছেন অরবিন্দ। কিন্তু আদৌ তা নয়। এটা বইও নয়। প্রুফও নয়। পুরো ব্যাপারটাই অস্ত্রকেন্দ্রিক। ‘যুগপুরুষ শ্রীঅরবিন্দ’ নামে মতিলাল রায়ের লেখা একটি বই আছে। সেখানে মতিলাল রায় লিখেছেন, পন্ডিচেরি ছিল ফ্রি পোর্ট। সেখানে যাঁরা বসবাস করতেন, তাঁরা নির্দ্বিধায় ভিপির মাধ্যমে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারতেন। চন্দননগরের বিপ্লবীরা এই নিষেধহীন ব্যবস্থাটাকে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। মতিলাল রায় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বইতে তার উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন—‘আমার বিপ্লবী সহযোগীগণ ঠিক করিলেন, পন্ডিচেরি হইতেই রিভলবার আনা হইবে। ইহার ব্যবস্থার ভার বন্ধুরা আমার উপর অর্পণ করিলেন। আমায় বাধ্য হইয়াই এই বিষয়টি শ্রীঅরবিন্দকে জানাইতে হইল। তাঁহাকে ৬টি রিভলবার ক্রয় করিবার জন্য নিবেদন করিলাম। অরবিন্দ আমার দাবী অপূর্ণ রাখিলেন না। কিন্তু স্বাভাবিক সতর্কতার বশে রিভলবারগুলি হস্তগত হইলে তাহা তিনি মাটিতে পুঁিতয়া রাখার ব্যবস্থা করিলেন। সেইগুলি আমাদের নিকট পাঠাইবার সুযোগ বহুদিন মিলিল না। পন্ডিচেরিতে অনেক বন্ধু তিনি পাইয়াছিলেন। কিন্তু তাহাদের নিকট তিনি যে তথায় যোগ সাধনার নিমিত্তই আসিয়াছেন সেই কথাই বলিতেন। বাংলার বিপ্লবীদের সহিত তাঁহার যে সংযোগ থাকিতে পারে সে কথা তিনি একেবারেই গোপন রাখিয়াছিলেন। প্রায় এক বৎসর পরে শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে দিয়া ওই রিভলবারগুলি অতি সন্তর্পনে ও সুকৌশলে লইয়া আসা হয়।’ এই শচীন্দ্রনাথ সান্যালের ইচ্ছে ছিল অরবিন্দের সঙ্গে পন্ডিচেরিতে যোগ সাধনা করবেন। কিন্তু অরবিন্দ তাঁকে পন্ডিচেরিতে আশ্রয় দেননি। শচীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চন্দননগরে, মতিলাল রায়ের কাছে। সুতরাং, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল যখন চন্দননগরে আসেন তখন ওই রিভলভারগুলি তাঁর হাত দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।
এরকম ‘কোডেড লেটার’ অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের লেখা অজস্র রয়েছে। যেমন প্রফুল্ল চাকীর লেখা একটি সাঙ্কেতিক চিঠি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রফুল্ল চাকী আর ক্ষুদিরাম কিংসফোর্ডকে মারার জন্য একসঙ্গে মজফ্ফরপুর যান। প্রফুল্ল চাকী ছদ্মনামে হন দীনেশচন্দ্র রায়। আর ক্ষুদিরাম হলেন দুর্গাদাস সেন। ক্ষুদিরাম জানতেনই না যে তাঁর সঙ্গে যিনি যাচ্ছেন তাঁর নাম প্রফুল্ল চাকী। তিনি জানতেন দীনেশচন্দ্র রায়ই তাঁর সহযোগী। পরবর্তীকালে কোর্টে যে জবানবন্দি ক্ষুদিরাম দিয়েছিলেন, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি প্রফুল্ল চাকীকে দীনেশ নামেই সম্বোধন করেছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রথমবারেই কিন্তু কিংসফোর্ডকে মারার জন্য বোমাটা ছোঁড়া হয়নি। তার আগেও ওঁরা একবার মজফ্ফরপুর গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা যাবতীয় খোঁজখবর নেন। যেমন কিংসফোর্ড কোথায় থাকেন, তাঁর বাংলোটা কীরকম, কোন পথে প্রতিদিন যাতায়াত করেন ইত্যাদি। প্রথমবার তাঁরা যখন মজফ্ফরপুর যান, তখন সেখান থেকে প্রফুল্ল চাকি অদ্ভুত সাঙ্কেতিক একটি চিঠি লিখেছিলেন বারীন ঘোষকে। কারণ, সে সময় বারীন ঘোষই ছিলেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকিদের নেতা। চিঠিটা ছিল এরকম—‘প্রিয় সুকুদা (বারীন ঘোষের ডাকনাম), বর দেখিনি। কিন্তু বরের বাড়ি দেখিয়াছি। বাড়িটি দেখিতে খুব সুন্দর। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখানে ভালো রসগোল্লা পাওয়া যায় না। কিছু ভালো রসগোল্লা পাঠাতে ভুলিবেন না।’ এখানে বর কে? যাঁকে মারতে তাঁদের মজফ্ফরপুর যাওয়া। অর্থাৎ কিংসফোর্ড। কিংসফোর্ডকে তখনও পর্যন্ত দেখতে পাননি। কিন্তু তাঁর থাকার বাংলোটি দেখে এসেছেন। ওখানে ভাল রসগোল্লা পাওয়া যায় না। ‘রসগোল্লা’ কী? সোজা কথায় বোমা।
এরকম আর একটা চিঠি উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের লেখা। কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় যে চারজনের ফাঁসি হয়েছিল, তার মধ্যে রামপ্রসাদ একজন। রেল ডাকাতি হয়ে যাওয়ার পর এঁরা সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। সেখান থেকেই বিসমিল লিখছেন, ‘আমি ভাল আছি। সম্ভবত আপনার মনে থাকবে যে, আমাদের পিতামহের শ্রাদ্ধশান্তি এ মাসের ১৩ তারিখে (রবিবার) হবে। এতে আপনার উপস্থিতি একান্ত কাম্য।’ বিপ্লবী সহকর্মীদের এই হাতচিঠি বিলি করা হয়েছিল। আসলে কাকোরি রেল ডাকাতির পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য বিপ্লবীরা বৈঠকে বসেন। সে কথাই চিঠির সাঙ্কেতিক ভাষার মধ্যে দিয়ে বলা হয়েছিল। ব্রিটিশের হাতে যদি চিঠি পড়ে তা হলে হঠাৎ এর মর্মবস্তু উদ্ধার সম্ভব হবে না। এটাই সাঙ্কেতিক চিঠি লেখার কারণ। এককথায় ব্রিটিশ সরকারের শ্রাদ্ধশান্তির জন্য সব বিপ্লবীদের একসঙ্গে হওয়ার ডাক।
এছাড়াও বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র জোয়ারদারের একটি চিঠিকেও ‘কোডেড লেটার’ হিসেবেই উল্লেখ করতে চাই। এই চিঠি পড়লে মনে হবে, বাংলা সাহিত্য পাঠ করছি। চিঠিটি বক্সা স্পেশাল জেল থেকে লেখা। তারিখ ১৮.৭. ১৯৪৪। লেখা হয়েছে ‘প্রিয়বরেষু ভাই ‘মি’ বাবু। রাজার বাগানের মালি, কাঙালী সারাদিন হাজারো রকমের ফুল গাছের যত্ন করে বেড়াবে, সন্ধ্যাবেলায় ভাবে কোন্ চারাটিকে কাল কিভাবে ক্ষিদমত করবে। রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে, গাছে গাছে বসে গেছে ফুলের মেলা। কনক চাপা সবার মাথার উপর মাথা জাগিয়ে আত্মপ্রচারে মুখর করে তুলেছে আকাশ বাতাস। আর শেফালী ধুলার বুকে লুটিয়ে পড়ে বাগান তলে একে দিয়েছে দিব্য এক আলপনা।’ এটাও কি কোনও ‘কোডেড লেটার’? ‘রাজা’টি কে? এই চিঠির মধ্য দিয়ে তিনি কি অন্য কোনও বক্তব্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন? দেখে মনে হচ্ছে আপাদমস্তক সাহিত্যিক চিঠি। কিন্তু পেছনে কিছু লুকিয়ে নেই তো? হতে পারে ‘রাজা’ এখানে ব্রিটিশ। ‘মালি’, ‘কাঙালী’ হয়তো ব্রিটিশ কর্মচারী। আর ‘ফুল’–এর অনুষঙ্গে হয়তো আছেন বিপ্লবীরা। তা ছাড়া, শুধুমাত্র সাহিত্য করার জন্য জেল থেকে চিঠি লিখছেন কোনও বিপ্লবী, এটা যথেষ্ট অসঙ্গত বলে মনে হয়েছে। আবার চিঠির শেষে লেখা হচ্ছে, ‘কী পরিমাণ হেঁয়ালিটাই হয়ে গেল!’ সুতরাং এই চিঠিতে সাঙ্কেতিক ভাষা থাকাটাই স্বাভাবিক।
এ প্রসঙ্গে আর একজনের কথা না বললে অন্যায় হবে। তিনি যতীন্দ্রনাথ দাস। ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে যে বোমা ছুঁড়েছিলেন খুব সম্ভবত সেগুলি ছিল যতীন দাসেরই বানানো। একসময় যতীন দাস গ্রেপ্তার হন এবং অনশন শুরু করেন। সেটা ১৯২৯। যদিও ১৯২৫ সালেও একবার অনশন করেছিলেন তিনি। রাজবন্দি মর্যাদার দাবিতে লাহোর জেলে ১৯২৯–এ অনশন শুরু করেছিলেন ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, যতীন দাস। পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকার কিছুটা নমনীয় হলে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর অনশন তুলে নেন। কিন্তু একরোখা যতীন দাস তা করলেন না। তাঁর মত ছিল প্রতিটি দাবি ব্রিটিশকে মানতে হবে। ৬৩ দিন অনশন চালিয়েছিলেন। পরে নল দিয়ে জোর করে খাওয়ানোর সময় শ্বাসনালিতে খাবার আটকে লাহোর জেলে যতীন দাসের মৃত্যু হয়। ১৯২৮ সালের ৮ জুলাই কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে বাবাকে লেখা যতীন দাসের চিঠিটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। লিখছেন ‘পাঞ্জাবের জেল হইতে অদ্য আমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছে। ... আমাকে বোধ হয় শীঘ্রই হয় খালাস করিয়া দিবে, না হয় কোনও গ্রামে নজরবন্দী করিয়া রাখিবে। আমি যত শীঘ্র বাড়ী যাইতে চেষ্টা করিব। ... কিরণ যদি আসিয়া থাকে ত’ অবিলম্বে আমার সহিত যেন সাক্ষাৎ করে। ইতি খেঁদু।’ কিন্তু তাঁকে ছাড়া হয়নি। বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যায়। প্রেসিডেন্সি থেকে তাঁকে আবার লাহোর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘কিরণ’ যতীন দাসের ছোট ভাই। আর ‘খেঁদু’ তাঁর ডাকনাম।
এভাবেই কত চিঠি ফিসফিস করে কত কথা বলে যায় কানে কানে। কোনওটা বোঝা যায়। আবার কোনওটা বা আমাদের বোধগম্যের অতীত। যেখানে লুকিয়ে থাকে বিপ্লবীদের চিন্তাভাবনা, তাঁদের জীবন দর্শন, জীবনবোধ, বৈপ্লবিক পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য, তাঁদের পাওয়া–না পাওয়ার হিসেব নিকেশ, তাঁদের সাধনা। এ রকম আরও কত কী। আর সবথেকে বেশি যেটা থাকে সেটা হল এক আকাশ স্বপ্ন। ‘সেই সব স্বপ্ন এখনও বাতাসে উড়ে বেড়ায়,/ শোনা যায় নিশ্বাসের শব্দ/ আর সব মরে,/ স্বপ্ন মরে না—’।
কৃতজ্ঞতা: আজকাল