ইরাবতী শিশুতোষ: হাসির তারকা বীরবল ও তার দশটি গল্প
ভারতের উত্তর প্রদেশে ১৫২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন বীরবল। মূল নাম মহেশ দাস হলেও বীরবল নামেই তিনি পরিচিত। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে অন্যতম সভাসদ ছিলেন। চতুরতার জন্যই বীরবল মূলত সবার কাছে সুপরিচিত। ১৫৫৬-১৫৬২ সালের দিকে কবি ও গায়ক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তীতে সম্রাটের অত্যন্ত কাছের মানুষে পরিণত হন এবং নানা সেনা অভিযানে অংশ নেন। যদিও তিনি এই বিষয়ে কোনো রূপ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। ১৫৮৬ সালে সম্রাট তাকে ভারতের উত্তর-দক্ষিণ দিকে অভিযানে (বর্তমান আফগানিস্তান) পাঠান। কিন্তু এই অভিযানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে বিদ্রোহী উপজাতিদের আক্রমণে বহু সৈন্যসহ বীরবল মৃত্যুবরণ করেন। আকবরের শাসনামলের শেষের দিকে তাঁর ও বীরবলের মধ্যকার মজার ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে এসব কাহিনী পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় হয়।
সম্রাটের যোগী তোতা
একদিন এক কৃষক এলেন সম্রাট আকবরের দরবারে। সঙ্গে একটি তোতা পাখি। সম্রাটকে কুর্নিশ করে তিনি বললেন, ‘মহামান্য সম্রাট, এই তোতাটি খুব সুন্দর করে কথা বলতে ও গান গাইতে পারে। আমি হুজুরের জন্য এটি উপহার হিসাবে এনেছি।’
খুশি হয়ে তাকে প্রচুর উপহার দিলেন সম্রাট। তোতাটিকে প্রাসাদের অন্দরে নিয়ে গেলেন। সম্রাটের নির্দেশে খাঁচায় রাখা হলো পাখিটিকে। দু’জন ভৃত্য নিযুক্ত হলো তোতা পাখির তত্ত্বাবধানে। সম্রাট হুকুম জারি করলেন, ‘তোতার খুব যত্ন করবে। এইটাই এখন তোমাদের একমাত্র কাজ। মনে রেখো, যে আমার কাছে তোতার মৃত্যু সংবাদ আনবে, তারই মৃত্যুদন্ড হবে।’
সম্রাটের আদেশ শুনে ভৃত্যদ্বয়ের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তারা তোতা পাখিটিকে খুবই যত্নের সঙ্গে খাওয়াতে এবং যত্ন করতে শরু করল। মাঝে মধ্যে সম্রাটকে দেখিয়েও আনে। কিন্তু সব সময় একটা দুশ্চিন্তা কাজ করত তাদের মাথায়। যদি তোতা পাখিটা মারা যায়? তাহলে তো সর্বনাশ! এই ভেবে তাদের নাওয়া, খাওয়া, ঘুম সব হারাম হয়ে গেল!
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভৃত্যদ্বয় দেখল, তোতা পাখিটি সত্যিই মারা গেছে! এ তো মহা বিপদ! কী করা যায় ভাবতে ভাবতে এক ভৃত্যের মনে পড়ল বীরবলের কথা। সঙ্গে সঙ্গে দুই ভৃত্য ছুটে গেল বীরবলের কাছে। বীরবল সব শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে, যা করার আমি করব। কোনো ভয় নেই তোমাদের।’
এর কিছুক্ষণ পর দরবারে এসে হাজির হলেন বীরবল। সম্রাটকে বললেন, ‘জাঁহাপনা, আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে!’
‘কী দুঃসংবাদ?’
‘মানে, আপনার প্রিয় তোতা পাখিটা দানাপানি কিছু খাচ্ছে না। এমনি কি ডানা পর্যন্ত ঝাপটাচ্ছে না। চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করছে।’
‘বলো কী!’ কাতর কণ্ঠে বললেন সম্রাট।
‘হ্যাঁ জাঁহাপনা।’ বীরবল বললেন, ‘সম্ভবত ভগবানের কৃপায় তোতা পাখিটা যোগী হয়ে গেছে।’
সম্রাট দুঃখিত মনে বললেন, ‘কী আর করা! ওকে ছেড়ে দাও। বনে গিয়েই ধ্যান করুক।’
কিন্তু খাঁচা থেকে যখন তোতা পাখিটাকে বের করে আনা হলো, অমনি সম্রাট বুঝে ফেললেন বীরবল তাকে ঠিক কথা বলেননি। তিনি ভীষণ রেগে বললেন, ‘বীরবল, তুমি এত বড় মিথ্যা বললে? এমন তামাশা করতে পারলে আমার সঙ্গে? যোগী-টোগী কিছু না, তোতা তো মরে গেছে দেখছি!’
‘আপনি কিন্তু প্রথম তোতার মৃত্যু সংবাদটি নিজেকে জানালেন, সম্রাট।’ বললেন বীরবল।
‘তাতে কী! কী বলতে চাও তুমি?’ সম্রাট স্থম্ভিত।
‘জাঁহাপনা, আপনি বলেছিলেন আপনার কাছে যে প্রথম তোতা পাখির মৃত্যু সংবাদ আনবে, তারই মৃত্যুদন্ড হবে। আপনার ভৃত্যরা এই ভয়ে আপনাকে তোতার মৃত্যুর খবরটি দিতে পারছিল না। তারা আমার কাছে এলো সাহায্যের জন্য। তাই বাধ্য হয়েই এটুকু চালাকির আশ্রয় আমাকে নিতে হলো মহামান্য সম্রাট। এখন আশা করি আপনি আপনার কথায় অটল থাকবেন। এ দুই ভৃত্যের কেউ কিন্তু আপনার কাছে তোতার মৃত্যু সংবাদ আনেনি। আপনি নিজেই প্রথম তোতার মৃত্যু সংবাদ জানালেন।’
বিচক্ষণ সম্রাট বীরবলের এই বুদ্ধিমত্তায় বেশ খুশি হলেন এবং বললেন, ‘সত্যিই বীরবল, তোমার বুদ্ধির তুলনা হয় না। আমি নির্বোধের মত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর তুমি বুদ্ধি করে দু’জন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছ। তোমার তুলনা কেবল তুমিই বীরবল।’
পেটুক সম্রাট
প্রাসাদের বারান্দার বসে একদিন সম্রাট আকবর বেগমকে নিয়ে আম খাচ্ছিলেন। আমের খোসা আর আঁটি জমা হচ্ছিল বেগমের পাশে। এমন সময় সেখানে এলেন বীরবল (Birbal)। সম্রাটের খাসমহলে তার অবাধ যাতায়াতের অনুমতি ছিল।
বীরবলকে দেখেই সম্রাট বললেন, ‘দেখো বীরবল, বেগম কী পেটুক! ওর পাশে কতগুলো আমের খোসা আর আঁটি, দেখেছ?’ বলেই তিনি খুব হাসতে লাগলেন।
এদিকে বেগম তো চটে লাল। বীরবল তা লক্ষ্য করে বললেন, ‘আসলে বিষয়ে হচ্ছে কি মহামান্য সম্রাট, সতীসাব্ধী স্ত্রীরা চিরদিনই স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকেন। কাজেই বেগম সাহেবার কোনো দোষ নেই।’
‘তার মানে তুমি আমাকেই পেটুক বলতে চাইছ? কিন্তু অবস্থা দেখেও কি কিছু বুঝতে পারছ না বীরবল? ওর পাশে খোসা ও আঁটি জমেছে কতগুলো দেখো ভালো করে। কিন্তু আমার পাশে একটিও নেই।’ বললেন সম্রাট।
‘সে জন্যেই তো বলছি সম্রাট।’ বীরবল (Birbal) বলতে লাগলেন, ‘বেগম সাহেবা কেবল আমের রসসহ শাঁস খেয়েছেন। আর আপনি তো খোসা আর আঁটিও বাদ দেননি। যথার্থ পেটুকের মত সব চেটেপুটে খেয়েছেন! নয়তো আপনার খাওয়া আমের খোসা এবং আঁটি গেল কই?’
বেগম এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ঠিক ধরেছ বীরবল, আমি সরিয়ে রেখেছি বলেই তো ওগুলো আর খেতে পারেনি।’
বীরবলের উপস্থিত বুদ্ধিতে সম্রাট একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। বেগম আর বীরবল সম্রাটের অবস্থা দেখে হেসে উঠলেন এক সঙ্গে।
‘আসলে বিষয়ে হচ্ছে কি মহামান্য সম্রাট, সতীসাব্ধী স্ত্রীরা চিরদিনই স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকেন। কাজেই বেগম সাহেবার কোনো দোষ নেই।’
বীরবলের আটটি গল্প
৮
বীরবলের ভাইপোও কাকার উপযুক্ত বটে। কেউ কম নয়।
সম্রাটের আনুকূল্যে বীরবল পাকাবাড়ি তুলেছিল। পাকাবাড়ি শেষ হওয়ার পর, বীরবল একদিন তার নতুন তৈরি পাকাবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের কুঁড়েঘরবাসী ভাইপোকে বলল, ‘ওরে শামু, বাড়ির ভেতর বসে কী করছিস রে?’
ভাইপো শামু বাড়িতেই ছিল, সে কাকার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করল না। সে জানত, নতুন বাড়ি দেখাতেই কাকা তাকে ডাকছে।
এক বছর পর বীরবলের ভাইপো একটা পাকাবাড়ি তৈরি করে, সেই নতুন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগল, ‘ও কাকা, কাকা, গত বছর তুমি আমায় ডেকেছিলে কেন?’
বীরবল (Birbal) বসে বসে ভাবল, ভাইপো লায়েক হয়েছে। কাকার মনের কথা ঠিক ধরতে পেরে, ঠিক সময়েই জবাব দিয়েছে বটে!
