| 11 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: অন্যদিনের গল্প । বিষ্ণু সরকার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

যখন ঘুম ভাঙল রৌদ্রর মনে হল বাইরে বেশ সকাল। চারদিকে আলোটুকুও ভালো করে ফোটেনি। সেই অল্প আলোতে কেমন ঝাপসা বাইরের প্রতিদিনের চেনা রূপ। অথচ কী চৎমকার তার আড়মোড়া ভেঙে এই জেগে ওঠা। যে সকালটা রৌদ্রর কখনই দেখা হয় না।

আসলে এত সকালে ঘুম ভাঙে না রৌদ্রর। সল্টলেকের অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। ঘুমতে ঘুমতে আরও রাত।একটা মল্টিন্যাশনাল কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে রৌদ্র। মাঝে মধ্যেই দিল্লি-মুম্বাই করতে হয় ওকে। কোন কোন মাসে একবার-দুবার মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর। এর বাইরেযে কদিন কলকাতায় থাকা, প্রতিদিনের রুটিন অভ্যেস বলতে অফিসের গাড়িতে চেপে বেহালার বাড়ি থেকেওই যাওয়া-আসা। এর বাইরে মাপা আর গুছিয়ে চলা জীবনে এতটুকু উদ্বৃত্ত সময় পায় না রৌদ্র।

যদিও আজ যখন ঘুম ভাঙল ওর এবং সচেতনভাবেই মনে হল এখন বেশ সকাল। ঘড়ির কাটার দিকেএকবার চোখ ফিরিয়েও সোজা উঠে এসে দাঁড়ালখোলা জানলাটার সামনে। এখন আরও কয়েক ঘণ্টা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা যেত। কিন্তু বাইরে ভোরবেলার এই সতেজ ভাব, দিন শুরুর মুহূর্তে ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকা আলো,ক্রমশ সেই সব আলোর ছড়িয়ে যাওয়া,দূরে কোথাও পাখির ডাক—সবকিছু দেখে শুনে মনে হল, এখনই বেড়িয়ে পড়া দরকার।

আর বাইরে বেড়িয়ে পড়তেই রৌদ্রর এই অপরিচিত সকালটাকে ঘিরে এক অদ্ভূত অনুভূতি শুরু হল। ফাঁকারাস্তা জুড়ে এই সময় যে কজন মানুষ প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েছে, যাদের সঙ্গে এতটুকু পরিচিত নয় সে, তাদের মত করেই হাঁটতে শুরু করল ও।আর হাঁটতে গিয়েই টের পেল,যে রাস্তাটা দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে, সেই চেনা রাস্তাটাও কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে। রৌদ্র দেখল গতরাতে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ধুয়ে যাওয়া পিচরাস্তা আর সেই রাস্তাকে ঘিরে দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলি, তার সামনের গাছগুলি পর্যন্ত স্নান সেরে কেমনসুন্দর সাজপোশাকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।এতক্ষণ মাথার উপরে জ্বলতে থাকা লাইট পোস্টের গত রাতের আলো,সেই আলোছায়ায় বন্ধ দোকানগুলোর সামনে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে হলুদ ট্যাক্সিরা।গত রাতের যানজট আর ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় কাটিয়েহাঁপিয়ে ওঠামোড়টা এখন কেমন ফাঁকা শূন্য হয়েগভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

রৌদ্রঠিক এই মোড়টাতেই এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।এখান থেকে গন্তব্য চলে গেছে এক এক দিকে।লাল সিগনাল সবুজ হলেই যে যার গন্তব্যে ছুট লাগাবে। এত ব্যস্ত মোড় অথচ সকালের এই দারুণ নির্জনতায় কেমন অন্য পথের দিশা দিতে চাইল আজ।রৌদ্র পেট্রোল পাম্প, জুয়েলারি শোরুম, প্যাথোলজি সেন্টারকে পাশ কাটিয়ে বিপরীত দিকেরগলিতে ঢুকে পড়ল।এই গলিটা শৈশবের। ঝর্ণা মাসির গানের স্কুল।ছুটির বিকেলে গান শিখতে আসত রৌদ্র।পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণের দিননতুন করে সেজে উঠত স্কুল চত্বর। কত গান, কত কবিতা, কত নাটক। কত মানুষ এসে ভিড় জমাতো সে-সব দেখতে, শুনতে। যেদিন হঠাৎ করেই ঝর্ণা মাসির স্কুলটা উঠে গেল, তারপর তো কতদিন এদিকটায় এসে স্কুলটাকে বারবার খুঁজতে চেয়েছিল রৌদ্র। কিন্তু ততদিনে সেই জমি ঘিরে গুড়িয়ে যাওয়া স্কুল বাড়িটা মুছে গিয়ে তরতরিয়ে উঠে গেছিল নতুন ফ্ল্যাট বাড়িটা। সেই বাড়িটে ঘিরে ধরেছিল আরও উঁচু পাঁচিল।

ঝর্ণামাসি মারা যাওয়ার খবরটা পেয়ে সেদিন রৌদ্রর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলএকটা মুখ। যার গা ঢেকে রাখা অজস্র ফুল আর সাদা রঙের মালা। রৌদ্রর কেন জানি মনে হয়েছিল ঝর্ণামাসির সেই শুয়ে থাকা শরীরটাকে ঘিরে ধরে সকলেই দাঁড়িয়ে আছে শুধু গান শোনাবে বলে। গান শোনাতে শোনাতে ঝর্নামাসিকে নিয়ে যাওয়া হবে শেষযাত্রায়।

সেদিনের পর থেকে রৌদ্র আর চায়নি সেই উঁচু পাঁচিলটার সামনে এসে দাঁড়াতে। এমনকি সকাল হলে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে রেওয়াজ। শুধু ঝর্ণামাসির কথা ভেবেই হয়তো অত সকালে গান গাইতে গাইতে চোখের জল ফেলা।একদিন দেখে ফেলেছিল মা। রৌদ্রর বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠেছিল সেইবার।

আজ একবার কেন জানি সেইস্কুল বাড়িটাকেইখুঁজতে চাইল রৌদ্র। খুঁজতে চাইল সেই ভেসে আসা সুর। সেই শৈশবকাল।কিন্তু বাড়ি কোথায়? এদিকে আজ যা কিছু দেখছে রৌদ্র, সবকিছুই নতুন আর অচেনা মনে হচ্ছে ওর। অচেনা মনে হচ্ছে এই চারপাশের ঘরবাড়ি, ঘরবাড়িগুলোকে ঘিরে ধরাউঁচু উঁচু দেওয়াল। ভেতরেঅজস্র দেওয়াল আর খোপ কাটাদরজা-জানালা-পর্দার ভিড়ে থমকে দাঁড়ানো সময়। থমকেযাওয়াসেই সেদিনেরহারানো সুর।

রৌদ্র আজ পুরনো স্মৃতিকে পিছনে ফেলে আরও এগিয়ে যেতে চাইল।আরও এগিয়ে সেই ছেলেবেলায়।ওর সামনে এসে দাঁড়াল দক্ষিণপল্লী উচ্চ বিদ্যালয়।বাবার হাত ধরে প্রথম এই স্কুলেএসেছিল রৌদ্র। তিনতলা সাদা বাড়িটার দোতলায় ছিলক্লাস ঘর। অবনীমাস্টার তখন হেডস্যার। কড়া মেজাজের মানুষ। রৌদ্রর মনে পড়ছে, একবার অঙ্কে ভুল হওয়ায় অবনীমাস্টারের ধমক খেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলসে। পরে অবশ্য সেই স্যারের মেজাজটাই কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল। অবসর নেওয়ার পর একদিক হঠাৎ দেখা হওয়ায় কেমন থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।কেমন গুটিয়ে যাওয়া মানুষ। সেই সঙ্গে স্যারের গলায় তখন কি আকল্পনীয় বিনয়। বলেছিল, একদিন বাড়িতে আসতে। আর যাওয়া হয়নি রৌদ্রর। তার কয়েক বছর পরেই তো স্যারের মৃত্যু সংবাদ।

আরও এগিয়ে যেতেচাইল রৌদ্র। আরও এগিয়ে সেই বিবেকানন্দ সায়েন্স কলেজ।গেট পেরিয়ে চওড়া উঠোনে। সোজা অফিস রুম আর বাঁদিকে ক্লাস ঘর ফেলে রেখে আরও এগিয়ে যাওয়া। প্রিয় রতনদার ক্যান্টিন, কমনরুম। সহেলির সঙ্গে এখানেই প্রথমবার দেখা হয়েছিল ওর। প্রথম প্রেম। সেই তরুণ বয়সের কেঁপে ওঠা বুকের শব্দটা এখনও টের পায় রৌদ্র। তারপর তো কতদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়েক্যান্টিনে বসে খাওয়া দাওয়া, কমনরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আড্ডা আর হাতে হাত ধরে ছাতিম গাছের তলায় কাটিয়ে দেওয়া দুপুর।ফাইনাল ইয়ারপেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই রৌদ্রর চাকরিতে জয়েন আর তার ঠিক বছর দুয়েকের মাথায় সহেলিকে বিয়ে করে বেহালার বাড়িতে নিয়ে আসা।

রৌদ্রর উজ্জ্বল ও সফলকেরিয়ার জীবনকে ঘিরে মনখারাপের তেমন কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু এতদিন পর আজ কেন জানিরৌদ্রর মন খারাপ লাগছে ভীষণ। মন খারাপ লাগছেসেইসকাল থেকে বেড়িয়ে ফেলে আসা এতটা পথ পেরিয়েএখনওঝিঙ্কিকে একবারও খুঁজে না পেয়ে।অথচ কেউ না জানুক, সে জানে এই ঝিঙ্কির জন্যই আজ সারাটা সকালসে কতটা পথ হেঁটে এসেছে।

হাঁটতে হাঁটতে কতটা যে পথ পেরিয়ে এসেছে রৌদ্র,তাকিয়ে দেখে ওর চারপাশেকেউ নেই। এমনকিএতক্ষণ প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়া লোকজন, এমনকি গতরাতে ওর পাশে শুয়ে থাকা সহেলি পর্যন্ত। নিজের মত ঘর গুছিয়ে সেও এতক্ষণে নিজের জগৎতেব্যস্ত হয়ে পড়েছে।রৌদ্র দেখল চারপাশের সবাই যে যার গন্তব্যে সরে গিয়ে রাস্তাটা কেমন ফাঁকা, জনশূন্য করে গেছে। এখন বেলা ঠিক কত? পকেটে হাতড়ে রৌদ্রর খেয়াল হল, মোবাইলটা তোফেলে রেখে এসেছে বাড়িতে। তার মানে এখন সময় দেখার উপায় নেই। উপায় নেই রাস্তায় কাউকে ডেকে জানতে চাওয়ার,এখন কটা বাজে বলুন তো?এতক্ষণে মাথার উপর রোদ ছড়িয়ে গেছে অনেকটাই অথচ দোকান-বাজার কিছুইখোলেনি আজ। এমনকি আজ কোন হরতাল নেই, নেই অবরোধ, কোন ছুটির দিনওনয়। তবু আশ্চর্য আজ সমস্ত রাস্তা জনশূন্য। একটা বাসও চলছে না।নেই কোন হলুদ ট্যাক্সির দেখা। যেন সময়টাই থমকে গেছে কোথাও।

গলিপথটা ধরে রৌদ্র ঘুরে বেড়াতে লাগল এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। আর তখনই দেখতে পেল, গাছতলায় একদল বাচ্চারা খেলা করছে আপন মনে। রৌদ্র এগোতেই বুঝল সেই ছেলেবেলার দল। তাদের সেই সব মজারমজার খেলার দিনগুলি। কানামাছি, ছোঁয়াছুঁয়ি, কিতকিত…। রৌদ্রও ততক্ষণে ওদের মত হয়ে গেছে। সেই ছেলেবেলাকে একদম জড়িয়ে নিয়ে।সেই খেলতে খেলতে সারাটা দুপুর গড়িয়ে যাওয়া। সন্ধ্যের মুখে মায়ের শঙ্খের ডাকেবাড়ি ফিরে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সেই গোল হয়ে পড়তে বসা।তখন পড়তে পড়তে হয়তো মায়ের বাড়িয়ে দেওয়া স্নেহের হাত।রূপকথার গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়া চোখ।

ফেরার পথে রৌদ্রর চোখ গেল গানের স্কুলটায়। সেই যে, যে বাড়িটাকে এতক্ষণ খুঁজছিল সে। আর কাছে যেতেই অবাক করে দিয়ে দেখল,বিরাট আয়োজন চলছে সেখানে।নতুন করে বানানো হয়েছে গেট। মঞ্চ বাঁধা হয়েছে অজস্র ফুল দিয়ে ভরিয়ে।স্কুল বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে রেওয়াজের সুর। ঝর্ণাপিসির গলা।আর এসবের মধ্যেই উৎসাহি মানুষের ভিড় উপচে পড়েছে গোল মঞ্চটাকে ঘিরে।এত মানুষ দেখে অবাক হল রৌদ্র।সবাই কী তাহলে ছুটে এসেছে আজ এই এখানে?

রৌদ্র ভিড় সরিয়ে মঞ্চের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।আর বিস্ময় ভরে দেখল মাইক হাতে এগিয়ে আসা ঝর্ণাপিসিকে। হারমোনিয়াম, তবলা আর চারদিকে থেকে ভেসে আসা সুরের মুর্ছনায় ঝর্ণাপিসির গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লাজুক মেয়েটা পর্যন্ত। সেই ফর্সা হাত।আজ সেও চাইল একটা গান শোনাতে।অনেক গানের ভেতর থেকে সেই হারানো সুর আকাশ বাতাস ছাপিয়ে শ্রাবণের ধারার মত চারপাশে ঝরে পড়তে।রৌদ্র জানে সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কিছুই বলা হয়ে উঠবে না আজ। যেমনটা বলা হয়নি কোনদিন ঝিঙ্কিকে।

ফিরে আসবার সময় এগলি-সেগলি ঘুরে যখন নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রৌদ্র, ততক্ষণে এদিকের সব ফাঁকা মাঠ, সেই সব বড় বড় মাঠ জুড়ে ফসলের ক্ষেত, চাষের জমি বুজে গিয়ে বাড়িঘর, উঠে দাঁড়ানো কংক্রিটের দেওয়ালগুলিহঠাৎ প্রকট হয়ে উঠল। প্রকট হয়ে উঠল সেই সব জমি ঘিরে ফসল, সেই ফসলবুজিয়ে গজিয়ে ওঠা দেওয়াল, ছেলেবেলার বন্ধ হয়ে যাওয়া খেলার মাঠ, আলপথ,ঝর্নামাসির স্কুল থেকে ভেসে আসাসুর। রৌদ্র দেখল ওর সামনে এখন শুধুই ইটের পর ইট গেঁথে দাঁড়িয়ে থাকা একটার পর একটা দেওয়াল।সেইসব দেওয়াল ঘিরে দরজা, জানালা আর চারদিকে ঘিরে ধরা উঁচু উঁচু পাঁচিল। সেই উঁচু পাঁচিলে বন্দী শৈশব।হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার দিন।

এখন এই নিজের বাড়িটাকে দেখে রৌদ্রর মনে হল,সদ্য রঙের প্রলেপ দেওয়া দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে রাখা,বুজে ফেলা আলপথ,দামি দামি আসবাব আর সাজসজ্জায় ভুলে থাকা দিনযাপন কেমন দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে।কেমন দমবন্ধ করে ঘিরে ধরছে ঘড়ি ধরে ছুটে চলা সময়।

রৌদ্র মুক্তি চাইল। এসবের থেকে ভীষণভাবে মুক্তি।

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত