| 19 মার্চ 2024
Categories
অন্য দেয়াল

ব্লাইন্ড স্টিক

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আমার গাইনোকোলোজিস্ট পরামর্শ দিলেন অফিস আমি নিয়মিত করতে পারবো, কিন্তু বাই রোড ট্রাভেল অ্যাভোয়েড করতে হবে, গাড়ির ঝাঁকুনি থেকে বাঁচতে।

সেইমতো লোকাল ট্রেনে ডিফারেন্টলি এবেল এবং প্রেগনেন্ট মহিলাদের জন্য যে একটি আলাদা কম্পার্টমেন্ট থাকে তাতে আমার নিয়মিত অফিস যাতায়াত শুরু হলো।

মুম্বাই এর লোকাল ট্রেনে লেডিস কম্পার্টমেন্টেও অফিস টাইমে কি পরিমাণ ভিড় আর ধাক্কাধাক্কি হয় তা যারা দেখেছেন তারাই শুধু বুঝবেন। আসা-যাওয়া দুটোতেই নির্দিষ্ট ট্রেন ধরতাম ভিড় এড়ানোর জন্য। রোজ একই ট্রেনে যাতায়াতের সূত্রে বেশ কিছু ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মুখ পরিচিত হয়ে উঠলো।

অফিস থেকে ফেরার সময় বিকেলে মুম্বই সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে আমার সাথেই ট্রেনে উঠতেন একজন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক। দৃষ্টিহীন।
হাতে ফোল্ডিং ব্লাইন্ড স্টিক।

আমি স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করতাম।
ছেলেটিও আমার সাথে অপেক্ষা করতো ট্রেনটির জন্য। ছেলেটি প্রতি পদক্ষেপের আগে তার স্টিকটি রাস্তায় ঠুকঠুক করে পথ বুঝে নিত তারপর এক এক পা ফেলে ঠিক জায়গায় এসে দাঁড়াতো। বারো ডাব্বার ট্রেনের স্টেশনে যেখানে ডিফারেন্টলি এবেলদের কোচ দাঁড়ায়, প্লাটফর্মে সেখানে একটি বিপ আওয়াজ দেওয়া থাকে তা শুনে দৃষ্টিহীন যাত্রীরা বোঝেন এখানে তার জন্য নির্দিষ্ট কোচটি থামবে। ছেলেটি ট্রেনে উঠে জানালার ধারের সিটে বসতো। রোজই একই সিট। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে ছেলেটি দরজার দিকে মুখ তুলে তাকাতো কারো আসার অপেক্ষায়। পরের স্টেশন থেকে উঠতো একটি মেয়ে।
মোটামুটি সেই ছেলেটির বয়সী।
মেয়েটিও দৃষ্টিহীন। তার হাতেও ফোল্ডিং ব্লাইন্ড স্টিক।। রোজই পোশাক পরতো সালয়ার কামিজ ওড়না। ট্রেনে উঠেই মেয়েটি হাসতো, একমুখ ঝলমলে হাসি।

ছেলেটির সাথে তার দৃষ্টিবিনিময় হতো। যেন পরস্পরকে তারা দেখতে পারছে।

মেয়েটি ধীর পায়ে, এগিয়ে যেত, ছেলেটি একটি সিট সরে এসে মেয়েটিকে জানলার ধারের সিটটি ছেড়ে দিত। মেয়েটি হাতের স্টিকটি ফোল্ড করে কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে, জানলার ধারের সিটে বসতো ছেলেটির পাশে। দুজনে পোশাক, ব্যাগ, ট্রেন ধরার টাইমিং দেখে মনে হতো তারা তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরছে।

আমি আমার সিটে বসে ওদের মাঝে মাঝে লক্ষ্য করতাম।

পাশাপাশি বসে দুজনে কখন গল্পে মশগুল, কখন হাসিতে উছ্বসিত, কখনও বা ট্রেনের আর যাত্রীদের আওয়াজকে উপেক্ষা করে গভীর কোনো আলোচনায় ব্যস্ত। আওয়াজে কখনও কথা শোনা যাচ্ছে না বলে মেয়েটি ছেলেটির কানের কাছে গিয়ে কথা বলছে।

পড়ন্ত বিকেলের তামাটে রোদ ট্রেনের জানালা দিয়ে দুজনের মুখে এসে পড়ে, হাওয়া এসে এলোমেলো করে দেয় দুজনের চুল। অসম্ভব ভালোবাসার ভাষাপূর্ণ ওদের দুজনের চোখ চেয়ে থাকে একে অন্যের দিকে। কে বলবে সেই চোখে আলো নেই !

দীর্ঘ সাত মাস এদের আমি দেখেছিলাম।রোজ।

একই দৃশ্য। একই বডি ল্যাঙ্গোয়েজ।
রোজ দুজনে আলাদা আলাদা স্টেশন থেকে উঠতো , আলাদা স্টশনে নামতো। ওদের দুজনের দৃষ্টিহীন চোখে একে অন্যের জন্য ভালোবাসা কম হতে দেখিনি একদিনও।এরপর আমি ছয় মাসের দীর্ঘ ম্যাটারনিটি লিভে চলে যাই। ওই ট্রেন ওই কম্পার্টমেন্টে যাওয়া শেষ হয় আমার।

মুম্বই এর পথে, স্টেশনে বহু দৃষ্টিহীন মানুষ একা একাই চলা ফেরা করেন, কাজে যান। তাদের অসম্ভব মনের জোরকে মনে মনে চলার পথে স্যালুট করলেও কতজনকেই বা মনে থাকে আমাদের ।

এই ছেলেমেয়েটির কথাও আমার মন থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল।

আমার মেয়ের জন্মের ছ’মাস পর যখন অফিস রিজয়েন করি আমি, ট্রেন ছেড়ে দিয়ে বাই রোড যাতায়াত শুরু করি।

বছর দেড় দু’য়েক পর।

একদিন বিকেলের দিকে আমার অফিসের একটি কাজে আমার অফিস ওয়ার্লি নাকা থেকে যাচ্ছিলাম পেডার রোডে।

রেসকোর্সের উল্টোদিকে মহালক্ষ্মী স্টেশনের সামনে একটি দীর্ঘ ট্রাফিক সিগন্যাল আছে, সেখানে আমার ট্যাক্সি রেড সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎই চোখ পরে মহালক্ষ্মী স্টেশন সংলগ্ন ফুটপাথে। সেই ছেলেটি আর মেয়েটি একসাথে হেঁটে যাচ্ছে। স্টেশনের দিকে । পাশাপাশি। একে অন্যের গা ঘেঁষে।মেয়েটির ডান হাতের আর ছেলেটির বাঁ হাতের আঙুলগুলি পরস্পরকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে আঁকড়ে ধরে আছে। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে হেসে হেসে কথা বলছে।

শেষ দুপুরের সূর্য আরব সাগরের ওপর দিয়ে অস্ত যাওয়ার আগে তামাটে রোদ ওদের দুজনের চোখেমুখে মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।আমি অপলকে ওদের দেখতে থাকি। একটু কাছাকাছি এলে দেখতে পেলাম, মেয়েটির গলায় কালো পুঁতির মঙ্গলসূত্র আর দু’হাত ভরা সবুজ কাঁচের চুড়ি। একসাথে জীবনে চলার পথ ওরা সামাজিক ভাবে বেছে নিয়েছে।

মনে মনে ভাবলাম,আমরা দৃষ্টিযুক্ত মানুষেরা জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার সময় কত কি চোখ দিয়ে দেখি- লম্বা না বেঁটে, ফর্সা না কালো, চোখ নাক সুন্দর তো, হাঁটা চলায় স্মার্ট তো, হাসিটা নজরকাড়া তো- কিন্তু সত্যিকারের একে অন্যকে নিয়ে খুশী হতে গেলে এতো কিছু দেখার দরকার পরে কি?
ভালোবাসতে গেলে তো দরকার একটুখানি ভালোবাসা আর বিশ্বাস।

ট্রাফিক সিগন্যাল খুলে যায়। আমার গাড়ি চলতে শুরু করে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে ইতিমধ্যে স্টেশনে ঢুকে যায়। এখন হয়তো আর দুজনে আলদা স্টেশনে থেকে ট্রেনে ওঠে না। আলাদা স্টেশনেও নামে না। একই ডেস্টিনেশন এখন ওদের। দুজনের হাতে আলাদা আলাদা ব্লাইন্ড স্টিক আর নেই।

স্ত্রী আঁকড়ে আছে স্বামীর হাত আর শুধু স্বামীর হাতে রয়েছে স্টিক যা দিয়ে স্বামী রাস্তা ঠুকঠুক করে পথ বুঝে নিয়ে খানাখন্দ উঁচু-নিচু এড়িয়ে একসাথে এগিয়ে চলেছে।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত