Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,book/author/24719/mohit-kamal story

অতিপ্রাকৃতিক ও মনস্তাত্বিক গল্প লুট । সালমা আক্তার

Reading Time: 3 minutes
“লুট”
লেখক : মোহিত কামাল
 
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও লেখক বাস্তবতার সাম্প্রতিক ধারাকে অতিপ্রাকৃতর আদলে ‘লুট’ গল্পটি তাঁর লেখনীতে ধারণ করেছেন। অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ঘটনাকে অবলম্বন করে এক ধরনের গল্প রচিত হয় যা পাঠকের মনে শিহরণ বা ভয়ের উদ্রেক সৃষ্টি করে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার মতো বাংলা অতিপ্রাকৃত গল্পও সমৃদ্ধ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে।ব্যক্তিগতভাবে কবি প্লানচেট,পরলোকতত্ত্ব সম্বন্ধে আগ্রহী ছিলেন।বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা একটি পত্রে তিনি প্ল্যানচেট সম্পর্কে আলোচনা করেন।যদিও পরবর্তীকালে তিনি একে ‘ছেলেমানুষী কাণ্ড’ বা ‘অনাচার’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।এর পরেও দেখা যায় তিনি অলৌকিক জগৎ সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। নির্মল কুমারী মহালানবিশকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি অলৌকিক,অতিপ্রাকৃত জগৎকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন:
“দেহহীন আত্মা কি রকম এবং তার চিত্তবৃত্তি কি ভাবের,কল্পনা করা কঠিন।কিন্তু আজকালকার বিজ্ঞান মানলে দেহটাই যে কেন বস্তুর মতো প্রতীত হয় সে রহস্য ভেদ করা যায় না।বস্তুর মূলে অবস্তু।অর্থাৎ সম্পূর্ণ অনির্বচনীয় পদার্থ;এই মায়াকে যদি মানতে পারি তবে দেহহীন সত্তাকেও মানতে দোষ নেই।অবশ্য যদি তার প্রমাণ পাওয়া যায়।আজকাল প্রমাণ সংগ্রহ চলছে এখনো সর্বসম্মত বিশ্বাসে পৌঁছায়নি।”
ক্ষুধিত পাষাণ,নীশীথে,জীবিত ও মৃত,মনিহার,গুপ্তধন এগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অতিপ্রাকৃত গল্প। লেখকের ‘লুট’ গল্পটি পড়ে আমার মনে হয়েছে অতিপ্রাকৃতর সাথে এখানে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও সংযুক্ত হয়েছে ফলে উদ্ভট পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান হিসেবে অতিপ্রাকৃতকে উপস্থাপন করা হয়।এরকম একটি ধ্রুপদী উদাহরণ হলো হেনরি জেমসের ‘দ্য টার্ন অফ দ্য স্ক্রু’ যেখানে বর্ণিত ঘটনাগুলোর অতিপ্রাকৃত এবং মনস্তাত্ত্বিক দুই ধরনের ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়।এই দ্ব্যর্থতা কাহিনীকে আরো রহস্যময় করে তোলে। ‘লুট’ গল্পে প্রেমা নামক অশরীরী চরিত্রটি অপমান, লাঞ্চনা,নির্যাতন,নিপীড়ন,যৌন হয়রানির প্রাত্যহিক ধর্ষণের,নিগ্রহের শিকার।প্রেমা একা নয় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এমন প্রেমা অনেক আছে। এখানে লেখক গল্পের মাধ্যমে বর্তমান সমাজের নারী চরিত্রের দুর্বলতা এবং পরকীয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন।সুযোগ পেলে মানুষ শুধু লুণ্ঠনকারীই নয় ধর্ষণকারী,নির্যাতনকারী,নিপীড়নকারী এমনকি হত্যাকারীও হয়ে উঠতে পারে।গল্পের মধ্যেও এমন নিদর্শন দেখতে পায়।এ গল্পে প্রেমার ধর্ষণের মূল কারণ ছিল তার পরকীয়া।
 
মূলত পারিবারিক অপশিক্ষা,বিদেশী অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে প্রকৃত মানবতাকে লুন্ঠন করতে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিনিয়ত কোন না কোন নারী কোন না কোনভাবে পুরুষের নিগ্রহের শিকার ও প্রতারিত হয়।হিন্দোলের সাংবাদিকতা পেশার কারণে এসব ঘটনার সাথে প্রতিনিয়ত তার একটা যোগসুত্র স্থাপিত হয়।কখনও হয়তোবা পুরুষের লালসার শিকার হয়ে সমাজের অলিতে-গলিতে ক্ষত-বিক্ষত,বিকৃত,বিবস্ত্র হয়ে পড়ে থাকা নারীর লাশ তার ক্যামেরায় ধারণ করেছে। স্বপ্নে সাংবাদিক হিন্দোলের অশরীরী প্রেমার নগ্ন ছবি তোলা এবং মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গার পরেও সে বাস্তবতার সাথে স্বপ্নের মিল খুঁজে পেতে ক্যামেরায় চোখ রাখে এবং প্রেমার ক্ষত বিক্ষত ছবি দেখতে পায়।আসলে মানুষ অনেক সময় এমন জিনিসের উপর অতিরিক্ত জোর দেয় যার অস্তিত্ব সম্পর্কে সে নিজেই সন্দিহান।অর্থাৎ বাস্তবে যার অস্তিত্ব আছে কিনা এ নিয়ে সে নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত অথচ তার আগ্রহী মন বস্তুর সম্ভাব্য অস্তিত্বকে অতিক্রম করে তাকে অস্তিত্বযুক্ত করে তুলতে চাই।তাই হিন্দোলও তার ক্যামেরায় ধারণকৃত পুরুষের লালসার শিকারে ক্ষত-বিক্ষত অন্য কোন নারীর মাঝে প্রেমার মুখচ্ছবি দেখতে পেয়েছে।লেখক গল্পে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি সর্বস্ব হারানো ( অর্থ-সম্পদ,সতীত্ব,জীবনীশক্তি )এক নতুন প্রেমাকে তুলে ধরেছেন। সমাজের একশ্রেণির কু-পুরুষের বিকৃত মানসিক ব্যাধি হলো ধর্ষণ।এদের মাঝে বাস করে এক কুৎসিত ধর্ষণকামী মানুষ।নারী নির্যাতনের আদিম প্রতিযোগিতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের পৈশাচিক আনন্দকে আইনগত বৈধতা দাবি করবে এবং আমাদের দেশের আইন এ দাবিকে স্বীকৃতি দিবে।নারী,শিশু সবার কাছেই মৃত্যু থেকেও মারাত্মক এবং ভয়ঙ্কর উদ্বেগের একমাত্র কারণ হল এইসব দানবীয় পুরুষেরা। যদি আইনের যথার্থ প্রয়োগ হতো তবে একের পর এক ধর্ষণ ও নিশংস হত্যার মতো জঘন্য কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটতো না।
 
সাংবাদিক হিন্দোল যখন সম্পাদকের সামনে যায় তখন তাকে অনেকটা বিবর্ণ,ফ্যাকাশে,উদভ্রান্ত,হতবিহ্বল মনে হয়।হিন্দোল সম্পাদককে কোন বীভৎস,বিবস্ত্র,ক্ষত-বিক্ষত নারীর ছবি দেখান।সমাজের অরক্ষিত মেয়েরা যে ফাঁদে পড়েছে সেই বিষয়টা হাইলাইট করে,প্রতারক চক্রের শেকড়-বাকড় সহ জাতির সামনে তুলে ধরতে চান সম্পাদক।সেই সাথে সম্পাদক ছবির প্রিন্ট ভার্সন জমা দিয়ে যেতে বলে এবং হিন্দোলকে আবার ছবি তুলতে পাঠাতে চাইলে সে ভীত হয়ে তার নিজের রুমে চলে আসে।নিজের টেবিলের সামনে চেয়ারটা দেখতে না পেয়ে বুকসেলফের সঙ্গে ঠেস দেওয়া চেয়ারটা টেনে আনার চেষ্টা করে বিফল হন হিন্দোল।তার মনে হয় ওজনদার,অদৃশ্য কেউ বসে আছে চেয়ারে।ভাবনাটা তার মাথায় আসার সাথে সাথে সে ঘামতে শুরু করে এবং শরীরের রোম খাড়া হয়ে গেল।স্পষ্ট কথা ভেসে এল চেয়ার থেকে,প্রেমার দেহে জখমের চিহ্নসহ ন্যুড ছবি কারো হাতে দেওয়া ঠিক হবে না।এক হাত থেকে অন্য হাতে গেলে সেটা ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে।গল্পের এই জায়গাটায় অদৃশ্য নারীর সাথে হিন্দোলের কথোপকথনে কিছুটা অতিপ্রাকৃত ও মনস্তাত্ত্বিক দিক ফুটে উঠেছে।এখানে মূলত হিন্দোলের বিবেক তাকে বাধা দিয়েছে।বর্তমান পেক্ষাপট বা সময়ে এই ধরনের অপ্রীতিকর ছবি বা ভিডিও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।সেই বিষয়টিকে লেখক খুব সচেতনভাবে তুলে ধরেছেন। সামাজিকতার সম্মানকে অসম্মান করে আজ আমাদের সমাজ মুখোশধারী মানুষে ভরে গেছে।এখানে আজ মুখের চেয়ে মুখোশেএ সংখ্যা বেশি।এই মানুষগুলো নানা সময়ে নানা মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখে ভয়ংকার এক মুখ।দেশ,সমাজ,পরিবার সবখানেই আজ মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে পিশাচের দারুণ নগ্নতার আরো একটি মুখ। হিন্দোলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র ভেতর দিয়ে এখানে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে,পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেই নগ্নতার মুখ পুরুষের অবয়বে দেখতে পাওয়া যায়।আর তাদের হাতেই প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত,বঞ্চিত,অবহেলিত ও নির্যাতিত আমাদের সমাজের বোকা নারীরা।কখনোবা বাইরে কখনোবা চার দেওয়ালের প্রকোষ্ঠে প্রকম্পিত ও প্রতিধ্বনিত হয় তাদের আর্তনাদ।নারীর উপর পুরুষের নগ্নতাকে সর্বোচ্চ জঘন্যভাবে প্রয়োগ বা আঘাত করে এখানে।নিজের জঘন্য হীনতাকে চরিতার্থ করে খুব সহজেই শহরের নিয়ন আলোতে তাদের বীভৎস মুখ গুলো লুকিয়ে মিশে যায় স্বাভাবিক জনস্রোতে।এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতিটি নারীকেই সবসময় পুরুষের লালসার লোলুপ দৃষ্টিতে নজরবন্দি হয়ে থাকতে হয়।তাই প্রতিটি নারীকেই বিবেকবর্জিত,পচনশীল সমাজে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হয়।’লুট’গল্পে লেখক নারীদের সচেতন হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন আধুনিকতা থাকে চিন্তায়,মস্তিষ্কে,মগজে, বিজ্ঞানমনস্কতায়।সেই সাথে নিজে পুরুষ হয়েও পুরুষ সত্তায় শেকল পড়াতে বলেছেন এবং নৈতিকতার পতাকা উড়াতে বলেছেন।মূলত নিজেকে সংযত রেখে ও চিনে পুরুষের পশুবৃত্তিকে পরিবর্তন করার কথা বলেছেন। সবথেকে ভালো হতো যদি মানুষের মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত মুখটা দেখার যন্ত্র থাকতো।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>