| 27 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্র সংখ্যা: পাঠপ্রতিক্রিয়া: ধনপতির চর । জয়ন্ত দে

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
এই উপন্যাসটি আমার সদ্য পড়া। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। আমি পড়লাম বারো বছর পর। প্রায় এক যুগ। অমর মিত্রকে আমি পড়েছি সেই ‘দানপত্র’ ‘আলোকবর্ষ’ থেকে। 
অমরদার লেখা উপন্যাসের তালিকায় সবার যখন ‘ধ্রুবপুত্র’ প্রথম স্থানে থাকে, তখন আমার পছন্দে থাকে ‘আগুনের গাড়ি’। কিন্তু ‘ধনপতির চর’ পড়ার পর মনে হল একটি ক্লাসিক লেখা পড়লাম। যার আবেদন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে চিরকালীন সম্পর্ক স্থাপনের পথে।
‘ধনপতির চর’ লেখকের তৈরি করা এক নিজস্ব ভুবন। এই চরের জেগে ওঠা, তার ছ মাসের জীবনের সে অর্থে কোনও বাস্তবতা নেই। কিন্তু পুরো উপন্যাসে এই চর জেগে উঠেছে সত্য হয়ে।
হাজার বছরের এক প্রাচীন কাছিম হার্মাদ পেদরুই এই চরকে পিঠে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তারই বংশধর ধনপতি এখন এই চরের মালিক।
‘আছিল চর এক, ধনপতি কহে
চারিদিক দিয়া তার বড় গাং বহে।’ 
এখানে ছ’ মাসের জীবন। আশ্বিনের শেষ থেকে চৈত্রের আরম্ভ। এই ছ মাসের জীবনে মূল ভূখণ্ড থেকে ধনপতির চরে মাছ ধরতে আসে জেলেরা। তারা মাছ ধরবে, মাছ শুকবে। এক শীতের অসংখ্য জীবন নিয়ে এই কাহিনী গড়ে ওঠে। জেলেরা আসে মাছ ধরতে আর অভাবী মেয়েরা আসে ভাতের খোঁজে। তারা এই জেলেদের সঙ্গে ছ মাসের সংসার গড়ে, যা চৈত্র বাতাস এসে ভেঙে দেয়। 
‘গন্ধতেল গন্ধ সাবান, লও মেয়ে হাতে,
অঙ্গে সুগন্ধ এলে, দেখা হবে রাতে’।
আবার ছ’ মাস অপেক্ষার পর আগামী বছর। আবার জেলেরা আসবে, আবার মেয়েরা আসবে, যদি না হারিয়ে গিয়ে থাকে, যদি বেঁচেবর্তে থাকে।
ধনপতি সর্দার এ বছর লাঠি ধরেছেন, তবু তিনি সোন্দর। তার শরীরে বইয়ে হার্মাদ ফিরিঙ্গি পেদ্রর রক্ত। চরে এসেছে ঘোড়াদল থানার কনস্টেবল মঙ্গল মিদ্দে। সেই এখানকার গরমেন। আর তার সঙ্গী পুরুল্যার ব্যবসায়ী দশরথ সিং। ব্যবসায়ী কী বেচে? গরম জামা বেচে, আলোয়ান বেচে। আর কী বেচে? সোনো, পাউডার, আলতা সিঁদুর, ঠোঁটের রং, নখের রং। না, সেই ব্যবসায়ী আরও অন্যকিছুর ব্যবসা করে। তার নাম মেয়েমানুষ। সে বাতাসিকে পেতে চায়। কিন্তু বাতাসি যে এই ছ মাসের জন্য গণেশ জেলের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। ব্যবসায়ী তাকে পুলিশ দেখায়, জেনে যাওয়া ধর্মের ভয়। যত রকম ভয় আছে তাতে সে আষ্টেপিষ্টে বাতাসিকে বেঁধে ফেলতে চায়। কাহিনী শুরু হয় ছ মাসের জন্য জেগে ওঠা চর দখলের সঙ্গে সঙ্গে দশরথ সিংয়ের বাতাসিকে দখল করা আখ্যানে। সে জেলেনিকে গন্ধ তেল সাবান মাখাতে চায়। বেচা কেনা করতে চায়। 
‘মৎস্যগন্ধা নারী ছিল একজনা
কীভাবে হইল শুনো, তার বেচাকেনা’।
এই মেয়ের ছ’ মাসের বউ, ছ’ মাসের বিবি। বাদ বাকি ছ মাস জেলেরা তাদের কথা ভুলে যায়। জেলেরা তখন নিজ নিজ ঘরে বউ ছেলেপুলের কাছে ফিরে যায়। আর অভাবী মেয়েমানুষের ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়। কিন্তু তাদের মন রয়ে যায় ছ’ মাসের সংসারে। ভাবে, এই ছ মাসকে যদি বারোমাস করা যেতে। এখানে ছ মাসের জীবন কাটিয়ে জেলেরা চলে যাক তাদের সত্যিকারের ঘর সংসারে। আর এরা এখানে থাকবে, ভাববে তাদের সোয়ামি মরদরা অন্য কোথাও কাজে গেছে। তারা ছেলেপুলে ঘর সংসার, গোরু বাগান নিয়ে থাকবে। কিন্তু এ এক অলীক স্বপ্ন। যা ধনপতির চরে হবে না। এই চরের নিয়মকানুনই আলাদা। কিন্তু ব্যাপারি সে নিয়মের ধার ধারে না। সে সব মেয়েমানুষ কিনে নেবে। পণ্য মেয়েমানুষ!
‘কনস্টেবল আসিবে ফিরে, হবে লেনাদেনা
কিনে বেচা, বিচে কেনা, এই রূপ জানা।’
এই কেনাবেচা ব্যাপারি থেকেই সংঘাত। যমুনা, কুন্তী, ধনপতি পুরো জড়িয়ে পড়ে পুরো চর। ইনকুমারি করতে আসে মালাকার। সে আর এক গরমেন। সে-ও মাংসলোভী। ব্যাপারি আর গরমেন্টেরা সব জোট হয়। 
‘ডলারে কারবার হবে, ডলারে পেমেন
ডলারে লাভ বেশি, জানো তো গরমেন’।
ওদিকে ধনপতি থেকে কামাখ্যা ঘুরে আসা কুন্তি হয়েছে ধনেশ্বরী। সে চায় চরকে বাঁচাতে। বারোমাসে ব্যবস্থা করতে। বিডিও অনিকেন সেন শোনেন পেদরুর কথা। চৈত্র আসে। চর ছেড়ে জেলে নৌকা ভাসে ঘোড়াদলের দিকে। সব মেয়েদের মুখঢাকা ঘোমটায়। কাউকে চেনার যো নেই। 
‘ধনপতি ধনপতি, এক সওদাগর,
ঘোড়াদলে এসে কহে হাতখানি ধর।
দুই হাতে ধরে তারে বিবি ধনেশ্বরী
 পিছে দ্যাখো হাসি মুখে বাতাসি ঈশ্বরী’।
কিন্তু চতুর্থ পর্বে যেখানে আর মেয়ে মানুষ নয়, পণ্য হয় জমি। চরে ধনপতিকে ঘরে রেখে লড়ে যায় ধনেশ্বরী কুন্তি। মেয়েরা কোমরে ছুরি গোঁজে। ওদিকে ব্যাপারির রং পালটে বহুজাতিক কোম্পানি গ্রিনউডে মিশে যায়। নগ্ন জেলেনিরা নেমে আসে গাঙের জলে। ঘুমন্ত কাছিম পেদ্রুকে জাগাতে হবে। কাছিমের পিঠে করে এই চর ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে অন্য কোথায়, অন্য কোনওখানে। আর গরমেন এসে দেখবে শুধু জল, আর জল। অনবদ্য এই উপন্যাসে অজস্র লোককাহিনী ছড়ানো। এই মায়া আর ঘোরের উপন্যাসে আপনিও ভেসে থাকবেন।
এই উপন্যাসে যা নেই, যা অলীক তা সত্য, যা সত্য তা ভেসে যায় কল্পনার খোঁজে। একদিন তা অলীক হয়ে যাবে। লোকমুখে ঘুরবে। হাওয়ায় উড়বে। জলস্তম্ভ হয়ে আছড়ে পড়বে। ভাসিয়ে দেবে ভূখণ্ড থেকে ভূণ্ড। 
‘গাং উথাল গাং পাতাল কেডা ভেসে যায়
পেরুর বিবিরা , ধনপতি ভাসায়।’
আসুন, ৩৮৩ পাতার এক অলীক চরে আপনাকে স্বাগত। ধনপতির চলে। ধনেশ্বরী বাতাসি যমুনারা আর শুধু মেয়েমানুষ নয় …
‘অঘঘানের জোসনা নিশি চর ডুবে যায়
ধনপতি প্রভু আমার একেলা ঘুমায়।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত