Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,book review

ধানফুল গাঁয়ের কবি আবু জাফর । বুলবুল চৌধুরী

Reading Time: 3 minutes

আগে কবি আবু জাফর খানের কোনো কবিতা আমি পড়িনি। কিছুদিন আগে দুয়ের প্রথম পরিচয় পর্বে তাঁর লেখা দুটি গ্রন্থ ‘একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর’ ও ‘সোনালি ধানফুল’ হাতে পেতেই গভীর অভিনিবেশ দাবি করে বসল। কোনো কবিকে বুঝতে হলে তার লেখা দুটো গ্রন্থভুক্ত কবিতা দিয়ে নিঃসন্দেহে এর যথেষ্ট মূল্যায়ন টানা সম্ভব। পড়তে নেমে অসুবিধা হয় না যে, কবি মুক্তছন্দেরই বিচরণ করতে বেশি স্বস্তি বোধ করেন। দুটি গ্রন্থে তাঁর ছন্দোবদ্ধ কবিতার সংখ্যা খুবই অল্প। এর মানে এই নয় যে, বাকি কবিতাগুলো ছন্দহীন কিংবা ছন্নছাড়া; মুক্তছন্দও রীতি মেনে চললেও এর অন্তর্গত ছন্দের টানটাও লক্ষণীয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এই কবির, তিনি চিত্রল পরম্পরায় সুন্দর ছবি আঁকতে পারেন; যা মানুষের বুকে গেঁথে যায় :
‘মেঘ আসে
অনিশ্চিত মেঘে জলের ক্রন্দন
পাহাড়টা বুকে করে রাখে
মেঘ উড়ে যায় জলশ্রী পেরিয়ে আকাশের পারে
ওই পারে আলোয় ভরা তাহার গাঁ
এপারে আঁধার, চেয়ে থাকি রাত্রিদিন
বুঝি নামে শুকতারাটি স্বপ্নহারা মাঠে।’
(একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, পৃ: ২০)

এই ক’টি পঙ্ক্তি বলে দেয়, সম্ভাবনার অপার দুয়ার তার হাতে। পাঠককে কবিতা ও কবির প্রতি আকর্ষণের জন্য কবিকে হতে হয় ঘোর-জাগানিয়া মানুষ। আবু জাফর খানের কলমে আছে ওরকম অনেক চয়ন। তাই তিনি বলেন, ‘প্রেম চলে গেলে বিরহ কী করে বাঁচে।’
তার আরেকটি কবিতা-পদশব্দ মিলিয়ে যায়’ (পৃ: ২৩); জীবন-রহস্যের নিগূঢ় তত্ত্ব বলে দেয়। আর এমন সুন্দর ছবি তৈরি করে-সত্যি বিস্ময় মানতে হয় :
‘আগে যেখানে ঘর ছিল
শালবনের গা-ঘেঁষে
এখনও সেখানেই আছে,
বারান্দা ডিঙিয়ে উঠোন, উঠোনের পাশে
পরাশ্রিত লতাগুল্ম, সটিগাছ, তারপর দখিনের মাঠ
হিম হাওয়া পাক খায় পুবে-পশ্চিমে।’

এ কবিতাটির শেষাংশে রয়েছে মানুষের জীবনের সত্য, অথচ নিষ্ঠুর উচ্চারণ, সেখানে তাই হাহাকার বা দীর্ঘশ্বাসও যেন নেই। আছে সত্য ও সরল স্বীকারোক্তি :
‘আগে যেখানে মুগ্ধতা ছিল
ছিল অনুযোগ, অভিমান
এখন শুধুই দায়সারা বর্ণগুলি ভেসে থাকে
ক্যানভাসে ক্ষয়ে যাওয়া আবছায়া মুখ।
যমুনার ঘাটে রাখা থোকা থোকা অঙ্গীকার
ভেসে ভেসে চক্রাকারে জলে দিয়েছে ডুব।’
(একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, পৃ-২৪)

কবির অন্তরজুড়ে প্রেম ও বিরহ কখনো কখনো পাশাপাশি থাকলেও বেশিরভাগ সময়ে তিনি বিরহে কাতর। দিশেহারা হয়ে অন্ধকারেও তাই চলে যেতে হয়, কিংবা মনে হয় শেষ পর্যন্ত আঁধারই বুঝি তাকে আশ্রয় দেবেন, ঠিক যে শেষাবধি, গভীর অন্ধকারেই জীবসত্তার সমর্পণ ও পরিণতি। তা বুঝেই ফিরে ফিরে আসার আকুলতা বাজে পঙ্ক্তিমালায় :
‘জেগে উঠে তোমায় দেখব বলে
তোমার কাছে ফিরে আসা হে শরণ্য অন্ধকার।’
(একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, পৃ: ৮০)

এবারে আসা যাক দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি ধানফুল’-এর আলোচনায়। এর মানে এই নয় যে, এটি কবির দ্বিতীয় কৃত্য, ইতোপূর্বে এই কবির আরো পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এবারে কবিকে দেখি আরো পরিণত ও সংহত উচ্চারণে:
‘আরেকবার তুমি আসতেই পারতে
খুব ভোরে না হোক, বিকেলে। বিকেল না হোক সন্ধেবেলা!
আসতেই পারতে তুমি
মধ্যরাতে এলেও দেখতে পেরে দরজা খোলাই ছিল।’
(সোনালি ধানফুল, পৃ: ১৫)

এ অপেক্ষা কখনো মাধবীর জন্য, কখনো অবসেশনে থাকা নলিন মাসি, জানকী, মুনিয়াদি, শিপ্রাদি ও মমদির জন্য; কিংবা বলা যায়, ষড়ঋতুর মতো ওই ছয় নারী মিলেমিশে শেষ পর্যন্ত একজন। আর তা হচ্ছে প্রেম। অপেক্ষার লক্ষ্য তাই অনির্দিষ্ট। ‘একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতরে’ গ্রন্থে কবি মাধবীর জন্য দাহপর্বে কাটিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন ওই নারীকে, ‘দাহপর্ব থেকে আর কতদূরে লাল-পলাশের বসন্ত?’

কিন্তু ‘সোনালি ধানফুলে’ এসেও ‘দাহপর্ব’ যেন ফুরোয় না। তবে সরাসরি অভিযুক্ত করতে পারেন না কাউকে। তাই বলে ওঠেন :
‘তুমি তো ফুল ফোটাও অন্য আঙিনায়
রথের মেলা থেকে রেশমি চুড়ি কিনে খিলিখিল হাসো
তোমার বাগানে বসন্ত যদি…।’
(সোনারি ধানফুল, পৃ: ৬১)

কবিকে কখনো-কখনো মনে হতে পারে যে, তিনি নিস্কাম প্রেমের পথিক; সে-কারণে মাধবীকে স্বীকারোক্তি দেন যে, ‘তোমার কথা আমি নলিন মাসিকে বলেছিলাম।’ উল্টো অভিযুক্ত করেন, আরেকজনকে, ‘অলক্ষ্যে আঙুলের কারুপ্যাঁচে কখন যে গড়ে তুললে / মৌন জনপদ আমি বুঝিনি।’ (পৃ: ৬১, ঐ)। এই নারী মাধবী বা নলিন নয়, মুনিয়াদি। যাকে তিনি দেখেন ‘অন্য আঙিনায় ফুল ফোটাতে…।’

প্রেমের তবু ঘাটতি হয় না। কারণ কবিই একমাত্র জানেন, সত্যিকার ভালোবাসতে। নারী এক্ষেত্রে নিমিত্ত মাত্র, তিয়াসই প্রধান। যে-ভুবনে এই কবির নিত্য যাতায়াত, আমি আশা করি যে, আমাদেরও একদিন অভিসার হবে ধানফুল গাঁয়ে।

*একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতরে। প্রকাশক: বেহুলা বাংলা, প্রকাশকাল-২০১৭, মূল্য-২৩০ টাকা।
**সোনালি ধানফুল। প্রকাশক: বেহুলা বাংলা, প্রকাশকাল-২০১৮, মূল্য: ২২৫ টাকা।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>