| 19 মার্চ 2024
Categories
সেল বাজার

বইমেলা ২০২০

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মেলা বাঙালি লোক-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। একালে নাগরিক জীবনকেও স্পর্শ করেছে মেলা। মেলার উপলক্ষ ও অনুষঙ্গের বহুমাত্রিকতার প্রমাণ বইমেলা। বইমেলার বাতাস বইছে কলকাতা ও তার আশপাশের জেলা গুলোয়, সদ্য বইমেলা শেষ হলো ত্রিপুরায়, আসামের বইমেলা আসছে, মহান ভাষা আন্দোলনে বাঙালির আত্মদানের মাস ফেব্রুয়ারি জুড়ে বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি আয়োজন করে বইমেলার। এই মেলা বাঙালির আধুনিক জীবন-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ বইমেলায় প্রকাশ পাবে যে সব বই তা নিয়েই ইরাবতীর আয়োজন “বইমেলা”।

আজ থাকছে ইশরাত তানিয়ার ২০২০ বইমেলায় চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বই ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ নিয়ে কিছু কথা।


ইশরাত তানিয়া লিখছেন-

‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিশীল কিছু মানুষের এক অন্তর্গত ভ্রমণ। যাত্রাপথে অন্যের সাথে কথা বলতে বলতে এ যেন নিজের সাথেও কথোপকথন। সাক্ষাৎকার মানেই শুধু আলাপচারিতা নয়। বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবনার অতলে ডুবে আত্মোন্বেষণ কিংবা নিজের সাথে বোঝাপড়া। এখানে নির্লিপ্তি বা নির্মোহতার অবকাশ নেই। একটি সাক্ষাৎকারে জীবন অভিজ্ঞতা, চিন্তা-ভাবনা, অন্তর্গত বোধ, স্মৃতি আর আকাঙ্ক্ষার উপাদানগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এই অ্যাম্ফিথিয়েটারে তাই ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়েছে আনন্দ, বেদনা, হর্ষ, বিষাদ, প্রসন্নতা, ক্ষোভ, আহ্লাদ, অভিমান, বৈরাগ্যসহ বিচিত্র সব অনুভবের মিশ্রস্বর।
পুরুষশাসিত সমাজে নারীর কথা বলার পরিসরটি তেমন বড় নয়। এই ক্ষুদ্র পরিসরেও লৈঙ্গিক রাজনীতির কৌশলে নারীস্বরকে ক্ষীণ করে রাখা হয়েছে। সাহিত্যজগতে ক্ষীণস্বরটি যেন আরও আরও ক্ষীণ। উপলব্ধিতে শুধুই নিস্তব্ধতা। ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ সেই নিস্তব্ধতার উপলব্ধিজাত সাক্ষাৎকার সংকলন। বাংলা সাহিত্যে নারীদের উচ্চারণ শোনার আগ্রহ থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন এমন দশজন নারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। বাংলা ভাষার অসীমান্তিক রূপরেখার অনুভব থেকেই বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কথাসাহিত্যিকদের নির্বাচন করা হয়েছে। গৃহীত সাক্ষাৎকারগুলো মলাটবন্দী হয়েছে ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বইতে। বাংলাদেশ থেকে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান এবং রাশিদা সুলতানা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃপ্তি সান্ত্রা এবং সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আসাম থেকে স্বপ্না ভট্টাচার্য এবং ঝুমুর পাণ্ডে, ত্রিপুরা থেকে মঞ্জু দাস এবং সুতপা দাসের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, অনেকেই কথাসাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমেও সমান দক্ষতায় সাহিত্য চর্চা করছেন। কিন্তু তাঁদের কথাসাহিত্যিক পরিচয়কে এখানে বিবেচনা করা হয়েছে। বাস্তবের সাথে লেখকের মন, মেধা, প্রজ্ঞা মিশে নির্মিত হয় বাস্তবের প্রতিরূপ। বিশাল ক্যানভাসে বাস্তবতার সাথে অন্তর্দৃষ্টির উদ্ভাসন শুধু কথাসাহিত্যের বৃহৎ পরিসরে সম্ভব। সৃষ্টিশক্তিতে অনন্য এই লেখকদের পাঠ করে মনে হয়েছে প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি অদেখা ভুবনের রুটম্যাপ পাওয়া যাবে। নির্বাচিত লেখকদের কেউ মূলধারার লেখক, কেউ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিল ম্যাগের লেখক। কেউ বা দুটো ধারাতেই লিখছেন। শুধু সাহিত্য রচনার স্বতন্ত্রতা নয়, তাঁদের পেশা ও বয়সের ভিন্নতা, অবস্থানগত সমাজ, ভূ-রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সাক্ষাৎকারগুলোকে বহুরূপসমন্বিত, তথ্যপূর্ণ ও ব্যতিক্রমী করে তুলেছে।
চারটি পর্বে প্রশ্নগুলো বিন্যস্ত। আলাপ শুরু হয়েছে ‘আপন আলোয়, আপন আলয়ে’ পর্ব। এখানে লেখক তাঁর নিজস্ব লেখালিখি নিয়ে বলেছেন। দ্বিতীয় পর্ব ‘সাহিত্যের আলো আঁধারে’ লেখকের কাছে অনুসন্ধান করা হয়েছে শিল্প এবং বাংলা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে। তৃতীয় পর্ব ‘ব্যক্তিগত এক্কাদোক্কা’ একান্ত কথকতার। সবশেষে ‘রাজনীতির পথরেখা, বিশ্বায়নের গতি-অগতি’ শিরোনামে চতুর্থ পর্বে লেখক বিশ্বজনীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন কার্যকারণ আলোচনা করেছেন। উল্লিখিত চারটি ভিন্ন পর্বে তাঁদের প্রভূত চিন্তার সুদূরপ্রসারী দিগবলয় উন্মোচিত হয়েছে।
সংকলিত সাক্ষাৎকারগুলো এ বছরই গৃহীত হয়েছে এবং অপ্রকাশিত। সাক্ষাৎকারগুলো নিয়েছি মুখোমুখি, ইমেইল, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ এবং ফোনের মাধ্যমে। লেখক যেভাবে উত্তর দিয়েছেন, সেভাবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। সাক্ষাৎকার প্রদানকারী লেখকদের কেউ হয়তো সম্পূর্ণ উত্তর দিতে অপারগতা জানিয়েছেন। না দেবার কারণ ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখক ও ব্যক্তিসত্তাকে সম্মান জানিয়ে প্রদত্ত সেসব উত্তরই এই সংকলনে রাখা হয়েছে। লেখকের জ্ঞাতসারে এবং অনুরোধে কোথাও সামান্য সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করতে হয়েছে। সাক্ষাৎকার প্রদানকারী লেখকদের আগ্রহ, স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।
সবিনয়ে বলি- বাংলা সাহিত্যে ক্রস বর্ডার সাক্ষাৎকার সংকলনের ইতিহাসে ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সামগ্রিকভাবে কথাসাহিত্যিকদের ভাবনা চিন্তাকে জানার ও বোঝার ইচ্ছে থেকেই সংকলিত সাক্ষাৎকারগুলোর আকার দীর্ঘ হয়েছে। এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার শুধুমাত্র আত্মোন্মোচণ প্রয়াস কিংবা চলমান সময়ের সার্থক চিত্রায়ণই নয়। এতে রয়েছে সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজবীক্ষণ, মনসমীক্ষণ, এমনকি নৃবিজ্ঞান গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত। নিশ্চিতভাবে বলা যায়- অকপট, স্বতন্ত্র ও বহুমাত্রিক একেকটি সাক্ষাৎকার পাঠ শেষে, পাঠকের কাছে তাঁর প্রিয় লেখক ভিন্নভাবে প্রকাশিত হবেন।
চারটি ভূখণ্ডের নারী লেখকের নিজস্ব ভাবনা, কাজের সুযোগ, অভিজ্ঞতা, প্রতিবন্ধকতা এবং সম্ভাবনাসহ বিভিন্ন আলাপনে সমৃদ্ধ এই সাক্ষাৎকার সংকলনটি লেখক, পাঠক মহল এবং গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করি।

ইশরাত তানিয়া


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


কথাসাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ কিছুক্ষণ…

ইশরাত তানিয়া: নতুন উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন? এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: সারাক্ষণ লেখার কথা ভাবি। মাঝে মাঝে মনে হয় মাথার মধ্যে এই চিন্তার বিজবিজি কোন পাগলামি নয় তো? এটা এত বেড়ে গেছে যে আজকাল একটু সংশয় হয়। ভাবছি অনেক। লিখছি নগণ্য পরিমাণ। কেন? কারণ কী? জানি না। টায়ার্ড? মনে হয় আমি একটু জীবনটা বাঁচতেও চাই। লেখার জন্য বাঁচতে চাই না। বাঁচলাম লিখলাম দেখলাম ভুলে গেলাম উড়িয়ে দিলাম এরকম হোক। সুচিত্রা ভট্টাচার্য হাত ভেঙে কষ্ট পাচ্ছেন, লিখতে পারছেন না, এক আঙুলে টাইপ করে করে লিখছেন, এত লেখার চাপ। তার মধ্যে বিষম খেয়ে মরে গেলেন। ইস! একটু রেস্ট দরকার ছিল মানুষটার। একটু আরাম দরকার ছিল। কিন্তু পাঠক পাঠক করে সেটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলেন… আমরা ভাবি পাঠক পাঠক। পাঠক একটা অবিরল স্রোত, একটা চৈতন্যের স্রোত। এই স্রোতের খিদের সঙ্গে লেখক পাল্লা দিতে পারে নাকি? কারণ লেখক ওয়ান ম্যান আর্মি। লেখকের থেকে একা, নিঃসঙ্গ, অসহায় কেউ হয় না। আমাদের মধ্যে, মানুষের সভ্যতার মধ্যে একটা দর্শন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কর্মবীর হতে হবে। যে অনেক কাজ করছে সেই আর কী সঠিক পথে আছে। আমার মনে হয় কাজ কম করা উচিত। উই নীড টু স্লো ডাউন। এটা একটা এমন মানসিক অবস্থা যা মানুষকে আরও তলিয়ে ভাবতে সাহায্য করবে যে আমাদের রিপু আর প্রবৃত্তিকে আমরা কী করে উন্নত করব। এই যে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, কোথায় এগোনোর কথা বলা হয় আমি বুঝি না। ক্রমশ তো সভ্যতারই প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। এখন আমাদের দরকার জঙ্গল, দরকার সরল সাদাসিধে জীবনে ফিরে যাওয়া। এই সব কথাই এখন বলতে হবে। আমার এখন আর এত অহঙ্কার হয় না এই সভ্যতা নিয়ে।
এই সব কারণে আমি অনেক লেখা মনে মনে লিখে ফেলি। অনেক লেখা বাতিল করি। আপাতত এত লেখা মাথায় আছে হয়ত একটা দুটো লিখব তার মধ্যে থেকে। কিন্তু আমার একটা বাতিক হল আমি কী লিখছি সেটা কাউকে কখনো বলি না। আমার লেখার কোন প্লট হয় না। একটা জার্নি হয়। শেষ মুহূর্তে অব্দি আমি জানতে পারি না কী লিখছি।

সাক্ষাৎকার বই: আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে
সংকলক ও সম্পাদক: ইশরাত তানিয়া
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশক: রাজীব চৌধুরী
প্রকাশনা: চৈতন্য প্রকাশনা

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত