| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প : ঝড়ের পরে । আদিমা মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

প্রথিতযশা সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী মৃত্যু নদীর ওপারে যেদিন হারিয়ে যান তারিখটি ছিল আটাশে জুলাই ২০১৬। সুইনা বাজারে এবছর মেলা বসার কথা ছিল। খুন ছিনতাই গাজা দলাদলি নিয়ে সুইনা বাজার উত্তপ্ত। মেলা কমিটি মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয় এই পরিস্থিতিতে মেলা বসানো ঠিক হবে না। তারপর নভেম্বর ২০১৭ মেলার দিন ঠিক হয়। ব্যবসায়ীরা ঘর বাঁধতে  আরম্ভ করে।

ও বাটুলের বাপ তোমার ওবায়দিয়া খাইরুন অগুরে তোরা জায়গা দিও। সুপারি গাছর খোল দিয়া পাখা, জামাবেতু বাঁশের খলুই কয়টা বানাইছে। লইয়া বইবো কেউ এয়হ করিয়া লইলে  লইবা। চাইরগু পুয়া-পুড়ি রাখিয়া  জামাই কোন লঙ্কাত গেছে। ছিনাল রেন্ডি একটার লগ ধরিয়া। অত্ত খাউজ তারার। ঘর বাঁধা কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে, ফিরোজা  পাগলী বকে- কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ ১৯৫১ নাহয়  ১৯৭১। পাগলীর কথা কে শুনে। এই কথার অর্থ কী? কিছু মানুষ আছেন পাগলীর কথা কে নিয়ে তর্জমা করেন। তারা মনে করেন পাগল এরা শুভ-অশুভ দেখতে পায়। কিছু একটা আগাম ইঙ্গিত দিচ্ছে পাগলী।  সেবার আর  মেলা বসানো গেল না।  

বিরাট খোলা মাঠে এবার শুরু নাটক যাত্রাপালা  গান প্রদর্শনী…  মাঠের চারদিক ভরে উঠে নানারকম দোকানপাট বাছাচোরের  মাথায় হাত। থানায় খুব গরম এক দারোগা এসেছেন এদিক ওদিক করতে দেন না। বাজারের লোকের মার খাওয়া তার আর গায়ে লাগে না। সবাই বলেন ইগু মেকুর অই গেছে। কত দারোগার পকেট কামাই করলো, বাছা। এবার কিন্তু রীতিমত ভয় পাচ্ছে।

 লাল নীল সবুজ হলুদ বিরাট বড় ছাতার নিচে বসে কানা ছয়ফুলের লিখা গান গাইছে কানা কুতুব। দুতারা বাজিয়ে গান ধরে, দিনের নবী মোস্তফায় হাটিয়া যাইতে রাস্তায়, হরিণ একটি দেখেন বান্ধা গাছের গোড়ায়  রে।… গানটি শেষ হতেই হবিবুর মোল্লা মুখের বিড়িটা   হাত বাড়িয়ে বলে-

অউ নেও বা একটান মারো। কুতুব চোখে দেখে না কিন্তু তার অনুমান অনুভূতি বড় প্রখর। বিড়িতে টান দিয়ে বলে-

ভালা আছোনি হবিবুর ভাই

আছি, আল্লায় রাখছইন।

আইচ্ছা কওছাইন,হিদিন দারোগায় তোমারে ইতা কিতা কইল।

না বা ইতা মাত তুলিছ না। আমি যাইয়ার গা। বিবির মোরকা (মোরগ) এগগু বেচাত আনসলাম, ইগু কেউ দরদাম করইন না, খালি দারোগায় আমারে কেনে মাইরলো… জবাব দিতে দিতে আমি হেরান।

গোসা করিওনাতে। আমারে কও, অনো বও।

আইচ্ছাতে  কই হুনো। ইন্দু (হিন্দু) বেটি এগু এক বছর থাকি বিছানাত। কিতা বেমার কোন ডাক্তারে ধরতে পারইন না। আমি তবিব করিয়া বাক্কা ভালা করিলাইসি। হিদিন তারারে কইসলাম একটা বাওন দেওয়া লাগবো, তারা রাজি অইছন। দশটা আওয়া বাসন,পাঁটা একটা, পাঁচটা  ধুতিচাইর চাটা হরু মোমবাতি, ধূপকাটি… 

ইতা হুনিয়া তারা কইনমিয়াসাবতুমি লইলাইও। টেকা দেলাই আমরা। খুশি অইয়া ২০ হাজার টেহা দিছিলা। কোন লাংগির পুলায় গিয়া তার মার হাইরে কই দিছে। থানাত আনিয়া মারিয়া তইছে না, কুত্তার বাচ্চায়। এগুতায় ধরছইন না। আমিও আল্লাহর কাছে বিচার দিয়া তইছি। আগে হুনলাম ঘুষ খায় না, এখন লাখ টেকার নিচে লয় না বুলে।

সঞ্জীবের ভাঙ্গা মোবাইলের দোকানে মেয়েদের প্রচুর ভিড়। দাদা আমারটা আজ চাই। তাড়াতাড়ি দাও। সঞ্জীব একটু টিপাটিপি করে মোবাইল, তারপরে বলে, না আজ হবে না দেখছি। কালকে হয়ে যাবে। আসলে সে মোবাইলের কিছুই জানেনা। মোবাইল কালেক্ট করে রাঙির খাড়ি এবি হাউসে নিয়ে দেবে। এইটা তার বিজনেস। কিছু টাকা পাওয়া যায়। হজে যাওয়ার পাসপোর্ট দালালি, রোগি নিয়ে দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু, ভেলুড় যায়। শিক্ষিত বেকার ছেলেটা। এই করে সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনরকম। 

ময়না কাকু, ও ময়না কাকু

কিতা মাতস বেটা, অউ দেখ ওখানো আমরার নাটক অইবো।

কোনটা কাকু।

পাঁচ গ্রামের কাগজ কলেরটা।

নাটকটা ফাটাফাটি হয়েছে কাকু। কাগজে টিভিতে কর্মচারীদের ধর্না, কান্না দেখে মা বলেছিলেন আমাদের নাটক দেখবেন।

নিয়ে আসিস মা, বউ বাচ্চাকে। শনিবারের রিহার্সাল  মিস করিস না। বিশ্বজিৎ শীল দীপঙ্কর চন্দ ফারুক কমলদা এরা আসবেন। কাগজকল নিয়ে কথা বলবে।

সত্যিই এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান, কাছাড়ের শান, চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভাবাই  যায় না। কর্মচারীদের পরিবার কিভাবে চলবে কেউ একবার ভাবলো না। সরকার ও উদাসীন। ইউনিয়নগুলো একে একে সরে গেল…। মেলা না হয়েও যেন মেলার আকার ধারণ করেছে সুইনা বাজার। মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নিষ্ঠুর সন্ত্রাসবাদীদের অত্যাচার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সভার আয়োজন করেছে মেলা কমিটি। সুশান্ত প্রশ্ন করে তাজমুলদাকে

অতনু দাস এর উত্তর সম্পাদকীয় পড়েছেন পত্রিকায়।

তও তও, বনর পশুর থাকি বেশি হিংস্র ইগু। হালার গতরো থাকি  বাংলাদেশী গন্ধ  এখনো গেল না। মুসলমান অখলে বাচাইলা এলকু হি বেটা অই  গেছে।

তাজমুল দা ইগে ইতিহাস সারা বিকৃত করিলার।

ইগুরে পাত্তা দিস না সুশান্ত। আমরা চলিয়ার নানি কছাইন। আমরার বাপ-দাদাও মিলিয়া জিলিয়া চলছইন।

 অন্যদিকে চলছে প্রবীণ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে নিয়ে আলোচনা, বাতাসে ভেসে আসছে কথা।” আমার সংবিধান আমাকে ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে সাম্প্রদায়িক হতে শেখায় নি।” কানা কুতুবের গান চলতে থাকে-কি বলিব হায়রে হায় কলিজা ফাটিয়া যায় গৌরী লঙ্কেশ খুন হইলা নিজের এলাকায়। গৌরী লঙ্কেশ খুন হইলা নিজের…কুতুবের গলায় এখন ও সুর আছে। ভাবুক হয়ে তালে তাল মেলাচ্ছে ময়না কাকু। অনেক দূর গ্রাম ঘুরে বেড়ায় ময়না কাকু গানের জন্য। আজাদ তইমুছ, কানা ছইফুল, কানা কুতুবউদ্দিন এরা থাকতে সুইনা বাজারে আড্ডা জমত ভালো।ধু ধু জ্যোৎস্নায়  চাঁদ নেমে আসত আদন মিয়া চাচার উঠোনে। ময়না কাকু আফসোস করে বলে, ‘অইনা নিয়ার নারে নারে নারিয়ারো নারেরে… গাট্টা জোয়ান মোরে মার গয়া রে নাইরে আগের গাজীর গান। ছয়ফুল যখন দুতারায় সুর তুলত, তোতা তোমার দেশের মান রাখরে বিদেশি তোতা… আবেগে মানুষ খুশি হয়ে ময়না কাকুর আলখাল্লায় টাকা  গেঁথে  দিতো। খাইরুনদির  ব্লাউজের সেফটিপিন পর্যন্ত লোকে চেয়ে নিত। তারপর চাচার ঘরের হলুদ রঙ্গের পোলাও, সিদ্ধ ছানা আর লাল ছোট মরিচ ভাজা! কি যে স্বাদ।

ওদিকে স্টেজে চলছে কম্পিটিশন। সব চা বাগিচার দল। ডলু, বিন্নাকান্দি, দামছড়া, জারুলতলা, দেওয়ান, আরকাটিপুর, কালাইন,কুম্ভা, ভরাখাই…। বিচিত্র দেশ বিচিত্র ভাষা! বিভেদের মাঝে যেন মহা মিলন ক্ষেত্র। নৃত্যের দাপটে স্টেজ নড়াচড়া করে। সুমন সুবীররা তাড়াতাড়ি নিচে ঢুকে খুঁটি লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভলান্টিয়ার কিছু ছেলে আজিম সারওয়ার বাবন সূর্য তপু একটু ফুরসত পেয়ে চলে গেছে মোবাইল নিয়ে বাগানী মেয়েদের সাজঘরে সেলফি তুলতে। আজ যে কতজনার প্রোফাইলে থাকবে বাগানী মেয়ে। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সাথে আজ তারা মাতোয়ারা। সূর্যকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। মুংরির মা খুঁজে মুংরিকে।

এ মুংরি তুনহি ইতনাটা সমই কাহালে ছিলিস রে? ই লাছটা সিরাইয়া গেলে হে হামনির ঝুমুর গাওনটা শুরু হইয়ে যাবেক,এ মুংরি তোকে   বলছিলুম কি… তোর সংতি ই আনজান লড়কা কে তো হামনি  চিনতে নাহি পারলি… উকে তো ভাই কুনুদিন ও নাই দেখলি… ই তুর কে লাগে বঠে।

এই মাই…তু মুখ বন করবি নো লাই… দুসরা লোক শুনলে হামি নো বেজানটা শরমায়ে যাবো মাইরি।

এই কম্পিটিশনের প্রাইজমানি পাঠিয়েছেন শিলচরের চিকিৎসক এবং সাহিত্যিক।তাদের স্বর্গীয় মা-বাবার নামে। আমাদের রসিক মাস্টারদা সূর্যসেন বিশ্বজিতদা  সেগুলো এনাউন্স করার সময় আরো কিছু হিউমার জুড়ে দেন।

তচির আলী চাচা ঘোড়া নিয়ে সমস্ত মাঠ এক চক্কর মারে। সুইনা বাজারের পূর্বাঞ্চলে আজ ওই তচির আলী চাচার চৈতকই আছে। একদা এই ঘোড়া পরিবহন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এক অন্যতম ভূমিকা বহন করে। মহারানা প্রতাপ সিংহের আত্ম বলিদানকারী-ঘোড়া চেতক‘  কে না জানে এই নীল ঘোড়ার ইতিহাস। তছির আলী চাচার ইয়া বড় গোঁফ দাড়ি। ঘোড়ার উপর চড়ে নিজেকে রানা প্রতাপই ভাবে। গ্রামের রাস্তা যেখানে গাড়ি যেতে পারে না সেখানে ইট বালু পাথর বহন করে চাচার চেতকই। আজ বিচিত্র সাজে সেজেছে চৈতক।

বাবা বাবা ঘোড়া চড়বো

চাচা আমার বাচ্চাটাকে একটা চক্কর দাও… এক চক্কর ২০ টাকা।

চল্লিশ টাকা দেবো ওর মা ও চড়বে। চৈতক চলছে চক্কর মেরে আবার নাল নীল ছাতার নিচে রানা প্রতাপ এর সামনে। ৪০টাকা বাড়িয়ে দেয় শিবুদা। ২০ টাকা ফেরত দেয় চাচা। ঝড়ের পরে সুইনা বাজারের এই রূপ সোশ্যাল-মিডিয়ায়-ভাইরাল হতে সময় লাগে নি।

ভুবন- মৌ খবর পেয়ে ছুটে  চলে সুইনা বাজার। ব্রিজটা পেরিয়ে গেলে ওপারে ছড়িয়ে থাকা আদিগন্ত বিস্তৃত ফসল বোনা মাঠ সোনা রোদে ঝলমল করছে পাকা ধান। বিশাল উদার আকাশের গায়ে পাখিদের বৃত্তকারে ছুটে বেড়ানো, বরাকের জলে ডিঙ্গি নৌকায় বসে মাঝির ভাটিয়ালি গান, কাঙ্খের কলসি গেলোরে ভাসি মাঝিরে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়া রে… এসব দৃশ্য দেখে মৌ এর আনন্দের সীমা থাকে না। আবেগে বুকে জড়িয়ে নেয় ভুবনকে।  বলে, জানো এই মুহূর্তে অনুভব করতে পারছি আমর একটা আর্ট আছে। হাঁটতে-হাঁটতে তারা শুনতে পায় গানের সুর  –মহাশয়ের টি স্টলএর  সামনে গাছটার নিচে গাট্টার গান।গায়ক মেয়েটির গায়ে লাল শাড়ি, বড় একটা লাল টিপ মাথায় গাইছে—যদি বেহেশতে যাইতে চাও গো অন্তরে রাইখো আল্লার ড… র/আমি আপনার মেয়ের বয়সী শরীয়তের হইয়া/মারিফতের বিষয়ে কিছু সাওয়াল যাব গাইয়া/বেয়াদবি নিবেন না দেইখা আমার ভান/হাদিস কুরান মানেন না কেমন মুসলমান /মোল্লা মুন্সি ক্ষ্যাপা কেন আপনাদের উপর গো অন্তরে/ রাইখো আল্লার ড… র।

ঝাঁকড়া চুলওয়ালা বাবাজি উত্তর দেন, ‘যদি আল্লাহর সন্ধান চাও গো প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর/কুরআন হাদিস বুঝতে কিছু জ্ঞানের প্রয়োজন/দুই  পারা সিপারা পইড়া বুঝবে কি মদন/নিজেরাই বুঝে না অন্যের বুঝায়, সবলোকেরে ভুল বুঝাইয়া কাঠমোল্লারা খায়/বেহেস্তের তলব করি নাই  দুজখের ড…র গো, প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর…

ডান দিকে মোড় নেওয়ায় মুখে বাধে ফিরোজা পাগলি কে নিয়ে জটলা। কেউ হাহা করে হাসছে অট্টহাসি। কেন এরকম করল পাগল একটাকে? এত নোংরা শরীর। ছিঃ!

কী রুচি পুরুষমানুষের। মৌ ভুবনকে বলে শুনো, যেকোনো উৎসব-আনন্দে মানুষের কাম ভাব বেড়ে যায়। পাগল ও হয়তো আনন্দে মেতেছিল। রাতে আবার প্রবল ঝড় বৃষ্টি  সুইনা বাজার মাটে জলে জল। নদীর স্রোত বইতে থাকে বিপদনাশিনী মূর্তি, খাইরুনের পাখা-খুলই কাজল দিদির পার্লারের কোন শিশি খুলে জল ফেনায় ফেনাময়।  এ যেন জলের এক নতুন খেলা। পাগলি রাম রহিমের পোস্টার বুকে করে কোমর জল দিয়ে ছুটছে। ধ্যাৎত্যারি। কে রে এত সাবান মেখে দিয়েছে জলে, হিহিহিহিহিহি, হিহি জল আজ তুই স্নান কর। ধুয়ে যাক সাফ হয়ে  যাক, ভাসিয়ে নিয়ে যাক।

তিন তলার উপর থেকে মেলা কমিটির সম্পাদকের মা রসুই বিবি তসবিহ হাতে ঝড়ের পরের এই দৃশ্য দেখেন। দেখেন মানুষের লীলা খেলা। দেখতেই থাকেন।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত