| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প

ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: ব্যাটন । শিবানী ভট্টাচার্য দে

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

স্বরূপ ধাক্কা খেয়ে একপাশে পড়ে গিয়ে ফিরে দেখল। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি, কিছুটা ভয়ের, কিছুটা পরাজয়ের— আচমকা বাধার সম্মুখীন হয়ে নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরের ভেতরে, নিজের এতদিনের দখলদারিতে যেখানে তার অপ্রতিহত প্রতাপ, সেখানে অতর্কিত, অভাবনীয় এই বাধা, ধাক্কা ও বেসামাল পতন! প্রতিহত হয়ে সে ধীরে ধীরে ফিরে গেল নিজের জায়গায়।

শোভনা উঠল চুপচাপ। সে কখনো ভাবেনি তাকে ঘিরে এই কাণ্ড হবে। সে অভ্যাসমত মত তার গালে, ঘাড়ে, বা মাথায় সজোরে চড়চাপড় খাবার জন্য প্রস্তুত ছিল। এই হঠাৎ, এই প্রথমবার তার গায়ে হাত পড়বার আগেই হাত ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। অন্য সময় স্বরূপের মুখেও চলত সমান গালিগালাজ, তার মাবাপকে উদ্দেশ্য করে, তার মা ও তার চরিত্রের যতরকম খিস্তি করা যায় সব দিয়ে। আজ এক মুহূর্তে সে সবও চুপ।

শরণ্যা মুখ নিচু করে ধীরে ধীরে নিজের পড়ার জায়গায় ফিরে গেল। আজ আর সারাদিন তার মন পড়ায় বসবে না।  সফল প্রতিবাদের চাইতেও অন্যায়ের বোধ ভেতর থেকে দুরন্ত কান্নার আকারে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু  বাড়িতে দিনের পর দিন চলতে থাকা এই অত্যাচারের   প্রতিকারে  কী করা যেতে পারে অনেক ভেবেছে, ভগবানকে ডেকেছে। আজ সকালে সহ্যের অতীত হয়ে গিয়েছিল। আটকাতে হবেই ভেবে গিয়েছিল সে, চড় মারতে তোলা ডান হাতখানিকে আটকাতে সে বাঁ কাঁধে ধাক্কা মারল, তাতেই যে বাবা যে পড়ে যাবে, তা সে ভাবতে পারে নি।

পরের ছেলেমেয়েরা, যাদের বয়স যথাক্রমে চোদ্দ, বারো, নয়, তিন, তারাও ঝগড়া শুরু হয়েছে শুনে ভীতমুখে উঁকি দিচ্ছিল। বাবাকে প্রতিহত হতে দেখে তারা আশ্চর্য, দিদির থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। শরণ্যা নিজের পড়ার জায়গায় গিয়ে বসে মাথা গুঁজল — চাপার চেষ্টায় কান্না দ্বিগুণ হয়ে আসছিল। পরের বোন প্রমিতা তার কাছে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল, ঠিকই করেছিস তো। কাঁদছিস কেন? শরণ্যা মারমুখী হয়ে বলল, ‘কী ঠিক?’ প্রমিতা একটু হকচকিয়ে গেল। ‘কেন, তুই যে বাবাকে —’। আরো রেগে শরণ্যা বলল,‘যা এখান থেকে, ভাগ্‌।’

এ বাড়িতে রোজই ঝগড়া। টানাটানির সংসার, খুব কমে ঘর চালাতে হয় শোভনাকে। তবুও তো জিনিষ ফুরোলে আনতে হয়। আনবার কথা বললেই স্বরূপের মাথা গরম হয়ে ওঠে। পরিবার যত বড় হয়, খরচ তত বাড়ে, তখন এদিক থেকে টেনে ওদিকে জোড়া দিতে হয়, কারণ আয় তো বাড়ে না। তখন চিনি ছাড়া চা, অল্প তেল মশলায় রান্না হয়, তা স্বাদু হয় না — তার মেজাজ খারাপ হয়। কোনো কাজে সামান্য খুঁত থাকলে মাথা গরম হয়ে যায়। বাচ্চারা দুষ্টুমি কিংবা অসাবধানে কিছু নষ্ট করলে বা ভাঙলে দায়ী তারা তো বটেই, তাদের মা ও দায়ী। সে সব অভিযোগের উত্তর দিলেই পালা শেষ হবে না। স্বরূপের অভিযোগ অযৌক্তিক ও লম্বা হতে থাকে ।

‘বাপের বাড়িতে যার এক পয়সা দেবার কেউ নেই কোনওকালে, তার তো সাবধান থাকা উচিত যাতে ঘরে কিছু নষ্ট বা অপব্যয় না হয়?’

‘রান্না এমন করেছে যে মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। ঠিক করে রান্না করতে পারে না এমন অকম্মা মেয়েমানুষ ।’

‘হ্যারিকেনের কাচ ভাঙল কি করে? বাচ্চাদের বলেছিস কেন কাচ পরিষ্কার করতে?’

‘নিজে কি করিস সারাদিন?’

এইসব দিয়ে শুরু হয়, প্রথমটা তুইতোকারি করে। চুপ করে থাকলে হয়তো হাত উঠাবে না, কিন্তু কত আর মুখ বুজে থাকা যায়। সারাদিন কাজ, বাচ্চাগুলোর তদারকি, দু-তিন বছর পরপর গর্ভধারণ, এর উপর দিনের পর দিন অভিযোগ ও মাবাপ তুলে গালি-খিস্তি শুনলে তারও রাগ চড়ে, পাল্লা দিয়ে তার ও গলা চড়ে।

শোভনাদের পরিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিল উদ্বাস্তু হয়ে, স্বরূপদের পরিবার ও তাই, শুধু কিছুদিন আগে এসেছিল। গ্রামে বাড়ি বানানোর জন্য স্বরূপের বাপ মা গ্রামের প্রান্তে একটা টিলার একাংশ কিনতে পেরেছিল; ওদিকে সমতল জমির মাঝে মাঝেই ছোটবড় টিলা আছে, লোকে টিলাতে ঘর বানায়। কিছু চাষের জমিও তারা কিনেছিল সস্তা পেয়ে। এদিকের জমির মালিক ছিল মুসলমান, টিলাগুলোতে উদ্‌বাস্তু পরিবারগুলোর বসতি হবার পর ধানি জমির মালিক কম দামে জমি বিক্রি করে দেয়।

স্বরূপ চেয়েছিল জমিজমা, চাষবাস, যা তাদে্র ভূতপূর্ব দেশে তারা ফেলে এসেছিল। বয়স কম, ভেবেছিল কয়েক বিঘা জমি, থাকলে নিজে খেটে চাষ করবে, জমির ধান ও সব্জি সারা বছরের খোরাক জোগাবে, পুকুর কাটবে, তাতে মাছ পাওয়া যাবে, টিলাবাড়ির বেশ খানিকটা জমি আছে, তাতে বেশ ফলের গাছ বাঁশ ইত্যাদি লাগালে বিক্রি করে কিছু নগদ টাকা আসবে, গরু পুষবে, দুধ খেয়ে কিছু বিক্রি করেও আয় হবে। গেরস্তের তো এই করেই বছরের পর বছর চলে এসেছে। মাটির পেছনে সময় দিলে মাটি ও প্রতিদান দেয়।

কিন্তু তাদের কপাল খারাপ। ধানি জমি ও বাস্তু জমি যা-ই কেনা হয়েছিল, তার বেশির ভাগটাই বেশ অনুর্বর। গ্রামের আর দশ বাড়ির মাটি বেশ দোঁআশ বা লাল মাটির, কিন্তু তাদের বাড়ির মাটি খুড়তেই শক্ত এঁটেল মাটি, যাতে বিশেষ কিছু ফলানো যায় না। বড় গাছ কিছু আগে থেকেই আছে, বা লাগালেও হয়, কিন্তু ফল তেমন ধরে না। ধানি জমি যা আছে, সেগুলো তিনদিক থেকে টিলায় ঘেরা, ছায়াচ্ছন্ন থাকে প্রায় সারাদিন। সে কারণে ধান ভাল হয় না, যা হয় তাও পোকায় খেয়ে যায়। ফলে জমি থেকে যা উৎপন্ন হয়, তাতে বছর তো দূর, ছমাস ও খাবার কুলোয় না। পরিশ্রমও প্রচণ্ড। কাজেই যা হারিয়েছে সেরকম কিছু ফিরে পাবার আশা রইল না। মাঝে মাঝে স্বরূপের দূরের কোনো শহরে চাকুরিরত ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তি দেখাশোনার মূল্যস্বরূপ পাঠানো কিছু নগদ টাকাই সে সময়ে সম্বল হয়ে দাঁড়ায়।

স্বরূপ কিছু লেখাপড়া জানত, যদিও হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোয় নি। শোভনা ও কিছু লেখাপড়া করেছিল। সেই সময়ে সেই পড়াশুনোয় ছোটখাট চাকরি পাওয়া যেত। তারা দুজনেই প্রাথমিক শিক্ষকতার পরীক্ষা দিয়েছিল, হয়তো ভাবনা ছিল চাকরি পেলে দুজনে এক স্কুলে নেবে। স্বরূপ সেই পরীক্ষায় উত্‌রোতে পারেনি, কিন্তু শোভনা পেরেছিল, চাকরি পেয়েছিল, উদ্বাস্তু ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকার কাজ। স্কুলে একজন পুরুষ টিচার ইন চার্জ, আর সে। জয়েন করার দু মাস পুরো হবার আগেই তাকে কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছিল, ‘ভারি তো কাজ, ঘরের বউকে চাকরি দিয়ে মাগি বানানোর কল! বাড়ির নতুন বউ পরপুরুষের সঙ্গে একজায়গায় কাজ করতে থাকবে!’ শোভনার মা কিন্তু স্বরূপকে বলেছিল ‘ওকে কাজটা করতে দিলে ভাল করতে। মাইনর পাশ ছিল। ঘরে কিছু টাকাও আসত ।‘ ‘কেন, মেয়েকে দিয়ে মাগিবৃত্তি করালেই পারতেন।‘ কানে আঙ্গুল দিয়ে শোভনার মা চলে গিয়েছিল।

বছর ঘুরতে পুত্রসন্তান এল। কিন্তু তিনমাস পুরো হবার আগে মারা গেল, গ্রামের অন্তত দশ কিলোমিটারের মধ্যে হাসপাতাল বা ডাক্তার নেই, গাড়ি  নেই।  ফলে কি হয়েছিল বোঝাও গেল না। কিন্তু দোষ হল শোভনার, সে কদিন বাইরে গিয়ে খারাপ হাওয়া লাগিয়ে এসেছিল! এর পরের মেয়েটিও বছর দেড়েকের হয়ে মারা গেল। তারপর শরণ্যা কোনো রকম টিকে গেল, তার পর একটা মেয়ে একটা ছেলে, তারপর আবার একটা মেয়ে। এরপর একটা মেয়ে আবার এক মাসের আগেই গেল। শোভনার শরীর ও ধ্বসে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলে একটাই, সেজন্যে অন্তত আরো একটি ছেলের দরকার, স্বরূপের দাবি। সে দাবি শোভনা পূরণ করতে প্রায় না পারার অবস্থায় এসে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় হল আরেকটা ছেলে।

মা মার খায় কেন তা ছোট শরণ্যা বুঝত না, আর ভাবত এইসব গালির কথার অর্থই বা কী! ঝগড়া শুরু হলে প্রচণ্ড ভয় পেত। সেই ভয় আজ কেন জানি ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু রেখে গেছে কষ্ট।

বাবাকেও সে ভালই বাসত, বাবাই তো পুজোর সময় তাদের বেড়াতে নিয়ে যেত, পৌষ মাসের সংক্রান্তির মেড়ামেড়ির ঘর বানিয়ে দিত, কালীপুজোর রাতে চোদ্দ প্রদীপের নৌকো বানিয়ে দিত, পরীক্ষার পর নতুন ক্লাসে উঠলে বইপত্রের সঙ্গে কয়েক দিস্তা কাগজ কিনে বাড়ী বসে পরিপাটি খাতা সেলাই করে উপরে সুন্দর হস্তাক্ষরে নাম লিখে দিত। বাবার যদি কদাচিত অসুখ করত, তখন তার ভয় লাগত, যদি বাবার কিছু হয়! বর্ষায় ভিজে ঘরে এলে বাবার বুকে পায়ে তেল মালিশ করে দিত, বাবা তাকে তাই মাঝে মাঝে মা বলে ডাকত। কিন্তু বাবার ওই বড় দোষ, এই হয়তো ভাল, কখন যে মেজাজ পালটায়। সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। তারা ভাইবোনেরাও কত মার খেয়েছে, সে নিজে অবশ্য আজকাল আর খায় না, কিন্তু তার ভাইবোনেরা এখনো বকা খায়, মার খায়, কখনো বেশি, কখনো কম, কখনো দোষে, কখনো বিনা দোষে। বাবা মায়ের উপর তো অত্যাচার করেই, খিস্তি করে, মারে। মনে হয় যেন যা কিছু খারাপ, সব কিছুর জন্যই বাবা পরিবারের মানুষকে দায়ী ঠাউরে তাদের উপর ঝাল মেটাচ্ছে।

শরণ্যা এমনিতে রোগা, যদিও মাথায় সাধারণের চাইতে একটু লম্বা। তার হাতে খুব যে একটা জোর আছে তা নয়, সে একটা কঞ্চি ও কাটতে পারে না। কিন্তু বাবার কাঁধ যখন সে ঠেলে দিল তখন কত সহজে বাবা পড়ে গেল। মানে বাবার গায়েই জোর কমে গেছে। কিন্তু যখন মারে, তখন সজোরে মারে, খুব বেশি হয়তো নয়, দুচার থাপ্পড় কিংবা গরু তাড়ানোর পাচনির বাড়ি। মাঝে মাঝে বলে লাঠি দিয়ে মারবে। লাঠি নিয়ে তেড়ে ও আসে। বিছানার নিচে একখানা দেড়ফুট লম্বা দা রাখে। মাঝে মাঝে কেটে ফেলবে বলেও ভয় দেখায়। সেই কবে নাকি দেশে দাঙ্গা হয়েছিল। তারপর এই দা বানানো এবং বিছানার নিচে রাখা হয়ে আসছে, একটা সুপুরির খোলের বানানো খাপের ভেতর। সীমান্তবর্তী গ্রামদেশ বড় শান্তির জায়গা নয়, তায় অভাব সর্বত্র, তাই ছিঁচকে চুরি, ইর্ষায় অন্যের ক্ষতিসাধন, গরুছাগল ছেড়ে দিয়ে অন্যের ক্ষেতের ফসল খাওয়ানো, সেসব সাধারণ ব্যাপার তো আছেই, সীমান্তের ওপা্র থেকে কখনো গরুচুরি, এবং ডাকাতি ও হয়ে থাকে। এরকম ক্ষেত্রে স্বরূপের ধারণা এই রকম একখানা দা বাড়িতে রাখা উচিত। সবাই অস্ত্রকে ভয় পায়।

বড় এবং যত্নশীল হবার কারণে শরণ্যা নিজে মার খায় না আজকাল। আরো একটা কারণ আছে। সে পড়াশুনোয় ভাল, এবারে হায়ার সেকেণ্ডারি দেবে। মায়ের তাকে দিয়ে ভবিষ্যতের একটু আশা আছে। এ বিষয়ে বাপের ভাবনা কী তা জানা যায় না, তবে লেখাপড়া করতে মানা করছে না, যেখানে আদ্ধেক মেয়েই স্কুলে যায় না, যাদের পাঠানো হয়, তাদের বেশির ভাগই স্কুল ডিঙায় না অভিভাবকের উৎসাহ না থাকার কারণে। শরণ্যা স্কুলে ভাল রেজাল্টের কারণে এখন স্কলারশিপ পায়, তার পড়ার খরচ দিতে হয় না। স্বরূপ বউকে চাকরি করতে দেয়নি যদিও, কিন্তু শোভনা যখন মেয়েকে বলে, ‘ভাল করে পড়ো, বড় হলে চাকরি করতে হবে’, এ কথায় স্বরূপেরও আপত্তি নেই বলেই মনে হয়। হালে অনেক মেয়েই পড়ছে, চাকরি করছে, খবর পাওয়া যায়। তবে এই লক্ষ্যে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার, তার জন্য শোভনা মেয়েকে যথাসম্ভব ঘরের কাজ থেকে বাঁচিয়ে পড়াশুনোয় সময় বাড়ানোর চেষ্টা করলেও স্বরূপের মোটে সেরকম খেয়াল নেই।

বাবা মাকে মারে এটা সে ছোটবেলা থেকেই দেখেছে। শোভনা কাঁদত, মাঝে মাঝে খাওয়া বন্ধ করত। ছোট কোলের শিশু কাঁদত খিদেয়। শরণ্যা ভয়ে বোবা হয়ে যেত। শোভনা দুবেলা পর আবার নিজেই উঠত, কাজকর্ম করত, খেত, উপোস আর কত সহ্য করা যায়। ছেলেমেয়ে ছোট ছোট। যত্নের অভাবে চিকিৎসার অভাবে, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মরেছে কজন। যে ক’জন বেঁচে আছে, তাদের মুখে অন্ন তুলে দিতে খাটাখাটুনি সারাদিন স্বামী স্ত্রী দুজনেরই। কিন্তু আড়াই তিন বছর পর পর পরিবারের সংখ্যাবৃদ্ধি হয়। খাদ্যে টান পড়ে, পরিধেয় ছিঁড়ে ন্যাতা হয়ে যায়, নতুন কেনার সঙ্গতি থাকে না, অসুখে ডাক্তার কোবরেজ দেখানো দূরের কথা।

ছোট ছেলেটা হবার আগে যেহেতু শোভনার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মনে মনে ভয় করছিল যদি না বাঁচে। মাঝে মাঝে রাতের দিকে বাবার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছিল শরণ্যা এ নিয়ে। অবোলা ভয়ে সে রোজ মায়ের জন্য প্রার্থনা করত। গ্রামের এক জেঠিমা প্রসবের সময় মারা গিয়েছিলেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের কষ্ট দেখেছে সে, তাদের মলিন মুখের কথা তার মনে আছে। তার মা মরে যাবে ভাবলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সব মিলিয়ে শেষপর্যন্ত মা মরে নি, ভাইটাকে নিয়ে কষ্ট পেরিয়ে বেঁচে এসেছিল।

ক্লাস টেনে ওঠা শরণ্যা কিন্তু বন্ধুদের সে ভাইয়ের জন্মের খবর বলতে পারেনি। বড় হবার পর তার বন্ধুদের কারো ভাইবোন হতে শোনে না, তাদের ভাইবোনের সংখ্যাও কম। তারা স্কুলের মাইনে দিতে পারে, হেড মাস্টারের কাছে গিয়ে কেঁদে কেটে মকুব করাতে হয় না, যেমন তার ক্ষেত্রে হয়েছিল। সে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কোনো কিছু কিনে খেতে পারে না, কারো বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠানের নেমন্তন্নে ভাল জামাকাপড়ের অভাবে, এবং কোনো উপহার কিনতে টাকা লাগবে বলে তার যাওয়া হয়ে ওঠে না। সবাই জানে সে গরিবের মেয়ে। আর তার কতগুলো ভাই বোন! মানুষের জন্মপদ্ধতি ঠিকঠাক না জানলেও তার একটা রহস্যময় আঁচ সে টের পায়। সেটা যে নিয়ন্ত্রিত করা যায় তা সে বুঝতে পারে। তাই ছোট ভাইয়ের জন্মের খবর বন্ধুদের জানাতে তার লজ্জা করে।

স্কুলের সময়টুকু পার করে বাড়িতে ফিরে বাবামায়ের কাজে সাহায্য করতে হয়, ভাইবোনদের দেখতে হয়, সন্ধ্যায় যতটুকু পারে পড়াশোনা করতে হয়। তাই তার গালগল্প করার সময় নেই, জীবনের অনেক দিক যা বন্ধুদের সান্নিধ্যে গল্পগুজবের মাধ্যমে উজ্জীবিত হয় তা তার অজানা অধরা থেকে গেছে। তার জন্য সে এখনো তেমন অভাব বোধ করে না, শুধু মনে হয় বাড়িতে যদি শান্তি থাকত।

ছোট ছেলের জন্মের পর শোভনাও বুঝল যে তাকে সচেতন হতে হবে। বাড়িতে দুখানা ঘর, একটিতে তারা শোয় দুটো বিছানায়, অন্য ঘরে এতদিন স্বরূপের মা থাকতেন, শরণ্যা পড়াশোনা করত সেখানে, রাত্রে শুত ঠাকুরমার কাছে। বাড়িতে নিত্য অশান্তির চোটে তিনি তাঁর ছোট ছেলের কাছে চলে যাওয়ায় শোভনা সেই ঘরে কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে শুতে থাকল। শরণ্যার মনে হল মা যেন তাকে নির্ভর করে তার কাছে আড়াল খুঁজছে। তার মনে পড়ল, ছোটবেলায় বাবা মাকে তেড়ে মারতে এলে সে দরজায় দুদিকে দুহাত দু পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেত বাবাকে আটকাতে। কিন্তু বাবা তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে ভেতরে ঢুকে মাকে মারত।

মাস চারেক পর একদিন দরজায় শব্দ। ঘরের দরজা বারান্দার দিকে খুলে, তাই তারা দরজা আগল দিত। সেটা খুলবার চেষ্টা করছে কেউ। শোভনার ঘুম পাতলা, চিৎকার করে উঠল। শরণ্যাও জাগল ভয় পেয়ে। বাইরে থেকে স্বরূপ বলল, এত চেল্লাচ্ছ কেন, আমি তো, বলে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল নিজের বিছানায়।

কদিন পর আবারও। এদিনও শোভনা ঝাঁঝিয়ে উঠল। শরণ্যা উঠল। এতরাতে কি বাবা মারতে আসছে? বাবার এই নৈশ অভিযানের কারণ সে বুঝে ওঠে নি তখনো। শুনল বাবা মার উদ্দেশ্যে খিস্তি করতে করতে চলে যাচ্ছে। এও বলতে শুনল বিড়বিড় করে ‘আমি খালি সারাদিন সবার পিণ্ডি যোগাব আর শালি খানকির বেটি — আমি তার কেউ না—’ গালাগাল দিতে দিতে যাচ্ছে।

এরপর প্রতিদিনের যুদ্ধ আরো ঘোরালো হয়ে উঠল। সকাল দুপুর রাত —কখন যে শুরু হয়, কেন যে হয় তার ঠিক নেই। খিস্তির পরিমাণ বাড়ল, অপর পক্ষের তীক্ষ্ণ জবাব ও বাড়ল, তাই মারতে ওঠার ঘটনা ও বেড়ে গেল। সেই সময়ই শরণ্যা এই ঘটনাটি ঘটাল।

কিছুদিন থম্‌থমে ভাব ঘরে, কী হয় কী হয়। শোভনা ও ছেলেমেয়েরা চুপচাপ কিছুটা, যে যার কাজ বেশি বাক্যব্যয় না করে করে যায়।

তবে স্বরূপ প্রায়ই গজগজ করতে থাকে। শরণ্যাকেও ছাড়ে না– ‘আমাকে ধাক্কা মারার মতন গায়ের জোর হয়েছে — কাজ করুক দেখি সব, তা হবে না। ঘরে শুধু খাবার লোক ভর্তি, কাজ করার লোক নেই’। সবাই শোনে কথাগুলো, চুপ করে থাকে। কাজকর্ম চলে অভ্যাসমত, কিন্তু গজগজ চলতে থাকে কখনো মাঝরাত্তিরেও।

রাতে বিড়বিড় করলেও শব্দ হয়, শোভনার পাতলা ঘুম ভেঙ্গে যায়, যেহেতু কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে আছে, তাই সেই মাঝরাত্তিরেও জবাব দেয় দু একখানা। এক একদিন মেজ মেয়ে প্রমিতাও বলে, মাঝরাত্তিরে এত চিৎকার শুরু করেছ, ঘুমোতে দেবে কি দেবে না। চুপ কর। অনেক দিক থেকে প্রতিবাদ ওঠায় স্বরূপ চুপ করে।

বছর ঘুরতে বাড়িতে কাজের ভূমিকাগুলোর কিছু অদল বদল হয়েছে। শরণ্যাকে এখন শহরের কলেজে যেতে হয়। সে বি এ পড়ছে, স্কলারশিপ ও ট্যুইশানিতে পড়ার খরচা চালায়।যদি কিছু বাঁচাতে পারে বাড়ির জন্য দরকারি জিনিশ কেনে। বাড়িতে কাটানোর সময় তার কমে গেছে। তার কাজ কিছু কিছু ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তার পরের স্কুলে পড়া ছোট ভাই বোনকে।

প্রমিতার পড়াশোনায় তেমন মনোযোগ নেই। তবে সে কিছু বলিয়েকইয়ে। তাকে মাঝে মাঝেই বাজার করার কাজ দেওয়া হছে, স্বরূপের কিছু কাজ ও তাহলে কমে । মুদিখানা ও রেশন দোকান গ্রামেই। কেনাকাটা করে বাবাকে হিসেব বুঝিয়ে দেয় সে। তার বন্ধুবান্ধব আছে, স্কুল ছুটি হলে নির্দিষ্ট সময়ের পরে ও বাড়ি ফেরে মধ্যে মধ্যে, জবাবদিহি করে না। নিজের খাবার নিজে নিয়ে খায়, বাড়ির গাছের ফল পেড়ে নিজে আগে খায়, তারপর অন্যদের জন্য আনে। সেজন্য অন্যের কম হলেও তার কম হয় না। তাই গায়ে বেশ জোর, গলায় ও। সে বাপকে সোজা বলে, ‘খেতে দিতে পার না তো জন্ম দিয়েছ কেন?’ আগে হলে স্বরূপ এইকথা বলার জন্য তাকে পেটাত, এখন এই বিদ্রোহের হাওয়ায় তার সঙ্গে তর্ক করে না, বাজার করে আসার পর হিসেব বুঝে নিয়ে কখনো বা প্রমিতার হাতে দু একটা খুচরো দিয়ে দেয়। সুকোমলকে বলা হয় স্কুলের পরে বাড়ির চাষবাস দেখতে সাহায্য করার জন্য। তার ও পড়াশোনায় বিশেষ মন নেই। দুজনেই নিজেদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে আজকাল, কারণ তারা বাবার কাজ করে। কিন্তু বাজার করে প্রমিতা পয়সা পায়, আর সুকোমল চাষের কাজে সাহায্য করে কিছু পায় না এতে বিরোধ বাধে।

প্রমিতা বলে, ‘বা রে, বাবা তো রোজ দেয় না, কখনোসকনো দেয়। তোর কি হল তাতে?’

‘আমি ও তো কাজ করি। আমাকে একপয়সা দেয় না, তোকে দেবে কেন?’

‘তুই যখন বাবার পাতে বসে আমাদের চাইতে বেশি মাছ খেতিস আমি কি বলতাম?’

ঝগড়া শুরু হয়ে যায় । স্বরূপ তখন ছেলেকেও কিছু দিয়ে ঝগড়া থামায়। প্রমিতাকে যদি পঞ্চাশ পয়সা দিয়েছিল, সুকোমলকে এক টাকা। বেশি পেয়ে সুকোমল খুশি। কিন্তু প্রমিতা বলে, তুমি তো ওকেই সব সময় বেশি দিয়ে এসেছ। আরো দিচ্ছ।

‘খুব তো দিচ্ছে।’ সুকোমল বলে, ‘ভাল একটু জমিও এত বছরে কিনতে পারে নি। কি রেখেছে আমাদের জন্য?’

আগে স্বরূপ খেতে বসলে সুকোমলকে আলাদা করে ডেকে নিজের সঙ্গে খেতে নিত। প্রমিতা কাছে ঘুরঘুর করত। স্বরূপ মেয়েদের সে বলেই দিত ছেলে বলে ভাইয়ের বাড়তি খাবার দরকার। গৃহকর্তা হিসেবে স্বরূপের পাতে সাধারণর সবচাইতে ভাল জিনিষটিই পড়ে, তার কিছু ভাগ সুকোমল পেত, যদিও সে আগে একবার অন্য ভাইবোনেদের সঙ্গে বসে খেয়েছে। সে কথাটা প্রমিতার মনে গেঁথে গেছে। স্বরূপ অসহায় চোখে তাদের দেখে।সে বুঝতে পারে, এদের উপর তার আর জোর নেই।

কলেজের পর শরণ্যা দূরের শহরে একটা চাকরি পায়। সে বাড়িতে টাকা পাঠায়, ছুটিতে এলে ভাই বোন মা বাবা সবার পরিবর্তন সে লক্ষ্য করে। প্রমিতা বলে ‘বাবা এখন শুধুই বিড় বিড় করে, আর তেমন বকাবকি করে না, মারে তো না-ই। জানিস, বাবার সব পাচনি আমরা ফেলে দিয়েছি। লাঠিটাও সরিয়ে দিয়েছি।’ সুকোমল বলল, ‘আমি দা-টা নিয়ে রেখেছি। সেটা এখন আমার বিছানার নিচে আছে।’

‘বাবা দেখেনি?’ শরণ্যা জিগ্যেস করল।

‘দেখেছে, বলেছে যা ইচ্ছে কর। খালি নিজেদের গলায় লাগাস না।’

শরণ্যা বলল, ‘এগুলো বাবার ওখানে থাকলেই হত।’

‘ওখানে রেখে কী হবে? বাবা এখন কি ব্যবহার করতে পারবে? তার চাইতে ওগুলো আমার কাছে থাকলে ভাল। আমিই তো এখন বাড়ি দেখাশোনা করি।’

‘বাড়ি দেখাশোনা করতে লাঠি আর দায়ের কী দরকার?’

‘কী বলছিস দিদি? বাবার কাছে ওগুলোর জোর ছিল বলেই তো সবাই ভয় পেত। তুই তো এখন বাইরে থাকিস, তুই বোধ হয় ভুলে গেছিস।’

‘আমার ওগুলো কখনো দরকার আছে বলে মনে হয় নি।’

‘জোর থাকার দরকার নেই? তুই-ই তো বাবাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলি গায়ের জোরে। তার পর থেকে বাবা তোকে ভয় পেত।’ ‘বাজে কথা বলছিস সুকোমল। বাবা মাকে মারতে গিয়েছিল, আমি সেদিন বাবাকে আটকাতে কাঁধে ধাক্কা দিয়েছিলাম। বাবা আগে থেকেই নিশ্চয় দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, ব্যালেন্স রাখতে পারে নি।’

‘হতে পারে, কিন্তু অস্ত্র থাকলে আরো বেশি জোর থাকে। লোকে ভয় করে। তাই আমাকে ওগুলো রাখতে হবে।’ সুকোমল জোরগলায় বলল।

শোভনা এখনও ঘর চালায়, প্রায় সব কাজ করতে হয় আগের মত।  কিছু সাহায্য করে ছোট মেয়ে সীমা। স্বরূপ দুর্বল হয়ে পড়েছে, লোক রেখে কায়িক শ্রমের কাজ করাতে হয়। কিছুটা নির্ভর করতে হয় সুকোমলের উপর। সে স্কুল কোনো রকমে শেষ করে আর পড়াশোনা করে না। প্রমিতা কলেজে যাচ্ছে বটে, কিন্তু যাচ্ছে বাইরে যাবার অভ্যাস রাখতে। পড়াশুনোর চাইতে ছোটখাট পলিটিক্সে নজর বেশি। বাড়িতে থাকলে তার সুকোমলের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধবেই।

‘বাড়িতে আছিস তো আজকে। সুনীলকে বলেছি সব্জিখেতের আগাছা তুলতে। খেয়াল রাখবি।’

‘বড় হুকুম দিচ্ছিস? আমি পারব না। কর্তা এসেছেন মস্ত!’

‘বাজারে ঘুরতে পারিস, আর বাড়িতে পাঁচ মিনিটের জন্য কামলার কাজ দেখতে গেলেই লজ্জাবতী হয়ে যাস? হয় ভাল করে পড়ে দিদির মত চাকরি কর, নয় তো বাড়িতে থেকে বাড়ির কাজ কর।’

‘আমি কী করব তা তোকে বলতে হবে না। তুই কি আমার গার্জেন?’

বাদবিবাদ চলতে থাকে। শরণ্যা আশ্চর্য হয়ে দেখে তাদের।

সন্ধ্যায় চা করে ছোট বোন সীমা, সবার জন্য। বিছানায় বসে বাবা চায়ের জন্য হাপিত্যেশ করছে অনেকক্ষণ। সীমা প্রথম কাপটি নিয়ে আসে শরণ্যার জন্য। শরণ্যা বোনকে বলে চা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আগে বাবাকে দিতে। বলে, ‘কাকে আগে দিতে হয় তা এখনই ভুলে গেছিস!’

শরণ্যা দেখল, সন্ধ্যায় সুকোমল সবাইকে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকতে বলে, বিশেষ করে বোনেদের, ঠিক যেমন করে তার বাবা আগে বলত। বিশেষত প্রমিতাকে সে বিশ্বাস করে না। বাবা মাকে যেসব কথায় গালাগাল দিত সেসব কথার মানে সে এখন বোঝে। তাই সে ঘরের ভেতর ও টর্চ জ্বালিয়ে চেক করে নেয় আর দা তো এখন তার কাছেই, সেটা তো বাবারই ব্যাটন!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত