বৃষ্টির দিন

Reading Time: 3 minutes

সকালটা মেঘলা, ম্লান, নিস্তেজ। রাতে টানা বৃষ্টি হয়ে ভোরের দিকে থেমেছে। হারেজের অদ্ভুত বাতিক বৃষ্টির শব্দে ঘুমাতে পারে না। তার ওপর ঘরের চালে পলিথিনের ওপর বৃষ্টি পড়ে ধপ ধপ…চর চর শব্দ হচ্ছে। হারেজের মাথার ভেতরও তখন ধপ ধপ করেছে। ঘুমাতে পারেনি সে। ঘরের চালে গোলপাতার ছাউনি,  তা-ও অনেক বছর হতে চলল। বিছানায় শুয়ে ওপরে তাকালে জায়গায় জায়গায় আকাশের তারার মতো দেখা যায়। ছোট্ট সে পথ ধরে বৃষ্টির জল পড়ে। জল গড়িয়ে ঘরের মেঝে গর্তের মতো হয়ে গেছে। গত বছর যে অবস্থা ছিল এবারও একই দশা। নতুন গোলপাতা কেনার ইচ্ছা ও সামর্থ্য কোনোটাই হারেজের হয়নি।

ভোর রাতের দিকে বৃষ্টি থামার পর তার চোখে ঘুম নামে। স্ত্রী গোলেজান চিৎকার করে ওঠে সাতসকালে-দামড়া বেটার খালি ঘুম আর ঘুম…

হারেজের ঘুম পাতলা। ঘুম ছুটে গিয়ে স্ত্রীর কথা শুনতে পায় সে। তেল-চিটচিটে বালিশে নাক গুঁজে আর্দ্রস্বরে বলে, গোলেজান বিবি, কী হয়েছে আপনার?

ওরে বলদা বেটা, ঘুমায়ে থাকলি চুলা জ্বলবিনে।

-জ্বলবি জ্বলবি। গোলেজান বিবি থাকতি আগুন জ্বলবি না, তা হতি পারে না…।  

হারেজ হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু পুরোপুরি হাসি ফোটে না। চোখ জ্বালা করে ওঠে তার। রাত জাগার ফল। চোখ-মুখ কুচকিয়ে ফেলে। স্ত্রীকে ক্ষেঁপিয়ে এ বেলায় ঝামেলা পাকাতে চাইল না।

এক লাফে বিছানা থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে দরজা খুলে দাঁড়ায় হারেজ। হাঁটু মুড়ে বসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বোঝার চেষ্টা করে। মেঘ থমথমে আকাশ দেখে সময় আন্দাজ করতে পারল না। গলা উঁচিয়ে বলে, কয়ডা বাজে কতি পারো গোলেজান?

-বারোডা ছাড়া আর কয়টা বাজবি? গোলেজান একটু থেমে আবার বলে, ঘরে যার পাঁচ-পাঁচটা ছাওয়াল, সে বেটা কি কইরে ঘুমায়? আমার হচ্ছে যত জ্বালা, ঘরে চাল, আলু না থাকলিও চুলোয় আগুন ধরাতি হবি। বুড়ো হারেজ তোরে আজকে একটা কথা কইয়ে দিচ্ছি, তোর সংসার তুই সামলা আমি আর নেই…

হারেজ গলা চড়াতে সাহস করে না। চুপ থেকেও লাভ হলো না। গোলেজান বিবি ছুটে এসে হামলে পড়ে, বলে, গলা দিয়ে কতা বেরোচ্ছে না যে হারামি?

-কী কব কও? সংসারের জন্যি আমি তো কিছু করতি পারি নে…সংসার যে তোমার চালাতি হচ্ছে…

-কীরাম চালাচ্ছি, তা যদি তুই বুঝতিস বলদা বিটা।

-হ।

-হ কী?

-হ।

-এহনও ঘরে বইসে রইছিস? ভ্যান নিয়ে যাচ্ছিস না ক্যান? ভ্যান না চালালি পেটে আর ভাত ঢুকপি নানে, কইয়ে দিচ্ছি…

-এই কথাই তো এত সময় ধইরে ভাবতিছি…দেহিছ জলে পানিতে রাস্তাডা কিরাম থকথক করতিছে! রাস্তার মধ্যি একশডা গর্ত হইছে, এর মধ্যি গাড়ি নিয়ে নামলি হ্যান্ডেল বাইকে-বুইকে যাবেনে…

-হারামির কথা শুনিছ! ওরে কামচোরার বাচ্চা, পাঁচটা ছাওয়াল জন্ম দিয়ে ঘরে বইসে থাকলে ওগে পেটে ভাত দিবি কি তোর আব্বা?

-বুঝিছি গোলেজান। কিন্তু আমার শরীর কিরাম যেন করতিছে…

-তা তো করবি-ই, মরণ আসতিছে যে…

গোলেজান বিবি আর দাঁড়ায় না। হারেজ আকাশের দিকে চেয়ে মনে মনে বলে, দোম মাইরে রইছিস ক্যান, ভাইঙ্গে-চুইরে নামতি পারিসনে বৃষ্টির বাচ্চা বৃষ্টি! নামবি তো নাম সাত দিনের জন্যি নাম, আর থামবি নে কলাম।

লুঙ্গির গিট্টু আলগা করে দিয়ে হারেজ গোলেজান বিবির পাশে এসে দাঁড়ায়। গোলেজান ডাঁটাশাক নিয়ে বসেছে। হারেজ তবু মিহি গলায় বলে, কি করতিছিস ও গোলে…?

-তোর বাপের শ্রাদ্ধ। তেজ ঝরে পড়ে গোলেজান বিবির কণ্ঠে।

-ছাওয়ালগুলান সহাল সহাল কোয়ানে গেছে? একটারেও দেখতিছিনে যে?

-ছাওয়ালগুলান তোর মতো হয়নি, এইডাই আমার কপাল। নদীতে গেছে মাছ মারতি, কয়ডা চিংড়িটিংড়ি ধরে ফেরবেনে ছাওয়ালরা…

-ও। হারেজ একটু থেমে আবার বলে, ও গোলেজান, তোরে একখান কতা কব, একটু এদিকে আসপি?

-ভাব মারাচ্ছ ক্যান? যা কবা কও।

-আয়-

হারেজ তাদের একমাত্র কাঠের চৌকির ওপর বসে পা নাচাচ্ছে। গোলেজান হারেজের পাশে ধুপ করে বসে বলল, কী কবা, কও।

হারেজ গোলেজানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথাটা বলল। শুনে চৌকি থেকে তড়াক করে নেমে পড়ল গোলেজান বিবি। তারপর খসখসে কণ্ঠে বলল, ওরে ওরে…ও হা হারেজ…

গোলেজান বিবি রাগে তোতলাচ্ছে। সে তার স্বামীর বলিষ্ঠ তেল মাখানো মেটে শরীরের কাছে হার মানল। তারপর অনেক দিনের পুরোনো চৌকির ওপর উপুড় হয়ে নিজের ভার ছেড়ে দিল।

মুহূর্তে গোলেজানের গলার স্বর গাঢ় আর দীর্ঘ হলো। ভেজা স্বরে বলে, আপনের কাজকর্ম কিন্তু বুঝি না মিন্টুর আব্বা!

-গরিবের বউ ছাড়া যাওয়ার জায়গা নাইরে…গো…লে…জান…

-হইছে চুপ করেন…। স্বামীর মুখে আঙুল চাপা দিয়ে বলে গোলেজান। তার কণ্ঠে আহ্লাদ উপচে পড়ে।

লম্বা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর গোলেজান হারেজের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, মিন্টুর আব্বা, আবার সর্বনাশ করলেন!

-কী? ভয় খাওয়া কণ্ঠে জানতে চায় হারেজ।

-বউয়ের পেটে ভাত জোটাতি পারেন না, ছাওয়াল তো আরেকখান আবার ঠিকই আসপেনে…

হারেজ কিছু বলে না।

তেলচিটে রংচটা গামছা ঘাড়ের ওপর ফেলে সোজা দরজা দিয়ে বাইরে পা রাখে। আকাশে তখনো ঘনঘোর মেঘ।  

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>