৩০৪ নং কেবিন (পর্ব-৯)

Reading Time: 3 minutes
এর মধ্যে ভোটের দিন এলো।হাসপাতালে কর্মীর সংখ্যা যথেষ্ট কম।ফলে যারা ছিল তাদের উপর অত্যন্ত চাপ পড়ে গেল।রিনাদি একাই চারজন পেশেন্ট সামলাচ্ছিল।
মেঘ জিজ্ঞেস করল, তুমি ভোট দেবে না?
না।ছোট্ট উত্তর দিল সে।
সেকী ভোট দেওয়া তো সাংবিধানিক অধিকার ।
সংবিধানে তো অনেক কিছুই লেখা আছে শুনেছি।তাতে কী আমার জীবন যাত্রা বদলছে দিদি? আর সবাই চলে গেলে এতগুলো রোগীর কী হবে? এদের দেখা টাও আমাদের কর্তব্য ।
রিনাদির  মুখে কথাটা শুনে মনটা ভালো হয়ে গেলো মেঘের।সে নিজেও ভোট দিতে পারেনি।এত বছরের জীবনে এই প্রথম সে তার নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারল না।সকাল থেকে এই ভেবেই মন বিষন্ন হয়ে ছিল তার।এখন রিনাদির কথা শুনে যেন নিজেকে খানিকটা হালকা লাগল।
পাশের কেবিন থেকে বেল বাজছে।রিনাদি দ্রুত সেদিকে চলে গেল।
চারদিকে ভোট কেমন হচ্ছে জানার জন্য মনটা অস্থির হচ্ছিল মেঘের।পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল হবে এবার- তার মন বলছিল ।কিন্তু এই ঘরের টিভি চালাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না।
সে জিয়াকে ফোন করল।ফোন ধরেই জিয়া বলল, কিরে ঠিক আছিস? খিদে পেয়েছে ? একটু বাদেই যাচ্ছি খাবার নিয়ে।
আচ্ছা , ভোটের খবর কী রে?
শান্তিপূর্ন ভোট।কোনো ঝামেলা নেই।শুধু সুমা আর নন্দনের নাম আসেনি লিস্টে ।
সেকী? কেন?
তা কি জানি ! কৈশোর  মজা করে বলছে বাংলাদেশের নাগরিক নন্দন, তাই নাম নেই।
যত সব ভুলভাল কথা।মেঘ বলল।আর দাদার কী খবর?
দাদা এবার খুব খুশি।এত বছর বাদে নিজের ভোট নিজে দিয়েছে ।
আরে বাঃ ।এতো দারুণ খবর।
হুম।আচ্ছা রাখছি, একটু বাদে আসছি।বলে জিয়া ফোন রেখে দিল।
যাক, সুমাও ভোট দিতে পারেনি।মেঘের মন এখন শান্ত।এবার দেখা যাক ফলাফল কী হয়!
ঊষাদি ঘরে ঢুকলো।কি ম্যাডাম, আজ কেমন আছেন?
মেঘ হেসে বলল, আপনাকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।
তাই? তাহলে তো দেখছি রোজ বারবার করে আপনার ঘরে আসতে হবে।
আসুন না, কে বারণ করল?
ঊষাদি হাসল।ইচ্ছে তো করে, আপনার সঙ্গে গল্প করি, কিন্তু সময় কোথায়! বলে ঊষাদি চলে গেল।
সময়! সত্যি তো মানুষ নিরন্তর দৌড়চ্ছে।কারোরই হাতে সময় নেই।অথচ মেঘের মনে হচ্ছে যাবতীয় সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে এই কেবিনটার মধ্যে ।কোনো বদল নেই।সেই এক ফিনাইলের গন্ধ, এক মুখ, এক ওষুধ, এক বিছানা।বাইরের এত কোলাহল, কলোরব, কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না এই ঘরটাকে। যেন চাপ চাপ অন্ধকার ঘিরে রেখেছে ।অথচ একটু এগোলে আলোর নাগাল পাওয়া যায় ।আর সেই আলোটাকে ধরবে বলে,  সেই সময়কে ছুঁতে চাইছে বলে প্রাণপণে  সুস্থ হবার চেষ্টা চালাচ্ছে ।
মেঘের এই মুহূর্তে আর কারোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করল না।সে মাথার উপর এসিটাকে বাড়িয়ে দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে  পড়ল।
ঠিক চার দিনের মাথায় ভোটের রেজাল্ট বেরোলো।মেঘ সকাল থেকে রেজাল্ট জানবার জন্য টিভি চালাবার চেষ্টা করল।কিন্তু টিভি চলছে না।সুজাতা এসে মোবাইলে লাইভ টেলিকাস্ট খুলে দিয়ে গেল।মাঝে রিনাদি , পিয়ালি এসে জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা !
মেঘ ভাবল ভোটের ফল জানতে চাইছে।সে বলার পর  দুজনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।রিনাদি বলল, তুমি কেমন আছো ? ওসব জেনে লাভ নেই।
মেঘ আবার বলল, তোমরা কী আশা করছ? কে জিতলে খুশি হবে?
রিনাদিই প্রথম উত্তর দিল।যেই জিতুক তাতে আমার কোনো উপকার হবে না।যখন বর মারা গেল, শ্বশুর বাড়ির লোক তাড়িয়ে দিল, কোনো পার্টির লোক সাহায্য করেনি।বরং দেওরের পক্ষে গেছিল।গরীব মানুষের আবার কী ভোট আর কী দল! সব বদমাইশ ।
এই উত্তরটাই যেন আশা করছিল পিয়ালি।সে বলল, ঠিক বলেছ, আমার বর যখন ছেড়ে দিল, বাবা গেছিল পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে ।পাত্তাই দেয়নি।কেন দেব এদের ভোট! সব কটা নিজেদের ধান্ধায় রাজনীতি করে।মানুষের ভালো কেউ দেখে না।
মেঘ শুনছিল ওদের কথা ।যে সব মানুষ সরাসরি ভুক্তভোগী তারাই জানে কোনো দল তাদের নয়।এই নাগরিক জীবনের মাপকাঠিতে গণতন্ত্র বা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন এদের কাছে কোনো আলাদা সকাল আনে না।
সে মোবাইলের লাইভ টেলিকাস্ট বন্ধ করে দিল।তার মনে হল, যেই জিতুক, এখনি সে ইচ্ছা করলেও এই ঘরটা থেকে বেরতে পারবে না।কোনো নির্দেশনামাই তাকে আজকের মধ্যে সুস্থ করে তুলবে না।কাজেই যা ঘটেছে ঘটুক।
তার এখন আলো দরকার, ভীষণ ভাবে বাবাকে দরকার ।একমাত্র বাবাই পারবে এই বদ্ধ ঘরটা থেকে তাকে বের করে বাইরে নিয়ে যেতে।
সে চোখ বুজে একভাবে বাবাকে ডাকতে লাগল।ততক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে রাখল যতক্ষণ না জিয়া এসে দিদি -বলে মাথায় হাত রাখলো ।
.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>