
ছড়া সংখ্যা ২০২২
বাংলাসাহিত্যের আদিসৃষ্টি বা নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়ার মূলছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা এবং এটি ছন্দ-মিলে রচিত। এই পদটি বাংলাসাহিত্যের আদিছড়া বললেও ভুল হবে না। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন। ছড়ার রয়েছে কমপক্ষে দেড়হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উৎকর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে এবং ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো। লোকসমাজে ছড়াই ছিল ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্যসাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়াকে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—’ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য’। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধান মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো ছড়াও সাহিত্যের একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং এর গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।
বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে ছড়ার দুটি ধারা দৃষ্ট হয়। একটি ধারা লোকজ সাহিত্য থেকে উৎসারিত এবং সমাজসচেতনমূলক বক্তব্যে ঋদ্ধ। দ্বিতীয় ধারাটি সুকুমার রায় প্রবর্তিত হাস্যরসাত্মক ছড়া যা অনেক সময় অথর্হীন বা অসংলগ্ন কথামালার বিন্যাস। ফররুখ আহমদ প্রমুখের হাতে এ ধারাটি সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রথম ধারাটির আধুনিক কালে যাদের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায় তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ এর পর ছড়াচর্চায় সুকুমার রায় ও অন্নদাশঙ্কর রায় — দুই ধারারই প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। এই সমাজমনস্ক ছড়ার ধারাটি ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪৮-১৯৭১ পর্বে পূর্ব পাকিস্তান-এর জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তান-এর শাসক সম্প্রদায়ের আধিপত্য-শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়ন, জোর-জুলুম এর বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ-আন্দোলন গড়ে ওঠে ততে সমাজমনস্ক ছড়ার একটি ভূমিকা ছিল। এ ধারার সার্থক রূপকারদের মধ্যে ছিলেন এখলাসউদ্দিন আহমদ, আল মাহমুদ, রফিকুল হক প্রমুখ।
