| 8 মে 2024
Categories
ইতিহাস

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, সোমপ্রকাশ ও বিদ্যাসাগর

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
শিবাশীষ বসু
বিশিষ্ট গবেষক বদরুদ্দীন উমর ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তা ছিল সর্বোতভাবে সংস্কারমুখী, ইউরেশীয় রেনেসাঁসের নেতাদের মতো তাঁর চিন্তাধারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও ভূমি-ব্যবস্থা উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত ছিলো না। এ জন্যেই তাঁর চিন্তার মধ্যে কোন বৈপ্লবিক সম্ভাবনাও থাকেনি। দীনবন্ধু মিত্র এবং হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র যেভাবে নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র তা কোনদিনও চিন্তাও করেননি। হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে তাঁর হৃদয় বিগলিত হলেও দরিদ্র কৃষকদের উপর নীলকরদের নির্যাতন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাজারো অত্যাচার তাঁর মনকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করেনি। তাই বিধবাবিবাহের সংস্কার আন্দোলনে তিনি প্রচুর অর্থ ও শক্তি ব্যয় করলেও নিজের কথা, লেখা ও কর্মের মাধ্যমে বৃহত্তর কৃষক সমাজের সুখ-দুঃখের প্রতি তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। কিন্তু এদিক দিয়ে আবার ঈশ্বরচন্দ্র কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। উনিশ শতকের বাঙলী মধ্যবিত্তের স্বার্থ সাধারণভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপরই ছিলো প্রতিষ্ঠিত এবং তার প্রভাবে সমগ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীই কৃষক স্বার্থের প্রতি শুধু উদাসীনই ছিলো না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো শত্রুভাবাপন্ন। অর্থাৎ তারা ছিলো দরিদ্র কৃষকদের শ্রেণীশত্রু। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ঈশ্বরচন্দ্র কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন বক্তব্য উপস্থিত না করলেও তার প্রতি ঔদাসীন্যই তাঁর চিন্তার একটা বিশেষ পরিধি নির্দিষ্ট করে।”
অর্থাৎ ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মতো বদরুদ্দীনবাবু বিদ্যাসাগরকে কৃষকদের শ্রেণীশত্রুরূপে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন প্রায়। এই যুক্তিধারাটি বড় অদ্ভুত। একই যুক্তিধারায় আপনি শচীন তেন্ডুলকরকে ফুটবলের শ্রেণীশত্রু অথবা সত্যজিৎ রায়কে যাত্রাঅপেরার শ্রেণীশত্রু বানিয়ে দিতে পারবেন নির্দ্বিধায় !
সত্যিই কি কৃষকদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার প্রতি বিদ্যাসাগর উদাসীন ছিলেন? এটা আমাদের ট্র্যাজেডি যে, বিবেকানন্দ অথবা রবীন্দ্রনাথের মতো ঘনিষ্ঠজনদের কাছে একান্তে তিনি যে সমস্ত উক্তি করেছেন তা কেউ সংকলন করবার কথা চিন্তা করেন নি। তবুও আমরা দেখতে পাই মাসিক ‘নব্যভারত’এর সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীকে করা বিদ্যাসাগরের উক্তি, “এদেশের নিম্নশ্রেণীর গতি না ফিরিলে দেশের গতি ফিরিবে না। সাহেবরা আমাদিগকে ঘৃণা করে বলিয়া আমরা কত আক্ষেপ করিয়া থাকি, কিন্তু আমরা নিম্নশ্রেণীকে পশু অপেক্ষাও ঘৃণার চক্ষে দেখি। হায়, শিক্ষিত শ্রেণীর এতই অহঙ্কার, এতই অভিমান ; দেশের শক্তি যাহারা, আশাভরসাস্থল যাহারা, তাহাদিগকে মনুষ্যের শ্রেণীতে গণ্য করিতে কুন্ঠিত হন। … হায় তাহাদিগকে আমরা পশুতুল্য জ্ঞান করি, মানুষের ন্যায় জ্ঞান করিলে হয়তো আমাদের দ্বারা তাহাদের কিছু উপকার হইত।” দেবীপ্রসন্ন নব্যভারতের চৈত্র ১২৯১ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে একটি বহুলপ্রচারিত অভিযোগ হল, তিনি ‘বাঙালার ইতিহাস’ গ্রন্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গুণগান গেয়েছেন। দেখা যাক উক্ত গ্রন্থে বিদ্যাসাগর ঠিক কি লিখেছিলেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে বিশেষ উপকার দর্শিয়াছে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।এরূপ না হইয়া যদি, পূর্ব্বের ন্যায় রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরিবর্ত্তের প্রথা চলিত থাকিত, তাহা হইলে এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না।” সমালোচক মহোদয়গন ঠিক এই বাক্যটি উদ্ধৃত করলেও পরের বাক্যগুলি ভুলেও উল্লেখ করেন না, যাতে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছে। প্রথম এই যে, ভূমি ও ভূমির মুল্য সঠিক না জানিয়া বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। তাহাতে কোন কোন ভূমিতে অত্যন্ত অধিক ও কোন কোন ভূমিতে যৎসামান্য কর নির্দ্ধারিত হইয়াছে। দ্বিতীয় এই যে, সমুদয় ভূমি যখন বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া গেল, তখন যে সকল প্রজারা আবাদ করিয়া চিরকাল ভূমির উপসত্ত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নুতন ভূম্যধিকারীদিগের স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোনো বিশিষ্ট উপায় নির্দ্দিষ্ট করা হয় নাই।” স্পষ্টতই, বিদ্যাসাগর প্রাথমিকভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপর সরাসরি বিরূপ না থাকলেও গোড়া থেকেই এই ব্যবস্থার কর বিন্যাস এবং কৃষকদের জমির স্বত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জমিদারদের অসীম ক্ষমতার ফলে এবং করের চাপে অবিলম্বে কৃষকরা জমির স্বত্ব হারিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস উঠবে।
এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে পড়ে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার কথা। হরিশ মুখার্জীর হিন্দু পেট্রিয়টের মতো বিদ্যাসাগরের মস্তিস্কপ্রসূত সোমপ্রকাশও সেকালে অবিরতভাবে বঙ্গদেশের কৃষকদের দুঃখকষ্ট ব্যথাবেদনার কথা তুলে ধরেছিল। বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক চর্চাকারী খবরের কাগজের অভাব অনুভব করেছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৫৮ সালের ১৫ই নভেম্বর (১লা অগ্রহায়ণ ১২৬৫) সোমপ্রকাশ সাপ্তাহিক পত্রিকারূপে আবির্ভূত হয়। পত্রিকাটি প্রতি সোমবার প্রকাশিত হত বলে নাম রাখা হয়েছিল ‘সোমপ্রকাশ’। স্বয়ং সোমপ্রকাশ তার জন্মবৃত্তান্ত সম্বন্ধে কি লিখেছে দেখা যাক। ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ১৫ই ভাদ্র সোমপ্রকাশের সম্পাদক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের মৃত্যুর পর সোমপ্রকাশে প্রকাশিত অরবিচুয়ারিতে পত্রিকার জন্মইতিহাস লেখা হয় – “সারদাপ্রসাদ নাম জনৈক বধির ছাত্রের ভরণপোষণ করিবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়ই প্রথমে এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। প্রস্তাব হয় যে বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং এই পত্রিকাখানি লিখিবেন এবং সারদাপ্রসাদ তাহার সম্পাদক হইবেন, সারদাপ্রসাদ তৎপরে বর্দ্ধমানের মহারাজার অধীনে একটি কর্ম্ম পাইয়া বর্দ্ধমানে গমন করেন। সঙ্গে সঙ্গে সোমপ্রকাশ প্রকাশের কল্পনাটিও পরিত্যক্ত হয়। এই সময়ে বঙ্গদেশে কেবল সংবাদ প্রভাকর ও সমাচার চন্দ্রিকা নামক দুইখানি সংবাদ পত্রিকা প্রকাশিত হইতেছিল। তখন এই দুইখানি পত্রেরই অবস্থা অতি দীন ছিল। কোন রাজনৈতিক বিষয়ই উহাদের আলোচনার বিষয় ছিল না। ধীরভাবে কোন সামাজিক বা ধর্ম্মনৈতিক প্রবন্ধ সংবাদ পত্রিকায় আলোচিত হইত না। কেবল কোন বিশিষ্ট লোকের নিন্দাবাদ, কোন সামাজিক কাণ্ডের রহস্যবাদ ইহা লইয়া পত্র দুইখানি পূর্ণ করা হইত। শ্রীরামপুর হইতে খ্রীষ্টীয় মিসনরিগণ যে সকল সাময়িক পত্রাদি প্রচার করিতেন তাহাও কেবল খ্রীষ্টীয়ভাব পরিপূর্ণ। সুতরাং সংবাদপত্রের সৃষ্টি করা নিতান্ত প্রয়োজন বলিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় আবার ‘সোমপ্রকাশ’ সৃজনের কল্পনা করিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় একদিন দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রমুখ আর কয়েকজন পণ্ডিতকে আহ্বান করিয়া ‘সোমপ্রকাশ’ প্রকাশের প্রস্তাব করেন। সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হন এবং বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের হস্তে ইহার সম্পাদকীয় ভার অর্পণ করা হয়।” এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতিকথায় – “শুনিয়াছি সোমপ্রকাশের প্রকাশের প্রস্তাব প্রথমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বিদ্যাভূষণের নিকট উপস্থিত করেন।” এই প্রসঙ্গে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা ১৮৬৫ সালের ৯ই জানুয়ারি লিখেছিল, “The Shome Prokash was first projected by Pundit Esear Chunder Vidyasaghur, and we believe the first number was written by him. But he fell sick and made over the paper to Pandit Dwarkanauth, under whose able management the paper attained the foremost place among the Bengalee newspaper.”
প্রতিষ্ঠার কিছদিন পর থেকেই দেখা গেল, বিদ্যাসাগর নিজে সরাসরিভাবে কলম না ধরলেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং স্নেহধন্য সংবাদপত্রটি একের পর এক প্রবন্ধের মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল সম্বন্ধে জনগণকে সজাগ করবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ‘বিদ্যাসাগর, সোমপ্রকাশ ও বাংলার কৃষকসমাজ’ প্রবন্ধে পূর্ণেন্দু শেখর মিত্র সোমপ্রকাশ থেকে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র কৃষকদের জমির স্বত্ব ও অধিকার নয়, এমনকি ভুমিহীন ক্ষেতমজুরদের অধিকার নিয়েও সোমপ্রকাশ আওয়াজ উঠিয়েছে। ১৫ই জুলাই, ১৮৭৮, সোমপ্রকাশ লেখে, “আমাদিগের অভিমত স্থায়ী বন্দোবস্ত। আমাদিগের মতে সেই বন্দোবস্ত এরুপ হওয়া উচিত যে সেই বন্দোবস্তের ভূমি সকল দান বা বিক্রয়াদির দ্বারা প্রজারা কোনরূপে হস্তাম্তর করিতে না পারে। জমিদার সেই ভূমির উপস্বত্ব হইতে আপনার প্রাপ্য খাজনা আদায় করিবেন কিন্তু জমি কোনক্রমে বিক্রয় করিতে পারিবেন না, মহাজনের দেনায়ও উহা বিক্রয় হইবে না। কেবল দখলী স্বত্ববান প্রজার সহিত স্থায়ী বন্দোবস্ত করা আমাদিগের অভিমত নয়। যাবতীয় ঠিকা প্রজা ও যাহাদিগের জমি সম্পর্ক নাই তাহারা যদি জমি গ্রহণার্থি হয় সেই সমুদয় প্রজাকে লইয়া এই বন্দোবস্ত করা আমাদিগের অভিমত।” এমনকি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদ করে সরকারি কৃষকদের হাতে জমি প্রদানের দাবী জানিয়েছিল সোমপ্রকাশ। ‘বিদ্যাসাগর এবং বেসরকারি সমাজ’ প্রবন্ধে প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য ৯ই শ্রাবণ ১২৮৯ সোমপ্রকাশে প্রকাশিত ‘ভারত সাম্রাজ্যের পরিণাম’ শীর্ষক রচনা থেকে উদ্ধৃত করেছেন – “আমাদের একান্ত অভিলাষ, রুশ গবর্নমেন্ট যেমন জমিদারদিগকে ভূমির মুল্য দিয়া প্রজার সুবিধা করিয়া দিয়াছেন, ব্রিটিশ গবর্নমেন্টও ভারতবর্ষে তদ্রূপ উপায় অবলম্বন করুন। প্রত্যেক ভূস্বামিকে তাঁহার জমিদারির মুল্যস্বরূপ লাভের বিশ গুণ পণ প্রদত্ত হউক। ঐ পণের অর্দ্ধেকটা প্রজাগণ দিবে অর্দ্ধেক গবর্নমেন্ট দিউন। প্রজারা নিস্কর ভূমি ভোগ করুক। ইহাতে মহোপকার সাধিত হইবে। কৃষকগণের গৃহে অর্থ সঞ্চিত হইবে, কদাচিৎ দুর্ভিক্ষের নাম শ্রুত হইবে না। তাহারা ক্রমে উন্নত হইয়া সমাজের পদস্থ লোক হইয়া উঠিবে।” অথচ বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্য “হিন্দু পেট্রয়ট-এর মতো সোমপ্রকাশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র উৎসাহী ছিল না।”
লক্ষণীয় যে, ১৮৭৮ সালের মার্চ মাসে ভার্নাকিউলার প্রেস এ্যাক্ট পাস হওয়ার পরেও ব্রিটিশ নীলকর ও চা-কর সাহেবদের অত্যাচার শোষণ নির্যাতন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে সোমপ্রকাশ নিরবিচ্ছিন্নভাবে শাসকবিরোধী অভিমত প্রকাশ করে যাচ্ছিল এবং স্বভাবতই পত্রিকাটি রাজরোষের শিকার হল। বিনয় ঘোষ লিখেছেন, “১৮৭৯ সনের মার্চ মাসে ‘লাহোরস্থ সংবাদদাতা’র একটি পত্র প্রকাশের জন্য ‘সোমপ্রকাশ’ রাজরোষে পড়েন এবং গবর্নমেন্ট এক হাজার টাকা জামানৎ ও মুচলেকা চেয়ে পাঠান। দ্বারকানাথ নিজেই প্রেস আইনের প্রতিবাদে পত্রিকা বন্ধ করে দেন। … পরে আইন (Vernacular Press Act) উঠে যাওয়ার পর পুনরায় সোমপ্রকাশ প্রকাশিত হয় …।”
বিদ্যাসাগর মানস সম্বন্ধে যাঁরা গভীর চর্চা করেছেন তাঁরা সকলেই জানেন, যে সংগঠনের সঙ্গে তাঁর মতে না মিলত, তৎক্ষণাৎ তিনি তার সঙ্গ ত্যাগ করতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায় এ ব্যাপারে তাঁর কাছে “স্বর্গ ও নরক ভিন্ন মাঝামাঝি একটা স্থান” ছিল না। সেই বিদ্যাসাগরের সোমপ্রকাশ পত্রিকার আজীবন শুভানুধ্যায়ী থাকাটাই প্রমাণ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিষয় সোমপ্রকাশ ও বিদ্যাসাগরের মতের মিল। এ বিষয়ে প্রদ্যুম্নবাবু মন্তব্য করেছেন, “… চাষী-মজুরদের প্রতি বিদ্যাসাগরের মনোভাব কী ছিল, তা নির্ণয়ের একটি পরোক্ষ উপকরণই হচ্ছে ‘সোমপ্রকাশ’। বিদ্যাসাগর ছিলেন ‘সোমপ্রকাশ পত্রিকার আদি-পরিকল্পক ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা’। ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর জবানবন্দি অনুযায়ী, ‘সোমপ্রকাশ’-এর প্রথম সংখ্যা স্বয়ং বিদ্যাসাগরেরই লেখা (এই সংখ্যাটি পাওয়া গেলে তাঁর রাজনৈতিক-সামাজিক মতামতের প্রত্যক্ষ দলিল আমাদের হাতে আসবে)। তাছাড়া তিনি পরামর্শ দিয়ে ‘সোমপ্রকাশ’ সম্পাদনায় বিদ্যাভূষণ মশাইকে বিশেষ সাহায্য করতেন। শুধু তা-ই নয়, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের মৃত্যুর পরেও, বিদ্যাসাগর এই পত্রিকার ট্রাস্টি নিযুক্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ‘সোমপ্রকাশ’-এর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধ ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। অতএব, এ-অনুমান যুক্তিসঙ্গত : এই পত্রিকায় প্রকাশিত বক্তব্যের সঙ্গে তিনি মোটামুটি একমত ছিলেন। অন্ততঃ বিদ্যাসাগরের মেজাজ বা চারিত্র যতটা জানি, ‘সোমপ্রকাশ’-এর সঙ্গে তাঁর খুব গুরুতর মতান্তর ঘটলে, তিনি নিশ্চিত এর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতেন।”
চারপাশের মানুষদের অপরিসীম দারিদ্র বরাবরই বিদ্যাসাগরকে দুঃখ দিত। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর কিছুদিন আগে বিদ্যাসাগর অনুরাগী শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য তাঁর শরীর সারানোর জন্য কার্মাটারে গিয়ে থাকবার পরামর্শ দিলে বিদ্যাসাগর জবাব দেন, “বাপু সেখানে যাইলে থাকি ভাল বটে, কিন্তু আমার যদি অতুল ঐশ্বর্য্য থাকিত তাহা হইলে সেখানে গিয়া নিশ্চিত হইয়া থাকিতে পারিতাম, মনও ঠাণ্ডা থাকিত, শরীরও সুস্থ হইত। আমার সে অদৃষ্ট কৈ? আমার সে ক্ষমতা কৈ? আমি সেখানে গিয়া দিব্য অন্ন ব্যঞ্জন আহার করিব, আর আমার চারিপাশে অসংখ্য নরনারী বালক বালিকা অনাহারে মারা যাইতেছে দেখিব। এটা কি প্রাণে সয়।” একজন শ্রেণীশত্রুরই বক্তব্য বটে ! সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিদ্যাসাগর একটি সভা স্থাপনের প্রচেষ্টা করেছিলেন বলে শোনা যায়। ৩০শে আগস্ট, ১৮৭২ ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকাতে ছাপা হয়, “আমরা শুনিয়া অহ্লাদের সহিত প্রকাশ করিতেছি, যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কতৃক প্রজাসাধারণ সভা নামে (জমিদারদিগের ব্রিটিস ইন্ডিয়ান এসোসিএসনের ন্যায়) এক সভা শ্রীঘ্রই স্থাপিত হইবে। উক্ত সভার দ্বারা সাধারণের বিশেষ মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা। ভরসা করি, এই জনরব সত্য হইবে।” বছরখানেক বাদে এই সংবাদেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল ৩০শে অগ্রহায়ণ, ১২৮০ ‘সাধারণী’ পত্রিকার পাতায় ‘বঙ্গদেশে প্রজার জন্য কি কর্ত্তব্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে। “যাহারা অস্থিভেদী পরিশ্রম করিয়া পৃথিবীর উপকার সাধন করিতেছে ; যাহারা সকলকে জীবনী শক্তি প্রদান করিতেছে, তাহারা চিরকালই এইরূপ পদদলিত হইতে থাকিবে? … ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সভা জমিদারদিগের। জমিদারগণ, হয়ত স্বার্থহানীর আশঙ্কায়, প্রজাদিগের প্রকৃত অবস্থা গবর্নমেন্টে জ্ঞাপন করেন না। অধিক কি, ভারতবর্ষীয় সভায় একজন প্রধান সভ্য ও একজন প্রধান জমিদারের এলাকাস্থ প্রজার প্রতি অত্যাচার কোন সম্বাদপত্রে আন্দোলিত হইয়া ছিল। অতএব প্রস্তাবিত সভাতে যাহাতে স্বার্থপর জমিদারদের কোনরূপ সংশ্রব না থাকে, তাহা একান্ত প্রার্থনীয়। … একবার জনরব উঠিয়াছিল, প্রসিদ্ধনামা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয় এইরূপ একটি সভা করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন।” এই জনরবকে ঠিক ভিত্তিহীন বলা যায় না কারণ একই সময় সোমপ্রকাশ পত্রিকাতেও ছাপা হওয়া একটি প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের নাম না করে একটি কৃষক সমাজকে সংগঠিত করবার জন্য একটি সভার আভাস পাওয়া যায়। জনরব সত্যি না হলেও কৃষক তথা সাধারণ মানুষদের দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা করে বিদ্যাসাগর একটি কৃষক সভার পরিকল্পনা করেছিলেন, নিঃসন্দেহে এটি একটি বিস্ময়কর সংবাদ। অবশ্য বিদ্যাসাগর-সমালোচকগণের লেখাপত্রে আপনারা কস্মিনকালেও এসবের উল্লেখ পাবেন না।
প্রদ্যুম্নবাবুর একটি চমৎকার মন্তব্য দিয়ে এ প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই – “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা সামন্ত্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর কেন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামেন নি, এটাই হয়তো বদরুদ্দীন উমরের আসল অভিযোগ (সকল পোষ্ট কলোনিজম তথা সাবল্টার্ন তথা অতিবাম লেখকগণেরও ওই একই অভিযোগ !) কিন্তু বিদ্যাসাগর কেন মাও হলেন না – এ আক্ষেপ অবান্তর।”
তথ্যসূত্র :
বিদ্যাসাগর সার্ধশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ, গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত, শোভা প্রকাশ
সমকালে বিদ্যাসাগর, স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি
বাঙ্গালার ইতিহাস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত যন্ত্র
সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র চতুর্থ খণ্ড, বিনয় ঘোষ সম্পাদিত, পাঠভবন
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, এস কে লাহিড়ী এ্যাণ্ড কোং
বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, বদরুদ্দীন উমর, চিরায়ত প্রকাশন
বিদ্যাসাগর প্রবন্ধ, শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, বঙ্কিম প্রেস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত