| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস এই দিনে বিনোদন

বড়ে গুলাম আলী যেভাবে চিরকালীন

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আজ ২৩ এপ্রিল। সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের প্রয়াণ দিবস। ইরাবতী পরিবার বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করছে। ইরাবতী’র পাঠকদের জন্য অশোক রানাদে ‘র একটি লেখার ভাষান্তর রইল।

ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের কণ্ঠ ছিল অনন্য। তার কণ্ঠের পরিসর ছিল বিস্তৃত, স্থিতিস্থাপক এবং সব লয়েই শ্রুতিমধুর। ব্যতিক্রমহীনভাবে তার কণ্ঠ তার সংগীতকে অসাধারণ প্রাঞ্জলতা দিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য কোনো কাজকে মূর্ত রূপে উপস্থাপন করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। তার কণ্ঠ তার সংগীতকে স্পষ্ট করে তুলেছে। তার সংগীতকে বোঝার জন্য কল্পনা বা বিনির্মাণ প্রয়োজন হয় না, কারণ তার সংগীত সরল, স্পষ্ট। বড়ে গুলাম আলী খানের সংগীতে স্বরের দুর্বলতা ঢাকতে কোনো পর্দার প্রয়োজন হয়নি কখনো। তিনি শব্দ উচ্চারণ করতেন ধীরে। এমনকি যুক্তব্যঞ্জনের উচ্চারণও স্পষ্ট হতো। তিনি উচ্চৈঃস্বরে গাওয়ার সময়ই উচ্চারণের স্পষ্টতা ধরে রাখতে পারতেন। তারানা গাওয়ার সময় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠত।

বড়ে গুলাম আলী চল্লিশের দশকের শেষদিকে ভারতীয় সংগীতের মঞ্চে আবির্ভূত হলেন, তখন ঠুমরিতে প্রতিষ্ঠিত ঘরানা ছিল বেনারস ও লখ্নৌ। বেনারস তার গাম্ভীর্য আর লখ্নৌ গজল সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বাঁধাধরা ছকে আটকে গিয়েছিল। ঠুমরির কথা, উপস্থাপনা ও রীতি সবই প্রথাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। নতুন কিছুর সংযোজন খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এই কানাগলি থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল সংগীতের সৃষ্টিশীলতা। এটা করতে গিয়ে খান তার ঠুমরিতে টপ্পার সংযোগ ঘটালেন। এই সংযোগ ঘটানোর জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ মানুষ, কারণ এজন্য যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হতো, সেটা তার কণ্ঠের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তার টপ্পা তার ঠুমরিকে প্রভাবিত করেছে, পরিণতিতে তার খেয়ালও প্রভাবিত হয়েছে। খান মনে করতেন ঠুমরিতে তার অবদান মৌলিক কারণ তিনি সোহোনির মতো রাগেও ঠুমরি উপস্থাপন করতেন। এভাবে ঠুমরিতে রাগ যোগের মাধ্যমে তিনি সংগীতের শ্রেণীভাগে নতুন প্রেক্ষিত যোগ করলেন। এই পদ্ধতি খুব বেশি হালে পানি পায়নি, তাই বলে তার নিরীক্ষার মূল্য তাতে কমে যায় না।

গুলাম আলী কখনো নিজেকে শিক্ষিত গায়ক হিসেবে দাবি করেননি। তিনি সবসময় বলেছেন যে তিনি কেবল অল্প কয়েকটি রাগ জানেন। তিনি মূলত মানুষের মেজাজ-মনোভাবসম্পর্কিত রাগ গাইতেন। সৌভাগ্যক্রমে তার গাওয়া রাগগুলো রেকর্ড করা হয়েছিল। তিনি লোকসুর পাহাড়ির ১৫টি ভিন্ন ভিন্ন সুর গাইতে পারতেন। আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে এগুলোর রেকর্ড নেই। তার লোকগানগুলোর রেকর্ড থাকলে সেটা তার সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের ওপর আরো আলো ফেলতে পারত। তিনি সৃষ্টিশীলভাবে ক্লাসিক্যাল সংগীত ও লোকসংগীত নিয়ে কাজ করেছেন। মনে হয় তিনি অল্প কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী কম্পোজিশন জানতেন, সম্ভবত তাই তিনি নতুন কম্পোজিশন তৈরিতে সবরঙ নামটি ব্যবহার করতেন। আবার এটাও হতে পারে যে তিনি মনে করতেন সংগীত নিয়ে তার দর্শনের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী কম্পোজিশনগুলো মানানসই নয়।

বড়ে গুলাম আলী যখন সংগীতের দুনিয়ায় পা রাখেন, তখন শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল শ্রোতাদের মাতিয়ে, চোখ-কান ঝলসে দেয়ার রীতি। স্বীকৃতির জন্য তিনি কখনই এই সহজ পথে হাঁটেননি। তিনি কখনই রাগ, তাল, কম্পোজিশন নিয়ে চমক সৃষ্টি করতে জোরাজুরি করেননি। তিনি নিজেকে কখনই পণ্ডিতমন্য বিবেচনা করেননি। বরং তার অকথিত নীতি-বিশ্বাস ছিল যে, আপনি যদি আপনার সংগীত দিয়ে সাধারণ মানুষকে আবেশিত করতে পারেন, তাহলে সমঝদাররাও মুগ্ধ হবেন অবশ্যই। সাধারণ সংগীতপ্রেমীদের সম্পর্কে তিনি আরো একটি সত্য উপলব্ধি করেছিলেন— শ্রোতারা চান শোনার সময় যেন তার কান ভরে যায়। পেশাদার বিনোদনদানকারী শিল্পীরা শব্দের তীব্রতা বাড়িয়ে, স্বরের ভিন্নতা এনে আরো নানা কারসাজি করে দর্শকদের সন্তুষ্ট করতে চান কিন্তু গুলাম আলী শুধু অবিরাম মিষ্টি সুরের ওপরই নির্ভর করেছেন।

বড়ে গুলাম আলী খান সবসময় বলতেন সংগীত হচ্ছে খেলা, নাচ কিংবা ঢেউয়ের ছন্দের মতো। তার এই ইম্প্রেশনস্টিক মনোভাব থেকে বোঝা যায় তিনি সংগীতকে গাম্ভীর্য থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। সংগীতকে তিনি সিরিয়াসভঙ্গি থেকে উপভোগ্য করতে চেয়েছেন। এমনও হতে পারে তিনি সংগীত নিয়ে সব সময় সিরিয়াস হয়ে থাকতে চাননি। আর তিনি তার এই মনোভাবকে প্রতিষ্ঠা করতে অসাধারণ আবেদনময়, সহজবোধ্য সংগীত উপহার দিয়েছিলেন।

[স্ক্রলইন থেকে সংক্ষেপিত]

 

ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের গলায় ভৈরবী ঠুমরিঃ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত