| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

চোরা স্রোত

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

নদীর ধারে একটা চিতল হরিণ পরিবার। পরিচিত দৃশ্য। তিনটি শাবক মায়ের দুধ খাচ্ছে, কখনও খুনসুটি করছে, কখনও বা নিজেদের সিং না গজানো মাথা নিয়ে ঢুঁসোঢুঁসি খেলছে। হঠাৎ তারা খেলা থামিয়ে থমকে গেল কয়েক মুহূর্ত। ক্যামেরায় ধরা পড়ল চারটে প্রমাণাকার বাঘ এগিয়ে আসছে। সিংহের মতো বাঘ দল বেঁধে শিকার ধরে না। যদি একই পরিবারেরও হয়ে থাকে তবু বিরল দৃশ্য।

ক্যামেরার লেন্স ধাওয়া করল হরিণ পরিবার আর বাঘগুলোর পিছু পিছু। একটি বাঘের ভয়ে হরিণের ঝাঁককে পালাতে দেখেছে। কিন্তু একটি মা আর তিনটে পুঁচকি হরিণকে চারটে বাঘ মিলে তাড়া করছে এমন দৃশ্য সত্যিই বিরলতমের মধ্যে বিরলতম। দেখতে দেখতে এই শব্দগুলোই মনে হল জয়িতার। এমন পুরুষাকার বাঘেরা মনুষ্য পুংগবের কাছে শিখেছে মনে হয়।

হরিণগুলো নদী পেরোচ্ছে। আহা! ঐ ক্ষুদে দুধের শিশুগুলো কি পারে মায়ের গতিতে ছুটতে? মা-টা পালাতে পারলেও বাচ্চাগুলোর খেল খতম। বাচ্চাদের মতো মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল জয়িতা, “ভগবান ওদের বাঁচিয়ে দাও।”

ও কী! মা হরিণটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কেন? বাচ্চাগুলোকে ঠেলে নদী পেরোনোর জন্য ছুটিয়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। কয়েক সেকেন্ড, ব্যাস! চারটি বাঘ একযোগে রাজকীয় শৌর্যে হরিণীকে ছিঁড়ে ফেলল। শব্দ শোনা না গেলেও পরিস্কার বোঝা গেল বাচ্চাগুলো নদীর ওপার থেকে ঘাঢ় ঘুরিয়ে দেখে যে আর্তনাদ জুড়েছে। জয়িতা “আঁক” করে আওয়াজ করে মেঝেতে গড়িয়ে গেল।

“ও কী? কী হল রে?”

মেঘনা কোলে মাথা নিয়ে বসল। অতনু চোখে মুখে জলের ছিটে দিল। সৌম্যজিত সামন্ত নিজের চলভাষে হোয়াটস্‌অ্যাপ খুলে ভিডিওটা দেখাচ্ছিল। ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ করে ডাকতে লাগল, “জয়িতা জয়িতা”। যে ফোটোগ্রাফার এই ভিডিওটা তুলেছে সে নাকি দৃশ্যটা দেখার পর অজ্ঞান হয়ে যায় এবং তারপরেও মাসাধিক কাল মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকে। কিন্তু মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় এই ছবি দেখে কারও এমন অবস্থা হতে পারে দেখানোর আগে মাথায় আসেনি।

এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল সৌম্যজিত সামন্তর। “নিজেকে কী মনে করো কী তুমি? তুমি মাতঙ্গিনী হাজরা নও, মাদার টেরেসাও নও। বুঝলে? তোমার ওপর নাই ভুবনের ভার। কী ভাবো, তুমি সব জেনে বুঝে বসে আছো, আর পৃথিবীর সবাই নিরেট? কারও কোনও ফীলিং নেই?”

“এসব কথা উঠছে কেন? আমার মাথা এখনও ঘুরছে একটু চুপচাপ থাকতে দিন”।

“নিজেকে বিরাট অবতার দেখাতে চাও? যিশু খ্রীস্ট, বুদ্ধ, বিদ্যাসাগর? কার কোন ভালোটা করতে পেরেছ আজ অব্দি? কোন ভালোটা করতে পারবে এইভাবে ন্যাকার মতো অজ্ঞান হয়ে? জনদরদী নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মানেকা গান্ধী, মাদাম কুরি?”

“আমি নেতৃত্ব দিতে পারব না বলে কারও কোনও কষ্টে রিঅ্যাকশন হবে না? আর মাদাম কুরি তো নেত্রী নন, বিজ্ঞানী – । অমন বীভৎস, অমন প্যাথেটিক দৃশ্য ….” সৌম্যজিতের নাগাড়ে চেঁচানির মধ্যে কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছিল জয়িতার।

“তোমাকে বোঝায় কার বাপের সাধ্যি। তোমার কাছে সব কথার জবাব আছে। নিজের সম্পর্কে এত বিরাট ধারণা, এত সুপিরিয়রিটি কম্পেক্স। আমরা যেন কিচ্ছু না। তোমার এই স্বভাবটার জন্য পৃথিবীর কেউ তোমাকে পছন্দ করে না তোমার আনফরচুনেট বর ছাড়া। সেই তোমাকে ভালো রেখেছে। আর কারও কথায় তোমার কিচ্ছু যায় আসে না। কবে থেকে নিজের মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েই চলেছি। যে নারীর কাছে পুরুষমানুষের ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই, সে হরিণের জন্য কাঁদছে – ব্যাপারটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিচ্ছু হতে পারে না”। বক্তার গলা সপ্তমে। চালক শুনছে। জয়িতার অপমানে লজ্জায় কান লাল হলেও আর একজন বেপরোয়া।

কোন জ্বালা থেকে লোকটা বলছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। বয়সে অন্তত চোদ্দ বছরের বড়ো। চাকরিটা নিজের জোরে পেলেও এটা সত্যি যে সৌম্যজিত লোকটার অধীনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞাপণে কপি লেখার সুযোগ পেয়েছে, সামান্য পদোন্নতিও হয়েছে এবং আরও হতে পারে। এটাও সত্যি যে সৌম্যজিত বহুবার জয়িতাকে নিবেদন করেছে, এক সাথে বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন দেখিয়েছে। জয়িতা অনড় দেখে তার কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আক্রমণ করেছে। তার মতো দেশ বিদেশ ঘোরা হাই প্রোফাইল ব্যক্তিকে জয়িতার মতো মামুলি মধ্যবিত্ত মেয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে? ব্যাপারটা হজম করা শক্ত। সে যে জোর করে পেতে পারে এবং চাইলেই জয়িতার চাকরিও খেতে পারে তাও একাধিকবার শুনিয়েছে। তারপরেও বরফ গলেনি দেখে ব্যর্থ আক্রোশে চিৎকার করেছে, “তোমার ভালো বর আছে। ভাত কাপড় কি ছাদের চিন্তা নেই। শখের চাকরি করতে আসা। আমার পরোয়া করবে কেন?”

সৌম্যজিত সামন্ত মুখে বলে “তোমার কাছে কিচ্ছু চাই না। শুধু তুমি বড়ো হও, আরও ভালো লেখো, নাম করো এটাই চাই”। কিন্তু পরক্ষণেই ‘কিচ্ছু চাই না’-টা ‘সবকিছু চাই’ হয়ে যায়, আর তা না পাওয়ার আক্রোশে কখনও জয়িতার লেখা কপিতে অমার্জনীয় ভুল খুঁজে পায় তো কখনও জয়িতার মধ্যে শ্রেয়মন্যতা।

“আপনি কি এভাবে চেঁচামেচি করবেন বলে আমায় গাড়িতে তুললেন? আমি কিন্তু আরও অসুস্থ বোধ করছি।”

সৌম্যজিত আবার বলল, “আমি খুব ইমোশোনাল। ভীষণ ইমোশোনাল। কিন্তু ইমোশন ভালোবাসা এসবের কোনও মূল্য দিতে জানো না তুমি।”

জয়িতা চিৎকার করতে চাইল, “আপনার ভালোবাসা আমার কাছে মানসিক নির্যাতন। প্লীজ ভালোবাসতে হবে না।”

কিন্তু কৃতজ্ঞতা, নাকি চাকরি খোয়ানোর ভয়, নাকি এমন কোনও চোরা টান যা ইন্দ্রিয়সর্বস্ব পুরুষ মানুষের কাছে মূল্যহীন – কে জানে, চুপ করে কথাগুলো হজম করল। চোখে তখনও হরিণীর ছিন্ন হওয়ার আর বাচ্চাগুলোর আতঙ্কিত মুখের ছবিটা তাণ্ডব করছে। পাশে বসা আধবুড়ো লোকটা চারজন বাঘা আততায়ীর চেয়ে তো নিশ্চই ভালো!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত