| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক সাহিত্য

চোরাকাঁটা (পর্ব-১১)

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

শান্তর দিকে এগুতে এগুতে অনিক অবাক হয়ে তাকেই দেখছিল।

শান্তকে এত উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন? কেমন যেন বিধ্বস্ত বেশবাস, মাথার চুলে সম্ভবত চিরুনি পড়েনি। গায়ের শার্টটা কুচকানো। চেহারাতে শেভ না করা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বেশ আশ্চর্য হলো অনিক। স্মার্ট সুদর্শন শান্ত এমন আলুথালু বেশে বাইরে আসতে পারে, এটা সে কোনোদিন ভাবতেই পারেনি। আজ কী এমন ইমার্জেন্সি পড়ে গেল যে নিজের চেহারার দিকে সে তাকানোর ফুরসতই পেলো না!

অনিককে আসতে দেখে শান্তর মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে। এতক্ষণ ধরে নানারকম ভাবনাচিন্তা ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল মাথার মধ্যে। অনিক আসবে কী না, না এলে কথাটা কি টেলিফোনে বলা উচিত হবে কী না, এরকম সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে আলাপ করলে অনিক রাগ করবে কী না…ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন অনিককে চাক্ষুষ দেখে মনের দুশ্চিন্তা অনেকটাই দূর হয়ে গেল শান্তর। যাক এসেছে যখন, বাকিটা সে ঠিকই ম্যানেজ করে নিতে পারবে। তার কথা কি কখনো ফেলে দিতে পারবে অনিক? 

অনিকের দিকে তাকিয়ে ম্লানমুখে একটু হাসলো শান্ত। নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা মনে হচ্ছে। সঠিক এক্সপ্রেশনটা কী হওয়া উচিত বুঝতে পারছে না। যে ঘটনা ঘটেছে তাতে বেশি হাসিমুখ দেখানো হয়ত উচিত হবে না। অনিক কাছে এলে শান্ত বললো,

‘কী রে এত দেরি করলি যে! জ্যামে পড়েছিলি নাকি?’

অনিক মজা করে বললো,

‘আমি না হয় জ্যামে পড়েছিলাম। কিন্তু তুই কোন ঝড়ের কবলে পড়েছিলি? চেহারা এমন ঝড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন?’

শান্ত দ্রুত আঙুল চালিয়ে চুলগুলোকে লাইনে নিয়ে এলো। আজ সত্যিই আয়নার সামনে দাঁড়ানো হয়নি। সকালে নাকে মুখে দুটো গুঁজে নিয়েই অফিসে গিয়েছিল। সেখানেও সবাই তাকে একই প্রশ্ন করে হয়রান করেছে। ‘এমন দেখাচ্ছে কেন?’ ‘কী হয়েছে?’ ‘শরীর খারাপ নাকি? বাড়িতে কেউ অসুস্থ নাকি?’ হাজারটা জিজ্ঞাসা সবার। কেন যে মানুষের এত আগ্রহ অন্যের সম্পর্কে! অফিস থেকে দুঘণ্টার ছুটি নিয়ে বেরিয়েছে। অনিক আসতে আসতেই অনেকটা সময় নিয়ে নিলো। ছুটির সময়কাল মনে হচ্ছে ফোন করে বাড়িয়ে নিতে হবে।

অনিক চেয়ার টেনে বসতেই শান্ত একরকম ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর ওপর।

‘ইয়ে অনিক…কিছু মনে করিস না দোস্ত। আমি ঘটনা শুনেছি। খুব খারাপ লাগছে শোনার পর থেকে। সুমনার নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ। হওয়ারই কথা! ছোটবোনটাকে কোলেপিঠে করে ঐ তো মানুষ করেছে! এমন একটা ব্যাপার কীভাবে যে ঘটে গেল…’

শান্ত হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলে গেল। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না এমন ভঙ্গিতে অনিক জিজ্ঞেস করলো,

‘তুই ঘটনা শুনেছিস মানে? কোন ঘটনার কথা বলছিস? কী শুনেছিস?’

‘মানে ঐ…রুমানার ব্যাপারটা!’

‘রুমানার ব্যাপার তুই জানলি কীভাবে? আমি তো কাউকে বলিনি এই ব্যাপারে!’

‘তুই না বললে শোভন জানলো কীভাবে? ঐ তো আমাকে বললো!’

‘শোভন কীভাবে জেনেছে? ওহ্‌ শিট! রিয়াজকে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম! ঐ সম্ভবত…’

শান্তর মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল এই কথা শুনে। ঢোক গিলে বললো,

‘বলার জন্য তুই আর মানুষ পেলি না অনিক? এতজনকে রেখে রিয়াজকে বলতে হলো তোর?’

‘কেন কী হয়েছে? রিয়াজকে বলা যাবে না কেন? ও কি সবাইকে বলে ফেলেছে নাকি?’

‘বলতে কি বাকি রেখেছে? আমি জেনে গেছি, শোভন জেনে গেছে…এতক্ষণে হয়ত অন্যরাও সবাই জেনে বসে আছে! আর…আর…এত মানুষ থাকতে তুই রিয়াজকে এত ভরসা করিস কেন বল তো? রিয়াজের কথাবার্তা আচার আচরণ দেখেও বুঝিসনি এতদিনে যে, ও কী জাতের ছেলে?’

‘কেন রিয়াজ কি আমাদের বন্ধু নয়? একই গ্রুপে থেকে আলাদা গ্রুপিং করছিস কেন?’

‘গ্রুপিং করছি না। কিন্তু সবাইকে কি এক সারিতে ফেলা যায়? রিয়াজের কথাবার্তা আচার আচরণ সম্পর্কে তুই যেন কিছুই জানিস না! নতুন শুনছিস আমার মুখে থেকে!’

‘এটা তোর ভুল ধারণা শান্ত। রিয়াজের মুখটা পাতলা। ফুটফাট মন্তব্য করে। কিন্তু মন ততটা খারাপ নয়।’

অনিকের কথা শুনে শান্ত মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘ইহহ্‌! মন ততটা খারাপ নয়! আর কী করলে মন খারাপ হওয়া বলে বল? তোর শ্যালিকাকে প্রথমদিন দেখেই ও কী মন্তব্য করেছিল জানিস কিছু?’

অনিক শান্তমুখে জিজ্ঞেস করলো,

‘না তো! কী মন্তব্য করেছিল?’

‘ওসব আমি মুখে উচ্চারণ করতে পারবো না! অন্য কারো কাছে শুনে নিস।’

‘আচ্ছা বেশ তাই শুনে নিব। এখন তুই বল, কী বলার জন্য এমন অস্থির হয়ে আমার খোঁজ করছিস?’

‘অনিক শোন, যা বলতে চাইছি তা খুব সিরিয়াস। তুই প্লিজ সিরিয়াসলি নিস বিষয়টাকে। সুমনার বোনের এই বিষয়টার জন্য আর কেউ নয়, রিয়াজ দায়ী! আমি জানি!’

‘আচ্ছা তুই জানিস? তা কীভাবে জানলি যে রিয়াজ এই ঘটনার জন্য দায়ী? তোকে বলেছে? নাকি তুই দেখেছিস নিজের চোখে?’ অনিকের গলার স্বরে অজানা বিদ্রুপ। শান্ত সেটা বুঝেও পাত্তা দিলো না। বরং খুব মন দিয়ে অনিককে বোঝানোর দায়িত্ব নিলো।

শান্ত যা যা দেখেছিল সেই গেট টুগেদারের দিন, সব একে একে বলে গেল। রুমানার নীচে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে রিয়াজের নীচে যাওয়া, পনের বিশ মিনিট পরে ফিরে আসা…কিছুই বাদ দিলো না। বলা শেষ করে সাগ্রহে তাকালো অনিকের দিকে। আশা করেছিল, অনিকের মুখে এবারে হয়ত কৌতুহল আর আগ্রহ দেখতে পাবে। কিন্তু হতাশ হতে হলো তাকে। অনিকের মুখে মিটিমিটি হাসি। শান্ত সবিস্ময়ে বললো,

‘তুই হাসছিস? হাসি আসছে তোর! এরকম কথা জানার পরও তোর হাসি আসছে কীভাবে?’

‘হাসছি এই কারণে যে, কত সুন্দরভাবে তুই পুরো ঘটনাটাকেই অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলি! তোর এক্সপারটিজ সত্যিই অসাধারণ!’

‘তার মানে? এ্যাই কী বলছিস তুই? আমি কেন ঘটনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিব? আমার কী স্বার্থ এতে?’

‘কী স্বার্থ সেটাও আমাকেই বলতে হবে? তুই ঘুরাবি এই কারণে যে, এই ঘটনার সাথে অন্যকেউ নয়, তুই নিজেই দায়ী! বুঝলি? তুই দায়ী! রুমানার এই অবস্থা অন্য কেউ করেনি। এটা করেছিস তুই! আর কবে করেছিস, সেটাও আমার জানা আছেলাস্ট গেট টুগেদারের এক সপ্তাহ আগে এসেছিলি না বাসায়? তুই আর শোভন? মনে পড়ে? অযুহাত দেখালি, টিভিতে কী নাকি এক অনুষ্ঠান দেখাবে তোর জব রিলেটেড! সেটা দেখার জন্য বসে থাকলি না? আমি শোভনকে নিয়ে বাইরে চলে গেলাম!’

‘ড্যাম ইট! ঐ সময় সুমনা ছিল বাসায়! তুই কী বলছিস এসব? একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিস তাই না?’

এখানে আসার আগেই আনিসুল হকের সাথে কথা বলে এসেছে অনিক। আনিসুল হক তাকে মুখ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু শান্তকে দেখেই কী যে হয়ে গেল অনিকের! মাথায় কেমন রক্ত উঠে গেল। ইচ্ছে করছে এখনই ওর এই ভালোমানুষীর মুখোশটা টেনে খুলে ফেলে। 

হিসহিসে গলায় অনিক বলে,

‘পাগল তো হয়েছিই! যার বাসাতে এমন একটা ঘটনা ঘটে তার কি মাথা ঠিক থাকে? তার মাথা এমনিতেই খারাপ হয়ে যায়! আর যার জন্য এমন ঘটনা, ঘটে ইচ্ছে করে তার মাথাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলি!’

শান্ত অবিশ্বাসীর চোখে অনিককে দেখছে। বন্ধুত্বের শুরু থেকে আজ অব্দি সে কোনোদিন অনিককে এই রূপে দেখেনি। এই অনিক তার একেবারেই অচেনা। 

ওয়েটার কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে। দুজনের কেউই তাকে লক্ষ করেনি। সেও এদের প্রাইভেসিতে বিঘ্ন ঘটাতে চায়নি। আশেপাশের টেবিল গুলো থেকে সবাই ঘুরে ঘুরে এদিকে তাকাচ্ছে। দুজনের মধ্যকার উত্তেজনার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো কফিশপে। শান্ত চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলে,

‘অনিক, প্লিজ শান্ত হ! এখানে এভাবে সিনক্রিয়েট করিস না। তুই জানিস, তুই যা বলছিস তা আগাগোড়া মিথ্যে। আমি জীবনেও এমন কাজ করতে পারবো না। আমি ওসব কল্পনাও করতে পারি না। রুমানা কথা বলতে পারে না, কিন্তু চিৎকার তো করতে পারে! ও কি তখন চিৎকার দিত না? আর…আর…তাছাড়া বাসায় তখন সুমনা ছিল। সুমনা কি এসব বলেছে তোকে? ও কি বলেছে আমি এই ঘটনা ঘটিয়েছি? ও যদি বলে আমি ঘটিয়েছি, তাহলে আমি বিনা প্রতিবাদে সবকিছু মেনে নিব। কিন্তু তুই এমনি এমনি আমাকে এত বড় অপবাদ দিতে পারিস না!’

‘চুপ বদমাশ! রুমানা চিৎকার দিবে! ইহহহ! কী দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছিলি কে জানে! আর তাছাড়া তোর মতো ছেলেদের হাতে অস্ত্রশস্ত্রর অভাব থাকে নাকি? মিষ্টি কথা বলে হয়ত মেয়েটার মুখই বন্ধ করে দিয়েছিলি! আর সুমনার কথা বলছিস? সুমনা কী বলবে রে? সুমনা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। তোদের পেট পুরে খাইয়েছিল না সেদিন? রান্নাঘরে কাজ করছিল, এই সুযোগেই তো আসল কাজটা ঘটায়ে ফেলছিস! এখন এসেছিস রিয়াজের ঘাড়ে দোষ চাপাতে? আমি এখনো সুমনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বাসায় গিয়েই আমি সুমনাকে সব বলে দিব! দাঁড়া!’

শান্ত স্তম্ভিত হয়ে অনিকের ফোঁসফাঁস দেখে। অনিকের মাথাটা কি সত্যিই খারাপ হয়ে গেল? অন্য কাউকে দোষী না বানাতে তো পারলে তো ও নিজেই ফেঁসে যাবে! সেজন্যই হয়ত এমন পাগলের মতোন আচরণ করছে! হঠাৎ অজানা এক ভয় জাগে শান্তর মনে। যেরকম পাগল হয়ে আছে ব্যাটা, সত্যি সত্যিই সুমনাকে কিছু বলে দিবে না তো! শান্ত এবার বেশ শক্ত কন্ঠে বলে,

‘না তুই সুমনাকে কিচ্ছু বলবি না!’ 

সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে উঠলো অনিক,

‘কেন বলবো না? তোর ভয়ে? তুই আমার কী ক্ষতি করবি? স্কাউন্ড্রেল! এসব শিখিয়েছে তোর শিক্ষক বাপ তোকে!’

‘অনিক, খবরদার বলে দিলাম আর একটা কথাও বলবি না! মুখে যা আসে তাই বলবি? ঠিক আছে তুই যদি মনে করিস, আমিই দোষী তাহলে সেটা প্রমাণ কর। দেখি কী প্রমাণ আছে তোর কাছে!’

‘হ্যাঁ করবোই তো! তোকে জিজ্ঞেস করে করবো নাকি? সবকিছু প্রমাণ করে আমি তোর আসল চেহারা খুলে দিব সবার সামনে!’

দুই বন্ধুর কথাবার্তা আর বিশেষ এগুলো না। ওয়েটারকে ডেকে নিজের দু’কাপ কফির বিলটা মিটিয়ে দিলো শান্ত। তারপর ধুপধাপ পা ফেলে প্রত্যেকটা বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে।

অনিক আরো কিছুক্ষণ বসে রইলো সেখানে। এতক্ষণে তার হুঁশ স্ব-স্থানে ফিরে এসেছে। আনিস আংকেল যা যা বলতে নিষেধ করেছিল, সে তো তার কিছুই মানলো না! একেবারে সপাসপ সব উগরিয়ে দিলো! শান্তকে সামনে পেয়ে দিনদুনিয়ার সবকিছু একেবারে ভুলে গেল! কী হবে এখন? শান্তটা যদি অশান্ত হয়ে কিছু একটা ঘটিয়ে বসে? তাহলে তো আনিস আংকেল ওর ভূত নামিয়ে দিবে!

সেদিন আর অফিসে ফিরলো না শান্ত। সোজা নিজের বাসায় ফিরে গেল।

মাথাটা একেবারে ভোকাট্টা হয়ে আছে। অনিক এসব কী বললো? কেন বললো? মেয়েদের প্রতি কোনোদিন সম্মান ছাড়া এতটুকু অসম্মান নিয়ে সে কথা বলেনি কখনো! সেই তাকেই দেওয়া হলো রেপের মতো এত বড় জঘণ্য অপবাদ? কিন্তু কেন? কী কারণে অনিকের এমনটা মনে হলো? শান্তকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে অনিক। এতদিনেও কি একজন মানুষকে একটুও চেনা যায় না? 

সেদিন অনিকের বাসায় গিয়ে শোভন আর ওর সাথে কাঁচাবাজারে গিয়েছিল না, এটাই কি ওর একমাত্র অপরাধ ছিল? সেদিন তো সত্যিই একটা জরুরি অনুষ্ঠান দেখার ছিল ওর। অনুষ্ঠানটা সে কিছুতেই মিস করতে চাইছিল না। তাই শোভন যখন ওকে অনিকের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, প্রথমে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি শান্ত। পরে শোভনের চাপাচাপিতে যেতে হয়েছিল। আর তাতেই এই আজগুবি অপবাদ এসে কাঁধে জুটলো।

বাথরুমে গিয়ে মাথাটা ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে এলো শান্ততারপর টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মাথার ওপরে বন বন করে ঘুরছে সিলিং ফ্যান। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথার মধ্যে অনেক রকম চিন্তা এসে সমান তালে ঘুরপাক খেতে লাগলো। দিনের পর দিন থ্রিলার মুভি দেখে দেখে আর ছোটবেলায় ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে বুদ্ধিতেও সে কিছুটা পাক খাওয়াতে পারে এখন। সবাই যা সচরাচর দেখে না, শান্ত সেটা দেখতে জানে। 

মাথা গরম করে ফেলেছিল বলে নিজের ওপরেই একটু রাগ লাগলো শান্তর। ঠান্ডা মাথায় বসে অনিকের সব অভিযোগ ওকে শুনতে হতো। যদিও সেসব অকথা কুকথা কান দিয়ে ঢোকানো যাচ্ছিলো না। তবু ঢোকাতে হতো। অনিক কিসের পানি কোথায় বইয়ে দিচ্ছে, এটা বুঝতে হতো তাকে। পরবর্তী দুই ঘণ্টা টানা চিন্তা করে চললো শান্ত। ক্ষুধা তৃষ্ণা সব বেমালুম ভুলে গেল এই সময়ে। মাথাটা যখন অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেল, তখনই ক্ষুধার অনুভূতিটা প্রথম টের পেল। গতকাল রাতের আলু ভর্তা, ভাত আর ডাল আছে ফ্রিজে। একটা ডিম ভেজে নিলেই হবে। খাওয়াদাওয়ার পেছনে এত মনোযোগ দেওয়ার কিছুমাত্র দরকার নেই এখন। আগে এই ঘটনার আসল হোতাকে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর অন্য কাজ।

সেদিন বিকেল বেলাতে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেল শান্ত। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভারী গলায় কেউ একজন বলে উঠলো,

‘আমি কি শান্তর সাথে কথা বলছি?’

‘জি শান্ত বলছি। আপনি কে বলছেন?’

‘আমি পুলিশ কমিশনার আনিসুল হক বলছিআপনি কি একবার পুলিশ স্টেশনে আসতে পারবেন? ভয়ের কিছু নেই। একটু রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিল।’

শান্ত ভড়কালো না। অনিকের আজকের ব্যবহারটা তাকে এই ব্যাপারে আগেই সতর্ক করে দিয়েছে যে, এমন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। খুব শিগগিরই পুলিশের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে তার। সেই দেখা হওয়াটা কতখানি বন্ধুবৎসল হবে সেটা এখনো জানে না শান্ত। 

আনিসুল হকের কথামত নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে হাজিরা দিলো শান্ত। 

আনিসুল হক তার কথা রাখলেন। শুধুমাত্র রুটিন জিজ্ঞাসাবাদই করলেন শান্তকে। এর আগে কখনো পুলিশ স্টেশনে আসার প্রয়োজন পড়েনি শান্তর। তার সাদাসিধে ছোটখাট পরিবারে বড়সড় ঘটনা কখনো তেমন একটা ঘটেইনি বলতে গেলে। আর পুলিশ স্টেশনের সাথে যোগাযোগটাই থাকে মূলত দু’শ্রেণীর মানুষের। অপরাধী কিংবা রাঘব বোয়ালদের। শান্ত এই দুই শ্রেণীর কোনোটারই প্রতিনিধিত্ব করে না।

আনিসুল হক শান্তকে দেখে অল্প হাসলেন। শান্তর নার্ভাস লাগছিল। কেমন একটা বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছিলো মনের ভেতরে। অনুভূতিটাকে সম্ভবত ভয় বলে। সামনে বসে থাকা মানুষটার মুখভাব শান্ত, ঠান্ডা। শান্ত জানে পৃথিবীতে বড় বড় ভয়ংকর মানুষজনের মাথা সাধারণত ঠান্ডাই হয়ে থাকে। তার সামনের এই মানুষটিও কি তেমনি ভয়ংকর কেউ? একটু পরেই হাসতে হাসতে রিমান্ডে নিয়ে যাবে শান্তকে? কিন্তু তার আগে তো তাকে গ্রেফতার করার কথা!

আনিসুল হক হাসিমুখেই বললেন,

‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? একদম ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে অল্প কিছু প্রশ্ন করেই ছেড়ে দিব। কেন ডেকেছি সেটা তো আপনি জানেন না নিশ্চয়ই। আচ্ছা অনিক তো আপনার বন্ধু, তাই না?’

‘জ্বি।’

‘কতদিনের বন্ধুত্ব আপনাদের?’

‘আমি আর অনিক ক্যাডেট কলেজে একসাথে পড়েছি। ক্লাস সেভেন থেকে। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব।’

‘বেশ বেশ। অনিকের পরিবারের অন্যদের চেনেন? মানে ওর বাবা-মা বা বর্তমানে ওর স্ত্রী কিংবা অন্য কাউকে?’

শান্ত দু’সেকেন্ড থামলো। তারপর যথাসম্ভব শান্তভাবেই বললো,

‘জ্বি ওর পরিবারের সবাইকেই চিনি আমি। অনিকদের বাড়িতে মানে ওদের দেশের বাড়িতে বেশ কয়েকবার আমরা বন্ধুরা একসাথে বেড়াতে গিয়েছি। কয়েকদিন করে থেকেছি প্রতিবার।  অনিকের বিয়ের পরে ওর স্ত্রী সুমনা আর সুমনার বোন রুমানার সাথেও দেখা হয়েছে। পরিচয় হয়েছে।’

‘অনিকের ঢাকার বাসাতে যান না?’

‘হ্যাঁ যাই। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনিকই কেবল বিবাহিত। তাই ওর বাসাতে আমাদের বন্ধুদের গেট টুগেদারটা হয়ে থাকে।’

‘গেট টুগেদার অন্য কোথাও হয় না? মানে কোনো রেস্টুরেন্ট অন্য কোনো জায়গায়?

‘নাহ্‌। অনিকের স্ত্রী সুমনা ভালো রান্নাবান্না করে। ওরা দুজনেই চায় আমরা ওদের ওখানেই একত্রিত হই। তাই…।’

‘আচ্ছা। এই গেট টুগেদারের সময় অনিকের স্ত্রী বা শ্যালিকা এরাও কি উপস্থিত থাকে? ওহ আচ্ছা…কী বলছি এসব! ওদের বাসাতেই হচ্ছে যখন, ওরা তো উপস্থিত থাকবেই, তাই না? মানে আমি বলতে চাইছি যে, অনিকের স্ত্রী আপনাদের সাথে কথাবার্তা বলে?’

 

(ক্রমশ)

 

 

আগের পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত