অনিক অস্থিরভাবে ঘরে পায়চারি করছে। তার মুখচোখ শুকনো, শ্বাসপ্রশ্বাস ওঠানামা করছে দ্রুতবেগে। দু’হাত স্থির রাখতে পারছে না। একবার প্যান্টের পকেটে ঢোকাচ্ছে। পরক্ষণেই বের করে আনছে। ঈষৎ কাঁপছেও যেন সে। চোখের তারা ছোটাছুটি করছে চঞ্চল গতিবেগে। উত্তেজনার মুহূর্তে এসবই তার স্বাভাবিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া।
একপাশে ছোট একটা সোফায় সুমনা বসে আছে পান্ডুর মুখে। তার পাশে বসে রুমানা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কিছু একটা বলে যাচ্ছে অবিরাম। মাঝে মাঝে হাসি হাসি মুখে বোন আর দুলাভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অনিক আর সুমনা দুজনের কারোরই সেদিকে দৃষ্টি নেই। তারা তখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার সর্বশেষ চুড়ায় বসে ধুকপুক করে শ্বাস নিচ্ছে। আর এক ধাপ উঠতে হলেও হুড়মুড়িয়ে নিচেই গড়িয়ে পড়তে হবে।
তবু মাঝে মাঝেই রুমানার সেইসব অর্থহীন কথায় কান চলে যাচ্ছে। উদ্বেগের চুড়ান্ত উত্তেজনায় সেইসব কথা শুনতে আরো অসহ্য লাগছে। এক পর্যায়ে আর পারলো না সুমনা। উঠে এসে রুমানার গাল লক্ষ্য করে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিল। সেই চড় খেয়ে রুমানা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো বোনের মুখের দিকে। তারপর দুনিয়া কাঁপানো চিৎকার দিয়ে জোরে জোরে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। জন্মের পর থেকে আজ অব্দি নিজের বড়বোনের কাছ থেকে এমন অদ্ভুত ব্যবহার কখনো পায়নি রুমানা। ছোটবেলায় কত হাত পা ছুঁড়ে কেঁদেছে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে মেরেছে, রাগের মাথায় সামনে যাকে পেয়েছে তাকে ধরেই কামড়ে হাঁচড়ে পিঁচড়ে একাকার করেছে! তবু কোনোদিন এমন অধৈর্য আচরণ পায়নি বোনের কাছ থেকে। তার অবোধ মাথায় এটা কিছুতেই ঢুকছে না, সুমনা আজ কেন তাকে এভাবে মারলো!
রুমানার চোখের অসহায় জিজ্ঞাসাটাকে সুমনা আদ্যোপান্ত পড়ে ফেললো। সেই অবুঝ অসহায়, দুনিয়াদারীর সাথে পরিচিত না হওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না সুমনা। পারিপার্শিকতা ভুলে গিয়ে নিজেও কাঁদতে লাগলো হাউমাউ করে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে চললো,
‘কেন তুই এমন হলি? কেন তুই কিচ্ছু বুঝিস না? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, তোর কি খবর আছে কোনো? কেন সবকিছু আমাকে সামলাতে হবে? আমি কী অন্যায় করেছি! আমি আর পারছি না…আর নিতে পারছি না!’
অনিক হতবুদ্ধির মতো দু’বোনের কার্যকলাপ দেখছিল। নিজের অস্থিরতার জন্য মনে মনে লজ্জিত হলো একটু। এখন সুমনার সামনে এমন করলে ও আরো অধীর হয়ে পড়বে। এমনিতেই বাস্তববাদী সুমনার এই আচরণ তার কাছে একেবারেই নতুন। এভাবে তাকে ভেঙে পড়তে দেখে এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত বোলালো অনিক। শান্ত দৃঢ় মমতাময় গলায় বললো,
‘আহা! তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে? আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে, কী করা যায়। এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, কী করলে আমরা অপরাধীর কাছে পৌঁছাতে পারবো…সেসব ভেবেচিন্তে বের করতে হবে তো! অপরাধীকে সাজা দিতে হবে না? তুমি এভাবে কান্নাকাটি জুড়ে দিলে কেন বলো তো? আর রুমানা তো ভয় পেয়ে যাবে! তুমিই তো বলো, ও ভয় পেলে আরো বেশি অস্বাভাবিকতা দেখায়!’
অনিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমনা সচকিতভাবে জিজ্ঞেস করলো,
‘অপরাধীকে ধরিয়ে দিবে মানে? এ্যাই…এ্যাই…কী বলছো তুমি? আমরা কেন অপরাধী খুঁজতে যাবো? কাউকে খোঁজার দরকার নেই। এসব কথা বাইরে জানাজানি করা যাবে না। না…না…কিছুতেই না। রুমানার জীবন না হয় অনেক তুচ্ছ সবার কাছে। কিন্তু আমার কাছে তো নয়! আমি ওকে এই এতটুকু বয়স থেকে মানুষ করেছি। মা ওকে আমার কাছে রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেছে। আর তুমি বলছো, ওর সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কথা সবার কাছে বলে দিব? তাতে আর কী লাভ হবে? ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে! যেটুকু ভালো থাকা সম্ভব, সেটুকুকেও নষ্ট করে দিতে বলছো?’
হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলেই সুমনা আবার কাঁদতে লাগলো। অনিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে। এই সুমনা তার কাছে একেবারেই অচেনা। বিয়ের পর থেকেই পরিণত একজন মেয়ের সাথেই সংসার করছে অনিক। রুমানার এই বিষয়টাতে সে এমনভাবে ভেঙে পড়বে, এটা অনিকের কল্পনার বাইরে ছিল। ভেবেছিল, এই বিষয়টাকেও বুদ্ধিমত্তার সাথেই সামলাতে পারবে সুমনা।
এদিকে রুমানা নিজে অনেকক্ষণ ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কান্নাকাটি করলো। এখন বোনকেও তার সাথে কাঁদতে দেখে সে নিজের কান্না ভুলে হাঁ করে বোনের কান্না দেখতে লাগলো। মাঝে মাঝে হাতের তেলো দিয়ে বোনের চোখের পানি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। সুমনার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ভেঙেচুরে যাচ্ছে আশেপাশের সবকিছু। কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে তার বোনটার! অথচ পাগলি সেটা বুঝতেও পারছে না!
অনিক হতবুদ্ধি অবস্থা কাটিয়ে সুমনার পাশে এসে বসলো। কিছুক্ষণ সময় নিল ওর কান্না থামার জন্য। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
‘তুমি কি বুঝতে পারছো না, পরিস্থিতির গুরুত্ব কতখানি?’
সুমনা অবরুদ্ধ গলায় বললো,
‘পরিস্থিতির গুরুত্ব আমি বুঝতে পারছি, সম্ভবত তুমি পারছো না! পারলে এমন কথা তুমি বলতে পারতে না।’
অনিকের গলার স্বরে অস্বাভাবিক ধীরতা। যেন সুমনাকে বোঝানোর গুরুদায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিছুতেই হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। সে বললো,
‘এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল রুমানার সাথে, আর তুমি বলছো চুপ করে থাকার কথা? তুমি কি চাও না অপরাধী সামনে আসুক? তাকে শাস্তি পেতে দেখতে চাও না?’
সুমনা দু’মুহূর্ত কী যেন ভাবলো। তারপর বললো,
‘অপরাধীকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাই। কিন্তু এই ঘটনা জানাজানি হলে রুমানার কী হবে, সেটা কি ভেবে দেখেছো? আমার ছোটবোনটাকে নিয়ে মানুষ এমনিতেই আড়ালে হাসাহাসি করতো, এখন ছি ছিক্কার করবে!’
‘এটা তুমি মনে করছো সুমনা। একজন অবোধ মেয়েকে নিয়ে কেউ ছি ছিক্কার করবে না। মানুষ এখনো এতটা নীচে নেমে যায়নি!’
সুমনা আরো কিছুক্ষণ নিজের মনে কেঁদে চললো। আশেপাশের কোনোকিছুই তাকে আজ থামাতে পারছে না। রুমানা হতবুদ্ধির মতো কিছুক্ষণ বোনের পাশে বসে থাকলো। বোনের কান্না থামার কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে সে আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা দিল। সুমনা একসময় শান্ত হলো। মাথা তুলে দেখতে পেল, অনিক এখনো শান্ত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ওর সিদ্ধান্তের আশায় অপেক্ষা করছে। সুমনা ভেতর থেকে শক্তি পাচ্ছে না। চারপাশে বুঝি অথৈ পানি। সে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই অথৈ পানিতে। তবু খড়কুটোর মতো কিছু একটাকে ভর করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো সে। ক্লান্ত গলায় বললো,
‘আচ্ছা…কিন্তু কী করতে চাও তুমি? পুলিশে খবর দিবা?’
‘হুম সেটাকেই সহজ মনে হচ্ছে আমার। আর কম রিস্কি। অন্য কাউকে বলে তো আর কালপ্রিটকে ধরে আনা সম্ভব নয়। আর সেক্ষেত্রে দশ জনে জানাজানি হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। তাতে করে অপরাধী সাবধান হয়ে যেতে পারে। তাই সবার আগে পুলিশের সাহায্যই নিতে হবে। কিন্তু…তার আগে আমাদের কিছু কাজ আছে। পুলিশ নানারকম প্রশ্ন করবে। সেসব প্রশ্নের জবাব কি আমাদের কাছে ঠিকঠাকমত আছে?’
সুমনা ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কী কী প্রশ্নের জবাবের কথা বলছো?’
‘এই যেমন… রুমানা কোথাও গিয়েছিল কী না… বাসায় কেউ এসেছিল কী না। রুমানার সাথে কারো কোনোরকম কথাবার্তা হয় কী না… এইসব।’
‘হাহ্! ভালোই বললা! রুমানা কি কথা বলতে পারে যে কারো সাথে কথাবার্তা বলবে? এসব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন কেন করবে পুলিশ? আর রুমানা তো কোথাও যায়নি কিংবা বাসাতেও…’
এটুকু বলেই থেমে গেল সুমনা। অনিক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অসমাপ্ত কথা শেষ করানোর আশায় বললো,
‘আর বাসাতেও কেউ আসেনি বলতে চাচ্ছো?’
‘না, মানে…বাসাতে তো…’
‘বাসাতে আমার বন্ধুবান্ধবরা প্রায়ই আসা যাওয়া করছে। তুমি কি মনে করেছো এই বিষয়টা পুলিশ বের করে আনবে না? আর প্রেগন্যান্সির মতো… না… মানে আমি দুঃখিত। আমি বুঝতে পারছি এই কথাটা তুমি নিতে পারছো না। কিন্তু বলতে তো হবেই। পুলিশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইবে সবকিছু। প্রেগন্যান্সির মতো এমন একটা ঘটনা যেহেতু ঘটেছে, কেউ না কেউ তো জড়িত আছেই এতে, তাই না? যতই দুঃখজনক হোক আমাদের জন্য, কালপ্রিটকে বের করে আনতে হলে তো সব কথা পুলিশকে বলতেই হবে! আর রুমানা কথা বলতে পারে কী না, কোথাও যায় কী না…এসব প্রশ্ন তো উঠে আসবেই!’
‘কিন্তু তোমার বন্ধুরা কি বিষয়টা সহজভাবে মেনে নিবে? তারা এরপরে কি আর কখনো আমাদের বাসায় আসবে?’
অনিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
‘না এলে কিছু করার নেই সুমনা। আমি কষ্ট পেলেও মেনে নিব। কিন্তু রুমানার অপরাধীকে বের করতে হলে যতদূর যাওয়া প্রয়োজন আমি যাবো। এই যুদ্ধ শুধু তোমার একার না সুমনা। আমিও আছি তোমার সাথে!’
সুমনা কিছু বললো না। বিয়ের পর থেকেই রুমানার ব্যাপারে অনিকের অনমনীয় সমর্থন পেয়ে এসেছে সে। এটা ওকে অনেক স্বস্তি আর ভরসা দেয়। এমনটা না হলে কী করতো, এটা সে ভাবতেও পারে না। কোনো প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র অথবা কোনো এনজিও কিংবা অন্যকোথাও রুমানাকে রেখে আসবে কী না সেই ব্যাপারেও ভেবেছে একসময়। আজ না হোক, যদি কোনোদিন অনিক একদিনের জন্যও রুমানার ব্যাপারে মুখ কালো করে, তাহলে তো সে সহ্য করতে পারবে না। মন থেকে অনিককে কিছুতেই ক্ষমাও করতে পারবে না। কিন্তু যতবারই রুমানাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছে, ততবারই কষ্ট আর বেদনায় বুক ভেঙ্গে গেছে সুমনার। প্রাণে ধরে কীভাবে রুমানাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেবে সে? এই জগতে ও ছাড়া আর কে আছে বেচারীর? নিরীহ অবলা একটা মানুষ। খেতে দিলে খায়, না দিলে না খেয়ে থাকে। ক্ষুধার কথা মুখ ফুটে বলতেও পারে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে সুমনার। এমন একটা অবোধ মেয়ের কে এমন ক্ষতি করতে পারে? সে কি মানুষ? যদি মানুষরূপী কিছু হয়, তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিতে চায় সুমনা। কিছুতেই ছাড়বে না! ছাড়া যায় না এমন জঘন্য বদমাশকে!
বেশ একটা জোর পেল সে এতক্ষণে। নিজের মধ্যে থেকে অন্য কেউ যেন বলে উঠলো, ‘তুমি পুলিশে খবর দাও। যা করার আমরা সব করবো! পুলিশের সব প্রশ্নের জবাব দিব!’ অনিক নিশ্চিন্ত হয়। এই সুমনাকেই সে চেনে। কষ্টে ব্যথায় ভেঙে পড়ে না এই সুমনা। সুমনার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে অনিক বলে,
‘পুলিশ কিন্তু অনেক আজেবাজে প্রশ্ন করবে! ভেঙ্গে পড়লে চলবে না কিন্তু! ভালোভাবে ভেবে দেখ।’
সুমনা স্থির গলায় বললো,
‘আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি ঠিক থাকবো।’
সেদিন বিকেলেই অনিক পুলিশ স্টেশনে গিয়ে একটা জিডি করে এলো। তার শ্যালিকা রুমানা রহমান, বয়স তের বছর। মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। গত এক বছর যাবত সে স্বেচ্ছায় কোথাও যায়নি। মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট বলছে, রুমানা দুইমাসের অন্তঃসত্ত্বা।
পুলিশ কমিশনার আনিসুল হক অনিকের বাবা ফজলুল আহমেদের সাথে অতি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। আনিসুল হকের বড়ভাই ছিলেন কলেজে ফজলুল আহমেদের সহপাঠী। ফজলুল আহমেদ তখন হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতেন। সেই সূত্রে আনিসুল হকদের বাসায় তার আসা যাওয়া ছিল। জমিদারের উত্তরপুরুষ হওয়ার সুবাদে বন্ধুমহলে ফজলুল আহমেদের আলাদা খাতিরদারি ছিল। তাছাড়া তিনি দেখতে শুনতে ছিলেন সুপুরুষ। সব মিলিয়ে বন্ধুর বাসায় তার বেশ সমাদর হতো। বন্ধুর ভাই পুলিশের চাকরিতে আছেন, তাই ফজলুল আহমেদ নিজেই উপযাজক হয়ে যোগাযোগটা বজায় রেখেছিলেন। ঢাকায় আসার পরে একবার ছেলের সাথে তার পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া ফজলুল আহমেদের জায়গা-জমি আর বাড়ি সংক্রান্ত কিছু মামলা মোকদ্দমা ছিল। সেসব মামলা মোকদ্দমার পুরোটা এখনো মীমাংসা হয়নি। সেসবের জন্যও পুলিশের কাছে আসতে হতো। কাজেই পরিচিত পুলিশ থাকলে সুবিধা হয়। হয়রানিটা কম পোহাতে হয়। এই যেমন আজকে অনিকেরও বেশ কাজে লেগে গেল। এরকম একটা ব্যাপারে পুলিশের কেউ পরিচিত থাকলে খুব ভালো হয়। আর তিনি যদি পুলিশের উঁচু পোস্টে কর্মরত কেউ হন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
পরিচয়ের পর থেকেই আনিসুল হক বেশ স্নেহ করেন অনিককে। চৌকষ বুদ্ধিমান সুদর্শন একটা ছেলে। কথাবার্তায় অতি অমায়িক। অনেকটা ওর বাবারই মতো। দেখে মনেই হয় না, এত বড় ঘরের সন্তান। জমিদারীর গল্পগাঁথা বইয়ের পাতায় পড়া হয়। সেই জমিদারের বংশধরকে চাক্ষুষ দেখাটাও একটা অন্যরকম ব্যাপারই বটে! যদিও দিন পালটে গেছে। এখন কোথায় সেই জমিদারীর রমরমা আর কোথায়ই বা তাদের প্রজারা!
আনিসুল হকের রুমের এক পাশে একজন প্রোঢ় ভদ্রলোক বসে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। অনিক তার দিকে তাকিয়ে ইতঃস্তত করতে লাগলো। আনিসুল হক তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন,
‘ওহ্! তুমি নিঃসঙ্কোচে সব কথা বলতে পারো অনিক। উনি আমার কাছের মানুষ। কোন সমস্যা নেই।’
অনিক আর আপত্তি দেখালো না। গোড়া থেকেই খুলে বললো সবকিছু। আনিসুল হক মন দিয়ে অনিকের অভিযোগ শুনে বললেন,
‘কী বলছো অনিক! তোমার শ্যালিকা প্রেগন্যান্ট! তাও আবার মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী একটা মেয়ে! এরকম একটা বিবেকহীন কাজ কে করতে পারে? ধরতে পারলে তো একেবারে গায়ের চর্বি বের করে ফেলবো!’
অনিক বিনীতভাবে বললো,
‘সেজন্যই আপনার কাছে এসেছি। আমি জানি আপনি আমার বাবার কাছের মানুষ। আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করেই ছাড়বেন!’
‘হুউম…তা তো ছাড়বোই। কিন্তু তার আগে বল দেখি, কেউ কি এর মধ্যে তোমাদের বাসায় এসেছিল? তোমার বিয়ে হয়েছে কতদিন? বাসাতে আর কে কে থাকে? ফজলুল ভাই তো বলেছিলেন, উনি উত্তরাতে বাড়ি বানিয়েছেন। তুমিও নিশ্চয়ই সেখানেই থাকো? বাবা-মা’র সাথে?’
অনিক শেষ প্রশ্নের উত্তরটাই আগে দিল।
‘বাসাতে বরাবরই আমরা তিনজন, মানে আমি… আমার স্ত্রী সুমনা আর সুমনার বোন রুমানা…এই তিনজনই থাকতাম। এখনো তাই আছি।’
‘কেন? তোমার বাবা-মা? উনারা থাকেন না তোমাদের সাথে?’
‘বাবা-মাও ঢাকাতেই থাকেন। আপনি ঠিকই শুনেছেন আংকেল। বাবা দেশের বাড়ির সবকিছু বেচে দিয়ে উত্তরাতে বাড়ি বানিয়েছেন। কিন্তু আমরা সেই বাড়িতে থাকি না। আমার বাবা-মা দুজনেই কিছুটা প্রাচীনপন্থী। মানে কিছু কিছু ব্যাপারে এখনো একেবারে সনাতন রীতিনীতি মেনে চলেন। তাই উনারা নিজেদের ইচ্ছাতেই আলাদা থাকতে চেয়েছেন। ছেলে আর ছেলে বউয়ের সংসারে এসে তাদের বিব্রত করতে চাননি। নিজেরাও চাননি আমরা উনাদের ওখানে গিয়ে থাকি। তারপরেও আমরা প্রতিমাসে কয়েকদিন করে উত্তরায় গিয়ে থেকে আসি। হাজার হোক বাবা-মা তো! আমি ও আমার স্ত্রী সুমনা দুজনেই অনেক চেষ্টা করেও উনাদের এই সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারিনি। তারা নাকি আলাদা থেকেই স্বস্তিতে আছেন।’
‘বল কী! তাই নাকি? কিন্তু ফজলুল ভাই তো আগে এমন ছিলেন না! আমি তো জানি উনি যথেষ্ট উদারমনা আধুনিক মানুষ।’
(ক্রমশ)
আগের পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
গল্পকার,
রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পুরকৌশল নিয়ে পড়ে এখন নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।