| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সময়ের ডায়েরি

পদসঞ্চার (পর্ব-১৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

অঞ্চল আর আমেরিকা অঞ্চলে তার দাপাদাপিটা বেশি। তালিকাটায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাটা দেখা যাক।

ক. প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল

চিন- ৮৪৩৩৮ + ৪৬৪২ ; সিঙ্গাপুর- ১২৬৯৩ + ১২ ; জাপান- ১৩১৮২ +৩৪৮ ; অস্ট্রেলিয়া-৬৭০৩ +৮১ ;  ফিলিপিনস- ৭২৯৪ + ৪৯৪ ; রিপাবলিক অফ কোরিয়া- ১০৭২৮ + ২৪২ ; মালয়েশিয়া- ৫৭৪২ + ৯৮ ; নিউজিল্যান্ড- ১১২১ + ১৮। ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশে সংক্রমণ নগণ্য।

খ. ইউরোপীয় অঞ্চল

স্পেন- ২১৯৭৬৪ + ২২৫২৪ ; ইতালি- ১৯৫৩৫১ + ২৬৩৮৪ ; জার্মানি-১৫৪১৭৫ + ৫৬৪০ ; ইংল্যান্ড- ১৪৮৩৮১ + ২০৩১৯ ; ফ্রান্স- ১২২৮৭৫ + ২০৩১৯ ; তুর্কি- ১০৭৭৭৩ + ২৭০৬ ; রাশিয়া- ৭৪৫৮৮ + ৬৮১ ; বেলজিয়াম- ৪৫৩২৫ + ৬৯১৭ ; নেদারল্যান্ড- ৩৭১৯০ + ৪৪০৯ ; সুইজারল্যান্ড- ২৮৯৭৮ + ১৩৩৬ ; পর্তুগাল- ২৩৩৯২ + ৮৮০ ; আয়ার্ল্যান্ড- ১৮৫৬১ + ১০৬৩ ; সুইডেন- ১৮১৭৭ + ২১৯২।

১৫ হাজার বা তার কম আক্রান্ত হয়েছে যেসব দেশের মানুষ : ইস্রায়েল, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ডেনমার্ক, সার্বিয়া, ফিনলয়ান্ড, গ্রিস, হাঙ্গেরি, নরওয়ে, কোরাশিয়া, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, গ্রীনল্যান্ড প্রভৃতি।

গ. দঃ পূর্ব এশিয়া

ভারত- ২৬৪৯৬ + ৮২৪ ; ইন্দোনেশিয়া- ৮৬০৭ + ৭২০ ; বাংলাদেশ – ৪৯৯৮ + ১৪০ ; থাইল্যান্ড- ২৯২২ + ৫১ ; শ্রীলঙ্কা- ৪৬০ + ৭ ।

মায়নামার, মালডেভিস, নেপাল, ভুটানে আক্রান্ত ১৫০ এর কম।

ঘ. পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল

ইরান- ৮৯৩২৮ + ৫৬৫০ ; সৌদি আরব- ১৬২৯৯ + ১৩৬ ; পাকিস্তান – ১২৭২৩ + ২৬৯ ; ইউনাইটেড আরব এমিরিটাস- ৯৮১৩ + ৭১ ; কাতার- ৯৩৫৮ + ১০ ; ইজিপ্ট- ৪৩১৯ + ৩০৭।

মরোক্কো, কুয়েত, বাহরিন, ওমান, ইরাক, আফগানিস্তান, জর্ডান, সোমালিয়া, লিবিয়ায় আক্রান্ত ৩ হাজারের কম ।

ঙ. আমেরিকা অঞ্চল

ইউনাইটেড স্টেস অফ আমেরিকা- ৮৯৯২৮১ + ৪৬২০৪ ; ব্রাজিল- ৫২৯৯৫ +  ৩৬৭০ ; কানাডা- ৪৪৩৫৩ + ২৩৫০ ; ইকোয়েডর- ২২৭১৯ + ৫৭৬ ; পেরু- ২১৬৪৮ + ৬৩৪ ; মেক্সিকো- ১২৮৭২ + ১২২১ ; চিলি- ১২৮৫৮ + ১৮১ ।

৬ হাজারের কম আক্রান্ত পানামা, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কোস্টা রিকা, উরুগুয়ে, গুয়াতেমালা, কিউবায় ।

চ. আফ্রিকা অঞ্চল

দঃ আফ্রিকা- ৪৩৬১ + ৮৬ ; আলজিরিয়া- ৩২৫৬ + ৪১৯ ; ক্যামারুন- ১৫১৮ + ৫৩ ; ঘানা- ১২৭৯ + ১০ ; নাইজিরিয়া- ১১৮২ + ৩৫।

আ্যঙ্গোলা, জাম্বিয়া, বেনিন, উগান্ডা, সিরিয়া লোরেন, মধ্য আফ্রিকা, কঙ্গো, রাওয়ান্ডায় আক্রান্ত ৩০০ এর কম।

মোবাইলের বাজনা। স্ক্রিনে মানস হালদারের নাম। সাগর দত্ত লেনের মানস। সে বলল, ফোনে সব কথা বলা যায় না। তোর মেলে একটা চিঠি পাঠিয়েছি । দেখে নিস।’

দিন চারেক আগে মানসের সঙ্গে আমার কথাকাটাকাটি হয়েছিল। কোন একটা টিভি চ্যানেলে দেখলাম মানস তার বাড়ির ভাড়াটে  দুজন তরুণ ডাক্তারকে উঠে যেতে বলেছে। কারণ তাঁরা করোনা হাসপাতালে কাজ করেন। অবশ্য মানস খুব রুডলি বলেনি। অনুরোধ করেছিল। এটা শুনে আমি তাকে ফোনে একচোট গালাগালি করেছিলাম। ডাক্তার,  নার্স প্রভৃতি স্বাস্থ্যকর্মীরা যে করোনা যোদ্ধা, আমাদের রক্ষাকর্তা, একথা বোঝাতে চেয়েছিলাম। ফারহান আলি সিদ্দিকি, রে লিভার, গিল ওকেস, মার্ক স্টানলি, ফিলোমিনা চেরিয়ান, ড. নাসির খান, জেরমিন রাইট, কেন ল্যাম্বাটন, ল্যারিক্স আ্যান্ডারসন, জেন্নি ডানকার, টমাস পাট্টুগ্যালন, ফ্রেডা ওক্রান, তেরেসা লক্কো, ড. ফ্র্যাঙ্ক গ্যাব্রিন, কিয়স কেলি, জুডি উইলসন র্গ্রি্ফিন প্রভৃতি ইউরোপ-আমেরিকার স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা বলেছিলাম, যাঁরা করোনাযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। চিন, ইরান প্রভৃতি দেশেও বহু স্বাস্থ্যকর্মী জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা করছেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কিভাবে কাজ করছেন সেকথা বলেছিলাম। মানস যখন বলেছিল যে সেটা তাদের জীবিকার অঙ্গ, তখন রেগে গিয়ে বলেছিলাম, ‘এর চেয়ে দ্বিগুণ মাইনে দিলে তুই কি করোনারোগীর সেবা করতে পারবি?’

তার কোন উত্তর মানস দেয়নি।

আজ সে কি লিখেছে, তা জানতে কৌতূহল হল। মেল খুলে মানসের চিঠি পড়তে লাগলাম।

‘ সেদিন ফোনে তুই একচোট গালাগালি করলি। তোর কথাগুলো নৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে একদম ঠিক। আমিও সেকথা ভাবি। তবু ভয় কাটাতে পারিনি। আমরা দুজন বুড়ো-বুড়ি থাকি। ছেলে তো কলকাতায়। তুই জানিস। আমরা করোনা আক্রান্ত হলে কে দেখবে বলতো?

‘আমার বাড়ির ভাড়াটে দুই ডাক্তার প্রায় আমার ছেলের বয়সী। ভালো ছেলে। আমরাও তাদের ভালোবাসি। আমার গিন্নি ভালো কিছু রান্না করলে তাদের জন্য রেখে দেয়। কিন্তু করোনা হাসপাতালে একজনের মৃত্যুর খবর শুনে কেমন হয়ে গেলাম। আত্মরক্ষার চিন্তাটা প্রধান হয়ে উঠল । সেটা কি খুব অস্বাভাবিক?

‘তার উপর আমাদের রাজ্যটায় করোনাযুদ্ধের নামে কি চলছে দেখতে পাচ্ছিস তো! রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় দল বনাম প্রশাসন, বিরোধী দল বনাম শাসক দলের তরজায় ব্যাহত হচ্ছে করোনা প্রতিরোধের কাজ। অভিযোগ উঠছে শাসক দল আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা চেপে যাচ্ছে। অভিযোগ, যথাযথ পরীক্ষা হচ্ছে না। অভিযোগ সত্য হলে মারাত্মক অবস্থা হবে। এ রাজ্যে অনেক আগে থেকে সচেতনতার প্রচার শুরু হলেও ডাকাত ঘরে ঢুকে পড়ার পরে দেখা গেল আমরা অপ্রস্তুত।

‘ তার উপর ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা অকিঞ্চিৎকর। আজকের কাগজেই দেখতে পাবি স্বাস্থ্য পরিযেবায় কর্মীরা কিরকম আক্রান্ত হচ্ছে। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের এক ইনটার্ন, কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নার্স, মিন্টো পার্কের বেসরকারি হাসপাতালের এক রাঁধুনি, স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিনের স্টোর ইনচার্জ আক্রান্ত হয়েছেন। নানা ছোটখাটো বিষয়ে নজর না দেওয়ার জন্য সংক্রমণ বাড়ছে। চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের আ্যম্বুলেন্স চালক করোনায় আক্রান্ত, কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ায় তিনি দিব্যি কাজ করে গেছেন। তাঁর দ্বারা আরও দুজন জুনিয়ার ডাক্তার সংক্রমিত হলেন। এভাবে চলছে। তাছাড়া টেস্ট কিট ত্রুটিপূর্ণ, যথেষ্ট পিপিই নেই …। ‘তাই আমার ভয় হচ্ছিল। ডাক্তার দুজনকে অন্য বাসা দেখে নিতে বলেছিলাম। আমার মাথা কাজ করছিল না। নিজেদের নিরাপত্তাটা বড় হয়ে উঠেছিল। ভাবি নি যে এ অবস্থায় নতুন বাসা পাওয়া সহজ নয়। কি করব, আমিও তো মানুষ।

‘কিন্তু গতকাল আমার ভুল ভেঙে গেল। তুই তো জানিস, আমার ছেলে বেলগাছিয়ায় থাকে। সে অঞ্চল এখন রেড জোন হয়েছে। সুযোগ পেলে সে বাড়ি চলে আসবে বলল। আমি ভাবলাম সে বা তার বউ তো লক্ষণহীন বাহক হতে পারে। তাদের সংস্পর্শে আমরা করোনা আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু তাই বলে তাকে কি আমরা বাড়ি আসতে বারণ করব! বাপ-মায়ের পক্ষে এতটা স্বার্থপর হওয়া কি সম্ভব! ছেলের ক্ষেত্রে যেটা সম্ভব নয়, ছেলের বয়সী অন্যদুটো ছেলের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব কেন! এই ছেলেদুটো তাদের বাড়ি গেলে তাদের বাপ-মাও তাদের দূরে ঠেলে দেবে না।

‘ বিশ্বাস কর, নিজের ছেলের আয়নায় ওদের যখন দেখলাম, তখন সব ভয় কেটে গেল।’

মানসের চিঠিটা পড়ে আমিও মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত জোর অনুভব করলাম। মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।

মানসকে ফোন করে বললাম, ‘ছেলেদুটোকে বলে দিয়েছিস তো!’

-‘হ্যাঁ, কাল রাতেই বলেছি।’

-‘ওরা কি বলল?’

ফোনের অপরপ্রান্তে মানসের হাসি শুনতে পেলাম। বলল, ‘ ওরা বলল, কাকু এরকম পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। আমরা জানি। আপনারা যাতে ভালো থাকেন, আমরাও সে চেষ্টা করব। দোতলা থেকে আপনাদের নামার দরকার নেই। দুধ,ওষুধ বা তরিতরকারি আমরাই সিঁড়ির উপর রেখে দিয়ে আসব। তিন-চার ঘন্টা বাদে সেগুলো তুলে নেবেন। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হলে ফোনেই বলবেন।’

আবার হাসতে লাগল মানস। আসলে মনটা বড় হয়ে গেলেই এরকম প্রাণের হাসি হাসতে পারে মানুষ।

 

 

 

 

[ক্রমশ]

 

 

 

 

আগের সবগুলো পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত