| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

করোনাকালে ইন্দু বিন্দু (পর্ব-৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

করোনা শুরুর দিকে শেষ হয়েছিলো তারপর দুইমাস কয়েকদিনের বিরতি, পাঠকদের অনুরোধে আবারো শুরু হল ইরাবতীর পাতায় করোনাকালে ইন্দু বিন্দু। আজ রইলো করোনাকালে ইন্দু বিন্দু পর্ব-৪।


মেমারিজ অফ মার্চ

সেদিন চৈত্রমাসকরোনার চোখে দেখব হয়ত আবারো আমাদের সর্বোনাশঠিক এমন ভাবছিলাম। এবার চৈত্রে চড়কের ঢাকে কাঠি পড়ল না। সজনে ডাঁটা বুড়িয়ে গেল। খাওয়া হল না আর। বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে বলে চীৎকার করে সেই মাধুকরীর সিধে নিতে ওরা কেউ এল না এবার কেউ বাড়ি বয়ে। এবার আমাদের চৈত্র সেল নেই। ফুটপাথে হকারদের রমরমা নেই। আমাদের এখন উইকেন্ডের জন্য মনকেমন নেই। শুক্রবারের বিকেল থেকেই রবিবারের বায়নাক্কা নেই। কোনও প্ল্যান নেই আমাদের কারোর। ভোরে উঠলেই কাজের সহকারীর আমার বাড়িতে আসার কোনও অনিশ্চয়তা নেই। তার জন্য অপেক্ষাও নেই আমাদের। কি রান্না হবে তা নিয়ে বাজারের তাড়া নেই। অফিসের জন্য টিফিন নেই। তার মধ্যেও ছাদ বাগানের ফুল গাছেদের জল দিয়েঘরের পোষ্যদের খাবারের ভাবনা আছে। নিজেদের সংসারের মাসকাবারির ফর্দ নেই। গল্প লেখার রসদ নেই। পঞ্চব্যঞ্জন ছেড়ে শুধু দিনগতে করোনা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছদনের উপায় বের করা আছে। কোথায় সবজীর খোসা ফ্রিজে জমিয়ে ডালের সঙ্গে ভাজা খাওয়ার বিলাসিতা আছে। ভাতের ফ্যানের স্যুপ কে নতুন মোড়কে আবিষ্কার করার নতুন ভাবনা আছে। আলুভাতের চমকদার রেসিপি ইনোভেশনের কৃতিত্ব আছে। গেরস্থ আলু পেঁয়াজ হিসেব করে খরচ করেনি এতদিন। এখন যেন মঙ্গলগ্রহের কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মত খাবারের হিসেব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। কটা আলুকটা পিঁয়াজ রোজ রান্না হলে কতদিন যাবে । নতুন করে ঐকিক নিয়ম মাথা খাটিয়ে বের করছে সুগৃহিণী। যেন অর্ধভক্ষ ধনুর্গুণঃ। কিছু না পেলে আটা গুলে পিঁয়াজলংকা কুচি দিয়ে তেলের ছিতে দিয়ে গোলা রুটিই খাব আমরা অথবা মাড়ভাতের স্যুপ । একটু সরষের তেলকাঁচা লঙ্কা আর নুন ছড়িয়ে। খিদের মুখে তাই অমৃত লাগবে।

চৈতালী হাওয়া গায়ে মেখে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি ছাদ বাগান থৈ থৈ বাসন্তী ফুলে। আমার মনের অগোচরে। আজ বসন্তে আমার ফুল গাঁথার সময় নেই। তবুও ওরা সব ছাদ আলো করে দোল খাচ্ছে। কত আনন্দেরঙীন হয়ে ফুটে রয়েছে। একে একে জড়াজড়ি করেহাত ধরাধরি করে। আমার মনের খবর নেই ওদের কাছে।আমাদের এখন বেঁধে বেঁধে থাকার উপায়ও নেই। আমরা সবাই দূরে দূরে তবুও আমার কাছাকাছি ফুলেরা কাছে যেতেই বলে ওঠে

” কি গো দেখলে না আমায়?”

আমি বলে উঠলামদেখছিই তো কিন্তু পারবি তোরা সবাই মিলে সারাদেশের মানুষের মন ভালো করে দিতেআচমকা দেখি রক্তকরবী খুব হাওয়ায় মাথা ঝুঁকিয়ে বলে উঠলআছিই তো। চিন্তা কিসের?

অদৃশ্য সেই শক্তির কাছে বারেবারে নতজানু হই আমি। কে তিনিশীতলারক্তকরবীনাকি করোনার প্রতিষেধক?

হঠাত যেন আলোর ঝলাকানি তারই মাঝে। অভিভূত হয়ে পড়ছি সবাই। এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারাপুত্রপরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত। এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে। শিখছে সভ্যশিক্ষিত মানুষ। পরিবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব একে অপরের খবর নিচ্ছেসেটাও আমাদের পরম পাওয়া। সব মানুষের পাখীর চোখ এখন করোনা দমন। রাজনীতির রঙজাতপাত সব ভুলে সবার লক্ষ্য এক । সেটাই বা কম কিসেরভাবছিলেন তো মিলন হবে কত দিনেএইতো এগিয়ে এল সেই বহু আশার মিলনক্ষণ। আমরা সবাই এখন এককাট্টা হয়েছি। মোরা মিলেছি আজ মায়ের সাথে।

ওদিকে রাস্তায় গাড়ি চলছেনা। সব বন্ধ। কেউ বাইরে বেরুচ্ছেনা। যেন বন্ধ উদযাপন চলছে দিনের পর দিন। অর্থাত প্রচুর এনার্জি কনজারভেশন হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। প্রকৃতি খুব খুশি। এজন্যই বুঝি বলে রিসোর্সেস লিমিটেডবুঝে চল।

আরেকদল শিক্ষিত মানুষ জেনেবুঝেও অন্ধ। এই একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের দাপটে রাজার ঘরেও যে অসুখ টুনির ঘরেও তাই। বিলেত ফেরত গায়ক গায়িকা এদ্দিন নিজেকে যতই সেলেব ভাবুন না কেন উনি আসলে কিস্যু নন। গণ্ডমূর্খ। মোটেও সমাজ সচেতন নন। শিল্পী হবার কোনো যোগ্যতাই আসলে নেই তাঁদেরশুধু গান গাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না। তাঁরা ছড়ালেন রোগ। ছড়াচ্ছেনও প্রতিমূহুর্তে। মরছি আমরাযারা সরকারি বিধি মেনে চলছি। দামী চিকিত্সক থেকে নামী আমলাখেলোয়াড় থেকে অভিনেতা আজ আমিআপনি কিন্তু সমান রিস্কেসেটা অন্ততঃ বুঝুন। রাজার রোগটুনির রোগ এখন সমান।

আমাদের তো দিব্য চলছিল কবিতার আড্ডাসাহিত্যআড্ডাজনসমাবেশমাল্টিপ্লেক্সে হৈ হৈ হ্যাঙআউটশপিংমলের ফুডকোর্টে মস্তির দিনলিপি। ক্রমে চীনজাপানকোরিয়া আর তারপর দস্তুর মত ইউরোপ। ইতালিকে শেষ করে ইরান। আমেরিকাতেও অনুরূপ অবস্থা।দাপিয়ে বেড়াতে বেড়াতে অবশেষে ভারতে ঢুকে এল করোনা । কাজের লোকেরা সবেমাত্র বলতে শুরু করেছেকি একটা রোগ এইয়েচে গোপরীক্ষাগারে সহজে রাসায়নিক স্যানিটাইজার তৈরী কিম্বা গ্রামে গঞ্জে ভেষজ পদ্ধতিতে। এমন সব ইনোভেশন দৌড়চ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই কলকাতার করোনা কথার জন্ম হল। নাহতারপর অ্যাটলাস্ট সেই অশৌচ পর্ব পালন আবশ্যিক হয়েই পড়ল। তবুও ভবি ভোলার নয়। শয়নে স্বপ্নে জাগরণে এভাবেই করোনা ঢুকে পড়েছে বাঙালীর জীবনযাত্রায়।

এখন অনলাইন ম্যানেজমেন্টের ছাত্রের পরীক্ষার ইন্টার্ভিউতেও করোনা ইস্যু। ম্যানেজমেন্ট গুরু শিষ্যকে শুধান আচ্ছা বল দেখি স্যনাইটাইজারের খুব চাহিদা এখন। বাজারে পাওয়াই যাচ্ছেনা। তোমায় যদি একটা মডেল সেট আপ করতে বলা হয় কি হবে তার স্ট্র্যাটেজি?” তারপর তার সাপ্লাই আর ডিমান্ড নিয়েও ভাবনাচিন্তা । ভাব ম্যানেজমেন্ট ট্রেনী ভাব। গ্রুম কর নিজেকে। করোনার যুগে তোমাদের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে ম্যানেজমেন্ট পড়লে।

এর মধ্যে ফুলেল শহরে বসন্তের কোকিলের কুহুতান । তার শুধু চিন্তা আহারমৈথুনের আর বাঙালীর ভ্রমণের। তায় আবার পুরোদস্তুর ছুটির আমেজ। বাঙালীর ভ্রমণ পিপাসা পায়। ভাবতে অবাক লাগে। হোয়াটস্যাপে দীপুদার প্ল্যান হয়। ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ যেন। এরা আবার গাড়ির মধ্যে ঢুকে সেলফি তুলে এই ডামাডোলের বাজারে ফেসবুকে পোস্ট‌ দেবার লোভ সামলাতে পারেনা। বলে ওঠেহ্যালো ফ্র্যান্দসচললুম পলাশের দেশে। কারণ বসন্ত ফুরায়। বাঙালীর বেড়ানোর নেশা পৃথিবীর সব জাতের চেয়ে বেশী কিনা।

ততক্ষণে লন্ডন ফেরত শিক্ষার্থীআমলা ও ডাক্তারের পুত্র ছড়িয়েই দিল সেই মারণ রোগ কলকাতায় । ঠিক তারপরেই দক্ষিণ কলকাতার ওয়েসিস আবাসনের ব্যাবসায়ী পুত্র। এরা সবাই লন্ডন ফেরত। কিন্তু কারোর কোনও হেলদোল নেই। নেই স্বাস্থ্য সচেতনতা। বাড়ির লোকেও ভাবল না নিজেদের কথাপড়শির কথা। মশাই এরা মানুষমানুষের তো আক্ষরিক অর্থে মান এবং হুঁশ দুই থাকতে হয় জানি। আবার নির্লজ্জের মত কলকাতার বাপ মায়েরা তাদের বিদেশে পড়া ছেলেপুলেকে ডেকে ডেকে নিয়ে এলেন দেশে। আহাবলুন তোমায়ের প্রাণআয় তোরা আয় ফিরে অথবা বেটা তুরন্ত বাপাস আ যা। সঙ্গে নিয়ে আয় দু‘ চারটে করোনা। তখন থেকেই পন্ডিতিয়া হল কলকাতার এপিসেন্টার।

তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলামআমাদেরও আছে মশাই বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ধন সেদেশে পড়ে। তবু বলেছি বেরুবি না একদম। প্রয়োজন না হলে। ঘরে বসে পড়াশুনো। কনফারেন্সমিটিং সব চলছে গবেষকদের। দুগগা নাম জপচিলাম অহোরাত্র ঘরে বসে।

ধীর গতিতে আমরা পেরিয়ে চলেছি একের পর এক স্টেজ গুলি। একদুইতিন। কে জানে ততদিনে আমিই বা কেমন থাকি। এ ছিল আমার মার্চ মাসের মোনোলোগ।  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত