দাঁড়কাক মিথ আর পিঠা তারামন

Reading Time: 4 minutes
কায়দা-আমপারা-সিপারা নিয়ে ছুটতে থাকা পোলাপান, বকুল ফুল কুড়ানো হেমা, মুরগির কক কক, হাম্বা, কাশি খুকখুক, টিউবওয়েলে কুরুত কুরুত, এবাড়ি ওবাড়িতে রান্নার আয়োজন- যেন গাঢ় এক আন্ধার ইঁদারা থেকে তুলে আনছে ওরা সকাল কিংবা ওরা কোন নবজাতক হাতে। যে শিশুর জন্ম বেয়ে নাড়ির মতো ঝুলে আছে অন্ধকার। ঘ্যাঁচ করে কেটে দিলেই আতুঁড় ঘর হয়ে যাবে আচাররঙা বেলুন। সকাল উপচে পড়া নিঃশ্বাসের ঝাপ্টায় সে বেলুন শুধু উড়ে, উড়ে আর উড়ে। ওদের মধ্যে আমরা যারা গতরাতের কলহ-যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে আসি, আমরাও তখন ভাবি-হেমলকেও ফোটে ফুল, মেঘ সাদা সব ফুল।  এখানে এমনই সকাল।
শীত এলে কোঁচরভর্তি আরও অন্ধকার নিয়ে  উঠে পড়ে নতুন-পুরনো বউ। কখনো সন্ধ্যা রাত, কখনো মাঝরাত তখন, ওদের কানে মন্ত্রণা দেয় কোন পাখি- বউ উঠ, ঝি হুত, বউ উঠ, ঝি হুত। সেইসব রাতে কন্যারা ভারী কাঁথা গায়ে বউ-না-হওয়া ভাগ্যে আরেকটু আরাম করে। বউয়েরা রাতের দরগায় শব্দ মানত করে। বলী হয় ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল, কেউ আবার নয়া বাড়ির ঢেঁকিঘর অবধি যেতে চায় না বলে গাইল-চিয়ায় ভাঙন খেলে। ঘরে তখন ঘুম কারো এপাশ ওপাশ করে, কোন ঘুম বউ ছাড়া তড়পায়, সুখদ হয় কোন ঘুম থালা ছড়ানো পিঠার কল্পনায়। এইসব শব্দের রাতে কেউ কি জেগে থেকে থেকে হয়ে যায় কাক- তীর্থের ক্ষুধার্ত কাক যে থাকে নৈবেদ্য ছড়িয়ে দেবার অপেক্ষায়,  নৈবেদ্যের গন্ধে-ভাবনায় এক আদ্যন্ত ক্ষুধা নিয়ে মোচড়ায় তার পেট?
আর তাই বুঝি ভোরের পিঠা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে!  পিঠা বানানোর আনন্দ ভাটা পড়ে মনোয়ারার। আরো খানেক গুড়ি মেশায়, পানি মেশায়, চিনি ছাড়ে, লাড়কির জ্বাল বাড়ায়, কমায়।  তাতেও বশে আসে না পোষ না মানা বুনো পিঠা। যেন তুষ্ট নয় কেউ। সেবার চিড়ার হাতু, কতো রকম পিঠা নিয়ে কুরাইলের পীরের কাছে গিয়েছিল রবিউল। মানত ছিল অথচ হুজুর সব ফিরায় দিল। রবিউলের মা হুমায়ূনের বউয়ের কাছে আসে বুঝ পৱামৰ্শ নিতে- হাতু খাইতে কী যে মন চাইছিল বউ সাহস করে কইতে পারি নাই, এত আয়োজন করে গেল, হুজুর কয় ঘরেই বলে পীর, ফিরায় দিল, রবিউল চিন্তায় বিছানা লইছে।’  হুমায়ূনের বউ দরদে পিছলায়, বলে- ‘পীর খুইজ্যা পায় না! মায়ের চাইতে বড় পীর কেডা? আপনের যে খাইতে রুহ পড়ছিল ঐ খাবার কেমনে বাবা মুখে দেয়।’
এমন ভাবেই কি কারো অতৃপ্ত রুহু খানজাব জ্বীনের মতো ভর করেছে পিঠায়! ভেবে ভেবে জুসু, যে এককালে জ্যোৎস্না ছিল, জানায় সন্ধ্যায় তারামনরেই বুঝি ও যেতে দেখেছে। ‘কি কস!’- তড়াক করে খাবি খায় পুরনো বউয়ের মন। সারা রাত মনে মনে ঐ মেয়ের কান থেকেই তো লুকোতে চেয়েছিল ঢেঁকির পাড়!  পালে হাওয়া লাগার মতো তড়তড়িয়ে  তারামনরে ডাকতে ছুটে কেউ। তারামনও আসে জলে ভাসানো দুর্গার মতোন, আমের শুকনা ডালের উপর পায়ের গোড়ালি ঠেস দিয়ে বসে।  কাই মাখানোর মতো কথা মেশে ওদের-  গুড়ি করলেন, আমারে ডাক দিতেন, নতুন দামানের লাগি এই অল্প কটা;  মাটি কাটতে যাইবা না আজ? নাহ; মন্তুর সংসারের খবর কি, সতীনের আচরণ কেমন? ভালোই, ভাত পানি মুখে দিতে পারে না, তিন মাস চলে;  সংসার করতে মন চায় না তারামন? যাও জামাইর বাড়ি ফিরা,  কি কন! টাকা দিবার কয়, জামাইয়ে কাম নাই গো।
নতুন বউ তখন ঘোমটার ফাঁক থেকে লবণ চাখে আর রাতের সোহাগ মনে করে ভাবে আউস মাউসও হয় না? তারামনকে এ গ্রাম সে গ্রামের লোকেরা বেহতার বলে।  যদিও মিঞা বাড়ির বড় বউ বলে ওর মতো বুদ্ধিমান আর নাই, লোকে অহেতুকই বোকা ভাবে। যা একটু পোলাপাইন্না স্বভাব। শহর থেকে কেউ গ্রামে আসলে কিংবা কোন গাড়ি ছুটলে সেও বাচ্চাদের সাথে দৌড়ুবে।  অতিথি আসার খবর সবথেকে  আগে দেবে তারামন- সুজনের মা চাচী, সুজনের নানী আইয়ে গো।  সুজনের মা চাচী একটা চড়াইয়ের মতো ফুরুৎ করবে আবার হোঁচট খাবে- এই যে আসছে একজন।  আর কি নড়ানো যাবে এই দাঁড়কাক।  গাবলা গাছের আঠা হয়ে গল্পগুজব করবে। গল্পের নেশা ওর নাই, সব ঐ বিস্কুট-চকলেট পাবার নেশা।
বাপ নাই সংসারে তাকেই বা কে শখ করে হাতে একটা দুটো বিস্কুট-টিস্কুট দেয়।  তারামন তাই তেত্ৰিশ ছাড়িয়েও বড় হয় না, বড়দের মতো খায়েশ মুয়েশ হয় না, ওকে নিয়ে কোন  প্রণয় ঘটিত কেচ্ছা কাহিনীও হয় না।  আমরা ছোট থেকে বড় হই, বৃত্ত হই, তারামন কেবল বিন্দুতেই পড়ে থাকে।  তারামন পিঠা বড়ো ভালবাসে।  এমনিতে ওকে দিয়ে কাজ করানো যায় না কিন্তু যেই কারো ঢেঁকিতে বা গাইলে আওয়াজ উঠে, তারামন দাঁড়কাক হয়ে নৌকা ভেড়ায়।  যারা গোপনেই পিঠার আয়োজন শেষ করতে চায় তারামনের রুহু ঠিক তাদের আটকে ফেলে একটা পিঠার ভেতর।  তেলের পিঠা তখন ফুলে উঠতে চায় না, ভাঁপা পিঠা ভেঙে ভেঙে পড়ে। তখন ওরা ডাকে- দাঁড়কাক আয়, আয়।  দাঁড়কাক এলেই নতুন বউয়েরা দেখে নিমিষেই কি চমৎকার ফুলের মতো ভেসে উঠে হার মানা হার পিঠা।
বোটানীর সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ুয়া মাসুমা ভাবে পিঠা নিয়ে যা  ঘটে সবটাই একটা অপরাধবোধ থেকে হয়। অথচ নতুন বউয়েরা এই যে দেখলো পিঠা তড়াক করে বাধ্য হয়ে যায় সেটাই মনে রাখে। একদিন ওরাও পুরনো হবে, শুধু থেকে যাবে দাঁড়কাকের মিথ কেননা এটা ওরা বয়ে নিয়ে যাবে নতুনের কাছে।  এভাবেই বংশপরম্পরাক্রমে ওরা পিঠার সাথে ধরে রাখে তারামন ও দাঁড়কাক।  ওদের গ্রামে যদি জন্ম হতো কোন ভিনসেন্ট গগের মতো কোন শিল্পীর, সে বোধহয় পিঠা, তারামন ও দাঁড়কাকের ছবি এঁকে সাড়া জাগিয়ে ফেলতো।  একটা পিঠার উপর দাঁড়কাকের ছায়া কিংবা অৰ্ধেক মানবী-অৰ্ধেক দাঁড়কাকের উপর উড়ে যাচ্ছ এক ঝাঁক পিঠা-আ ইজেলের অস্তিত্বে জন্ম হতো এমনই কিছু কিংবদন্তী ছবির।
ছোট-বড়ো হরেক দাঁড়কাকের জন্ম অথবা জন্মের সম্ভাবনা দিয়ে তারামন একদিন মরে গেলো। গতানুগতিক মৃত্যুই ছিল তারামনের।  এ গ্রামে একটা বাড়ি মানেই একটা কবরস্থান। যে যার আপন মানুষ ধারেকাছেই শুইয়ে রাখে। প্রথম প্রথম কিছু রাত ভয়ে কাতরায়।  তারপর ভয়ও কেমন একঘেঁয়ে পানসে হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে।  কবরকে পেছনে রেখে ওরা উঁকুন বাছে, কাইজজা ফ্যাসাদ করে। কেবল বাঁশ পাতা কুড়ানোর সময়  দু-একবার সালাম ঠুকে। তারামনও বুঝি হারিয়ে যেতে থাকে।
 অথচ কোন পিঠার দিনে যখন  পিঠার জো আসে না কিংবা ভাঁপা পিঠা ভেঙে যায়, পুরনো বউদের তারামনকে বড়ো মনে পড়ে। বড় হয়েও ছোট হয়ে থাকা মরা মেয়েটার জন্য কচুরীপানার মতো মায়া টলটলায়। ঘরে হয়তো আবারও এক নতুন দামান, পিঠাদায়গ্ৰস্ত মন আল্লাহরে ডেকে চলেছে, পুরান বউ তখন চোখের ফোঁটা ঘষে ঘসে পথ বাতলে দেয়- একটা পিঠা তারামনের কবরের কাছে দিয়া আস। নতুন বউ তর্ক করতে শেখেনি তখনও, তারামনের কবর ঠিক কোনটা সে প্রশ্নও সে করে না। পুকুর পাড়ে একটা কবরস্থানে কচু পাতায় পিঠা দিয়ে দৌড় লাগায় বউ।  ছমছমে ভোরে এ ঘটনা চোখে পড়ে গোসল করতে আসা আলানী বউয়ের। বাড়ি গিয়ে সে বউ বাঁশরিয়া হয়,  পিঠার বাঁশি বাজায় ছোট জা, চাচী শাশুড়ি, ননদের কাছে। একে একে সে ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে।
 তারপর থেকেই বাত্তি দেয়ার মতো মাঝেসাঝে একটা কবর ঘিরে থাকে পিঠা। যে কবরের প্রতিবেশী কাঁঠালের গাছে কিছু দাঁড়কাক বসে থাকে। একই প্ৰসঙ্গ পাল্টাতে কেবল একদিন থেকে দাঁড়কাকের সাথে বাকবাকুম বাকবাকুম করে কবুতর। এক, দুই, তিন ধীরে ধীরে সংখ্যাটাকে অসংখ্য মনে হয়- যা একটি নিখুঁত মিথের জন্য তুমুল লোভনীয়।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>