ইরাবতী,ইরাবতী.কম,বিতস্তা ঘোষাল,irabotee.com,bitasta ghoshal,copy righted by irabotee.com

দিল্লির ডায়েরি (পর্ব-১১)

Reading Time: 3 minutes

সমস্ত উত্তরাখণ্ড জুড়েই নিরামিষ খাবার ।মাছ মাংস ভীষণ কম পাওয়া যায় ।এখানকার মানুষেরা সবাই কী নিরামিষ খায়! জানি না ঠিক।তবে সুমন ভাবী বলে, নিরামিষ রান্না করা বেশ কষ্টকর এবং খাওয়া খুব ভালো ।আমি অবশ্য আমিষ রান্না মানে মাছ মাংস একেবারেই ভালো রাঁধি না।নিরামিষ অনেক পদ যেমন মোচা, পোস্ত, আলুর দম, ধোকার ডাল্লা, কোপ্তা, শুক্ত, পনির ইত্যাদি বরং ভালো রাঁধি।বাড়িতে মাছের চল নেই বললেই চলে, মাংসও তথৈবচ ।ডিম অবশ্য রোজই হয় ডাক্তারের নির্দেশে ।কাজেই এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই আমাদের।
হরিদ্বার এলে সকলেই দাদা বৌদির হোটেলের কথা বলে।মুসকিল হচ্ছে এখন হরিদ্বারে অনেকগুলো দাদা বৌদি।হর কি পেয়ারি ঘাট থেকে বাজার পর্যন্ত অন্তত ২০ থেকে ২৫ টা তো হবেই ।এর আগে আদিত্য ডিলাক্সে যখন উঠেছিলাম, তার গায়েই ছিল দাদা বৌদির হোটেল।সেখানেই খেতাম।
এবার আমাদের হোটেল হাইফেন গ্রান্ট মন্দির চত্বর থেকে ১২ -১৩ কিলোমিটার দূরে।ফলে রাতে আমরা সেখানেই খেয়ে নিই। আসার আগের দিন সনাতন বলল, দুপুরে পুরোনো সেই দাদা বৌদির হোটেলেই খাবে। অগত্যা । এটা দেখলাম, ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ।হোটেলের ম্যানেজার বললেন, তারাই নাকি আদি দাদা বৌদি।বাকি সব কটা পরে হয়েছে।সে বিতর্কে না গিয়ে ভাবছিলাম, বাঙালি ঘর কুনো বলে পরিচিত অথচ বিশ্বের যে প্রান্তেই যাই না কেন বাঙালির দেখা মিলবেই। এমনকি সুদূর আন্টার্টকটিকাতেও। কাজেই হরিদ্বারেও বাঙালি থাকবে তাতে আশ্চর্য কী! তবে সালটা দিয়ে বিচার করলে অবাক হতে হয় বৈকি।১৯৩৯ সাল মানে স্বাধীনতার আগে ।ইংরেজ ভারত ছাড়ো অভিযান শুরু হয়ে গেছে ।পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে ।সেই সময় ব্রিটিশ শক্তি সর্বরকম ভাবে ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালিদের কোনঠাসা করে দিচ্ছে ।কারণ এই সংগ্রামগুলোতে অধিকাংশই পাঞ্জাবি কিংবা বাঙালি।সেই রকম উত্তাল সময়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহুদূরে এক মন্দির অধ্যুষিত গঙ্গার তীরে হোটেল তৈরি করছে বাঙালি দম্পতি, এটা কিন্তু সোজা কথা নয়।
দেরাদুন চালের ভাত, গাওয়া ঘি, আলুভাজা, উচ্ছে ভাজা, আলু পোস্ত, পোস্তের বড়া, এচোঁড়, ফুলকপির ডালনা, চাটনি , পাপড় খেতে খেতে এসবই ভাবছিলাম।হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা এই দাদা বৌদি কোনো বাঙালি বিপ্লবী ছিলেন নাতো! ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দেবার জন্য এখানে আস্তানা গড়েছিলেন হয়তো, জীবিকার প্রয়োজনে শুরু করেছিলেন এই হোটেল।তখন আর কজন তীর্থ যাত্রী আসতেন এখানে? তাই ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল না।তাছাড়া তীর্থ ক্ষেত্রে গোলাগুলি চলার সম্ভাবনা কম ছিল ।এখনকার মতো ভিড় না থাকায় আর নিজেদের নিরাপত্তার কারণেই এই স্থান বেছে নেওয়া। সুদূর আন্দামানে জারোয়াদের মধ্যে এভাবেই তো লুকিয়ে থাকা বাঙালির খোঁজ পাওয়া গেছিল।
অবশ্য এ সবই আমার অনুমান।কাকে জিজ্ঞেস করব এর কারণ, ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষ করলাম।
সনাতন হোটেলে ফিরে গেল।আমি আর ভোরাই আরতি দেখার জন্য রয়ে গেলাম।
হর কি পেয়ারি ঘাটের থেকে একটু এগিয়ে বাঁদিকে গলির মুখে রাবড়ি পাওয়া যায় । বিগত বছরগুলোতেও এই দোকানেই খেয়েছিলাম ।আজও খেলাম।দেখলাম একই স্বাদ।
চারদিকে থরে থরে সাজানো শীত বস্ত্রের দোকান ।এর আগে দুবার এসেই প্রচুর সোয়েটার, শাল, উপহার কিনেছিলাম সকলকে দেওয়ার জন্য।কিন্তু কেন জানি না এবার ইচ্ছে করল না কিছু কিনতে।একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি , আজকাল কিছু কিনতেই ইচ্ছে করে না।কেমন যেন মনে হয়, এই তো চলে যাচ্ছে দিন।কী হবে আরও কিনে! শাশুড়ি মা বারবার বলে দিয়েছেন ননদের জন্য কিছু নিয়ে যেতে।কিন্তু কী নিয়ে যাব! এই যে এত জিনিসের পসরা, সেগুলো হয়তো নিয়ে গেলাম, কিছু উপহার দিলাম, বাকিটা আলমারিতে বন্দী রইল। সময়ের স্রোতে ভুলেই গেলাম তাদের কথা ।(সত্যি আমি ভীষণ ভুলে যাই জিনিস পত্রের কথা।)দীর্ঘ দিন পর যখন সেগুলো আবার খুঁজে পেলাম তখন আর সেগুলো ভালো লাগে না।এভাবেই তো কত জিনিস পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ।রুচি ক্রমাগত বদলে চলেছে ।বয়স বাড়ছে আমার।মাঝে মাঝেই আজকাল ভাবি, এ সব তো পড়েই থাকবে , আমি চলে গেলে কেই বা এসব নেবে! একটাই তো কন্যা।সে তার মতো করে গুছিয়ে নেবে।তাহলে অকারণে কেন এ বোঝা বইব?
আসলে আমার মধ্যে কেনাকাটির উৎসাহ মরে গেছে ।অথচ এই আমিই একসময় হাতিবাগান ঘুরে ঘুরে কত কিছু কিনতাম।তার মধ্যে খুশি লুকিয়ে ছিল।এখন সেই খুশিটা পাই না।বরং সেই সময় বই পড়তে কিংবা চুপচাপ বসে আকাশ দেখতে ভালো লাগে । এখানে গঙ্গার পাড়ে একসঙ্গে এতগুলো প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি, গঙ্গার স্তব, হাজার হাজার মানুষের মিলিত সুর. . সব মিলিয়ে যে মাদকতা তা তো কিনতে পারব না।বরং এই যে প্রাপ্তি তাই তো সুখ, শান্তির সঙ্গে এই সুখের অবস্থান ।
আমরা চললাম ঘাটের দিকে।একটু পরেই শুরু হবে আরতি।লাল সূর্যের বিদায়ী আলো নদীর জলে. . সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ঘুচিয়ে দাও. .

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>