| 13 মার্চ 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: পাতার ছবি । দেবদ্যুতি রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

এক

রুমি আপা মাঝেমাঝেই তার ঘরের যন্ত্রটায় জোর সাউন্ড দিয়ে ভারি সুন্দর একটা গান শোনে- আমি একটা পাতার ছবি আঁকি, পাতাটা গাছ হয়ে যায়, মাথাভরা সবুজ কচি পাতা, গাছটাকে ছাতা মনে হয়… এই গান বাজলেই পাতার মনে হয় গানটা কেবল ওর জন্যই, এই বাসার এক কোণে নিতান্তই হতশ্রী এক পাতা নামের মেয়ের জন্যই কেউ খুব দরদ দিয়ে গান গাইছে। এই গানটা শুনলে ওর মনে হয় পৃথিবীর কারো না কারো কাছে সে অনেক দামি, যে বসে বসে ওর ছবি আঁকতে থাকে সারাবেলা। গানটা যে পাতার খুব পছন্দ, সেটা জানে রুমি আপা, মন মেজাজ ভালো থাকলে তাই সে মাঝেমাঝে ডাকও দেয়- এই পাতা, এদিকে আয়, তোর গান শুনে যা।

 

তাই বটে, এ জগতে এই একটা গান পাতারই, কেবল ওর জন্যই। এই গানটা চারপাশটা মা মা গন্ধে ভরে ওঠে, সেই গন্ধ গায়ে মেখে পাতা ভুলে যায় ওর সমস্ত কষ্টবোধ। আপা গানটা শুনতে ডাকলেই পাতা তাই হাতের কাজ ফেলে রেখে পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগায় আপার ঘরে, মেঝেতে থাবড়া মেরে বসে মন দিয়ে গান শুনতে শুনতে নিজেও গুনগুন করে। কোনো কোনো দিন রুমি আপা ওর জন্য গানটা দুই তিনবারও চালায়। নিজেকে তখন ওর কী যে সুখী মনে হয়!

 

এ বাড়িতে ‍রুমি আপা ছাড়া আর কাউকে তার পছন্দ হয় না। আন্টি তো কারণে অকারণে চড়থাপড় মারধর ছাড়া ওর সাথে কথাও বলতে চায় না। আর রুমি আপার আব্বাকে সে আংকেলও ডাকে না, সেই লোকের মতোন খারাপ মানুষ পাতা এই নয় বছরের জীবনে আর দেখেনি। বদমাইশ লোকটা দুই দু’বার ওর গায়ের উপর উঠতে গেছিল, অতোবড়ো মানুষটার গায়ের নিচে পড়ে পাতা কী ব্যথাটাই না পেয়েছিল দুবারই! সেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছিল সে। আন্টি অবশ্য প্রতিবার ওকেই বকেছে, বলেছে- তুই এত ছোটো মানুষ, এমন করে বড়োদের নামে মিথ্যা কথা বলিস কেন, বেয়াদপ! কেবল রুমি আপা দাঁতে দাঁত চেপে বাপের উপর বলেছিল- ছিঃ! এমন ঘটনা যেন আর এ বাড়িতে কোনোদিন না ঘটে!

 

শেষ যেদিন এমন হয়েছিল, রুমি আপা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল খুব। তারপর অনেক মাস হয়ে গেছে, এমন কিছুই আর হয়নি ওর সঙ্গে। আন্টির কথায় কথায় চড়থাপ্পড় আর বকাবকি নিয়ে পাতা তাই তেমন ভাবে না। আর ভেবেই বা করবে কী সে, যাবে কই! প্রত্যেক দুই মাসে আব্বা একবার করে টাকা নিতে আসে, এসে ঘণ্টাখানেক কি দুই ঘণ্টা থাকে, দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি! পাতা কতদিন বাড়ি যায় না? সেই হিসেব সে করতে পারে না। আগে আব্বা এলেই পাতা তার পায়ের কাছে গিয়ে কাঁদত বাড়ি যাবার জন্য। আব্বা ওর বেতনের টাকা থেকে দুশো টাকা বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেত। কাঁদতে কাঁদতে পাতার চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে যেত সেসময়, আন্টি তাই দেখে বিরক্ত হয়ে বলত- কেঁদেই মর শুধুশুধু, দেখিস না তোর বাপ তোকে বাড়ি নিয়ে যায় না? যা, ঘ্যানঘ্যান না করে কাজগুলো সেরে ফ্যাল…

 

তারপর থেকে আব্বা এলে পাতা আর বাড়ি যাবার কথা তোলে না। আব্বা এলে যতক্ষণ থাকে, পাতা চুপ করে এই ঘরে বসে থাকে, আব্বা কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা করে উত্তর দেয়, আম্মা আর ফুলের কথাও  শুনতে ইচ্ছে করে না আব্বার থেকে।  আসলে আব্বার সঙ্গে কথাই বলতে ইচ্ছে করে না ওর- বাড়ি থেকে ক’দিন পর পর আন্টির ফোনে কল এলেও সে শুধু আম্মা আর ফুলের সঙ্গে কথা বলে শেষ করে। অবশ্য ফুল আর আম্মার সঙ্গেও সে খুব একটা কথা বলে না আজকাল। তার যে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে, খুব একলা লাগলে ওদের পাড়ার শেষে দোলার পুকুরের ঢিবির উপর আগের মতো হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকতে ইচ্ছে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ফুল, ইসমাইল, নাহার, টুম্পাদের সঙ্গে আবার পাড়া দাঁপিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে, এ বাড়িতে আর কোনোদিন ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না – এসব কথা সে কাউকেই বলে না। তার মনে হয় তার সুবর্ণখালি নামের গ্রামটার মতোই সে পেছনে ফেলে এসেছে তার সকল আপনজন। রুমি আপা অবশ্য বলে ওকে, এত ছোটো একটা মানুষ তুই, এসব উল্টাপাল্টা কথা ভাবিস কেন, বল তো!

 

পাতা জানে না সে কেন এত উল্টাপাল্টা কথা ভাবে। ও আসলেই তো এই একটুখানি একটা মানুষ। গ্রামে থাকলে এই বয়সে সে ফুলের সঙ্গে খেলত, আম্মার গায়ে পিঠে গড়াগড়ি খেত, সকালে বাড়িতে পান্তা কি মুড়ি খেয়ে একটা কাচা জামা পরে ওদের পাড়ার শেষ মাথায় প্রাইমারি স্কুলটায় পড়তে যেত! ওই স্কুলটার মাঠে অনেকগুলো ঝুরি নামা একটা মোটা বটগাছ আছে, আব্বা বলত, ওই বটগাছে নাকি সন্ধ্যাবেলা ভূত আসত আগে। সেই ভূতের নামে পাতার গা ছমছম করত ভয়ে, দিনের বেলাতেও ওর মনে হতো সাদা সাদা কাপড় পরে অনেকগুলো মাথাকাটা ভূত পা ঝুলিয়ে বসে থাকে ওই গাছের উঁচু উঁচু ডাল থেকে। আজকাল পাতার মনে হয় আম্মা, ফুল, টুম্পা, প্রাইমারি স্কুলটা, হাজার ঝুরি নামা বটের গাছ- কারো সঙ্গে এ জীবনে আর কোনোদিন দেখা হবে না ওর! মাঝেমধ্যে এইসব ভাবনা থেকে পালিয়ে যেতে চায় সে, রুমি আপা তো সত্যিই বলে, কতোটুকুই বা বয়স ওর, এমন উল্টাপাল্টা কথা ও কেন ভাবে!

 

কিন্তু ভাবতে না চাইলেও ভাবনারা ওর পিছু ছাড়ে না। এই যে আলিশান বাড়িটায় ও ছাড়া আর মাত্র তিনটা মানুষ, তারা কেমন যেন আজব কিসিমের, ওর মনে হয়। নিজের বাপ, মা, মেয়ে কেউ কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলে না। রুমি আপা বাসায় থাকলে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পড়ে থাকে আর গান শোনার যন্ত্রটায় জোরে জোরে গান শোনে। মাঝেমধ্যে ল্যাপটপে মনে হয় সিনেমা টিনেমা দেখে। আন্টি তার অফিসের সময় বাদে নিজের ঘরের টিভিতে সিরিয়াল দেখে। আর রুমি আপার আব্বা সেও অফিস থেকে ফিরেই ঢুকে যায় নিজের ঘরে। এতবড়ো বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে কোনো গল্প নেই, কথা নেই, আদর মহব্বত নেই। তারা কেবল খাবার টেবিলে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে। এসব দেখেশুনে পাতার মনে হয় তাদের গ্রামে এমন একটা বাড়িও নেই যেখানে একেকজনের ঘরের ভেতর তার পুরো দুনিয়া ঢুকে গেছে। উফ! কত কী আজব চিন্তা যে মাথায় আসে ওর! পাতার মনে হয় ও যদি বটগাছের মাথাকাটা ভূতগুলোর মতো হতো, বেশ হতো, এতসব হাবিজাবি চিন্তা আসত না তাহলে।

 

পাতা শোয় এবাড়ির উত্তরমাথার শেষ ঘরটায়, এমনিতে ওটা গেস্টরুম। কিন্তু তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন তো আর আসে না, রুমি আপা তাই ওকে ওই ঘরটাতেই শুতে বলেছে। আর বলে দিয়েছে শোবার সময় যেন ঠিকমতো দরজা লাগিয়ে দেয়। শেষবার রুমি আপার আব্বা তার গায়ের ওপর ওঠার রাতেই আপা এই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বলেই আন্টি বা লোকটা কোনো কথা বলার সুযোগ পায়নি, নাহলে সে আগে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে শুত, ওই ঘরে আলাদা দরজা নেই। এই ঘরের বিছানায় শুতে পাতার খুব ভালো লাগে, কেমন নরোম, সুন্দর আর পরিষ্কার বিছানা। গ্রামে থাকতে এমন বিছানায় শোবার কথা ও কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। এ বাড়িতে দিনের বেলা কাজ করতে আসে যে সালেহা বুবু, পাতা জানে সেও কোনোদিন এমন নরোম বিছানায় শুতে পারেনি। তবু সারাদিনের কাজের ক্লান্তি শেষে রাতে বিছানায় গা মেলে দিলেই আজকাল পাতার কান্না পায়। ওদের বাড়ির কটকটে চৌকির বিছানায় ওরা তিনজন ঘুমাত- ও, আম্মা আর ফুল, আব্বা ঘুমাত ঘরের ছোট্ট বারান্দাটায়। চৌকির আঁটসাট জায়গায় আম্মাকে জড়িয়ে ধরলে আম্মার শরীর থেকে রান্নার মশলামাখানো ঘামের গন্ধ আসত। সেই কটু গন্ধটাই কী আপন ছিল পাতার! এ বাড়ির এত সুন্দর বিছানায় আম্মার শরীরের গন্ধ নেই। ঘুমের মধ্যে ওর চুলে ফুলের হাতের স্পর্শ নেই- এই হাহাকারে পাতার নয় বছরের ছোট্ট শরীরটা ফুলে ফুলে ওঠে কান্নায়। আব্বা না হয় বোঝে না, আম্মাও কি বোঝে না যে এত বড়ো বাড়িতে এত আরামের জীবন সে কোনোদিন চায়নি? সে চেয়েছে তেলহীন শাকের ঝোল দিয়ে মোটা চালের ভাত, বটের ঝুরির ওপর পা ছড়িয়ে বসা স্কন্ধকাটাদের ভয় আর আম্মার শরীরের ভুরভুরে গন্ধ! এইসব অকিঞ্চিৎকর জিনিসের অভাবে আম্মার ওপর প্রবল অভিমানে পাতার কান্নার বেগ প্রবলতর হয় রোজ রাতে।

 

যতই আজকাল আব্বা এলে অভিমানে কথা না বলুক, পাতার সারাটা অন্তরাত্মা আকুল হয়ে অপেক্ষা করে আব্বা একদিন বলুক ওকে, চল পাতা মা, তোক মুই বাড়ি নিগিবার আসছু… পাতা জানে আব্বা এই একটা কথা বললেই সেদিন পৃথিবীটাতে ঝলমলে রোদ উঠবে ওর জন্য, ও বহুকাল বাদে বাড়ি যাবে বলে ওদের বড়ো রাস্তাটার দুইধারের কানশিষার ফুলগুলো সব শাদা হয়ে ফুটে উঠবে। অথচ ওর আব্বা আজগর আলী একবারের জন্যও পাতাকে বাড়ি যেতে বলে না। আগের মতোই এসে ঘণ্টাদুয়েক থেকে দুপুরের খাবারটা খায়, তারপর একটা দুশো টাকার নোট বের করে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। পাতার অবাক লাগে, সে যে আজকাল আব্বার সঙ্গে কথা বলে না, আব্বা কি তা খেয়ালও করে না?

 

টাকা, শুধু টাকা। এই এতটুকু বয়সেই পাতা বুঝে গেছে সংসারে পাতার যতটুকু খাতির তা শুধু এই টাকা কয়টার জন্য। এই যে ক’দিন পর পর আম্মা, ফুল কী সুন্দর সুন্দর কথা বলে ওর সঙ্গে, কই ওরাও তো ওকে একটাবারও বাড়ি যেতে বলে না! আম্মা তো একদিনও, একবারের জন্যও ওকে বলে না- তোকে কতদিন দ্যাকো নাই, পাতা, একবার বাড়ি আসলু হায়…

 

না, পাতার জন্য কেউ কোথাও অপেক্ষা করে থাকে না। আব্বা না, আম্মা না, ফুল না। সবাই তাকে ঢাকা শহরের এই বিশাল বাসাটার ভেতরে জীবনটা কাটিয়ে দেবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। ওকে তাদের দরকার শুধু মাস শেষ হলে বেতনটার জন্য। ফুলও কী ভীষণ স্বার্থপর, তাই না? অথচ ফুলকে কতই না ভালোবাসে সে! বাড়িতে নিজের খাবারটা থেকে ভালো জিনিসটা বাঁচিয়ে সে ফুলকে দিত, নারকেলপাতার ঘড়ি বানিয়ে দিত, যে একটা বছর স্কুল যেতে পেরেছিল সে, হঠাত মঠাত আম্মা টাকা দিলে স্কুল থেকে ফেরার পথে আচারটা, ঝালমুড়িটা আনত ফুলের জন্য! সেই ফুলও তো তাকে ডাকে না একবারও বাড়ি যেতে!

 

রোজ রাতে পাতার মনে হয় আর কাঁদবে না সে বাড়ির জন্য। কেন কাঁদবে, কাদের জন্য কাঁদবে? হতচ্ছাড়া কান্না তবু পিছু ছাড়ে না। তাই সে রোজ কাঁদে বিছানায় শুয়ে। নাহারটা কী দুষ্ট ছিল, বিপ্লবদের আম বাগানে সেবার কী বড়ো একটা মৌমাছির চাক হয়েছিল, ভয়ে ওরা কতদিন ওদিকটায় যায়নি, ইকবালদের বাড়ির দুধসাদা বাছুরটাকে ওরা সবাই কী ভালোই না বাসত, এইসব ছোটোখাটো কথা মনে করে পাতা কাঁদে। দুয়েকদিন ওর ফোলা চোখ দেখে রুমি আপা জিজ্ঞেস করেছে ওর শরীর খারাপটারাপ নাকি, পাতা ঘাড় নেড়ে জানিয়েছে যে কিছুই হয়নি তেমন। ঠিকই আছে সে।

 

দুই

আজ ভারি আনন্দের দিন। চারপাশটাকে এত সুন্দর, এত রঙিন লাগছে আজ! পাতার মনে হচ্ছে যেন বহুকাল পরে এমন আলো ঝলমলে দিন দেখল আজ। আসলেও তো বাসার ভেতর থেকে তেমন একটা বের হয় না সে কোথাও, বের হয় না মানে বের হতে পারে না। আন্টি তার বাইরে বের হওয়া একেবারেই পছন্দ না করলেও রুমি আপা আশেপাশে হাঁটতে বের হলে বা মন ভালো থাকলে পাশের দোকানে আইসক্রিম, ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যায়। সেইসব দিন খুব ভালো লাগে ওর। তবু আজকের দিনটি যেন আর সব দিনের থেকে বেশি উজ্জ্বল, বেশি সুন্দর। পাতার সবকিছু কেমন অন্যরকম সুন্দর লাগছে আজ।

 

পাতার মনে হয় সে যেন অনন্তকাল ধরে পথ চলছে। আম্মার কাছে, ফুলের কাছে, সুবর্ণখালি গ্র্রামের কাছে যেতে আর কত দেরি লাগবে ওর? এখনো কত পথ বাকি সে জানে না। ট্রেনে তুলে দেবার সময় রুমি আপু ওর হাতে ঠিকানা লেখা কাগজটা গুঁজে দিয়েছিল। পাতা অবশ্য ঠিকানা জানে- ওদের বাড়িটা  গ্রামের ঠিক মাঝখানে, ওদের পাড়ার শেষ মাথায়  যে ‘সুবর্ণখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ আছে, তার থেকে একটুখানি উত্তরদিকে এগিয়ে গ্রামের বড়ো পুকুরটা পার করেই। উফ, এই ট্রেনটা কখন পৌঁছাবে সেখানে!

 

ট্রেনটা অবশ্য ঠিক সুবর্ণখালি পর্যন্ত যাবে না। ঠিকানা লেখা কাগজটা থেকে বানান করে পড়েছিল সে, তাকে গিয়ে নামতে হবে রায়গঞ্জ স্টেশনে, সেখান থেকে ভ্যানে করে ওদের গ্রামে যাওয়া যায়। ‍রুমি আপা ওকে দু’টো একশো টাকার নোট আর কিছু কিছু খুচরো টাকাপয়সাও দিয়েছে, ট্রেনের টিকেট কেটে দিয়েছে। তারপর ট্রেনের সিটে বসিয়ে দিয়ে নেমে যাবার সময় হাতের পিঠে চোখও মুছেছে, পাতা দেখে ফেলেছিল। যাবার সময় রুমি আপা বলেছিল- খবরদার আর যেন এদিকে আসিস না জীবনেও। দেখেছিস না মানুষ কতো খারাপ! যা, এবার মায়ের কাছে গিয়ে না খেয়ে থাকিস, সেটাই বরং ভালো।

 

রুমি শুধু ঘাড় নেড়ে বলেছিল- আপনেও খুব ভালো থাইকেন, আপা।

 

সেই কত দিন থেকে বাড়ির বাইরে বাইরে সে। এতদিনের মধ্যে সে রুমি আপা ছাড়া আর কোনো ভালো মানুষ খুঁজেও পায়নি। আজও সকালে যদি রুমি আপা বারান্দায় এসে না পড়ত, ও এতোক্ষণে হয়তো মরে পড়ে থাকত বাসাটার নিচের ড্রেনের ওপর। ভাবতেই ওর গা শিউরে ওঠে আবার। আন্টি আজ ওকে মেরেই ফেলত, ও জানে; রুমি আপা পেছন থেকে টেনে না ধরলে আন্টির ওই ধাক্কাটা থেকে সে কোনোমতেই বেঁচে ফিরতে পারত না। আন্টি ওকে কেন ধাক্কা মারতে গিয়েছিল পাতা জানে না। ও তো কোনো ভুলভাল কাজ করেনি আজ বা কাল, কোনো বাসনপত্রও ভাঙেনি, কিছু পুড়িয়ে ফেলেনি। এমনকি রুমি আপার আব্বাও তো ওর ঘরে ঢোকেনি। তাহলে? পাতা জানে না আন্টির এমন ক্ষেপে যাবার আসল কারণটা, শুধু প্রায় পড়ে যাবার মুহূর্তে আন্টির দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ‘তোকে আজ মেরেই ফেলব’ কথাটা শুনতে পেয়েছিল সে। সেই একদম পড়ে যাবার মুহূর্তে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল রুমি আপা, আপা কি মানুষ না ফেরেশতা, সে জানে না কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারে তার জন্যই সে আজ বাড়ি ফিরতে পারছে।

 

ট্রেনের কামরাটা লোকে লোকারণ্য। ওদের তিনজনের সিটে এখন পাঁচজন বসার ফলে পাতার শরীর ট্রেনের জানালার সঙ্গে লেগে যাবার দশা। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতেও পাতা টের পায় এবার তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। আপা দু’টো রুটি আর ডিমভাজা কিনে দিয়েছিল, সেগুলো সেই কখন খেয়ে ফেলেছে। এখন সঙ্গে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা ছাড়া আর কোনো খাবার নেই। সেই বোতলটা থেকে ঢকঢক করে পানিটুকু শেষ করে বোতলটা পায়ের কাছে রাখতে রাখতে পাতা টের পায় ওর জেগে থাকার মতো শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে।

 

পাতার শ্রান্তির অন্য প্রান্তে হাসিমুখ ফুল আনন্দে ঝলমল করছে। বড়ো পুকুরপাড়ের বটগাছটার নিচে দাঁড়ানো ফুলের হাতে একটা ঘুড়ির নাটাই, সেই নাটাইয়ের সুতোর রেখা ধরে আকাশে তাকিয়ে পাতা দেখতে পায় একটা বিশাল বড়ো লাল রঙের ঘুড়িটা বাতাস কেটে কেটে একলা আকাশে উড়ছে। ফুলের মুখের হাসি সে ঠিক কতদিন পর দেখল? সময়ের হিসেব সে আসলে জানে না কারণ ঠিক কবে সুবর্ণখালি ছেড়ে গেছে, সে হিসেব তার ছোট্ট মাথায় কখনো ধরেনি। ওকে দেখে ফুল নাটাই ফেলে দৌড়ে আসে, ইশ এত্তো সুন্দর ঘুড়িটা কয়েকটা পাক দিয়ে কই চলে গেল! পাতার মন একটু খারাপ হয় ঘুড়িটার জন্য, তবু সেটা ভুলে যায় সে। ফুলের হাসির কাছে লাল টুকটুকে ঘুড়িটা আসলে ভীষণ তুচ্ছ। দুজনে হাত ধরে নাচতে নাচতে ওরা বাড়ির দিকে যায়। ফুল ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলে- জানিস বু, আম্মা আইজ ত্যালের পিটা বানাইচে।

 

পাতার যেন আর তর সয় না। ওর প্রিয় তেলের পিঠা খাবার জন্য ফুলের হাত ধরে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হঠাতই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। ‘ফুল, হাতটা ধর, খুব বিষ’- বলতে বলতে ফুলের জন্য চোখ মেলে পাতা নিজেকে আবিষ্কার করে জনমানবহীন ট্রেনের কামরাটার জানালার পাশের সিটে। ট্রেনটা থেমে আছে, এটা কোনো একটা স্টেশন, জায়গাটা প্রায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। চোখ কচলে সে বাইরেটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। বাইরে আবছা অন্ধকার, সন্ধ্যে হয়ে গেছে মনে হয়। কিন্তু রুমি আপা বলেছিল, রায়গঞ্জ সে বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে যাবে। আম্মাকেও কল করে বলে দেবে ওর যাবার কথা। পাতার হঠাতই ভয় লাগতে থাকে। সে কি রায়গঞ্জ পেরিয়ে এসেছে এতোক্ষণে? কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে আসলে? ভয়ের চোটে বুক উথালপাথাল করে পাতার কান্না পায়। সে কেন আরো আগে টের পেল না? কেন ওর আশেপাশের মানুষগুলো একবারও ওকে ঘুম থেকে ডেকে দিলো না?

 

পায়ের কাছ থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পাতা ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। এত বড়ো একটা জায়গায় কোনো জনমানুষ চোখে পড়ে না, বাইরের আবছায়ায় পাতা কিছুদূর হেঁটেও কাউকে দেখতে পায় না। এমন ভয়ঙ্কর জনমানবহীন কোনো জায়গা কোনোদিন দেখেনি সে। চারপাশটাকে মনে হতে থাকে ঝুরিবটের ডালে পা ঝোলানো স্কন্ধকাটাদের প্রাসাদ। পাতার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, ওর মনে হয় সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে একবার। ওর চিৎকার নিশ্চয়ই আম্মার কানে পৌঁছাবে, আম্মা যে ছোটোবেলায় ওকে বলত বাচ্চারা কষ্ট পেলে, ভয় পেলে মায়েরা সব বুঝতে পারে!

 

কিন্তু আম্মা কই এখানে? দুর্বল, শ্রান্ত, ভীত পাতার ডাকতে চাওয়া আম্মা ডাক ওর ঠোঁটের ফাক গলে বাইরে আসে না। এই একাকী অন্ধকার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর পাতা আর এগোতে পারে না। প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় ছোট্ট ঘরটার সামনে গিয়ে সে বসে পড়ে। হাতের ব্যাগটা মাথায় সেখানেই দিয়ে শুয়ে পড়ে, ওর খুব ঘুম পায় ছোট্টবেলার মতো। অনেকদিন বাদে যেন আম্মার আদরকোলে ফুলের হাত ধরে পাতা আদরঘুম ঘুমায়।

 

সেই রাতে, প্রায় প্রাণহীন এক নয় বছরের বালিকার শীর্ণ দেহের ওপর ঢেউ খেলে যায় কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমীর চাঁদের আলো আর ঝকঝকে আলোর নিচে অপার্থিব সেই অচেনা শরীরটাকে ঘিরে বসে থাকে কয়েকটি শেয়াল, নিঃশব্দে।

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত