| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের ছাপচিত্র | নম্রতা মনস্বী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

শত শত বছরের পুরোনো শহরকে ঘিরে কত-শত ইতিহাস জড়িয়ে আছে। একেকটা রাস্তা, ঘরবাড়ির দেয়ালে লেগে আছে প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের গল্প। প্রতিটি রাস্তার পরিচয় হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে, তার পিছনেও রয়েছে আস্ত একটা শাসনামল, স্থাপত্য এবং তার সংস্কৃতি। এই শহরের নাম “ঢাকা”। ঐতিহাসিক এই ঢাকাকে বলা হচ্ছে পুরোনো ঢাকা। আসলেই কি তা পুরোনো হয়ে গেছে! কতো বছরের পুরোনো যা আজও  ধরে রেখেছে আভিজাত্য! চলুন সে সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সদরঘাট
সদরঘাট আসলে কবে নির্মিত হয়, তার সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, এর বয়স হাজারের কম নয়। সদ্য জন্ম নেয়া ঢাকা শহরে, যখন ট্রেন কিংবা সড়ক যোগাযোগ উদ্ভব নয়, সদরঘাটই ছিল যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে সদরঘাটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিলো ব্যবসায়িক কেন্দ্র, ঢাকা।
ওয়াইজঘাট
১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল বলে জানা যায়। নীলকরদের মধ্যে ঢাকায় জনাব ওয়াইজ ছিলেন প্রধান। বুড়িগঙ্গার তীরেই একটি বাসা বানিয়ে তিনি থাকতেন। তার বাড়ির পাশে একটি বড় নৌকা এ বজরা বাঁধা থাকত বলে ধীরে ধীরে লোকমুখে সেই ঘাটের নাম ‘ওয়াইজঘাট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে তিনি তার জমিদারি সব বিক্রি করে ইংল্যান্ডে চলে যান। কিন্তু এখনো সেই ঘাটের নাম তার নামেই ডাকা হয়।
ধোলাই খাল
ঢাকার প্রথম মোঘল সুবাদার ইসলাম খান ১৬০৮ সালে শহরকে সুরক্ষার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগের সুবিধার জন্য  এই খাল খনন করেন। বালু নদীর তীর ধরে বয়ে যেয়ে এটি ফরিদাবাদের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে মেশে। তার আমলে এই খালটি প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছে। ধোলাই খালের উপরে নির্মিত হয়েছিলো  লোহার সাস্পেনশন ব্রিজ, যা লোহারপুল নামে পরিচিত ছিল। 
ওয়ারী
১৮৮৪ সালে, ঢাকা নগরীর ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ওয়্যার নামের এক ব্যক্তি। তার নামানুসারেই তখনকার ঢাকার উপকণ্ঠ এলাকাটি পরিচিত হয়েছিলো ওয়ারী নামে। ঢাকাইয়্যাদের (পুরান ঢাকার স্থায়ী নাগরিক) কাছে ওয়ারীই পুরান ঢাকার রাজধানী। সেসময় ওয়ারী খুবই পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল। তাই এর রাস্তাগুলো সুন্দর, পরিষ্কার এবং প্রশস্ত। এখানে সেই সময়ে এবং বর্তমানেও, একটু উঁচু শ্রেণির লোকেরা বাস করে।
শাঁখারিবাজার
পুরান ঢাকায় বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকার নাম শাঁখারিবাজার। এই এলাকায় বসবাসকারী শাঁখারিদের নামানুসারেই এলাকাটির নাম বলা হয় শাঁখারিবাজার। শাঁখা, সিঁদুর থেকে শুরু করে পূজার যে কোনো সামগ্রী পাওয়া যায় এ বাজারে। ঢাকার এই শাঁখারিদের তৈরী শাঁখার জন্য বিখ্যাত, যা এখনও বহন করে চলেছে সেই ঐতিহ্য। ঢাকার প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো এই এলাকায় সেসময় ৮৩৫ জন শাঁখারি রা থাকতেন, যা এখন ২০ হাজারের মতোন। কিন্তু ৭১ এর যুদ্ধে তা গুড়িয়ে দেয়া হলেও, পরবর্তীতে আবার তারা বাসস্থান নির্মান করেন। তারা মূলত দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিলেন। শাঁখা হচ্ছে শঙ্খ থেকে কেটে বানানো হয় যা হিন্দু রমণীরা মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে পরিধান করেন।
তাঁতিবাজার
জামদানী শাড়ি বুনতেন এমন একদল তাঁতি বহু আগে থেকেই এখানে বাস করতেন। এখন অনেকেই কলকাতায় চলে গিয়েছেন যদিও, কিন্তু নামটি রয়ে গেছে। গায়ে গায়ে লাগোয়া বহু পুরনো বিল্ডিং। দোতলা তিনতলা বিল্ডিং, সিঁড়িগুলো প্রায় অন্ধকার, সরু। প্রতিটি বাড়ির সামনেই তুলসীতলা, রাস্তার উপরেই। 
আর্মানিটোলা
সতেরো শতকের দিকে আর্মেনীয়রা ঢাকায় আসে। ঢাকায় অবস্থান করে তারা খুব দ্রুত স্থানীয়দের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে মিশে যায়। তারা মূলত পাট, বস্ত্র, লবণ এবং সুপারির ব্যবসা শুরু করে ঢাকায়। এই আর্মেনীয়রা ঢাকার যে স্থানটিতে শ্রেণিবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে, সেই স্থানটি আর্মানিটোলা নামকরণ হয়। পুরান ঢাকায় সেই সময় আর্মেনীয়রাই প্রথম খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
গেন্ডারিয়া
ঢাকার জৌলুশ পৃথিবীর সবাইকেই আকর্ষিত করত। একবার এক ইংরেজ পর্যটক ঘোড়ায় চড়ে ঢাকায় এলেন। তিনি ঢাকায় এসে, বর্তমানের গেন্ডারিয়া এলাকায় গিয়ে বলে ওঠেন, ‘হোয়াট অ্যা গ্রান্ড এরিয়া!’। সে থেকে এলাকাবাসী এই আবাসিক এলাকার নাম দেন ‘গেন্ডারিয়া’।
চাংখারপুল
প্রাচীন ঢাকার ভেতরেও নানা পুকুর, খাল, বিল ইত্যাদি ভরপুর ছিলো। বর্ষার মৌসুমে ঢাকার চারপাশ যখন পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যেত, ঢাকার সৌন্দর্যও দ্বিগুণ হারে বেড়ে যেত। এই জল নগরী ঢাকাকে তখন পশ্চিমের ভেনিস নগরী বলা হতো। এ সকল ছোট খাল বিল অথবা ‘পুল’ পার হওয়ার জন্য সুদৃশ্য সেতু-সাঁকো নির্মাণ করেছিলেন শাসকেরা। এটাকেই ‘চান-খার-পুল’ বলা হত। সেই পুল এখন আর নেই, কিন্তু ইট-বালুর সড়ককেই এখনো চাংখারপুল বলে অভিহিত করা হয়।
নারিন্দা
নারিন্দায় ১৮৭৫ সালে পর্তুগীজদের নির্মিত খ্রিস্টান সমাধিস্থল। পুরান ঢাকার অন্যতম প্রাচীন জনপদ নারিন্দা। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আগমনকারী পর্তুগিজ পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী  বর্ণনায় নারিন্দা এলাকাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানেই তারা এসে তাদের বাসস্থান, ব্যবসা-বানিজ্য এবং চার্চ নির্মান করেন।সাথে খ্রিষ্টীয় কবরস্থান নির্মান করেন।এখানেই পুর্তগীজিয় দের সমাধিস্থ করা হতো।লোকালয়ে সব দালান, চার্চ গুলো বিলীন হয়ে গেলেও এই কবরস্থানটিই রয়ে যায় বাংলায় পুর্তগীজদের আগমনের চিহ্ন হিসেবে।
লক্ষ্মীবাজার
লক্ষ্মীবাজার পুরান ঢাকার একটি জনবহুল ঐতিহ্যবাহী এলাকা। এর নামকরণ হয়েছিল ঐ এলাকায় অবস্থিত প্রাচীন লক্ষী নারায়ণ মূর্তির নামানুসারে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখানে অবস্থিত বলে এ এলাকা পুরান ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।
টিপু সুলতান রোড
সুলতান আলী সাহাব টিপু ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশুর রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি তার শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) নামে পরিচিত ছিলেন।ভারতের স্বাধীনতাকামীতার জন্য তাকে ভারতের বীরপুত্র বলা হয়।তার নামানুসারেই টিপু সুলতান রোডের নাম দেওয়া হয়।
ফুলবাড়িয়া 
১৮৮৫ সালে ঢাকার প্রথম রেলস্টেশন ফুলবাড়িয়া  রেলস্টেশন ঢাকায় সুগন্ধি ও আতর তৈরির জন্য এক এলাকায় প্রচুর ফুলের চাষ করা শুরু হয়। ফুল উৎপাদনের কারণেই অত্র এলাকার নামকরণ হয় ‘ফুলবাড়িয়া’। এরপর ঢাকার প্রথম রেলস্টেশন এখানেই নির্মাণ করা হয়। পরিবহন সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে ৫০ একরেরও বেশি জমিতে রেললাইন স্থাপন শুরু করেছিল।তখন এর নাম ছিল ঢাকা স্টেট রেলওয়ে।
গুলিস্তান 
আজকের জ্যামে ভরা গুলিস্তান যে একসময় ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ছিল? কারণ সেখানে ছিল বিনোদনের মাধ্যম, সিনেমা হল। ‘গুলিস্তান সিনেমা হল’ এর নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয় গুলিস্তান। গুলিস্তান এলাকাটির প্রকৃত নাম বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। তবে দেশবিভাগের আগে এর নাম ছিল জিন্নাহ এভিনিউ এবং ১৯৫৩ সালে নির্মিত হয় গুলিস্তান সিনেমা হল। প্রথমে হলটির নাম ছিল লিবার্টি। পরে গুলিস্তান করা হয়। এখানে দেশি-বিদেশি সব সিনেমা দেখানো হতো। গুলিস্তান শব্দের অর্থ ফুলের বাগান।
স্থাপনার বৈচিত্র্য
পুরান ঢাকার শত শত বছরের পুরনো স্থাপনাগুলো এখনো মাথা উঁচু করে জানান দিচ্ছে ঢাকাইয়া কৃষ্টি-কালচার ও ঐতিহ্যের। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, রূপলাল হাউস, আর্মেনীয় গির্জা,  হোসনি দালান, তারা মসজিদ, শায়েস্তা খাঁ জামে মসজিদ, বেগম বাজার মসজিদ, খান মুহাম্মদ মসজিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, হিঙ্গা বিবির মসজিদ ও চকবাজার শাহী মসজিদ। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সুরম্য আধার বলা হয় আহসান মঞ্জিলকে। আজকের বাংলাদেশ এককালে শাসন করেছেন জমিদার, রাজা, নবাবরা। কালের বিবর্তনে তারা হারিয়ে গেলেও শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন ও গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর ‘আহসান মঞ্জিল’ নিয়ে এখনো পর্যটকদের আগ্রহের কমতি নেই। স্মরণীয় ঘটনাবলি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্মৃতিবিজড়িত ‘গোলাপি’ এই ভবনটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলীতে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ১৮৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন নওয়াব আবদুল গনি। মুঘল কিংবা সুলতানি স্থাপত্যের নিদর্শন না হলেও দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে আরমানিটোলার তারা মসজিদ। এটি ঢাকার নান্দনিক মসজিদগুলোর একটি। মির্জা গোলাম পীর ওরফে মির্জা আহমেদ জান নামে এক ব্যবসায়ী এর নির্মাতা বলে জানা গেছে। 
স্থাপনাগুলোর অন্যতম হলো রূপলাল হাউস। রূপলাল দাস ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন এবং সেই সময় স্কলারশিপ পেয়েছিলেন ১০ টাকা। জানা যায়, রূপলাল একজন সংগীত অনুরাগীও ছিলেন। রূপলাল হাউসের এক পাশে সুন্দর বাগান ছিল যা ‘রঘুবাবুর বাগান’ এবং এক পাশে একটি পুল ছিল যার নাম ছিল শ্যামবাজার পুল। কালের বিবর্তনে অযত্ন অবহেলায় এসব নষ্ট হয়ে যায়। এরপর নদীকে ঘিরে বাজার গড়ে ওঠে যার নামকরণ করা হয় শ্যামবাজার। বাড়ির ভিতরের অংশে ইউরোপিয়ান অফিসার এবং ব্যবসায়ীরা থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে নদীর অংশটি ব্যবসা কেন্দ্র হলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলে তারাও জায়গাটি ছেড়ে যান। রূপলাল হাউস তার রূপ হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই আর এখন এর অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থানে স্থানে ভেঙে পড়েছে। মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। ছাদে কার্নিশে এবং অন্যান্য স্থানে বটগাছ গজিয়েছে। কিন্তু বসবাসকারীরা এখনো নির্বিঘ্নে বসবাস করে যাচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য দোকানপাটসহ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে মূল ভবনকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
মোগলদের আরেকটি অপূর্ব নিদর্শন হলো লালবাগ কেল্লা। মোগল আমলে স্থাপিত এই দুর্গটির প্রথমে নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়নে কাজ শুরু করে। সে সময় থেকে দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। অনেকে মনে করেন এটি পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত। আর তাই এর নামকরণ করা হয়েছে লালবাগ কেল্লা। এটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। তবে কেল্লার স্থাপনার মধ্যে পরী বিবির সমাধি বেশ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও আছে লালবাগ কেল্লা মসজিদ।
হোসনি দালান ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। মহররম মাস এলে নিদর্শনটির গুরুত্ব বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মহররম মাসের ১০ তারিখে অর্থাৎ আশুরার দিন সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। উপমহাদেশের প্রাচীনতম ইমামবাড়া ঢাকার হোসনি দালান। এটি নির্মিত হয় ১৬৪২ সালে সুবেদার শাহ সুজার শাসনামলে। শাহ সুজার নৌবহরের এক অধিনায়ক (মীর মুরাদ) এ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তার পর পরই নির্মিত হয় হোসনি দালান। এটি নির্মিত হয় মূলত কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণে এবং হযরত ইমাম হোসেনের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই। আর বর্তমান কাঠামোটি নির্মাণ করা হয় গত শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সরকারের সময়। এটি নির্মিত হয় প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর। এখানে দেখতে পাওয়া যায় সুন্দর একটি দ্বিতল ভবন। এর উত্তরে রয়েছে প্রশস্ত চত্বর, আর দক্ষিণ দিকে পুকুর। পশ্চিমে রয়েছে তাজিয়া ঘর, সামনে দেউড়ি ও দ্বিতল নহবতখানা।
অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে টিকে আছে বিউটি বোর্ডিং। বাংলাবাজারের শ্রীশদাস লেনে এই বোর্ডিং অবস্থিত। এখনকার বিউটি বোর্ডিং বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। দেশভাগের আগে সেখানে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল এ পত্রিকায়। দেশভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় চলে যায়। এরপর পঞ্চাশের দশকে দুই ভাই প্রদাহ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হন প্রদাহ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। সে সময় প্রদাহ চন্দ্রের পরিবার জীবন বাঁচাতে চলে যায় ভারতে।১৯৭২ সালে প্রদাহ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা দুই ছেলেকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের মুখর আড্ডা আগের মতো না থাকলেও খাবার ঘরে এখনো খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকে। নগরের ভোজনরসিকরা এখানে ছুটে আসেন। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের মোহিনী মোহন দাস লেনে কারুকার্যখচিত ব্রিটিশ যুগের প্রাসাদ ‘মঙ্গলাবাস’। নামটি হারিয়ে গেছে বলা চলে। শতবর্ষী জরাজীর্ণ ভবনটি এখন কেবলই পুরান ঢাকার একটি কলেজের ছাত্রাবাস।পুরোনো ইটের তলায় চাপা পড়ে আছে কতই না আনন্দ-বেদনার কাব্য।এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই ভবনটির ইতিহাস জানেন না।বাড়ির মালিক যতীন্দ্র কুমার সাহা ছিলেন জমিদার। উনিশ শতকের শেষের দিকে নির্মিত বলে ধারণা করা যায়। সামান্য কিছু সংস্কার ছাড়া প্রাসাদটির আদিরূপ এখনো বর্তমান। 
ঢাকার বড় বড় সব মন্দিরের একটি এই জগন্নাথ মন্দির। এই মন্দিরের নামেই জগন্নাথ কলেজ পরে যা ইউনিভার্সিটি হয়ে যায়। শ্যামাপূজাও এখানে হয় খুব ধুমধাম করে।এ তল্লাটের প্রতিটি গলিতে মন্দির। মন্দিরে আছেন পুরুত ঠাকুর,সারাক্ষণই চলেছে পুজোপাঠ।
ঢাকেশ্বরী মন্দির বর্তামানে বাংলাদেশের জাতীয় এবং বৃহত্তম মন্দির। রাজা বল্লাল সেনের নির্মিত দূর্গা দেবীর প্রথম মন্দির এবং ঢাকার নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয়েছে।এটি ঐতিহাসিক একটি নিদর্শন। 

ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র পুরান ঢাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় পুরান ঢাকাকে। এর মধ্যে ইসলামপুর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার। সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবি, শাড়ি-লুঙ্গি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড়ের বৃহৎ সম্ভার রয়েছে এখানে। মিলছে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাপড়ও। কাঁচা ও নিত্যপণ্যের আরেক স্থান হলো শ্যামবাজার, ফরাশগঞ্জ, রহমতগঞ্জ। কসমেটিকস, খেলনা, প্লাস্টিকসামগ্রী ও নানা ডিজাইনের ঘর সাজানোর উপকরণের পাইকারি বাজার চকবাজার ও মৌলভীবাজার। একসময়ের একক আধিপত্যে থাকা এসব বাজার এখন নানা সমস্যায় ভারাক্রান্ত। তরকারির নিত্যপণ্যের জন্য শ্যামবাজার-ফরাশগঞ্জ, বইয়ের জন্য বাংলাবাজার আর ওষুধ এবং কেমিক্যাল সামগ্রীর জন্য মিটফোর্ডে চলছে শত বছরের ব্যবসা। অন্যদিকে চকবাজারে প্রসাধনী, ইমিটেশন, খেলনা, বিয়ে ও বার্থডের আইটেম সবচেয়ে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। তাছাড়া রমজান মাসে এখানে রকমারি ইফতারের পসরা বসে। কাবাবের কথা এলেই চকবাজারের নামটিও আসবে। চকবাজারের কাবাব খুব বিখ্যাত। মৌলভীবাজার মনোহারি এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় মালামালের জন্য বিখ্যাত। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সবচেয়ে পুরনো বাজার শ্যামবাজার। পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড হাসপাতালকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৫০ বছর আগে গড়ে ওঠে ওষুধের ব্যবসা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সাকরাইন উৎসব
মাঘ মাসের প্রথম দিনটি পুরান ঢাকার আকাশ থাকে ঘুড়িওয়ালাদের দখলে। অর্থাৎ সেখানে শোভা পায় নানা রং আর বাহারি ঘুড়িদের সাম্যবাদ। অনুষ্ঠিত হয় সাকরাইন উৎসব। একে ঘুড়ি উৎসব বা পৌষ সংক্রান্তিও বলা হয়। আগে এ উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয় এ দিনটি। উৎসবে অংশ নেন সব ধর্মের সব বয়সী মানুষ।সবাই এ উৎসবে দিনব্যাপী ঘুড়ি ওড়ান। আয়োজন করেন নানা খাবারের। এ ছাড়া সন্ধ্যায় আতশবাজি ফোটানো এ উৎসবের অন্যতম অঙ্গ। তবে পঞ্জিকা অনুযায়ী কোনো কোনো এলাকায় মাঘের দ্বিতীয় দিন উৎসব উদযাপিত হয়।শুরু ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনা। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এসব এলাকায় চলেছে আতশবাজির খেলা।
ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়ি।ঘোড়ার গাড়ি রাজকীয় ঐতিহ্যের অংশ। ঘোড়ার গাড়ি অনেক জায়গায় ‘টমটম’ নামেও পরিচিত। ঘোড়ার গাড়ির যখন প্রচলন হয় তখন ভারতবর্ষে চলে ইংরেজ শাসন। সর্বপ্রথম ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার ইংরেজরা শুরু করলেও স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির মানুষও এই সুবিধা নেয়। এ দেশে ঐতিহ্য বেয়ে ১৫০ বছরেরও বেশি সময় পার করেছে রাজকীয় বাহন ঘোড়ার গাড়ি। পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোড়ার গাড়ি চলে। এখনো সদরঘাট-গুলিস্তান যাত্রী পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়িকে অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম ব্যবহৃত হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রায়, সিনেমার শুটিংয়ে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  অনেকেই পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
পুরান ঢাকার খাবার
ভোজনরসিকদের কাছে পুরান ঢাকার কদরই আলাদা। কয়েক’শ বছরেও কদর হারিয়ে যায়নি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবারগুলোর। পুরান ঢাকাবাসীর খাবার ও তাদের খাদ্যাভ্যাস ঢাকার খাদ্যবিলাসে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করে। এ এলাকার বাবুর্চিদের অনেক সৃজনশীলতা ছিল। তারা মুঘলদের খাবার রান্নার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিল। মোগল আমলের এই প্রিয় খাবারগুলো পাওয়া যায় নির্দিষ্ট কিছু স্থানে। তবে বাকরখানির বিস্তার ঘটেছে প্রায় সবখানে। বাকরখানি আর এক এক কাপ দুধের চায়ে। ভাজাপোড়ার  তৈলাক্ত খাবারের আধিক্য রয়েছে চকবাজার, চানখাঁরপুল ও নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে। একসময় পুরান ঢাকায় অতিথি আপ্যায়নে বা জামাই এলে শাহি মোরগ-পোলাওকে প্রাধান্য দিত বেশি।এখানের উল্লেখযোগ্য খাবারের মধ্যে আছে মোসাল্লাম, রেজালা, ঝাল গরুর মাংস, জালি কাবাব, নিম কালিয়া, শাহি টুকরা, পেস্তাবাদামের শরবত,পোলাও বিরানির মধ্যে বুন্দিয়া পোলাও, খাসির বিরানি, সাদা পোলাও দিয়ে ঝাল গরুর মাংস, ডিমের কোরমা, গরুর গ্লাসি, রোস্ট ইত্যাদি পছন্দ অনুযায়ী খাবার থাকত বিরিয়ানির পাশাপাশি। কাবাবের আগমন মোগলদের হাত ধরেই। কাবাব আগে থেকে সান্ধ্যকালীন, বিশেষ করে রাতের খাবার হিসেবে পছন্দের। জনপ্রিয় কাবাবের মধ্যে শিক কাবাব, বঁটি কাবাব, কাঠি কাবাব, সুতি কাবাব, রেশমি কাবাব, মুরগির কাবাব, পেষা মাংসের কাবাব, টুন্ডা কাবাব, টিক্কা কাবাব, টেংরি কাবাব, গরুর ছেঁচা মাংসের কাবাবসহ নানা ধরনের মাছের কাবাব ইত্যাদি।
মোগল আমলে এখানে আসা বিভিন্ন আমির আর শৌখিনদের অনেক মিষ্টি স্থানীয় হয়েছে,এর মধ্যে বরফি, শাহি টুকরা, জিলাপি, মোতানজান, ক্ষীর, দরবেশ, দইবড়া ইত্যাদি ছাড়াও হালুয়া ছিল জনপ্রিয়। এখানে রয়েছে নানা জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির ঠিকানা। অন্যদিকে পুরান ঢাকার অলিগলিতে পিঠাওয়ালিদের তৈরি পিঠা আদি ঢাকার মানুষের সকালের নাস্তার অংশ। আদি ঢাকার মানুষের নানা উৎসবে আর সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে আয়োজন করা হয় বাহারি আর শাহি খানার, যাতে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া অতীতের সঙ্গে পুরোপুরি মিল না থাকলেও তাতে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়।
পুরান ঢাকার আদিম সব বাড়ির দেয়ালে এখনো লেগে আছে শত বছরের হাসি-কান্না।হাজার গলির এই অন্যরকম শহরটুকু বহন করছে বাংলার ঐতিহ্যেরও একটি অংশ। পুরান ঢাকাবাসীদের আছে কথা বলারও একটা নিজস্ব ভঙ্গি। অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের প্রায় কাছাকাছি পুরান ঢকার ঐতিহ্যের নানা স্থাপনা। একটু সচেতন হলেই সংরক্ষণ করা যাবে ঢাকার এই প্রাচীন নিদর্শন গুলো যা আমাদের ইতিহাসকেই করবে আরো সমৃদ্ধ।
তথ্যসূত্র:
তথ্যসূত্র – বিভিন্ন সময়ের পত্রপত্রিকা ও ব্লগ।
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Rituparno Ghosh - Dahan
লেখক

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত