| 27 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

পাঠ প্রতিক্রিয়া: ধ্রুবপুত্রে মেঘ নেই । সুপ্রিয় নায়েক

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

প্রলম্বিত আলাপের মতো উপন্যাসটির নাম ধ্রুবপুত্র। চোখ বন্ধ করে এই আখ্যানের মূর্চ্ছনায় বুঁদ হয়ে থাকে পাঠক। শুরুর থেকেই, ভাষার সৌকর্যে চোখের পলক পড়ার চারভাগের একভাগ সময়ে পাঠক হাজির হয় অবন্তীদেশের রাজধানী উজ্জয়নীতে। এই সেই উজ্জয়নী! যে শহর মহাকবি কালিদাসের জন্মস্থান বলে কথিত রয়েছে! সেই মহাকবি যিনি লিখেছিলেন মেঘদূত! তবে ধ্রুবপুত্র উপন্যাস দাঁড়িয়ে থাকে মেঘদূতের ঠিক বিপরীত প্রান্তে। মেঘদূতে মেঘ রয়েছে, সজল বর্ষা রয়েছে! ধ্রুবপুত্রে মেঘ নেই। বরং রয়েছে সুতীব্র মেঘের যাঞা! মেঘের জন্য আকুল প্রার্থনাই যেন এই উপন্যাসকে করে তুলছে জীবন্ত! ফুটে উঠেছে প্রাচীন ভারতের বর্ষানির্ভর জীবনযাত্রার ছবি।

টানা দুই বছর ধরে তীব্র তৃষ্ণায় ডুবে রয়েছে অবন্তী দেশ। নদীগুলির জলে যেন মেঘ বিদায় নিয়েছে! রাজধানীর সাতটি সরোবর শুকিয়ে কাঠ। প্রতিটি কুয়ায় কলসি ফেললে উঠে আসছে বালি। উদ্ভিদের পাতা শুকিয়ে কাঠ। বন্ধ চাষ আবাদ। দেখা দিচ্ছে খাদ্য সঙ্কট। একফোঁটা জলের জন্য যেন ধুঁকছে সমগ্র দেশ। ‘এ কোন কালের কথা? কোন যুগের স্মৃতি? সেই মেঘ উধাও হল কত বৎসর আগে, তারপর তার আর দেখা নেই।’ কেন দেখা নেই মেঘের? রাজধানীর বাজারে, গলিতে কান পাতলে শোনা যায় অন্য আখ্যান। আকসু নদীর তীরে, বাহ্নিক দেশে যেখানে মেঘ আছে, হলুদ রেশম আছে, ফসল আছে সেই দেশই নাকি নগরের প্রধান গণিকা দেবদত্তার পিতৃকুল। দেবদত্তার মতো সুন্দরী ও নৃত্যগীত পটিয়সী সারা দেশে নেই। সেই দেবদত্তার কাছেই নাকি কাছে প্রেমপ্রার্থনা করে অপমানিত হতে হয়েছে নীল চোখের তরতাজা তরুণ ধ্রুবপুত্রকে। রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তাকে! সে বিদায় নিয়েছে, অথচ নাগরিকের মুখে মুখে ভেসে থাকে এই ধ্রুবপুত্রের গল্প, সে ছিল জ্ঞানের আধার! লোকেরা আড়ালে বলে, বণিক সুভগ দত্তই নাকি ধ্রুবপুত্রকে দেশ থেকে বিতাড়নের মূল কাণ্ডারি? অথচ এই ধ্রবপুত্রকেই নাকি দেবদত্তার কাছে বীণাবাদন, গান শিখতে পাঠিয়েছিল সুভগ দত্ত!

এই রটনার মাঝখানে পাঠক জানতে পারে, এক সন্ধ্যায় রূপবতী কিশোরী গন্ধবতীকে অরুন্ধতী নক্ষত্র চিনিয়েছিল ধ্রুবপুত্র! বশিষ্ঠ ও অরুন্ধতী এই জোড়ের নক্ষত্র চেনানো যে প্রেমেরই প্রতীক! তারপরেও ধ্রুবপুত্র হারিয়ে গিয়েছে রাতারাতি। সে কি তবে বেঁচে নেই? কানাঘুষোয় শোনা যায়, রাজ্যে থাকাকালীন সময়ে সে নাকি অস্পৃশ্য শূদ্র গৃহেও অন্নগ্রহণ করত! তাদের সঙ্গে মিশত মানুষের মতো করে। দীর্ঘাকায়, লালিত্যে পূর্ণ ধ্রুবপুত্রকে চিনত নগরের সকলেই। তার উধাও হওয়ার পর কেটে গিয়েছে দু’বছর। আর দুই বছর ধরেই উজ্জয়িনীর শ্রী যেন হারাতে শুরু করেছে! অনাবৃষ্টির সুযোগে রাজপরিবারে শুরু হয়েছে এক বৃহৎ এবং ঘৃণ্য চক্রান্ত! কারা জড়িত নেই সেই যড়যন্ত্রে! দেশে ক্রমশ শুরু হচ্ছে মাৎস্যন্যায়! দেখা দিচ্ছে দুর্ভিক্ষ! রাস্তায় নেমে আসছে শকুনের দল! অথচ এই প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্যেও কেউ একবারও ভুলে যায়নি ধ্রুবপুত্রের নাম! তার জ্ঞানের স্পৃহা, সত্যকে জানার আকাঙ্খাই তাকে পরিচিত করে দিয়েছিল সকলের কাছে। তাহলে সে অন্তর্হিত হল কীভাবে? তার অন্তর্ধানে দেবদত্তার ভূমিকাই বা কতখানি? অথচ গন্ধবতী এখনও রয়েছে ধ্রুবপুত্রের অপেক্ষায়! গন্ধবতীর পিতামহ ইতিমধ্যে পেয়েছেন এক দশার্ণদেশীয় যুবক তাম্রধ্বজের সন্ধান। এই যুবক আকাশের তারা দেখে গণনা করে বলতে পারে নিরুদ্দিষ্টের অবস্থান! শুধু গন্ধবতীকে মনে করে বলতে হবে ধ্রুবপুত্রের নিষ্ক্রমণের সময়ে আকাশে চন্দ্রের সঠিক অবস্থান! কিন্তু ধ্রুবপুত্র কি আদৌ ফিরে আসবে?

কে এই ধ্রুবপুত্র? সে কি সত্যের রূপ যার সন্ধানই ক্রমশ চিনিয়ে দেয় জাতপাত, ক্ষমতা দখলের লড়াই, বিষাক্ত চক্রান্ত, অজ্ঞানতা এবং প্রেমের স্বরূপ! প্রেম, হ্যাঁ, ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের মূল চালিকা শক্তি অতিঅবশ্যই প্রেম! প্রতিবার শৃঙ্গার ও প্রেমের বর্ণণায় লেখক যেন পাথর কুঁদে নির্মাণ করেছেন নিখুঁত ও পেলব ভাস্কর্য!

এই উপন্যাসের পটভূমি বিরাট, অসংখ্য চরিত্র। তবু নিপুণভাবে কোমল স্বরে সুর ছোঁওয়ানোর মতোই নদী থেকে ধ্রুবপুত্রের উঠে আসার বর্ণণায় লেখক যেমন প্রচ্ছন্নভাবে ছুঁয়ে যান মহাকবি কালিদাসের আত্মহত্যার চেষ্টার প্রসঙ্গ ও জ্ঞানলাভ, তেমনই তীব্র খরা, মেঘের আকুতির সঙ্গে মিলিয়ে রেবা, শিবনাথ, চতুরিকা, উদ্ধব, পরাশর, দেবদাসী সুভদ্রা ও ললিতা, দাসী নিপুণিকা, রাণী ভানুমতির মতো ছোট ছোট চরিত্রগুলিরও ব্যক্তিদ্বন্দ্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণণায় এই উপন্যাসকে উন্নীত করেন ক্লাসিক সাহিত্যে!

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত