ভূমিকা
যদি আপনি সময় ও ধৈর্য নিয়ে এই গল্পের পুরোটাই পড়েন, তাহলে জীবনে যে শত শত গল্প পড়েছেন এবং পড়বেন সেই তালিকায় এটি যুক্ত হবে মাত্র, এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। তবু গল্পটা শুরু করার আগে পাঠকের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে। পড়া শুরু করার আগে পাঠককে বলব তাঁর নিজের নামটি উচ্চারণ করতে।
এই অনুরোধটা লেখকের ঔদ্ধত্য নয়, বরং আমার অর্থাৎ গল্পকারের স্পর্ধা বলে ভাবতে পারেন (লেখক আর গল্পকার এক নন)।
এবার বলি পাঠক যদি তাঁর নামটা উচ্চারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তবে যেনতেন ভাবে যেন নামটা উচ্চারণ না করেন। আশেপাশে যদি লোক থাকে তাদের তোয়াক্কা করবেন না, আমার মনে হয় আপনার প্রতি এই মূহুর্তে তাঁদের কোনোই মনোযোগ নেই। গভীরভাবে নামটা বলুন, নিজের কানে শুনুন, নিজের কাছে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ রাখুন। আপনার কানে কীভাবে এই নামের শব্দতরঙ্গ অনুনাদ সৃষ্টি করেছে সেটা মনে ধরে রাখার চেষ্টা করুন। নিজের পৃথিবীকে জানতে সেই স্মৃতি পরে কাজে লাগবে।
১.
এখানে কোনো বাড়ির গায়েই রঙ নেই। ইঁট, সিমেন্ট, পলেস্তরা, পেইন্ট ক্ষয়ে গেছে যেন সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তারপর দেশভাগ, দাঙ্গা, স্বাধীনতা যুদ্ধ, রাজনীতি, জনসমুদ্র নিয়ে এসেছে এমন মলিনতা তাকে যেন কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। রঙ্গীন টেলিভিশনে ঝলকে ওঠে উত্তর মেরুর শুভ্র তুষার, কিন্তু সেই ঝলক ঘরের বাকি অংশগুলোয় পৌঁছায় না, কোণায় জমে রাস্তার ধুলো, মাকড়সার জাল, কাগজের ঠোঙ্গা। কিন্তু রঙ্গীন নয়, একটা সাদা-কালো টেলিভিশনে পৌঁছাতে হলে পার হতে হবে দু-একটা অন্ধকার গলি, রিকসার বেড়াজাল, বেশ কয়েকটা ওষুধের দোকান, রাস্তার গর্তে জমা জল। সেখানে যেতে যেতেই যাবার সব উৎসাহ শরীরে ওপর নামা সহৃদয় বৃষ্টির জলে গলে নেমে যাবে রাস্তায়, হয়তো জমা থাকবে রাস্তারই গর্তে। জীবনের যত আশাবাদিতা গচ্ছিত থাকবে জমা জলে, কিন্তু তাকে মুহূর্তে ছলকে দিয়ে শূন্য করে চলে যাবে কোনো অবিমৃষ্যকারী মোটরগাড়ি।
তখন ১৯৭৩ সন, মহামারী, বন্যা সবই হয়েছিল সেই বছর, নতুন দেশে ছিল এক ধরণের অস্থিরতা। বর্ষা শেষ হয়ে যাবার কথা। কার্ত্তিক মাস তখন। ভাবছেন বাংলা মাস কেন বলছি। আসলে আমি যে জায়গায় যেতে চাইছিলাম, সেই অন্ধকার বৃষ্টির দিনে, কোনো কারণে ঠিক কি ইংরেজী মাস ছিল সেটা আমি হঠাৎ মনে করতে পারছিলাম না। ৪ঠা কার্ত্তিক আমার জন্মদিন ছিল, আর তার পরদিন গিয়েছিলাম কেশব ব্যানার্জি রোডে এক টেলিভিশনের খোঁজে। একটি টেলিভিশন কেনার শখ ছিল বহুদিনের, সামর্থ্য ছিল না। খবর পেলাম কেশব ব্যানার্জিতে বাস করেন এক ভদ্রলোক, তিনি নাকি মাত্র পাঁচশো টাকায় তার টেলিভিশন বিক্রী করে দেবেন, ঠিকানা পেলাম, নামটা পেলাম না।
বৃষ্টিতে ভেজার কোনই পরিকল্পনা আমার ছিল না। তাঁতি বাজার থেকে এখানে হেঁটে আসতে বেশী সময় নেবার কথা নয়, কিন্তু পথে পড়ল কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে এল, ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক ঘুরলাম, কিন্তু মনে যা ছিল তার সঙ্গে মিল পেলাম না। সাত বছর বয়সে মন হত এ যেন এক গোলকধাঁধা, ক্রিটের মিনাটর মহিষ-মানুষকে ধরে রাখার জন্য ডাডালেস নির্মিত ল্যাবিরিনথ। ভয় হত স্কুলে যেতে, মনে হত আমার সহপাঠিদের কাছে পৃথিবীর রহস্য উদ্ঘাটনের চাবিকাঠি আছে, আমিই যেন আলাদা, অন্ধকারে দেয়াল হাঁতড়ে চলেছি।
স্কুলের মাঠে কয়েকটা ছেলে ফুটবল খেলছে। ওদের দেখে মনে হল অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে দৌড়াচ্ছে, তারপর মনে হল ওরাও আমাকে দেখে ভাবছে একটি লোক মাঠের মধ্যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বসে আছে। আমি এক কোণায় বসে ওদের খেলা দেখি, আত্মবিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এক ধোঁয়াশা সমচ্ছেদে।
এই স্কুলের ব্রাহ্ম ঐতিহ্য কি ঐ ছেলেরা জানে? জানার কোনো কথা নয়, ব্রাহ্ম কথাটাই ওদের কাছে অচেনা হবে। তারা কি জানে বালিয়াটির কিশোরীলাল চৌধুরীর কথা? জানার কথা নয়। এই সব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল, দেখি মাঠের ছেলেরা আর নেই, চারদিকের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে, একটি বাড়ির দোতলার রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে, এক গৃহিণী বাড়ির ঝিকে বকাবকি করছেন, তার পাশের ফ্ল্যাটে একটি কিশোরী মেয়ে জানালার গরাদ ধরে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে শহর রহস্যময়ী হয়ে ওঠে, এক একটা বাসার কোঠায় এক একটা পরিবার, তাদের জীবনরেখা তাদের প্রতিবেশীদের থেকে ভিন্ন, চিন্তাধারা, চেতনা, জীবনের লক্ষ। দূর থেকে আমি তাদের দেখি যেন ভিন গ্রহের আগন্তুক আশ্চর্য হয়ে পৃথিবীর মানুষকে দেখছে।
তারপর মনে হয় আমার মত অনেকেই হয়তো নিজেকে পৃথিবীর অধিবাসী ভাবেন না, হয়তো ভাবেন ভুল করে তারা এই গ্রহে জন্ম নিয়েছেন। হয়তো পাঠক মাথা নাড়িয়ে মনে মনে বলছেন, “ঠিক কথা ঠিকই, মাঝে মাঝে এই গ্রহটাকে চিনতে পারি না, এর মানুষদের বুঝতে পারি না।”
মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, ওপরে তাকিয়ে দেখি আকাশ মসীময় হয়ে আছে। স্কুলের গেট পার হয়ে বেরিয়ে আসি। একটা রিক্সার খোঁজ করি, খালি পাই না। কেশব ব্যানার্জি পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছাতে ভিজে একশা, তাও ভাল, বৃষ্টিটা মুষল ধারে পড়ে নি। পুরোনো বাড়ি, সামনে একটা বারান্দা, বারান্দায় উঠতে তিনটে ছোট সিঁড়ি। তারপর দরজা, দরজায় কড়া। কড়া নাড়লাম, একটা ১৮/২০ বছরের ছেলে দরজাটা খুলে দিল, দরজায় পর্দা লাগানো, সরিয়ে বলল, “কে?” বললাম, “টেলিভিশনের খোঁজে এসেছি।” ছেলেটা বলল, “ভিতরে আসুন।”
ভেতরে ঘরটা একটা অস্বচ্ছ টিউবলাইটের আলোয় মলিন হয়ে আছে, ছেলেটা দেখলাম তার থেকে একটা মলিনতর পাজামা পরে আছে, মুখে কয়েক দিনের খোঁচা দাড়ি, ধারালো নাক ও চোয়াল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, অগোছালো লম্বা চুল, কিন্তু চোখে দীপ্তি আছে। পড়ুয়া ছেলে, ভাবলাম আমি। “বসুন,” বলে খুব নিচু একটা নিচে বেত-লাগানো কাঠের চেয়ারকে ডান হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল। বসতে বসতেই ঘরের কোণায় টেলিভিশনটির দিকে চোখ পড়ল, একটা কাজ-করা ছোট কাপড় দিয়ে ঢাকা। ছেলেটি “আব্বুকে ডেকে দিচ্ছি,” বলে অন্যদিকের একটা দরজার পর্দা তুলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘরে দেখলাম তিনটি দরজা, একটা ভেতরের দিকে গেছে যেটা দিয়ে ছেলেটা এই মুহূর্তে ঢুকে গেল, সেটার ওপরে ঘরের একমাত্র বাতি একটা টিউবলাইট। একটা দরজা বাইরের বারান্দায় গেছে, যেটা দিয়ে আমি এই বাড়িতে ঢুকলাম, আর একটি দিকে পর্দা ছাড়া একটা হাল্কা-সবুজ রঙা দরজা, তাতে একটা হাতল-দেয়া ছিটকিনি। দরজার ওপরে ফ্রেম করা একটা হলদে কাপড়, তাতে লাল সুতোয় বোনা ছিল এই কথাগুলো:
চৈত্রে চালিতা, বৈশাখে নালিতা, জৈষ্ঠে অমৃতফল, আষাঢ়ে খই, শ্রাবনে ঘোলপান্তা, ভাদ্রে-তালের পিঠা, আশ্বিনে-শশা মিঠা, কার্তিকে ওল, অঘ্রাণে খৈলসার ঝোল, পৌষে কানজি, মাঘে তেল, ফাল্গুনে পাকা বেল ।
খনার বচন। ভাবলাম পৌষ মাসে কানজি, কানজি কথাটার মানে কী। তখনই একটা হলদে টিকটিকি টিক টিক টিকটিক বলে টিউবলাইটের পেছনে লুকালো। টিকটিকির নির্দেশের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন গৃহকর্তা, তিনি টিউবলাইটের নিচের দরজাটা দিয়ে ঢুকলেন।
ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাট হয়তো হবে। পাজামা, সাদা পাঞ্জাবি পরা। চুল সাদা-কালোর মিশ্রণ, উঁচু কপাল, তীক্ষ্ম থুতনি, গালে দু-দিনের না-কামানো দাড়ি, লক্ষ্যণীয় কোটরাগত দুটি চোখ। কিন্তু মুখে সদয় ভাব। মাথায় টাক পড়ছে। আমি ওনাকে কিছু না বলতে দিয়েই বলে উঠলাম, “আমি টেলিভিশনের জন্য এসেছি।”
আমাকে বসতে বললেন। তারপর বললেন, “টেলিভিশনটা আসলে খারাপ হয়ে গেছে, আপনি যদি সারাতে পারেন তো নিয়ে যান, আমাকে কিছু দিতে হবে না।”
বললাম, “কী হয়েছে?” ভদ্রলোক বললেন, “সুইচ টিপছি, চলছে না।” বললাম, “আমি কি একটু দেখতে পারি?” ভদ্রলোক উঠে গিয়ে টেলিভিশনের কাপড়টা সরিয়ে সুইচ টিপলেন, কিছু হল না। আমি দাঁড়ালাম, জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কাছে কি একটা স্ক্রু ড্রাইভার হবে?”
উনি আমার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার নামটা কী?” বললাম, “অমল।” উনি বললেন, “আপনি কী টেলিভিশন মেরামত করতে পারেন?” বললাম, “চেষ্টা করতে পারি।” তারপর ইতস্তত করে বললাম, “আপনার নামটা একটু যদি জানতাম?” উনি বললেন, “নিস্তার মোল্লা।” নামটা ঠিক শুনেছি কিনা সেটা বুঝতে পারলাম না, এর মধ্যেই নিস্তার মোল্লা চিৎকার করে উঠলেন, “আকাশ, আকাশ!”
হঠাৎ করে আকাশ বলায় আমি একটু হতচকিত হয়ে পড়লাম, উনি কি বলছেন যে ওনার নামের শেষে আকাশ আছে, তারপর বুঝলাম উনি ছেলেকে ডাকছেন। কিন্তু ছেলের বদলে ভেতরের দরজা দিয়ে একটি কিশোরী মুখ বেরিয়ে এল, সে বলল, “ভাইয়া বাইরে গেছে।”
বুঝলাম এটি হল ছোট বোন। আকাশ কোন দিক দিয়ে বাড়ির বাইরে গেল বুঝলাম না। নিস্তার মোল্লা বললেন, “বীথি, দেখো তো বাসায় কোনো স্ক্রু ড্রাইভার আছে কিনা।”
বীথি আমার দিকে তাকালো, হাসলো। এই দেশে কোনো কিশোরী অপরিচিত একটি পুরুষ দেখলে সহজে হাসবে না। তার মুখ দরজার পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি নিস্তার মোল্লাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম টেলিভিশনটা কত দিনের, তার মধ্যেই বীথি স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে হাজির। বীথিকে দেখে মনে হল পনেরো থেকে সতেরো বছর, একটা সাদা সালোয়ারের ওপর লাল জামা পড়া। চুল পেছনে বিনুনী করা, মুখটায় ভাইয়ের ছাপ আছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটাতে হবে?” অচেনা মানুষের সঙ্গে তার সাবলীল ব্যবহার আমাকে চমৎকৃত করেছিল। আমি তার হাত থেকে স্ক্রু ড্রাইভারটা নিয়ে বললাম, “দেখি।”
কিন্তু ওটাতে কাজ হল না, আমার দরকার ছিল একটা ফিলিপস স্ক্রু ড্রাইভারের। আমি নিস্তার মোল্লাকে বললাম, “টেলিভিশনের ভেতরে একটা পাওয়ার সাপ্লাই আছে, সেটা নষ্ট হয়েছে কিনা দেখতে আমাকে সেটটা খুলতে হবে। কিন্তু এই স্ক্রু ড্রাইভারে হবে না। আমি বরং কাল পরশু সঠিক যন্ত্রটা নিয়ে আসবে। হয়তো কিছুই হয় নি, হয়তো একটা ফিউজ বদলাতে হবে।”
কি কারণে এরকম স্বপ্রণোদিত হয়ে টেলিভিশন সারাই করতে সচেষ্ট হলাম? নিস্তার মোল্লা ও তাঁর দুই সন্তানকে আমার প্রথম দেখাতেই খুব পছন্দ হয়েছিল। আমি নিঃসন্দেহ পাঠকের এরকম অনেক অভিজ্ঞতা আছে যেখানে মানুষের দু-একটা বাক্য উচ্চারণের মধ্যেই সেই মানুষের সঙ্গে আপনার হৃদয়ের তন্ত্রীর অনুনাদ সঞ্চারিত হয়, আপনি নিজেকে বলেন এই লোকের সঙ্গে আমার আত্মিক বন্ধন হতে পারে।
নিস্তার মোল্লা অবাক হয়ে বললেন, “আপনি এটা সারাই করতে আসবেন? আপনার পারিশ্রমিক কত হবে?”
আমি বললাম, “কোনো পয়সা লাগবে না।” তারপর কি ভেবে যেন যোগ করলাম, “স্যার।”
নিস্তার মোল্লা তাতে খুশী হলেন কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু বীথি হাত তালি দিয়ে উঠল, বলল, “বাহ, বিনা পয়সায় টেলিভিশন ঠিক হয়ে যাবে।”
পরদিন সন্ধ্যাবেলা হাজির হলাম কেশব ব্যানার্জির সেই বাসায়, একটা ব্যাগে কয়েকটা স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে। বাসায় ছিল বীথি ও তার বাবা। টেলিভিশনটা খুলে পাওয়ার সাপ্লাইটা বসার ঘরের কফির টেবিলটার ওপর বসিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে বসলাম। ফিউজটা ঠিকই আছে। বীথি উল্টোদিকে এসে বসল, বলল, “কী দেখছেন?”
আমি বললাম, “এগুলো হল ক্যাপাসিটর। ক্যাপাসিটর খারাপ হয়ে গেলে সেগুলোর ওপরটা অসমান হয়ে যায়, কোনো ক্যাপাসিটর খারাপ হয়েছে কিনা দেখছি।”
আমি কথাটা শেষ করতে না করতেই বীথি আঙুল দিয়ে একটা বড় ক্যাপাসিটর দেখালো, বললো, “এইটা?” সত্যি মনে হল সেটা খারাপ হতে পারে। আমি বললাম, “আমি আজ এটা নিয়ে যাই, কাল পরশু সারাই করে নিয়ে আসব।”
কিন্তু পাওয়ার সাপ্লাইটা সারাই করতে বেশ কয়েকদিন লেগে গেল, সঠিক মানের ক্যাপাসিটর পাওয়া যাচ্ছিল না। যাইহোক অবশেষে সেটা ঠিক করে নিয়ে গেলাম, টেলিভিশনও কাজ করল। নিস্তার মোল্লা বললেন, “করেন কী?” আমি বললাম, “রসায়নে অনার্স নিয়ে পাশ করেছি স্বাধীনতার ঠিক আগে, ভেবেছিলাম অধ্যাপকের কাজ একটা পাওয়া যাবে, তো সেটা হল না। এখন এদিক ওদিক পড়াই, তবে রসায়ন নিয়ে আরো পড়ার ইচ্ছা আছে। আমাকে তুমি করে বলবেন।”
উনি বললেন, “আমার ছেলে মেয়েদুটিকে পড়াও না কয়দিন। ছেলে দেবে উচ্চ মাধ্যমিক, মেয়ে মাধ্যমিক।” আমি বললাম, “অবশ্যই।” উনি বললেন, “কত মাইনা দেব তোমাকে?” আমি বললাম, “সপ্তাহে চারদিন আসব, তিনশো টাকা দেয়া যাবে?” উনি বললেন, “তাই হবে।” আমি বললাম, “স্যারের স্ত্রী কোথায়?” উনি বললেন, “মারা গেছেন, তা বছর পাঁচ তো হবে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাকে কী বলে ডাকব? নিস্তার চাচা না নিস্তার কাকা?” উনি বললেন, “চাচা কাকা হতে চাই না, আমাকে ভাই বলে ডেকো?” আমি বললাম, “তাহলে আকাশ আর বীথি আমাকে কী বলে ডাকবে? আমিও চাচা হতে চাই না। ওদের ডাকুন, আমি বলে দিচ্ছি আমাকে কী বলে ডাকবে?”
আকাশ আর বীথি এলে আমি বললাম, “তোমাদের পড়াব, আমাকে অমলদা বলে ডাকবে।” তারা মনে হল খুশীই হল। এইভাবে আমি নিস্তার পরিবারের সবার ভাই হয়ে গেলাম।
২.
কাহিনীটা একটু সংক্ষিপ্তভাবেই বলছি। এই তিনটি মানুষকে আমি খুবই ভালবাসতাম। ভালবাসাটা যে এক দিনে হয় নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ধীরে ধীরে দুটি বছর ধরে সেটা গড়ে উঠেছিল। আমি খুব ছোট থাকতেই আমার বাবা ও মা মারা যান, আমার কোনো ভাই-বোন ছিল না। এর পরে আমি কাকার বাড়ি বড় হই। কাকাও ১৯৭১ সনে মারা গেলেন অসুস্থ হয়ে, শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া গেল না, পথেই পাকিস্তানি বাহিনী সবাইকে মেরে ফেলতো। তাই স্বাধীনতার পর থেকেও আমি স্বাধীন, ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে না হোক, কোনো কলেজে একটা পড়ানোর কাজ পাওয়া যাবে। তা আর হল না, এখন দুএকটা টিউশনি করি, কারু রেডিও টেলিভিশন খারাপ হলে সারাই করি কিছুটা শখেই। একা ছিলাম, নিস্তার ভাইয়ের পরিবার আমার জন্য বর হয়ে এল।
নিস্তার ভাই বললেন তার নামটি এসেছে ফারসী নিশতার থেকে, সংস্কৃত নিস্তার থেকে নয়। নিশতার মানে হল ছোট ছুরি যা কিনা কাঁটা-ছেড়া জাতীয় চিকিৎসায় লাগে, ইংরেজীতে বলে lancet। ভাবলাম ফারসী ও সংস্কৃতের একটা যোগসূত্র আছে। এই দুটি শব্দের মধ্যেও কি আছে? কেমন করে মোল্লা ওনার পারিবারিক পদবী হল সেটা বলতে পারলেন না।
কিন্তু আপনাদের সেই বিস্তারিত কাহিনী পড়ার সময় নেই, আমারো লেখার ধৈর্য নেই। এটুকু বলি বীথিকে আমার নিজের ছোট বোন, আকাশকে ছোট ভাই আর নিস্তার ভাইকে আপন বড় ভাইয়ের মতই ভাবতাম। ওরাও আমাকে আপনজনই ভাবতো, অন্ততঃ তাই আমার মন হয়। বীথিকে মাঝে মাঝে ডাকতাম বীথিবন, মাঝে মাঝে ডাকতাম বীথিবোন। কিন্তু এই গল্প নিরঙ্কুশ ভালবাসার নয় তাই এখন সময় হয়েছে এই কাহিনীতে আর একটি মাত্রা যোগ করার।
একদিন নারায়ণগঞ্জে কাজে গিয়েছিলাম, সেখানের কাজটা একটু আগেই শেষ হয়ে যাওয়াতে আমি নিস্তার ভাইয়ের বাড়িতে যথাসময়ের একটু আগেই এসে পড়েছিলাম। বিকাল তখন চারটা মত বাজে, শীতের দিন, একটু পরে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, এসে দেখি কেউ নেই। সুখী নামে ওদের যে কাজের মেয়েটি ছিল সে কাজ সেরে বসে আছে, কেউ ফিরলে সে চলে যাবে। আমি বললাম, “তুমি চলে যাও, আমি থাকবো।” সুখী চলে গেল। আমি বসার ঘরে বসে একটা বিচিত্রা দেখছিলাম, কিন্তু তাতে মন ছিল না, মাঝে মধ্যেই চোখ তুলে ফ্রেমে হলুদ কাপড়ের ওপর লাল সুতোয় লেখা খনার বচনটা দেখছিলেম। হঠাৎ চোখ পড়ল কফি টেবিলের ওপর রাখা একটা সাদা কাগজের ওপর, কাগজটা সবুজ কালির হাতের লেখায় ভর্তি। কাগজটা তুলে নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এলাম, স্পষ্ট হাতের লেখা। ওপরে দেখলাম পৃষ্ঠার নম্বর ৫,৮৮৯। এতগুলো পাতা লেখা হয়ে গেছে? এতো অসম্ভব একটা ব্যাপার। পড়া শুরু করলাম।
“পৃষ্ঠা ৫,৮৮৯
গতিতে বাঁশের ভেলাটি ঘূর্নীর আবর্তে ঘুরতে থাকে, গোপাল বুঝতে পারে না সে জলে ঝাঁপ দেবে নাকি ভেলার দড়ি ধরে ভেলার সাথে মিশে থাকবে। কিন্তু তার আর সময় হয় না, নদীর বাঁকের আবর্তে তাকে ভেলাসহ জলের গভীরে নিয়ে যায়, নিচে বহু নিচে, চক্রাকার গতিতে। ঘোলা ঘূর্ণীতে কিছু দেখতে পায় না গোপাল, দম বন্ধ হয়ে আসে, ভেলা থেকে ছিটকে পড়ে সে। তবু সে জানে, বহু নিচে, জলের গভীরে এই আবর্ত তার শক্তি হারাবে, সেখানেই নদীর তলদেশে, কাদার কাছে তার মুক্তি আছে। তাই সে আত্মসমর্পণ করে স্রোতের কাছে, যেমন সে করেছিল নৃপতি মহাশাসনের কাছে। যুদ্ধ কর না, বিজয় তোমার দর্শনের মঝেই নিহিত আছে। মহাশাসন শেষ পর্যন্ত তার শিষ্য হয়েছে। এই কথাগুলোই গোপালের মাথায় ঘূর্নীর আবর্তে পাক খায়। বহু ওপরের সূর্যের আলো এখানে আর পৌঁছায় না, পলিমাটির অন্ধকার ঘূর্ণনকে বর্ষার মাছেরা এড়িয়ে যায় সন্তর্পণে। অবশেষে তার পা ঠেকে মাটিতে, চক্রাবর্ত এখানে দুর্বল। মাতা অনিন্দিতা ও পিতা বাপট্যকে স্মরণ করে পা দিয়ে যতদূর পারা যায় নিজেকে ঘূর্ণন থেকে দূরে ঠেলা দেয় গোপাল। ডুবসাতাঁর দিয়ে যতদূর যাওয়া যায়, তারপর ওপরে উঠে আসতে থাকে। মনে হয় অনন্তকাল সময় পার হয়ে হতে থাকে, বুক প্রায় ফেটে যায়। অবশেষে তার মাথা জল ভেদ করে বের হয়ে আসে পৃথিবীর বায়ুতে। খাবি খায় গোপাল, নিঃশ্বাস নেয় বুকভরে, না শেষ হয়ে যায় নি এখনো সবকিছু। দক্ষিণে স্রোতে ভেসে যায় গোপাল, তা যাক, বেঁচে থাকলে উত্তরে আবার যাওয়া যাবে। তখনি তার চোখে পড়ে পশ্চিম পাড়ে তিনজন বর্শা হাতে দৌঁড়াচ্ছে, একজন হাত তুলে তাকে ইঙ্গিত করছে পাড়ে উঠে আসার জন্য। শঙ্কিত হয় গোপাল, এরা কি প্রতীহাররাজের সান্ত্রী? কী করে তারা এই ভরা বর্ষার বন্যায় খুঁজে পেল তাকে, পূর্ব পাড়ে”
লেখাটা এখানেই শেষ, বোঝাই যাচ্ছে এর পরেও লেখাটা চলেছে, কিন্তু এর আগের বা পরের পাতাগুলিই বা কোথায়? আর এত হাজার হাজার পাতা কার লেখার সামর্থ্য আছে? হাতের লেখাটা ভাল করে দেখলাম, না কোনো সন্দেহ নেই, এটা নিস্তার ভাইয়ের লেখা। আমার সারা শরীর শিউরে উঠল, নিস্তার ভাই লিখেছেন প্রায় ছয় হাজার পাতা? নিস্তার ভাই এরকম একটা পাতাই যে লিখতে পারবেন তাই আমি বিশ্বাস করি না, আর ছয় হাজার? সে কী করে সম্ভব? আর গোপালের যে কাহিনী তা মনে হয় বাংলার অতীতে সংঘঠিত কোনো কিছু, সেই সম্বন্ধে নিস্তার ভাইয়ের যে আদৌ কোনো উৎসাহ থাকবে সেটাও আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম, পাতাটা আবার পড়লাম, গোপাল ডুবে যাচ্ছে এক বিশাল নদীতে? কে এই গোপাল? তার সম্বন্ধে এত কথা নিস্তার ভাই কেমন করে জানলেন, বা তা যদি কল্পনা হয় কেমন করে কল্পনা করলেন?
এই ভাবছি এর মধ্যেই বীথি ফিরল স্কুল থেকে, বলল, “ওঃ, তুমি কখন এসেছ, দাঁড়াও তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।” এই বলেই ভেতরে ঢুকে গেল। আমি বীথিকে লেখাটার কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম, চা’টা আগে নিয়ে আসুক। কিন্তু চা আসার আগেই নিস্তার ভাই এসে পড়লেন। ঘরে ঢুকেই ওনার চোখে পড়ল টেবিলের ওপরে রাখা কাগজটার ওপর। আমার মুখের দিকে তাকালেন, বুঝলেন আমি লেখাটা পড়েছি। আমার সামনে এসে বসলেন, পাতাটা তুলে নিলেন হাতে, পড়লেন, নামিয়ে রাখলেন। এর মধ্যেই বীথি চা নিয়ে এল। চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে কিছু লক্ষ না করেই নিস্তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আব্বু, আজ আমার রহমত স্যারের ওপর খুব রাগ হয়েছে। ক্লাস শেষে করে বার হয়ে যাচ্ছেন, বুঝলা আব্বু, এর মধ্যে ক্লাস শুদ্ধা মেয়েরা চিৎকার করা শুরু করেছে, কে যেন কেন, আর উনি ফিরে এসে আমাকেই শুধু খুব বকাবকি করলেন।” নিস্তার ভাই বীথির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আমার দিকে চাইলেন, তিনি জানেন আমি কী জন্য ওরকম বাকরূদ্ধ হয়ে বসে আছি। এবার আমাকে বলল বীথি,”তুমিই বল, অমলদা, আমি কি অমন হই-চই করার মেয়ে?” আমার চোখ টেবিলের ওপর কিছু একটা দেখছে সেটা দেখে এবার বীথির দৃষ্টি পড়ল কাগজটার ওপর, সে সাথেই সাথেই নিস্তার ভাইকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল। আমার দিকে তাকালো, তারপর তার বাবার দিকে।
নিস্তার ভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, বললেন, “তোমাকে একটা জিনিস দেখাব বলে অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম, কিন্তু কখন কিভাবে সেটা হবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এই জিনিসটা আমরা পরিবারের তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না, এমন কি কাজের মেয়ে সুখীও জানে না।”
আমি আগেই বলেছি, আপনাদের সেটা খেয়াল আছে কিনা জানি না, নিস্তার ভাইয়ের বসার ঘরে তিনটি দরজা আছে। একটা বাইরে থেকে ঢোকার, একটা ভেতরে যাবার, আর একটা ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ, তার ওপর হলুদ কাপড়ে লাল সুতা দিয়ে খনার বচন লেখা। ঐ বাসায় বীথি ও আকাশকে কয়েক মাস পড়াতে যাবার পরও, সেখানে মাঝে মধ্যেই রাতের খাবার খাওয়া সত্ত্বেও, বসার ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও আমার মাথায় এই ভাবনাটা আসে নি যে ঐ দরজার পিছনে কি থাকতে পারে। আমি প্রথম থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম সেটা হয়তো বাইরে গলিতে যাবার একটা পথ।
নিস্তার ভাই আমাকে বললেন, “আমার সাথে এস, অমল।” আমাকে তৃতীয় দরজার কাছে নিয়ে গেলেন। দরজাটা ছিটকিনি খুলে খুললেন, ভেতরে অন্ধকার, পুরনো বইয়ের গন্ধ ভেসে এল। নিস্তার ভাই অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকারে যেন কী করলেন, তারপর একটা জানালা খুললেন, ঘরটা বিকালের লাল পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ভেসে গেল। কীভাবে সূর্যের আলো ঘরে ঢুকলো প্রথমে বুঝলাম না, কারণ ঘরটার কোনোদিকই বাইরে উন্মুক্ত ছিল না, একটা দিক বাড়িরে বাইরে, সেখানে একটা গলি, গলির পরে আর একটা বাড়ি।
চোখটা আলোয় সয়ে এলে বুঝলাম নিস্তার ভাই জানালায় কিছু একটা লাগিয়েছেন যেটা বাইরে থেকে সূর্যালোক ঘরে নিয়ে আসতে পারে। সেই আলো ঘরের চার দেয়ালে রাখা চারটা আয়নায় প্রতিফলিত ও পুনঃপ্রতিফলিত হয়ে একটা উজ্জ্বল লাল ক্রসের বা যোগচিহ্নের সৃষ্টি করেছে। দেখলাম ঘরটার মেঝে থেকে প্রায় তিন ফুট উঁচু সব কাগজের স্ত্ম্ভ, দিস্তা দিস্তা কাগজ, সারা ঘরটায় এরকম প্রায় দশটা স্তম্ভ ছড়ানো। দেয়ালের আয়নাগুলোর আকার বিশাল আয়াতক্ষেত্র ছয় ফুট বা চার ফুট হবে। সোনার ফ্রেমে মোড়া মনে হল। একদিকের আয়নার নিচে একটা ড্রেসিং টেবিল, সেখানেই ঘরের একটা মাত্র চেয়ার।
আমি কাগজের স্তম্ভগুলোর কাছে যেয়ে দেখলাম সেগুলো হাতের লেখায় ভর্তি। আমি নিস্তার ভাইয়ের দিকে তাকালাম, জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো আপনার লেখা?” উনি মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলতে চাইলেন। আমি বললাম, “এতে হাত দেয়া যাবে?” উনি আবার মাথা দিয়ে ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলেন।
আমি একটা স্তম্ভ থেকে একটা পাতা তুলে নিলাম, তাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা, নিস্তার ভাইয়ের হাতেই লেখা, শুধুমাত্র প্রথম দিকটা পড়লাম,
“পৃষ্ঠা ১১, ২৩৪
বারবক শাহ তাঁর চিকিৎসক অনন্ত সেনকে ডাকলেন, বললেন, ‘দেখুন এই তরুণের কোনো শুশ্রুষা করা সম্ভব কিনা’…?”
আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল। ১১,০০০ পাতা? এই ঘরের এত কাগজ, এ সবই নিস্তার ভাইয়ের হাতের লেখায় ভর্তি! এ কেমন করে সম্ভব? পূর্ণাঙ্গ মহাভারত শুনেছি ১৩,০০০ পাতা হয়েছিল, কিন্তু সেটাতো আর একটি লোক লেখেনি। আর আধুনিক সময়ে মার্সেল প্রুস্তের ‘হারানো সময়ের খোঁজে’ হয়েছে মাত্র ৩,০০০ পাতা। অবশ্য এগুলো সব ছাপানো পাতা। কিন্তু আমি যা দেখছি নিস্তার ভাইয়ের বই ছাপানো হলেও ১৫,০০০ পাতার ওপরে হবে।
এবার বুঝলাম আয়নার মধ্যে সূর্যের আলো যেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, আমরাও সেরকমভাবে প্রতিফলিত হচ্ছিলাম। চার দেয়ালে চারটা আয়নার মধ্যে আমাদের অসীম সংখ্যক প্রতিফলন কাছ থেকে দূরে, অসীম দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
আমি অসুস্থ বোধ করি, বিড়বিড় করি, “আয়না ও শারীরিক সঙ্গম দুটিই ঘৃণ্য, কারণ দুটিই মানুষের সংখ্যা বর্ধন করে।” কথাটা আর্জেটিনার লেখক হোরহে লুইস বোর্হেসের, কোথায় যেন পড়েছি মনে নেই। নিস্তার ভাই বললেন, “কি বললে?” আমি বললাম, “কিছু না, মাথাটা একটু ঘুরছে।”
আমরা ঐ ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। দেখলাম বীথি কি মনে করে আমার জন্য ঠাণ্ডা জল নিয়ে এসেছে। “পানি খাও, দাদা, কলসীর পানি, ঠাণ্ডা আছে।”
আমি বসে ঢক ঢক করে জল খেলাম। কি হয়েছে বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পরে আকাশ বাড়ি ফিরল, কিন্তু সে রাতে ওদের আর পড়াতে পারলাম না। রাতের খাবার খাইয়ে আকাশ আমাকে একটা রিক্সায় তুলে দিল। বাসায় ফিরে শুয়ে পড়লাম, দুঃস্বপ্নে ভর্তি ছিল সেই ঘুম। আমি দেখলাম দোকানে নাপিত আমার চুল কাটছে, সামনে আয়না, পেছনে আয়না, আমার মাথার পিছন আর আমার মুখ জোড়া জোড়া হয়ে একে অপরকে দেখছে। এ রকম জোড়া যতদূর চোখ যায় ততদূর বিস্তৃত। কিন্তু আশ্চর্য সেখানে নাপিতের কোনো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে নাপিত চুল কাটছে তো কাটছেই, সেই কাটা আর শেষ হয় না। পরে যেন বুঝলাম দোকানের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটাও প্রতিফলিত হতে হতে অসীমে মিলিয়ে গেছে। তার সময়টাও প্রতিফলিত হয়েছে উল্টো হয়ে, দুপুর ১টা ২৫ হয়েছে সকাল ১০টা ৩৫। সেই উল্টোপাল্টা সময়ে দেখাতে গিয়ে আসল সময় যেন স্থিত হয়ে গেছে।
আমার মনে হল সময়কে আবার চালু করতে হবে, তার জন্য আয়নার মধ্যে যেতে হবে। হামাগুড়ি দিয়ে নাপিতের টেবিলে উঠে আমি প্রথম আয়নায় ঢুকি, ঢুকতে কোন বাধা পাই না। সেখানকার দেয়াল থেকে ঘড়ি নামিয়ে আনি। না, এই জায়গাটা আমি মনে করতে পারি না, হয় ঘড়িটাকে নামিয়ে আনি, অথবা সেটার কাঁটাগুলোকে সঠিক সময়ে ঠিক করে দিই। সেখান থেকে দ্বিতীয় আয়নায়, কিন্তু কিছু পরেই বুঝলাম এই কাজটা অসম্ভব। আমার সামনে অসীম সংখ্যক আয়না বিস্তৃত, সময়কে ঠিক করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এরকম ভাবছি তখনই মনে হল আমি আয়নার মধ্যে আর নেই। একটা সুন্দর বাগানের মধ্যে আছি, অনেকটা মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বাগানের মত, কিন্তু খুব ছোট, একদিকে একটা বাঁধানো খুবই ছোট একটা পুকুর, তাতে জলপদ্ম। চারপাশে কিছু উঁচু গাছ। একটা মেয়ে কোথা থেকে যেন এল, লম্বা সাদা পোষাক পড়া। সে আমাকে একটা ফুল দিয়ে বলল, “এই গোলাপটা নাও, তোমার মত আমিও সময় ঠিক করতে চেয়েছি, পারিনি। আমাকে আজ আর কেউ মনে রাখে নি, আর ঐ দেখ আমি এখানে শুয়ে আছি।” দেখলাম পুকুরের পারে একটা পাথরের স্মৃতিফলক।
ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নের মাঝে কোনো গূঢ় অর্থ নেই। কিন্তু স্বপ্ন সৃষ্টি হয় অভিজ্ঞতা দিয়েই। কিসের থেকে সৃষ্টি এই স্বপ্ন? এই স্বপ্নটা আমাকে এমন একটি ব্যথায় ভরিয়ে দিল সেটা কল্পনাতীত। কষ্টে ঢোক গিলতে অসুবিধা হচ্ছিল।
৩.
পরদিন সকাল থেকেই কেশব ব্যানার্জির বাড়িটা আমাকে টানে। বাড়িটা বলব না, সেই ঘরটা। সকালেই আমি নিস্তার ভাইয়ের বাড়ি চলে যাই। ওনাকে বাসাতেই পাই। উনি যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। আকাশ কলেজে গেছে, বীথি বাড়িতেই আছে।
নিস্তার ভাই বললেন, “আমরা বসার ঘরেই বসি। ঐ পাণ্ডুলিপির ঘরটা তোমার ওপর খুব চাপ ফেলছে।” আমি আশ্চর্য হয়ে ওনার দিকে তাকাই। ঐ ঘরটা আমার ওপর চাপ ফেলছে? উনি এমনভাবে কথাটা বললেন যেন ঐ ঘরটার প্রাণ আছে।
উনি বলতে থাকলেন, “তুমি এখন এই বাড়ির ছেলে। তোমাকে আমি এখন যে ঘটনা বলব তা বীথি, আকাশ আর আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। ঈশ্বরগঞ্জের কাছে ডালিয়া বিলের ধারেই আমার গ্রামের বাড়ি। বরাইগাঁও হল গ্রামের নাম। যুদ্ধ শুরু হলে আমি এই দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে ওখানে পালিয়ে যাই। রাস্তাঘাট সেরকম না থাকার জন্য পাকিস্তানী আর্মি সহজে যেতে পারতো না। কিন্তু কিছুদিন পরে রাজাকারের খুব উপদ্রব শুরু হল। আকাশের বয়স তখন ১৬, বীথির ১২। দুজনকে নিয়েই মুশকিল। স্থানীয় শান্তি বাহিনীকে টাকা পয়সা দিয়ে পরিস্থিতি সামলে রাখলাম, ভাগ্য ভাল ওদিকে পাকিস্তানী আর্মি কখনো যায় নি। বরাইগাঁয়ের পূর্বতন জমিদারের বংশধর অচিন্ত্য কুমার রায়চৌধুরী আমার ছোটবেলার বন্ধু, একসাথে স্কুলে পড়েছি। সে পরিবারসহ উত্তরে পাহাড় পেরিয়ে ভারতে চলে গেল, বাড়ির কিছুই সাথে নিয়ে যেতে পারল না, আমাকে বলল বাড়ির কোনো জিনিস যদি উদ্ধার করতে পারি তা যেন করি। যে রাতে তারা গেলে, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তুমি যে চারটা আয়না দেখলে সেগুলো মাত্র আমার বাড়িতে নিয়ে আসতে পারি। পরদিন সকালেই রাজাকার ও স্থানীয় অনেক লোক বাদবাকি জিনিস লুট করে নিয়ে যায়, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর আয়নাগুলো ঢাকায় নিয়ে আসি। অচিন্ত্য এই দেশে আর ফিরে আসে নি।”
এই বলে নিস্তার ভাই থামলেন। তারপর বললেন, “হয়তো একদিন আসবে।”
শীতের দুপুর, আমি শুধু একটা জামা পরে ছিলাম, আমার শীত করতে লাগল, বীথি হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে একটা আলোয়ান এনে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। নিস্তার ভাই আবার বলতে শুরু করলেন, “১৯৭২-য়ের জানুয়ারি মাসে আমি আয়নাগুলো ঢাকায় নিয়ে আসি। কি যেন খেয়াল হয় ঐ ঘরের চারদিকে চারটা আয়না লাগাই। আষাঢ় মাসে দুপুর বেলা এই ঘরে সূর্যের আলো ঢোকে, একদিন এরকম বসে আছি, দুপুরবেলা সূর্যের আলো এসে পড়ল একটা আয়নায়, সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে আর একটিতে। চার দেয়ালে একে অপরকে প্রতিফলিত করে আয়নাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি চেয়ারে বসে আলোর খেলা দেখতে দেখতে যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম, যেমন তুমি গতকাল সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলে।
“পরের দিন সকালে ঘরে ঢুকে বসে থাকি, দুপুরের দিকে যখন সূর্যের আলো ঢুকলো তখন আবার আগের দিনের মত আমি সম্মোহিত হলাম। আমার প্রবল ইচ্ছা হল একটা কিছু লেখার, আমি জানতাম না আমি কি লিখতে চাইছি। একটা কাগজ আর কলম নিয়ে ড্রেসিং টেবিলটায় বসি। একটাই মাত্র লাইন লিখি – “এক শুষ্ক শীতের দিনে আমরা সাগরের ধারে পৌঁছলাম।” কীভাবে ঐ বাক্যটা আমার মাথায় এসেছিল সেটা বুঝতে পারলাম না। এরপরে আমি ঐ একটা লাইনকেই ইংরেজীতে অনুবাদের চেষ্টা করি, সেটা করতে যেয়ে দেখি একটা বাক্যের বদলে দুটো হয়েছে, বুঝলাম আমি নতুন কিছু যোগ করেছি, অথচ কী যোগ করেছি সেটা জ্ঞানতঃ বুঝলাম না। সেই দুটো ইংরেজী বাক্যকে আবার বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে দেখি সেটা চারটা লাইনে পরিণত হয়েছে। পরে আমি যা বুঝলাম সেই ঘরে আমি যাই লিখি সেটা নতুন একটা কিছু হবে, ইংরেজীতেই হোক কি বাংলায় হোক। আমি এটাও বুঝলাম সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে এই বাংলায় একদল লোক পৌঁছেছিল পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, তারাই “সাগরের ধারে পৌঁছেছিল”। তাদের কেউ এখানে থেকে গেল, কেউ পূর্ব দিকে চলে গেল, তাদের বংশধরদের মধ্যে কেউ কেউ সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছালো।
“কিন্তু এই ইতিহাস আমার জানার কথা নয়, আমার এ সম্বন্ধে কোনো ধারনাই ছিল না। এখন যে সমুদ্র উপকূল তখন সেটা আরো কয়েকশো কিলোমিটার দক্ষিণে ছিল। এর পর থেকে নিয়মিত লেখা শুরু করি। দু-একদিনের মধ্যেই বুঝলাম সূর্যের আলোর প্রতিফলন ছাড়া এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। তাই ছাদের ওপরে কয়েকটা ছোট আয়না লাগালাম যাতে সূর্যের আলোকে আমি একটা নল দিয়ে নিচে নিয়ে আসতে পারি। এখান থেকে ছাদের আয়নাগুলোর দিক পরিবর্তন সম্ভব। সূর্যের স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাদের আয়নার দিক পরিবর্তন আমি একটা দড়ি দিয়েই করতে পারি।
“যাইহোক, প্রথম প্রথম দশ বিশ পাতা লিখতাম, তারপর কোনো কোনো দিন পঞ্চাশ পাতা লিখেছি, সর্বোচ্চ একশোর কাছাকাছি। তুমি ভাবতেই পার এটা একটা অমানুষিক পরিশ্রমের ব্যাপার। আর আমার মাথায় এত দ্রুত ইতিহাসের ছক গল্পের ছকই বা আসবে কোনখান থেকে। কিন্তু জানো ওখানে ঢুকলে আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে যাই। এই মানুষ সেই পঞ্চাশ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে বাংলার জঙ্গলে যেন পথ হারিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। কিন্তু সে যেন অমর, তার প্রথম বিশ ত্রিশ হাজার বছরের কাহিনী খুব অস্পষ্ট, কিন্তু ধীরে যত আধুনিক সময় এল ততই তার গল্প স্পষ্ট হল কারণ সেগুলো সে এখনো ভুলে যায় নি।”
“আমিই যেন সেই মানুষ, তার সামনে ইতিহাস রচিত হচ্ছে, শত শত বছর চলে যাচ্ছে, কিন্তু সে যেন সব তার মনে ধরে রেখেছে। তুমি যেই পাতাটি বসার ঘরে আবিষ্কার করেছিল সেটা ছিল সপ্তম শতকের রাজা গোপালদেবের কথা। আর ঐ ঘরে ঢুকে প্রথমেই যে পাতাটা তুলে নিয়েছিলে সেটা ছিল ১৪ শতকের সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহর কথা। নানান অরাজকতা, মন্বন্তর, স্বৈরশাসন, বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা শেষে আমি এখন প্রায় আধুনিক কালে পৌঁছেছি। অমল, ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর, মানুষের জীবনে আশাবাদিতার কোনো স্থান নেই।”
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। এই কাহিনী অভূতপূর্ব, ইতিহাসে এরকম মহাগ্রন্থ আর লেখা হয় নি। কিন্তু সেই আয়নাগুলোই কি পুনঃপ্রতিফলনে এই কাহিনী সৃষ্টি করেছে?
“আপনি আধুনিক সময়ে পৌঁছেছেন বলছেন, ১৯৭১ পার হয়ে গেছেন?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি না এর পরে কী হবে? এই কাহিনী তো থামার নয়,” নিস্তার ভাই বলেন।
“এই কাহিনী থামার নয়,” আমি বিড়বিড় করি, “তাহলে এই কাহিনী কি ভবিষ্যৎ দেখাবে?”
“বুঝতে পারছি না, অমল, কিন্তু মনে হচ্ছে আমার লেখায় একটা অশান্তির আভাস, সেটা আগেও ছিল এখনও আছে। এই দেশের টাল-মাটাল অবস্থা কখনও দূর হয় নি।”
“আমি কি আপনার লেখা পড়তে পারব?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“নিশ্চয়, অমল, তবে তুমি তো দেখেছই ঐ ঘরে ঢুকলে শরীরের ওপর চাপ পড়ে, চেষ্টা করে দেখতে পার।”
৪.
পরের দিন আমি বেশ সকাল সকাল হাজির হই। নিস্তার ভাই আমাকে নিয়ে ঘরটায় ঢোকেন, মনে হল প্রথম দিনের মত অত প্রতিক্রিয়া হল না। আমি একটা কাগজের স্তম্ভ থেকে সবচেয়ে ওপরের পাতাটা নিয়ে পড়তে শুরু করি, নিস্তার ভাই আমাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসিয়ে সূর্যের আলো যাতে ঘরটায় ঢুকতে পারে সেই ব্যবস্থা করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
“পৃষ্ঠা ৬,৪৪৪
আপাতঃদৃষ্টিতে মানুষের দেহকে খুবই দুর্বল মনে হলেও তার দেহের গঠন কাশগাছের মতই নমনীয় আবার লোহার মত কঠিন। আমি একটি বিশেষ ধরণের কন্টকারীর পাতা খুঁজছি বহুদিন ধরে,’ চক্রপাণি ভূর্যপত্রে একটি মসীমাখা বেতের কলমে লিখলেন, ‘আমার নিশ্চিত বিশ্বাস বেদনার উপশমে কন্টকারী কার্যকরী হবে।’ এই সময়ে বদ্ধ দরজার বাইরে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘আচার্য চক্রপাণি দত্তকে রাজসভায় তলব, মহারাজ নয়পালের সমূহ প্রয়োজন।’ চক্রপাণি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, চিকিৎসাসংগ্রহ বইটি তাঁর জীবদ্দশায় আর শেষ হবে না…।”
আমি ধীরে ধীরে সেই লেখায় হারিয়ে যাই, আমি হয়ে উঠি চিকিৎসক চক্রপাণি, রাজা নয়পাল, বিগ্রহপাল। কতক্ষণ ধরে পড়ছিলাম খেয়াল নেই, চমকে উঠলাম যখন নিস্তার ভাই আমার কাঁধে নাড়া দিয়ে বলছেন, “অমল, অমল, ফিরে এসো।” চারটা ঘন্টা কোথা দিয়ে কীভাবে চলে গেল জানি না, পাল বংশের ততদিনে পতন হয়েছে।
দুপুরে খাবার পর নিস্তার ভাই আমাকে আর সেই ঘরে ফিরে যেতে দেন না। বললেন, “ঐ ঘরে বেশীক্ষণ থাকলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।”
আমি একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। জিজ্ঞাসা করি, “কিন্তু, কীভাবে, কীভাবে এটা সম্ভব? আপনি কি আয়নাগুলো পরীক্ষা করে দেখেছিলেন?”
নিস্তার ভাই বললেন, “ভাল করে দেখিনি, অমল, ভাল করে দেখতে গেলে খুলতে হবে, কিন্তু খুললে যদি
সেগুলো আর কাজ না করে। যেদিন আমি এই মহাউপন্যাস শেষ করবো সেদিন খুলবো।”
আয়না কোনো ক্যামেরা নয় যে সে ছবি ধারণ করে রাখবে। কিন্তু এমন যেন চারটি আয়নার প্রতিফলনে আলোক রশ্মির ব্যতিচার ঘটছে, সেই ব্যতিচার প্রতিটি আয়নায় রেকর্ড করেছে অতীত।
এর দুদিন পরে ঐ বাড়িতে গিয়েছি, সন্ধ্যা হয় হয়। নিস্তার ভাই দরজা খুললেন, মুখে উত্তেজনা, আমার হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিলেন, বললেন, “অমল, আমি বর্তমান পার হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সামনে মনে হয় খুব খারাপ দিন আসছে।”
এর মধ্যেই বছর পঞ্চান্ন বছর বয়স হবে এরকম একজন নারী ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। একটা সাদামাটা শাড়ি পড়া, মুখের আদল একেবারে নিস্তার ভাইয়ের মত। আমার দিকে খুবই সন্দেহের চোখে তাকালেন। কোনো ধরণের সম্বোধন করলেন না, তারপর নিস্তার ভাইকে বললেন, “ভেতরে আইস, কথা আছে।”
ধারনা করলাম এটা নিস্তার ভাইয়ের ছোট বোন, ওনার কথা শুনেছিলাম, ময়মনসিংহ থাকেন। আমি ভেতরের ঘর থেকে চাপা স্বরে দুজনের কথা শুনি। নিস্তার ভাই মিনিট পাঁচেক পরে বের হয়ে এলেন। একটু আগের উৎসাহ উদ্দীপনা সব চলে গেছে। উনি বললেন, “অমল, তুমি এখন এস, আমাদের কিছু পারিবারিক কাজ আছে।”
আমি খুব দমে গেলাম, আহত হলাম। নিজেকে এই বাড়ির সদস্য ভাবতাম। কী হল যে নিস্তার ভাই আমাকে বিদায় দিয়ে দিচ্ছেন? আমি বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি আপনার বোন?” নিস্তার ভাই উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমার বোন নুসরা, আজই ময়মনসিংহ থেকে এসেছে।”
কী এমন পারিবারিক কাজ হতে পারে যেটা আমার সামনে করা যাবে না? আর মাঝখান থেকে নিস্তার ভাইয়ের শেষ লেখাটা সম্বন্ধে শোনা হল না। পরদিন যখন সেই বাসায় গেলাম আকাশ দরজা খুলল, আমি বসতে না বসতেই বলল, “অমলদা, বীথির বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
আমার কথাটা বিশ্বাস হল না, কিন্তু আকাশ যা বলে ভেবে চিন্তে বলে। আমি নুসরা বেগমের ঢাকা আগমনের রহস্য যেন উদ্ঘাটন করতে পারলাম।
“ছেলেপক্ষ কাল রাতে বীথিকে দেখতে এসেছিল,” আকাশ বলল।
এখন বোঝা গেল কেন আমাকে গতকাল সন্ধ্যায় এত দ্রুত বিদায় দেয়া হল।
আমি সোফায় বসলাম। আকাশকে বললাম, “কিন্তু বীথি মাত্র ১৬ পেরিয়েছে, ও তো একটা বাচ্চা, ওর তো অনেক কিছু করার আছে।”
নিস্তার ভাই ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন, ওনার মুখে একটা দোষী ভাব। আমার শেষ কথাটা শুনেছেন। বললেন, “একটা ভাল ছেলে পাওয়া গেছে, অমল, এখন বিয়ে না দিলে ফসকে যাবে।” আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে, পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ গ্রন্থের লেখক এই কথা বলছেন, নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ এই ভাবে নষ্ট করছেন! আলোর ভাষা যিনি পড়তে পারেন তাঁর কাছ থেকে আমি এটা আশা করি নি। অনেক কষ্ট করে বললাম, “আপনারা বীথির মতামত নিয়েছেন।”
নিস্তার ভাই কিছু বললেন না, মুখ দেখে মনে হল বলতে চাইছেন এখানে বীথির মতামতের কোনো মূল্য নেই। বললাম, “বীথি কোথায়, ওকে একটু ডাক দিন।”
কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বীথির সঙ্গে আমার দেখা হল না। যেমন দ্রুত আমি নিস্তার মোল্লা পরিবারের সদস্য হয়েছিলাম, তেমনই দ্রুত আমার সদস্যপত্র খারিজ হয়ে গেল। বীথির সঙ্গে পরদিন আমার দেখা হয়েছিল, বুঝেছিলাম তার এতে মত না থাকলেও বাবা ও ফুফুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবার মত তার শক্তি নেই। আকাশ বিয়ের ঘোরতর বিরোধী ছিল, কিন্তু শক্তিশালী নুসরা বেগম ও তার পরিবারের প্রভাবকে আটকানোর ক্ষমতা তার ছিল না। শেষ পর্যন্ত বীথির বিয়েটাও আমি হয়ত মেনে নিতাম কারণ নিস্তার ভাই যে মহাভারত রচনা করেছেন তার যবনিকা কী হতে পারে সেটা দেখতে আমি আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিন নুসরা বেগম নিস্তার ভাই আর আকাশের সামনে আমাকে বীথির সঙ্গে আমার প্রেম আছে এবং সেই জন্য এই বিয়েতে বাগড়া দিতে চাইছি এরকম একটা ইঙ্গিত করলেন। বীথি আমার ছোট বোন ছিল, তার ভবিষৎ যাতে মঙ্গলের হয় তাই ছিল আমার কাম্য। ঐদিনই ছিল কেশব ব্যানার্জির বাড়িতে নিস্তার ভাই থাকতে আমার শেষ যাওয়া।
এর কয়েক দিন পরে আকাশ খুঁজে খুঁজে আমার তাঁতি বাজারের বাসাটা বের করে, তার হাতে ছিল নিস্তার ভাইয়ের একটা চিঠি, চিঠিতে লিখেছিলেন যে তিনি এখন ভবিষ্যতে, যে ভবিষ্যৎ তিনি লিখছেন তা ভয়াবহ। আমি যেন পারলে একবার আসি।
কিন্তু নিস্তার ভাইয়ের বাড়িতে আমার আর যাওয়া হল না, চিঠি পাবার পরদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হল। আমি ঢাকা ছেড়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। চার মাস পরে জেল হত্যাকাণ্ড হল, তাজুদ্দিন, খালেদ মোশাররফ মারা গেলেন, আমার ঢাকা আসা আরো পিছিয়ে গেল। ১৯৭৬য়ের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ফিরে আমি কেশব ব্যানার্জির বাড়িটাতে যাই, কিন্তু পরিচিত কাউকে পাই না। সেখানে অন্য ভাড়াটিয়া ছিল, তারা নিস্তার ভাইয়ের পরিবার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারল না। আমি ওনাদের অনেক অনুরোধ করে সেই আয়নার ঘরটি দেখতে পেরেছিলাম, নতুন লোকেরা সেটাকে একটা শোবার ঘরে পরিণত করেছিল, দুটো বিসদৃশ খাট, একটা সাধারণ কাঠের টেবিল, দেয়ালে ক্যালেন্ডার। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম সেই ঘরে কোনো কাগজপত্র ছিল কিনা। না, তারা এই ঘর খালিই পেয়েছে।
নিস্তার ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হল না, আকাশ আর বীথি কেমন আছে তাও জানা হল না। নিস্তার ভাইয়ের মহাগ্রন্থের কী হল সেটাও অজ্ঞাত রয়ে গেল।
৫.
এর পর বহু বছর কেটে গেল। ১৯৭৬ সনের সেপ্টেম্বরে আমি একটা বৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় রসায়ন পড়তে চলে যাই, তারপর সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোস্টড্ক হয়ে আসি। আমি মার্কিন দেশেই চাকরি নিয়ে থেকে গেলাম বোস্টনের কাছে। উত্তর অক্ষাংশের গ্রীষ্মের সবুজ, হেমন্তের পাতা ঝরা আর শীতের তুষারে সময় চলে গেল। এভাবে ২০ বছর কেটে গেল।
একরাতে স্থানীয় এক বাঙ্গালি পরিবারের বাড়িতে আমন্ত্রিত হলাম, সেখানে আরো পনেরো-ষোলজন লোক ছিল। সেই সন্ধ্যায় অপরিচিত অত লোকের মধ্যে আমার বলার কিছু ছিল না যদিও গৃহকর্তা নাজমুল সাহেব খুব অমায়িক লোক ছিলেন। গৃহকর্ত্রী অন্যান্য মহিলাদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন, ওনার নামটা জানা হল না। খাওয়া-দাওয়ার পরে আমি আগেই বিদায় নেবার জন্য উঠলাম, নাজমুল সাহেব অন্যদিকে ব্যস্ত ছিলেন, গৃহকর্ত্রীর কাছে যেয়ে বললাম, “সব খুব ভাল হয়েছে, আমি আজকে যাই।” উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি এখনো টেলিভিশন সারাই করেন?”
কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। বীথি আমাকে কখনই আপনি করে সম্বোধন করে নি। দেখলাম বীথির সংসার ভালই হয়েছে, ছেলে মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, নাজমুল সাহেবও ভাল লোক বলে মনে হল। বীথির বিয়েতে আমার আপত্তি ঠিক ছিল না। এগুলো ভাবতে আমার তিন সেকেন্ডের বেশী সময় লাগে নি। বললাম, “বীথি?” কিন্তু এর পরে কী বলব ভেবে পেলাম না। বীথি বলল, “দাদা, আপনাকে আমি ফোন করব।”
অনেক কিছু জানার ছিল, কিন্তু সেখানে অত লোকের মাঝে আর দাঁড়ানো সমীচীন ছিল না, আমি বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিলাম। কেন বীথিকে প্রথম দেখেই চিনতে পারি নি সেটা নিয়ে আমি পরে অনেক ভেবেছি।
এর পরদিন বীথি ফোন করেছিল, আমাদের একটা ক্যাফেতে দেখা হয়েছিল। বীথিকে বললাম, “আমাকে আপনি করে বলো না।” বীথি বলেছিল ১৯৭৫য়ের সেপ্টেম্বর মাসেই তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের খরচ তুলতে ঐ আয়নাগুলো বিক্রী করে দেয়া হয়, এটা কিছুটা নুসরা বেগমের চাপেই হল, তিনি নিস্তার ভাইয়ের লেখাকে ছাইভস্ম ভাবতেন। এদিকে নিস্তার ভাই ভেবেছিলেন তাঁর কাহিনী লেখা শেষ হয়ে গিয়েছে, এখন আর আয়নাগুলো দরকার হবে না। কিন্তু দেখা গেল আয়নাগুলো ঘর থেকে সরিয়ে নেবার পরে যা এতদিন সবাই ভেবেছিল একটা বিশ্বসাহিত্য পর্যায়ের মহাউপন্যাস সেটা আসলে কিছুই না, কোনো পাতারই কোনো মানে করা গেল না, কিছু অর্থহীন বাক্য লেখা, কিছু পাতায় আবার তাও না, সব বর্ণমালা ওলোট-পালট করে লেখা।
বীথি বলল, “আসলে আব্বু কখনই সেরকম কিছু লেখেন নি, ওপরদিকে কয়েকটা পাতার অর্থোদ্ধার করা গেলেও বাকি সবকিছু একেবারেই পাগলের প্রলাপ ছিল- সব সময়ই।”
আমি জোরে মাথা নেড়ে বললাম, “সেটা একেবারেই ঠিক কথা নয়, বীথি।”
বীথি বলল, “তোমার মত আব্বুও নিঃসন্দেহ ছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে, আয়নাগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে চাইলেন, কিন্তু সেগুলো কেনার মত টাকাও ছিল না, আর দুটো আয়নার হদিশ মিললেও অন্য দুটির খবর পাওয়া গেল না। উনি প্রায় পাগল হয়ে গেলেন, ১৯৭৬য়ের জানুয়ারী মাসে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেলেন। এদিকে আকাশ সবার ওপর রাগ করে, তারও আমার বিয়েতে মত ছিল না, সে ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে গেল। দু বছরের মধ্যে কেমন করে যেন জার্মানী চলে গেল।”
বীথি তার শ্বশুরবাড়িতে একা হয়ে গেল (শ্বশুরবাড়ি কোথায় ছিল সেটা আমার জানা হল না)। সেখানে সবাই বীথিকে খুব মানসিক নির্যাতন করত (বিয়েতে আমার আপত্তি তাহলে ঠিকই ছিল)। বছর দুয়েক বাদে নিস্তার ভাইয়ের স্ট্রোক হয়ে আংশিক পক্ষাঘাত হল। বীথি শ্বশুরবাড়ির আপত্তি উপেক্ষা করে গ্রামে চলে গেল বাবার সেবা করার জন্য। সেই তার শ্বশুরবাড়িতে শেষ থাকা। বাবা দুবছর পরে মারা গেলেন। এর মধ্যে বীথির স্বামী আর একটা বিয়ে করে, তবে বীথির সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদে সে বাধা দেয় না। বীথি নিজের চেষ্টায় আবার ঢাকা ফিরে এসে একটা হোস্টেলে থেকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করে। কয়েক বছর পরে নাজমুল ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হবার পরে আমেরিকায় আসে। আকাশ এখনো জার্মানীতে, তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।
কিন্তু বীথি এখন একটি মেয়ে ও একটি ছেলের মা, সরকারি একটা কাজও করছে। এখানে তার নতুন বন্ধু হয়েছে, সমাজ হয়েছে। সপ্তাহান্তে পঞ্চাশজন লোককে ডেকে খাওয়ায়, বৈশাখী মেলা করে, ছেলে-মেয়ে-স্বামীকে নিয়ে ইউরোপে বেরাতে যায়।
বীথি এক নাগাড়ে প্রায় আধ ঘন্টা কথা বলে গেল। আমি শুনলাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আর লেখাগুলি, নিস্তার ভাইয়ের কাগজগুলি কোথায়?” বীথি বলল, “আব্বু দেশের বাড়ি চলে যাবার পরে, কেদার ব্যানার্জির বাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়, তখন ঐ কাগজগুলি সের দরে বিক্রী করে দেয়া হয়।” আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। “কী বলছ বীথি? ঐভাবে ওনার লেখাগুলো ফেলে দিলে?”
“ওনার লেখা বলো না, অমলদা। ঐ পাতাগুলো ছিল নিতান্তই শিশুর প্রলাপ, মাঝেমধ্যে শুধু বর্ণমালা লেখা।”
“তুমি কি সব পাতা পড়ে দেখেছিলে, বীথি? আমি কয়েক হাজার পাতা পড়েছি, ওরকম ঐতিহাসিক উপন্যাস পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি হয় নি।”
“তোমার এখন তাই মনে হচ্ছে, দাদা। কিন্তু আসলে তুমি একশো পাতাও পড়ো নি। আর যে কটা যেভাবে পড়েছ শুধুমাত্র হয়তো সেগুলোরই কিছু অর্থ ছিল।”
আমি বললাম, “কিন্তু আয়নাগুলো সরিয়ে নেবার পরই নিস্তার ভাইয়ের মনে হয়েছিল তার অনুপ্রেরণা চলে গিয়েছে, আর তার লেখারও অর্থোদ্ধার করা যাচ্ছিল না। ঐ আয়নাগুলোর প্রতিফলনে তোমার মনে হয় না অতীত আবদ্ধ ছিল?”
বীথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি কি বল? এটা কি আদৌ সম্ভব?”
লেজারের ব্যতিচার দিয়ে তথ্যকে সিডি জাতীয় জিনিসে লিখে রাখা যায়, একই ভাবে তার পাঠোদ্ধারও করা যায়, কিন্তু প্রাচীন আয়নায় সূর্যের আলোতে এসব সম্ভব হবে কেমন করে?
“না, সম্ভব নয়,” আমি মেনে নিই বীথির কথা। “কিন্তু আমার মনে পড়ে নিস্তার ভাই বলেছিলেন ভবিষ্যৎ আশঙ্কামূলক, এর কয়েকদিনই পরেই শেখ মুজিব নিহত হন।”
বীথি ডান হাত নিজের কপালে রাখে, আমার কথা শুনে সে যেন হাসবে না কাঁদবে বুঝে পায় না, বলে, “তুমি জান অমলদা ঘটনাস্রোত কখনই এভাবে প্রবাহিত হয় না।”
বীথি ঠিকই বলেছে, আমি তার কথাকে খণ্ডাতে পারি না। বীথি তাঁর বাবার সৃষ্টিকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছে, আমার স্মৃতিতে সেই সৃষ্টি চিরদিনের জন্য গাঁথা। বীথির স্মৃতির পৃথিবীর সঙ্গে আমার পৃথিবীর মিল নেই।
আমি ভেবেছিলাম বীথি অনুযোগ করবে কেন আমি তাদের আর একটু খোঁজ করি নি, কিন্তু সে সেরকম কিছুই বলল না। সেই ক্যাফেতে দেখা হবার আর একদিন মাত্র বীথির সঙ্গে দেখা হয়। ওদের বাড়িতেই। এর একটি বড় দাওয়াত পার্টিতে, সেখানে গোটা পঞ্চাশেক লোক ছিল, ভুলে গেছি কী উপলক্ষে এত লোক ডেকেছিল, হয়তো কোনো উপলক্ষে নয়। সেদিন তাদের বাড়ির আর একটা ঘরে দেখলাম হলুদ কাপড়ের ওপর লাল সুতায় খনার বচনটা কালো ফ্রেমে শোভা পাচ্ছে। ভাবলাম, যাক, কেশব ব্যানার্জির একটা জিনিস অন্ততঃ বীথি রক্ষা করতে পেরেছে। লেখাটা ছিল –
চৈত্রে চালিতা, বৈশাখে নালিতা, জৈষ্ঠে দই, আষাঢ়ে খই
শ্রাবনে ঘোলপান্তা, ভাদ্রে তালের পিঠা, আশ্বিনে শশা মিঠা, কার্তিকে কইয়ের ঝোল,
অঘ্রাণে ওল, পৌষে সংক্রান্তি, মাঘে তেল, ফাল্গুনে গুর,আদা,বেল ।
আমি অনেকক্ষণ ধরে লেখাটা দেখলাম। কতকাল আগে সেটা দেখেছি, মনে হল পুরানো বন্ধু। তারপর মনে হল এই লেখাটায় যেন কিছু গরমিল আছে। কেশব ব্যানার্জির বাসায় লেখা ছিল কার্তিকে ওল, অঘ্রাণে খৈলসার ঝোল। এই লেখাটায় দেখি কার্তিকে কইয়ের ঝোল আর অঘ্রাণে ওল। আর ওখানে লেখা ছিল ফাল্গুনে পাকা বেল, এখানে লেখা ফাল্গুনে গুর, আদা, বেল। পৌষে লেখা ছিল কানজি যার অর্থটা আমি পরে জেনেছিলাম, আর এখানে পৌষে লেখা আছে সংক্রান্তি। আর সংক্রান্তি তো অন্যগুলোর মত কোনো বস্তু নয়। আরো কিছু ওলোট-পালোট আছে কিনা ধরতে পারলাম না। বীথির ব্যস্ততা একটু কম হলে ওকে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম এই খনার বচনটাই কেশব ব্যানার্জির বসার ঘরে বাঁধানো ছিল কিনা। বীথি বলল, “হ্যাঁ।” আমি ওকে বললাম, “কিন্তু, এর মাঝে দু-একটা কথা ওটার সঙ্গে মিল খাচ্ছে না।” বীথি বলল, “তোমার কি আর অত খেয়াল আছে?” এই বলে চলে গেল অতিথি সেবা করতে।
সেদিনও একটু আগেই বিদায় নিয়েছিলাম। বিদায়ের আগে বীথি আমাকে একটা বড় খামে ভরা কাগজ দিয়ে বলেছিল, “আব্বুর এই লেখাটাই শুধু বেঁচেছে, বাইরের ঘরে কফি টেবিলের ওপর ছিল। পড়ে দেখো।”
বীথি আমার ছোট বোন ছিল, কিন্তু মাঝখানে ২০টা বছর কেটে গেছে। পৃথিবীতে এর মধ্যে কত মানুষ জন্মেছে, কত মানুষ মারা গেছে, পৃথিবী বদলেছে। বীথিও বদলেছে, আমিও। বীথির ওপর দাদা হিসাবে আমার দাবি এই নতুন পৃথিবীতে চলবে না। হয়তো ওর ওখানে আর না যাওয়াই ভাল। লেখাটা পড়ে ডাকে পাঠিয়ে দেব ভাবলাম।
সেই রাতে বীথির বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি পাহাড়ে গাড়ি নিয়ে উঠি। এখানে একটা ছোট পার্ক আছে, তার একটা বেঞ্চে বসে শহরের আলো দেখি নিচে। দিনের অল্প উষ্ণতা খুব দ্রুত উবে গিয়ে ঠাণ্ডা পড়ছে, শহরের আলো শিহরিত থাকে উষ্ণ-শীতল বাতাসের আন্দোলনে, ঝিকমিক করে।
গাড়ি থেকে বীথির দেয়া খামটা নিয়ে আসি। টর্চের আলোয় পুরোনো একটা দেশী পাতা বের করি, তাতে নিস্তার ভাইয়ের পরিচিত হস্তাক্ষর। আমি পড়ি,
“পৃষ্ঠা ৫,৮৮৯
গতিতে বাঁশের ভেলাটি ঘূর্নীর আবর্তে ঘুরতে থাকে, গোপাল বুঝতে পারে না সে জলে ঝাঁপ দেবে নাকি ভেলার দড়ি ধরে ভেলার সাথে মিশে থাকবে। দড়ি শক্ত করে ধরে সে টানটান হয়ে ভেলায় শুয়ে পড়ে। চক্রাবর্তের ধার দিয়ে ভেলা যায়, কিন্ত জল তাকে গভীরে টেনে নিতে পারে না। নিরাপদ ভেলা ভেসে যায় দক্ষিণে স্রোতে। আত্মসমর্পণ করা গোপালের চরিত্রে নেই, যেমন সে আত্মসমর্পণ করে নি নৃপতি মহাশাসনের কাছে …”
২০ বছর আগে আমি একটা লেখা পড়েছিলাম, সেখানে রাজা গোপাল জলের আবর্তে নদীর তলদেশে চলে গিয়েছিলেন ওপরে ওঠার আগে। সেখানে তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন মহাশাসনের কাছে। এই নতুন পৃথিবীতে গোপালের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হয়েছে। সেখানে আয়নাগুলো বেচে দেবার পরে শুধুমাত্র এই পাতাটাই পৃথিবীতে তার অর্থ নিয়ে থেকে গেছে, বাইরের ঘরে কফি টেবিল থেকে তাকে আর সরানো হয় নি বলে।
এই নতুন পৃথিবীতে নিস্তার ভাইয়ের বিশাল উপন্যাস হযবরল অক্ষরসমূহে পরিণত হয়েছে, কেশব ব্যানার্জির খনার বচন বদলে গেছে, বীথি গৃহস্বামিনী হয়েছে, তাকে আমি প্রথম দর্শনে চিনতে পারি নি, তাকে বীথি নামে এখানে কেউ চেনে না। এই পৃথিবীতে দাদার কাছে তার কোনো দাবি নেই, কোনো অনুযোগ নেই।
পৃথিবীটা কখন বদলালো ভাবি। সেটা কি যেই মুহূর্তে নিস্তার ভাইয়ের বোন নুসরা বেগমের পদক্ষেপ পড়েছিল কেশব ব্যানার্জির বাড়িতে তখন থেকে? মনে পড়ল নিস্তার ভাই সেদিন খুব উত্তেজনা নিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলেন, কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন, হয়তো তিনি ভবিষ্যৎ দেখেছেন সেটাই বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহাবিশ্বের কার্য ও ফলাফলের মধ্যে একটা সমীকরণ রয়েছে, সেইজন্য আলোর গতির বেশী গতিবেগে আমরা সংকেত আদান প্রদান করতে পারি না, তাই মহাবিশ্ব নুসরা বেগম হয়ে হয়ে নিস্তার ভাইয়ের কথায় বাদ সেধেছিলেন, আমার পুরোনো পৃথিবীর সমাপ্তি সেখানেই হয়েছে।
মহাবিশ্ব ভবিষ্যতে কী হবে সেটা আমাকে জানতে দিতে চায় নি। তাই নুসরা বেগমকে ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে আসতে হয়েছিল। দিনটা কী ছিল মনে করার চেষ্টা করি, ১৯৭৫য়ের ৮ই অগাস্ট। হয়তো নিস্তার ভাই আমাকে শেখ মুজিবের আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে বলতে চেয়েছিলেন। আমার এই অনুমান সত্য কিনা কোনোদিন জানবো না, নিস্তার ভাইয়ের সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি।
তুষার পড়তে আরম্ভ করে। সাদা পেঁজা তুলোর তুষারে পাহাড়ের ঢাল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি ভাবি হয়তো পুরোনো পৃথিবী বদ্লায় নি, আমি ছিটকে পড়েছি এই নতুন বেখাপ্পা পৃথিবীতে। আর যেটাকে বাছতে পারি নি, যেই পৃথিবীতে নুসরা বেগমের আবির্ভাব হয় নি, সেখানে নিস্তার ভাই বিখ্যাত হয়েছেন তাঁর উপন্যাস ছেপে। বীথি আর আকাশ তাদের বাবাকে এই বিশাল কাজে সাহায্য করেছে। তারাও বড় হয়েছে, সুখী হয়েছে, সংসারী হয়েছে, কিন্তু বাবাকে বিখ্যাত করার কাজ থেকে তারা কখনো বিরত হয় নি। অমলও তাদের দাদা হিসাবে থেকেছে। সেই পৃথিবীতে বীথি তার দাদার কাছে আবদার করে, অনুযোগ করে।
সেই রাতে কী একটা স্বপ্ন যেন আমার দেখা উচিত এই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্নটা ঠিকই আসে মাথায়। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বাগান, একদিকে বাঁধানো খুবই ছোট পুকুর, তাতে জলপদ্ম। অপেক্ষা করি, কিন্তু লম্বা সাদা পোষাক পড়া মেয়েটির দেখা পাই না। আমার হাতে একটা লাল গোলাপ, দেখলাম পুকুরের পারে একটা পাথরের স্মৃতিফলক। ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভাবি কার কথা কে মনে রাখে নি।
পরিশেষ
এই কাহিনীর শেষ এখানেই। আপনি যদি ধৈর্য নিয়ে এতখানি পড়েছেন তাহলে বলব এখন সময় হয়েছে আপনার নামটি আবার উচ্চারণ করার। করুন, লজ্জা পাবেন না। করলেন? এখন বলুন এই কাহিনীর শুরুতে আপনার নামটি কানে যে ভাবে স্পন্দিত হয়েছিল, এবারো কি সেভাবে হল? যদি না হয়ে থাকে তবে এই কাহিনীর মাঝে, কোনো এক সময়ে আপনার পৃথিবী বদলে গেছে, আপনি আজ এটা ভাল করে খেয়াল করতে পারবেন না, কিন্তু আজ থেকে বহু পরে, হয়তো দশ বছর পরে পৃথিবীটাকে অচেনা মনে হলে এই মুহূর্তটা স্মরণ করবেন, হয়তো (আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবো না) আপনার পৃথিবী তখন থেকে বদলে গিয়েছিল। আর আজ যেখানেই থাকুন ভাল থাকবেন।
জ্যোতির্বিদ ও গল্পকার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মোরেনো ভ্যালি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তাঁর চারটি গল্পগ্রন্থ ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।