| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

প্রবন্ধ: বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিয়ানায় নারী । ইশরাত তানিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

ফ্লাইওভার দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। গাড়ি চালাচ্ছে রুবিনা। ফ্লাইওভার থেকে নেমে ডান দিকে ফোয়ারা। বাঁয়ে চোখ ধাঁধানো বিশাল শপিং মল। শপিং মল ছাড়িয়ে গেলে আবাসন প্রকল্পের বড় বড় দালান। এক ছুটির দিনেসেই হাই রাইজ বিল্ডিং এর বিভিন্ন ফ্ল্যাটে উঁকি দিলে দেখা যায়-ইউটিউবে ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ গান শুনছে আরিয়া। গলায় সুর তুলে নিচ্ছে।হয়তো স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে গাইবার জন্য রিহার্সেল। একটু পর পর আদা চায়ে চুমুক। কোনো এক রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে সর্ষে ইলিশের ঘ্রাণ। রান্নার সহকারী চলে যাবার সময় হাতে দুটো আপেল তুলে দিল রত্না। আজ দীপার অফিস নেই তাই রোদে মেলে দিয়েছে সপুরা সিল্কের শাড়ি। অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের বিল দিয়ে এখন ফেসবুকের নোটিফিকেশান দেখছে। একটু পর শুরু করবে ইন্টারন্যাশনাল জুম মিটিং। টিভিতে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে চলছে টক শো…

ঘরে-বাইরে এই কোলাজ দৃশ্য গুলো দৈবচয়ন হলেও প্রতিটি দৃশ্যই চেনা। পরিচিত দৃশ্যগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জানা গেল এসবই নাকি ‘কালচার’ বা ‘সংস্কৃতি’। ফ্লাইওভার থেকে টিভির বিজ্ঞাপন। এর মাঝে কারো হাতে দুটো আপেল তুলে দেয়া আর নোটিফিকেশান দেখাও যদি সংস্কৃতি হয় তাহলে সংস্কৃতি শব্দটার বিস্তৃতির ব্যাপকতা নিয়ে আর প্রশ্ন ওঠে না। বোঝা যায় বস্তুগত আর অবস্তুগত এই দু’ধরনের উপাদান নিয়েই সংস্কৃতি। এ সত্যটিও নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া যায় সংস্কৃতি সমাজের মানুষের জীবনধারার প্রতিফলন। জীবনের সামগ্রিকতা মিলেই সংস্কৃতি।

বস্তুগত সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নির্মিত বস্তুর মাধ্যমে। হতে পারে সেটা ঘরবাড়ি, পোশাক, খাদ্য, স্থাপনা কিংবা যানবাহন।বস্তুগত সংস্কৃতি শুধুমাত্র বস্তুই নয়।বস্তু গুলো সংস্কৃতির ব্যবহারিক ও সৃজনশীল কাজের গভীরতা আর জটিলতা ধারণ করে। সামাজিকভাবে প্রবাহিত জ্ঞান,আচরণ, অনুশীলন, সৃজনশীলতার উৎপাদন এবং ভোগ প্রবণতাকে বস্তু প্রকাশ করতে পারে। এর বাইরেও আছে মানুষের আনুভবিক বা মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে নির্মিত হয় অবস্তুগত সংস্কৃতি। ভাষা, আচার-আচরণ, রুচি, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, ধর্মবিশ্বাস, চিন্তা, জ্ঞান-বুদ্ধি, শিল্পকলা, সাহিত্য, দর্শন অবস্তুগত সংস্কৃতি। একটি সমাজের মানুষ এই দু’ধরণের সংস্কৃতির উপাদানের সামাজিকীকরণ করে আর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই নিজস্ব সংস্কৃতি অর্জন করে।

একেকটি সমাজের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিরও কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। সেখানে রয়েছে নারী ও পুরুষের যৌথ অবদান। বাঙালি সংস্কৃতিতে নারীর কাজ বা অবদান খুঁজে দেখতে হলে আগে দুটো বিষয় সম্পর্কে ধারণার স্পষ্টতা প্রয়োজন। এর একটি বাঙালি সংস্কৃতি আর আরেকটি বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থান। ‘সংস্কৃতি’কে যত সহজে বোঝা যায় সে তুলনায় ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী,নানা শ্রেণির মানুষের সংযোগ, পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। নৃ-তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বাঙালি সংস্কৃতি একটি জটিল রূপরেখা। বাঙালি সংস্কৃতির বয়স আটশ’ থেকে হাজার বছর কিন্তুতারও হাজার হাজার বছরের পুরনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করেএই সংস্কৃতির গড়ে ওঠা। বঙ্গভূমির ভৌগোলিক অবস্থান আর বিভিন্ন সংস্কৃতির পরস্পর-বিরোধী উপাদানের সহাবস্থান আর সমন্বয়ে বাংলা সংস্কৃতি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে।বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার ফল এইবাঙালি সংস্কৃতি। আজকের বাঙালিয়ানা।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন- ‘বাঙালিয়ানার অর্থ এই যে, বাংলার যা ভালো তাহা ভালো বলিয়া জানা, আর যাহা মন্দ তাহা মন্দ বলিয়া জানা।’ জানাটা প্রত্যেক বাঙালির দরকারি কাজ এবং জানাটা কেমন করে সম্ভব সেটাও তিনি বলে দিয়েছেন। ‘জানিতে হইলে বুদ্ধিপূর্বক বাংলা দেশটা কী দেখিতে হইবে, বাংলায় কে থাকে দেখিতে হইবে, বাংলার আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি, সমাজ-সংসার, উৎসব-আনন্দ, দুঃখ-শোক, কুস্তি লাঠিখেলা, টোল পাঠশালা দেখিতে হইবে। ইহার গান গীতি, পয়ার পাঁচালী, নাচ খেমটা, কীর্তন ঢপ যাত্রা কবি সব দেখিতে হইবে। মন প্রাণ দিয়া দেখিতে হইবে। আবার এখনকার কালে যাহা যাহা বদলাইতেছে, তাহাও দেখিতে হইবে। খবরের কাগজ, মাসিক পত্র, কনসার্ট, থিয়েটার, ইস্কুল, কলেজ, আপিস, আদালত সবই দেখিতে হইবে। বাংলার এবং বাঙালি জাতির সমস্ত জীবনটা ভালো করিয়া দেখিতে হইবে, তবেই তুমি বাঙালি হইবে।’ বাঙালিয়ানাকে খুঁজতে গিয়েই দেখা গেলোবাঙালি সমাজ আগাগোড়াই পিতৃতান্ত্রিক। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ধর্মবিশ্বাস, শিক্ষা, শিল্পসাহিত্য, সঙ্গীত, উৎসব, খেলাধূলা, জীবিকাসহ সমাজের সর্বত্র পুরুষের প্রভুত্ব স্থাপিত হয়েছে এবং নারীর অবস্থান নির্ণীত হয়েছে দাসত্বে। প্রাচীন যুগ থেকে সামন্তযুগ পর্যন্ত নারী-পুরুষের সম্পর্ক মালিক-ক্রীতদাস পর্যায়েই ছিল। লাগাতার শাস্ত্রের শাসন নারীকে অধস্তন করে রেখেছিল। এখনও অব্দি অসমতার কাহিনী ফুরায়নি। সর্বস্তরে নারীর অধিকার, চিন্তা-ভাবনা, মেধা ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে রাধিকাকে নদী পার করতে কানাই মাঝি রাধিকার ষোলআনা উসুল করে নিয়েছিল। নারীর সাথে পুরুষের ছলের এই নমুনা আজও বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থানকে ব্র্যান্ডিং করছে।

সময় থেমে থাকে না। বাঙালিত্ব বিশেষ করে আধুনিক কালে বাঙালি সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে নারীর হাত ধরে। বিনোদবেণী বাঁধা চুলের শাড়িসুন্দরী থেকে হাল আমলের অ্যাথলিট কন্যার ছাঁটা চুল আর ট্র্যাক স্যুটের বিবর্তন রাতারাতি হয়নি। বিশ্বায়নের প্রভাব, প্রযুক্তির উন্নতি, নারী শিক্ষার বিস্তার আর নারীর ক্ষমতায়নের ফলে পৌরাণিক দ্রৌপদীর রন্ধন গুণের সাথে নারীর আকাশে প্লেন উড়িয়ে নেয়ার গুণ যুক্ত হয়েছে। যা বাঙালি নারীর সংস্কৃতি সংস্করণের মানসিকতার প্রকাশ। বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে নারীর বিবর্তন ঘটেছে ব্রিটিশ রাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে। উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বাংলা রেনেসাঁর উদ্ভব হয় কলকাতায়। বঙ্গদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটালেও অনেকেই বাংলায় ‘রেনেসাঁ’ শব্দটি বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য মতে রেনেসাঁ সমাজের সব স্তরকে প্রভাবিত করে। কিন্তু বঙ্গীয় রেনেসাঁ অর্থনীতি, রাজনীতি, উৎপাদন ব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন আনেনি। তবুও অস্বীকার করা যায় না উনিশ শতকের মাঝামাঝি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাচীন আর আধুনিক জ্ঞান আহরণ করে কলকাতা মহাবিদ্যাপীঠে পরিণত হয়। সে সময় নতুন বাংলা গদ্যভাষা ও নতুন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি হয়। ভারতের স্বর্ণযুগ নামে আখ্যায়িত ধ্রুপদী যুগের পুনরাবিষ্কার হয়। ভারতীয় বিদ্বানরা নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থানের সাথে প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন সম্পর্কে নতুন ব্যাখার মিল খুঁজে পান। বিশ্ব প্রগতি সম্পর্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ধারণায় উপনীত হন। ধর্ম সংস্কার ও সমাজ সংস্কারের সে ধারায় বিশ শতকের শুরুতে বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, উপপত্নীত্ব, সতীদাহ, অবরোধপ্রথা বিলোপ হয়। একই সাথে বিধবাবিয়ে, নারীশিক্ষা ও নারী মর্যাদা অর্জনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে সমাজে নারীর অবস্থান বিবর্তিত হয়।

ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রাহ্ম-নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘ব্রাহ্মিকা’ সমাজ। সেখানে সনাতনী হিন্দু নারীত্বের আদর্শ নতুনভাবে নির্ধারিত হয়। ‘নবগার্হস্থ্য’ আদর্শের উত্থান ঘটে এবং নারীর আধুনিকায়ন শুরু হয়। ‘কল্যাণী’ ধারণায় নারীকে অন্নদানকারী, অভিভাবক, গৃহদেবীর সংরক্ষক, নীড়রচয়িতা বলা হলেও পুরুষই পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রধান ক্ষমতাবান ব্যক্তি আর পরিবারের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে নারী। কর্তার সংসারে ভাঁড়ার সামলানো, রান্না করা, ধর্মাচার পালন, দাস-দাসী আর শিশুদের দেখা-শোনার কাজের অবসরে নারীরা সেলাই করত, পুঁথি পড়ত, গল্প করত। জন্মদিন, বিয়ের উৎসবসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। এই ছিল বাঙালি নারীর বিনোদন সংস্কৃতি। বাংলার হিন্দু নারীরা শারদোৎসব, দোলপূজা ছাড়াও বারো মাসে তের পার্বণে আমোদিত হবার সুযোগ পেত। বাংলায় মুসলমান আগমনের পর নারীর বিনোদন অনেক ক্ষেত্রেই সংকুচিত হয়। এটাও সত্য যে বাংলায় ইসলামি সংস্কৃতি চিরায়ত বাঙালিয়ানার সাথে মিশে গিয়েছিল। কঠিন পর্দা প্রথা বা কঠোর বিধিবিধান কোনো কালেই বাঙালি মুসলমান সমাজে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। তাই মুসলীম নারীরা বিনোদন চর্চায় ধর্মীয় অনুশাসনে শাসিত হতো না। বিয়ে-শাদীর মতো অনুষ্ঠানে নারীরা অংশগ্রহণ করতো। অপ্রকাশ্যে বিভিন্ন মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। বিশ শতকের শুরুর দিকেও ঘর-বারান্দা-উঠান জুড়ে ছিল অন্দরমহল। নারীর অবস্থান ছিল এই চৌহদ্দির ভেতরে। ‘অবরোধবাসিনী’তে বেগম রোকেয়া এই অন্দরমহলকে নারীর একমাত্র জগৎ বলেছেন।

বাংলার নারী জাগরণের প্রথম ক্ষীণ আলোটি দেখা যায়মধ্যযুগে। কবি চন্দ্রাবতীর পালা গীতি থেকে সেই সত্যতা মেলে। ষোল শতক থেকেই কবি চন্দ্রাবতীর পালা আর গীত ময়মনসিংহের ঘরে ঘরে পঠিত হয়েছে। চন্দ্রাবতী রচিত ‘মলুয়া’র পালায় সাত ভাইয়ের এক বোন মলুয়া সুন্দরী কলসি নিয়ে জল ভরতে ঘাটে যায়। এক ঘুমন্ত পুরুষের রূপমুগ্ধ মলুয়ার সহজাত অনুভব- ‘ভিন দেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতন/ লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন।’ মধ্যযুগের নেপথ্যচারিণী নারী অনুভবের এমন অকপট উচ্চারণে বিস্মিত হতে হয়। কারণ সে যুগে নারীর প্রেম ছিল পাপতুল্য। সেই বিস্ময়কে চূড়ান্তে পৌঁছে দেয় চন্দ্রাবতীর আরেক অসামান্য কীর্তি ‘রামায়ণ’। রাম নয় সীতার বয়ানে রামায়ণের গল্প। নবনীতা দেবসেন চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে ‘সীতায়ণ’ বলেছেন। মধ্যযুগের ধর্মীয় ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক নারী রামায়ণের ডিসকোর্স বদলে দিল। উনিশ শতকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যে দৃষ্টিভঙ্গির যে বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন এর প্রায় তিনশ বছর আগে প্রাচীন কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণের বিনির্মাণ করেছেন। আরো উল্লেখ করা দরকার যে,ষোল শতকেই কবি রহিমুন্নিসা ‘পদ্মাবতী’ পুঁথি রচনা করেছেন।

১৮৫৬ সালে বাংলা সাহিত্যে প্রথম বাঙালি নারী কবি কৃষ্ণকামিনী দাসীর কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তবিলাসিনী’ প্রকাশিত হয়। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় রাসসুন্দরী দেবীর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’। ১৮৭৬ সালেপ্রকাশিত হয় নবাব ফয়েজুন্নেসা চৌধুরাণী রচিত ‘রূপজালাল’। এটি বাঙালি মুসলমান নারীর লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। কবিতা ও গদ্যের সংমিশ্রণে রচিত ‘রূপজালাল’ প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। একই বছর কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘দ্বীপনির্বাণ’। এটি ছিল বাঙালি নারী লিখিত প্রথম উপন্যাস। নবাব ফয়জুন্নেসা ছিলেন নারী শিক্ষার পথিকৃৎ। ১৮৭৩ সালে মেয়েদের জন্য তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকেই নারীশিক্ষা প্রসঙ্গটি প্রসার পায়।

এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী লেখক বেগম রোকেয়া। সাহিত্যের এমন কোনো মাধ্যম নেই যাতে তিনি বিচরণ করেননি। ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসিকায় সার্থক ইউটোপিয়া রচনা করেন। কল্পনা শক্তি দিয়ে ‘নারীস্থান’ নামের এক স্বপ্নরাজ্য সৃষ্টি করেন। যেখানে নারীর অবস্থান ঘরের বাইরে আর পুরুষ ঘরের ভেতরে। সমাজে নারী-পুরুষের প্রচলিত ভূমিকা থেকে সরে ‘রিভার্স রোল’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি এই উপন্যাসিকা রচনা করেন। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদী নারীবাদী সাহিত্যের আদিতম উদাহরণ ‘সুলতানার স্বপ্ন’। বেগম রোকেয়া সমাজে নারীশিক্ষার মতাদর্শ প্রচার করেন। ১৯১১ সালে কলকাতায় ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে নারীকে একজন ভাল মা, গৃহিনী বা সঙ্গী হিসেবে তৈরি করার পাশাপাশি তিনি নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেছেন। এখানেই তাঁর চিন্তা-ভাবনার স্বাতন্ত্র্য। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নারীদের জন্য পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। বামাবোধিনী, খাতুন, মহিলা, পর্দানশীন, ইসমত, ভারতী পত্রিকার নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে নারী সম্পাদিত বাৎসরিক পত্রিকাও প্রকাশিত হতো। জাহানারা চৌধুরী ১৯৩২ সালে কলকাতা থেকে ‘রূপরেখা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।

১৯২৭ সালে প্রথম বাঙালি মুসলমান মহিলা ফজিলাতুন্নেসা এম. এ. পাশ করেন। তিনি একটি নিবন্ধে নারী-পুরুষদের অভিন্ন শিক্ষার পক্ষে মত দেন। কামিনী রায়, মানকুমারী বসু, সুফিয়া কামাল, শামসুন্নাহার মাহমুদ, আখতার মহল, নুরুন্নেছাসহ অনেকেই বিভিন্ন লেখায় তাঁদের চিন্তা-ভাবনা এবং মতামত প্রকাশ করেন। ১৯৪৭ সালে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন প্রতিষ্ঠিত ‘বেগম’ পত্রিকা বাঙালি নারীদের সাহিত্যচর্চা ও সৃজনশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নারীর সৃজনশীল লেখা নারীর আত্ম-প্রকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। নির্দ্বিধায় বলা যায় নারী লেখকরা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির সংস্কার কর্মের অপরিহার্য আধার এবং কর্মী।

বাঙালিত্ব বা বাঙালিয়ানায় নারীর ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে রাজনীতিতে বাঙালি নারী প্রসঙ্গটি অবধারিত ভাবে চলে আসে। বলতে হয় স্বদেশী অন্দোলনের অন্যতম নারী সংগঠক সরলা দেবীর কথা। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম স্মরণ করতে হয়। ১৯৩২ সালে মাস্টার দা সূর্যসেন পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব তাঁর হাতে তুলে দেন। ইতিহাস বলে বিশ শতকে নীলবিদ্রোহের সময় গ্রামীণ বাংলার নারীরা প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলেছিল। বিশ শতকেরই চার দশকে তেভাগা আন্দোলনের নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক ছিল কৃষক-শ্রমিক নারী সমাজ। ব্রিটিশ পুলিশ আর ভূস্বামীদের লাঠিয়ালের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে ভাগচাষীদের স্ত্রী-কন্যা। সংগ্রামী কৃষক নেতা ইলা মিত্র সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষক সমাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীরা সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে। রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে। সংসার পরিচালনার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালক হয়ে বাঙালি নারী সামর্থ্য আর যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে।

বিশ শতকেই প্রাচীন ও সেবামূলক কাজ যেমন কৃষিকাজ, ঘরকন্না, সম্প্রদায়গত পেশা, শিক্ষকতা, ডাক্তারির বৃত্তের বাইরে এসে নারীরা চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হয়। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতে নারী যোগ দিয়েছে। ড্রাইভিং, স্থাপত্য, ব্যবসা পরিচালনা, দেশ-বিদেশের উচ্চ প্রশাসনিক পদে বাঙালি নারী কৃতিত্বের সাথে অবদান রাখছে। ক্ষমতায়নের বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিধিত্ব করছে। উইমেন্স ডে স্পেশালে আজ নারীর সাফল্যের যে কথা শোনা যায় তাঁর পেছনে আছে হাজার বছরের ক্রমসঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর লড়াইয়ের ইতিহাস। সেই লড়াই আজো জারি আছে। 

জীবনের সামগ্রিকতা নিয়েই যদি সংস্কৃতি হয় তাহলে বাঙালি নারীর কৃতি, কীর্তি আর জীবনচর্চাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নারী এখন খেলোয়াড়, সঙ্গীত-নৃত্যশিল্পী, সমাজকর্মী, সাহিত্যিক, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, ফ্যাশান ডিজাইনার। সাংবাদিক থেকে শিল্পপতি। কোন জায়গায় নারীর অংশীদারিত্ব নেই? ক্রমশ বদলে যাওয়া জীবন ও যাপন পর্বে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ আর রোকেয়ার বাঙালিয়ানার ছিটে-ফোঁটাও আজ আর অবশিষ্ট নেই। সমকালীন সংস্কৃতিতে কিছু সাবেকিয়ানা থেকে গেলেও নারীর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে বিবর্তিত হচ্ছে নারীর জীবনালেখ্য। সাজপোষাকের স্টাইল স্টেটমেন্টের সাথে বদলে গেছে নারীর দর্শন, সমাজ ও জীবনভাবনা। রান্নাঘরের রেসিপি থেকে রেজিলিয়েন্স কিংবা মাঠ পর্যায়ে মাইক্রো ক্রেডিট স্কীম থেকে মজুরী সমস্ত কিছুই প্রয়োজন অনুযায়ী সামঞ্জস্য রেখে নিজস্ব গতিতে বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের ইতিবাচকতার কথা বলবে সময়। 

সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর মেধা, প্রতিভা, শ্রম, ভাবনা-চিন্তা, সংবেদনশীলতা, সূক্ষ্মতা বাঙালি সংস্কৃতি আর সভ্যতার চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে। শুরুতেই বলেছি সংস্কৃতি সমাজের মানুষের জীবনধারার প্রতিফলন। একুশ শতকে সেই প্রতিফলনের দিকে তাকালে চেনা পরিচয় ছেড়ে নারীকে অন্য পরিচয়ে দেখা যায়। বাঙালিয়ানায় নারীরা জীবন জীবিকার সাফল্যের সংজ্ঞাটি নতুন করে যুক্ত করে দিয়েছে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত