| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

প্রবন্ধ: বাংলাদেশের যাত্রাপালা ও পালাকার । তপন বাগচী

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

বাংলাদেশের যাত্রামঞ্চে যে সকল পালা অভিনীত হয়ে থাকে তার বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গের পালাকারদের রচনা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে খ্যাতিমান পালাকারদের অনেকের জন্ম এই বাংলাদেশে। এঁদের কেউ কেউ দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বাস করছেন এবং পালা রচনা অব্যাহত রেখেছেন। কেউ কেউ অভিনয়শিল্পী হিসেবে কলকাতার দলে যুক্ত হয়ে আর দেশে ফেরেননি। পরে পালা লেখায় মন দিয়েছেন। তাঁদের রচনায় বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি যথার্থভাবে উঠে আসছে না, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অবিভক্ত বাংলায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী, মনোমোহন বসু, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মশাররফ হোসেন, অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ, নফরউদ্দিন, মন্মথ রায়, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, জিতেন্দ্রনাথ বসাক, সত্যপ্রকাশ দত্ত, নির্মল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পালাকার আমাদের যাত্রামঞ্চকে সচল রেখেছেন।

ব্রজেন্দ্রকুমার দে, জিতেন্দ্রনাথ বসাক, সত্যপ্রকাশ দত্ত, নির্মল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পালাকার দেশ ছেড়ে চলে যান। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরে উলে­খযোগ্য কোনও পালাকার আর এদেশে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতা-উত্তর বালাদেশে সংলাপপ্রধান পালা লিখে পরিতোষ ব্রহ্মচারী এবং গীতপ্রধান পালা লিখে মাস্টার সেকেন্দার আলী সুনাম অর্জন করেছেন। এই দুইজন বাদে এই সময়ে আর কোনও পেশাদার মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ পালাকার এদেশে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। পশ্চিবঙ্গের পালাকে নকল করে লেখা বেশ কিছু পালা আমাদের বাজারে পাওয়া যায়। নকল পালগুলোও কোনও কোনও দল আসরস্থ করে চলছে। যাত্রা সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস দেশীয় পালা মঞ্চায়নের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশের খ্যাতিমান নাট্যকারদেরকেও তিনি অনুরোধ করেছেন। তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মামুনুর রশীদ, নাজমুল আলম, নরেন বিশ্বাস প্রমুখ। তাঁদের নাটককেই তাঁরা খোলামঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী করে রূপান্তর করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এগুলো যাত্রামঞ্চে তেমন কদর পায়নি। এত প্রতিকূলতার পরেও যেসকল পালাকার বাংলাদেশের যাত্রামঞ্চের চাহিদা পূরণ করছেন, তাঁদের সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা যায়।

কৃষ্ণকমল গোস্বামীর (১৮১০-১৮৮৮) জন্ম নদীয়ার ভাজনঘাটে আর মৃত্যু চুঁচুড়ায়। পিতা মুরলীধর গোস্বামী, মাতা যমুনাদেবী। তাঁর কর্মজীবন কেটেছে ঢাকায়। বিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই অর্থাৎ ১৮৩০ এর আগেই তাঁর প্রথম পালা ‘নন্দহরণ’ রচিত হয়। এই পালাটি আর পাওয়া যায় না। এরপর তিনি ‘স্বপ্নবিলাস-যাত্রা’, ‘দিব্যোন্মাদ-যাত্রা’ (একে ‘রাইউন্মাদিনী’-যাত্রা’ও বলা হয়), ‘বিচিত্রবিলাস-যাত্রা’, ‘কালীয় দমন’, ‘সুবলসংবাদ’, ‘নন্দ-বিদায়’, ‘ভরত-মিলন’, ‘নিমাই-সন্ন্যাস’, ‘গন্ধর্ব্ব মিলন’ প্রভৃতি পালা রচনা করেন। গবেষক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, অভিসন্দর্ভ রচনাকালে তিনটি পুস্তক তাঁর সংগ্রহে ছিল এবং তিনটির লেখকই কৃষ্ণকমল গোস্বামী। ‘বিচিত্রবিলাস’ গ্রন্থে মুদ্রিত লেখকের ভূমিকা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পালা তিনটি প্রকাশিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৮৭২, ১৮৭৩ ও ১৮৭৪ সালে। নিশিকান্তের অভিসন্দর্ভে উদ্ধৃত ১৮৭৪ প্রকাশিত কৃষ্ণকমল গোস্বামীর ‘বিচিত্রবিলাস’ গ্রন্থের ভূমিকা-বক্তব্য থেকে জানা যায়-

With a view, therefore, to produce the innocent amusement of the public, I composed, about fourteen years ago (1916 Samvat or 1860 A.D.), the two Pieces Swapnabilasa and the Dibyonmada based on the amours of Krishna at Braja (Brindaban), wich were chiefly composed of songs. These two pieces were acted, and subsequently printed in the form of books, by the combined exertions of the celebrated Zeminder of Murapara (in East Bengal), Babu Ishan Chandra Bandopadhyay, and the respectable communities of Abdullapur and Ekrampur of Dhaka. That these two pieces of must have contributed to the pleasure of public I must conclude from the fact that no less than 20,000 books were sold in a few days. having hereafter recieved much encouragement from the rich, respectable society of Dhaka, so well known for their appreciation of music and song, I compose this drama, Bichitrabilasa, about three years ago (1871 A.D.), depending for its meterials chiefly on the two Vaishnava works, Pada-kalpataru and Chamatkara-Chandrika.[1]


দীনেশচন্দ্র সেন (সম্পা.), কৃষ্ণকমল গ্রন্থাবলী, ভট্টাচার্য এন্ড সন্, কলিকাতা, ১৯২৮, পৃ. ০৫

Nishikanta Chattopadhyay, Yatras or the Populae Dramas of Bengal, [উদ্ধৃতি : সৈকত আসগর সম্পা. বাংলার লোকসংস্কৃতি : যাত্রাশিল্প, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৫৮৮]

[1]      Nishikanta Chattopadhyay,প্রাগুক্ত, [উদ্ধৃতি : সৈকত আসগর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯০]


‘স্বপ্নবিলাস-যাত্রা’ (১৮৭২) প্রথম প্রকাশিত যাত্রাপুস্তক। এই পালাটি মুড়াপাড়ার জমিদার এবং ঢাকার আবদুল­াহপুর ও একরামপুরের সুধীসমাজ অভিনয়ের আয়োজন করেন এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এই পালাগ্রন্থের ২০ হাজার কপি বিক্রি হওয়া একটি বিষ্ময়কর ঘটনা। পালাটি কৃষ্ণকমল রচনা করেন ১৮৬০ সালে। একই বছরে ‘দিব্যোন্মাদ-যাত্রা’ (প্রকাশকাল ১৯৭৩) পালাও তিনি রচনা করেন। এ দুটি পালার মাধ্যমে কৃষ্ণকমল গোস্বামী যাত্রাক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টি করেন। তাই ১৮৬০ সালকে যাত্রার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বছর হিসেবে গণ্য করা যায়। পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে যাত্রার পূর্বগৌরব ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব এই কৃষ্ণকমল গোস্বামীর । কৃষ্ণকমল গোস্বামীকে ‘বৈষ্ণব পনরুত্থানকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ পালাকার হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন।

পালাকার মনোমোহন বসুর (১৮৩১-১৯১২) জন্ম যশোর জেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম দেবনারায়ণ বসু। কলকাতার হেয়ার স্কুলে এবং জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে পড়ালেখা করেন। জীবনের শুরুতেই সাংবাদিকতায় দীক্ষাগ্রহণ করে ১৮৫২ সালে ‘সংবাদ বিভাকর’ ও ১৮৭২ সালে ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ‘প্রভাকর’ ও ‘তত্ত¡বোধিনী’ পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করতেন। নাট্যকার হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৭২ সালে ন্যাশনাল থিয়েটারের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এর সমর্থক ছিলেন। তাঁর রচিত নাটক ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হয়েছে। ১৮৬৮ সালে রচিত তাঁর ‘রামাভিষেক’ নাটকটি যুগপৎ নাটক ও পালা হিসেবে অভিনীত হওয়ার যোগ্য। এই পালার কারণে তিনি গীতাভিনয়ের অন্যতম পথিকৃতের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি ‘হরিশ্চন্দ্র’, ‘পার্থ পরাজয়’, ‘যদুবংশ-ধ্বংস’, ‘রাসলীলা’ প্রভৃতি নাটককে যাত্রাপালায় রূপান্তর করেছিলেন। এগুলো যাত্রামঞ্চে অভিনীত হত। কৃষ্ণযাত্রার সমকালে তাঁর এই পালাগুলো ভিন্ন স্বাদ আনতে সহায়ক হয়।

উনিশ শতকের খ্যাতিমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার সমাজচিন্তক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৮৩৩-১৮৯৬) বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পিতা-মাতাকে হারিয়ে প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। অর্থাভাবে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ হয়নি। কিন্তু পেশা হিসেবে তিনি শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন। বিদ্যালয় স্থাপন, নারীশিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ এবং পাঠ্যপুস্তক রচনায়ও তিনি মনোযোগী হয়েছিলেন। কাঙাল হরিনাথ সৃষ্টি করেছেন নীতিশিক্ষামূলক পাঠ্যপুস্তক, ধর্মকথা, কবিতা-সংগীত, পাঁচালি-গীতাভিনয়-নাটক, চিন্তামূলক প্রবন্ধ, উপন্যাস প্রভৃতি বিচিত্র রচনা। তাঁর রচিত পাঁচালি-গীতাভিনয়-নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘কংসবধ’, ‘প্রভাসমিলন’, ‘পাষাণোদ্ধার’, ‘রামলীলা’, ‘শিববিবাহ’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ’, ‘বিজয়া’, ‘কবিকল্প’, ‘অক্রুর-সংবাদ, ‘সাবিত্রী নাটিকা’, ‘ভাবোচ্ছ্বাস’, ‘কৃষ্ণকালী-লীলা’, ‘আগমনী’ প্রভৃতি। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের মৃত্যুশতবর্ষে প্রকাশিত ‘কাঙাল হরিনাথ মজুমদার নির্বাচিত রচনা’ গ্রন্থে ‘সাবিত্রী নাটিকা’ ও ‘ভাবোচ্ছ্বাস’ গ্রন্থ দুটি নাটক-যাত্রাপালা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। দুটিই পালার আখ্যানই গ্রহণ করা হয়েছে ‘মহাভারত’ থেকে। প্রথমটি সাবিত্রী ও সত্যবানের কাহিনী এবং শেষেরটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী। ‘ভাবোচ্ছ্বাস’কে কৃষ্ণযাত্রাও বলা যেতে পারে। এটি পৌরাণিক পালা। ‘সাবিত্রী নাটিকা’ গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হওয়ার (১৮৭৩) পরে বিভিন্ন যাত্রামঞ্চে অভিনীত হয়। ১৮৭৪ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ‘ভাবোচ্ছ্বাস’ পালাটি ১৮৮৪ সালে গ্রন্থিত হয়। এই দুটি পালার মাধ্যমে বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার মর্যাদার আসন লাভ করতে পারেন।

কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১১) ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাসের জন্যে এত বেশি নন্দিত যে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিসম্ভার কিছুটা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তিনি উপন্যাস, স্মৃতিকথা, কবিতা, গান প্রভৃতি রচনার পাশাপশি প্রায় ছয়টি নাটক ও প্রহসন রচনা করেন। বিশিষ্ট গবেষক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী তাঁকে প্রথম মুসলিম নাট্যকার হিসেবে অভিহিত করেছেন। মীর মশাররফ হোসেন ‘বসন্তকুমারী নাটক’ (১৮৭৩) ও ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩) নাটকের মাধ্যমে স্বীয় নাট্যপ্রতিভা প্রকাশ করেন। তিনি যাত্রামঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী করে ‘বেহুলা গীতাভিনয়’ (১৮৮৯) রচনা করেন। গীতাভিনয় তথা যাত্রাপালা রচনা করে তিনি সময়ের দাবি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। সাহিত্যচর্চার অংশ হিসেবেই তিনি অভিনেয়-সাহিত্য রচনা করেন। এটি তাঁর সময়ে অভিনীতও হয়েছিল।

নড়াইল জেলার মলি­কপুর গ্রামের অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ (১৮৭২-১৯৪৩) একজন উলে­খযোগ্য পালাকার। কাব্যতীর্থ তাঁর অর্জিত উপাধি হলেও কৌলিক পদবি ছিল ভট্টাচার্য। কেউ কেউ তাঁর নাম ‘অঘোরচন্দ্র’ বলে উলে­খ করেছেন। তিনি কলকাতার ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’ স্কুলে হেডপণ্ডিত ছিলেন। শেষজীবনে তিনি নিজগ্রামের মলি­কপুর দক্ষবালা বিদ্যানিকেতনে শিক্ষকতা করেন। এখানেই তিনি ১৯৪৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচিত প্রথম যাত্রাপালার নাম ‘কল্কি অবতার গীতাভিনয়’ (১৮৯৮)। এরপর তিনি ‘মগধ-বিজয়’ (১৯০৩), ‘দাতাকর্ণ’ (১৯০৪), সমুদ্রমন্থন’ (১৯০৪), ‘ধর্মের জয়’ (১৯১৩), ‘হরিশ্চন্দ্র’ (১৯১৪), ‘অনন্ত মাহাত্ম্য’ (১৯১৬), ‘কুরুপরিণাম’ (১৯২১), ‘বিজয় বসন্ত’ বা ‘সৎমা’ (১৯২১), ‘অদৃষ্ট’ (১৯২১), ‘চন্দ্রকেতু’ (১৯২২), ‘মেবার কুমারী’ (১৯২৩), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯২৩), ‘তরণীর যুদ্ধ’ (১৯২৪), ‘নহুষ উদ্ধার’ (১৯২৫), ‘প্রতিজ্ঞা পালন’ (১৯২৫), ‘রাধাসতী’ (১৯২৫), ‘তারকাসুর বধ’ (১৯২৬), ‘নলদময়ন্তী’ (১৯২৭), ‘শতাশ্বমেধ’ (১৯২৯), ‘নদের নিমাই’ (১৯৩৫), ‘প্রহ্লাদ’ (১৯৩৫), ‘অনুধ্বজের হরিসাধনা’ (১৯৩৬), ‘জয়দেব’ (১৯৩৭), যাজ্ঞসেনী (১৯৩৮) প্রভৃতি পালা রচনা করেন। অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ পৌরাণিক পালার মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা বিস্তারে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা অতুলনীয়। যাত্রায় পৌরাণিক পালার যুগে অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ ছিলেন অপরিহার্য নাম। পরবর্তী পালাসাহিত্যেও তাঁর অবদান তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত না হয়ে উপায় নেই।

নফরউদ্দীন আহম্মদ (১৮৯৭-১৯৭২) : পালাকার নফরউদ্দীন আহম্মদের জন্ম ১৮৯৭ সালে, বর্তমান নওগাঁ জেলার ধামুরহাট থানার শ্যামপুর গ্রামে। পিতা আল­াহ বকশ ও মাতা আতরচি বিবি। তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। গান্ধিজির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজনীতির জন্যে তিনি জেলও খেটেছেন। বাংলাদেশে মুখে মুখে প্রচলিত মধুমালা ও মদনকুমারের কাহিনী নিয়ে তিনি ‘মধুমালা’ (১৯৩৬) পালা রচনা করেছিলেন। তিনি পুথি আর কিস্সাকে পালারূপ দিয়ে যাত্রায় ভিন্ন স্বাদের প্রবর্তন করেছেন। তাঁর ‘কাঞ্চনবতী’, ‘সাগরভাসা’, ‘বিন্দুমতি’, ‘পুষ্পমালা’ প্রভৃতি পালা লোকায়ত কাহিনী থেকে নেয়া। ‘যাত্রাওয়ালাদের কোনও কোনও পালা দেখে বা শুনে তিনি তাঁর মধুমালা, সাগরভাসা, কাঞ্চনবতী প্রভৃতি লোকনাট্য লিখে থাকবেন’ বলে গবেষক মুহম্মদ মজির উদ্দীনের ধারণা। তিনি মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ অবলম্বনে ‘কারবালা’, ‘এজিদবধ’ প্রভৃতি পালা রচনা করেন। ঐতিহাসিক নাটক ‘রাজশ্রী’ ‘রাখিভাই’ বা ‘কর্ণবতী’ (১৯৩১) কিংবা পৌরাণিক ‘তারাশাহ’ (রচনাকাল ১৯৩০), ‘ভাগ্যলিপি’, ‘ভাগ্যচক্র’ প্রভৃতি যাত্রাপালা রচনা করেন। ‘কারবালা’ ১৯২৫-২৬ সালে রচিত, তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সাল। ‘এজিদবধ’ রচিত ১৯২৮ সালে, প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। প্রথমটির প্রকাশক এম.এস. আলীর নর্থবেঙ্গল পাবলিশার্স, নওগাঁ। আর দ্বিতীয়টির প্রকাশক বোরহানউদ্দিন আহম্মেদ ৪০ বনগ্রাম, ঢাকা। ‘দেশী যাত্রা-আদর্শ তাঁর নাটকে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে’। নফর উদ্দীন আহম্মদের যাত্রাপালা সম্পর্কে গবেষক মুহম্মদ মজিরউদ্দিনই প্রথম মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছেন। তাঁর নাটকে যাত্রার প্রভাব নিয়ে তিনি লিখেছেন
‘দেশী যাত্রার ঢঙ ও মানস নাট্যকার নফর উদ্দীনের মধ্যে মাঝেমাঝে লক্ষ করা যায়। তাঁর অধিকাংশ নাটকের দৃশ্যপট মোচনের বিপরীতে দেখা যায় ঝাড়–দার-ঝাড়–দারনী বা তাদের রসালাপ। এই কৌতুকবহ দৃশ্যগুলো আসলে যাত্রার বৈশিষ্ট্য। নফর উদ্দীন আহম্মদের কোনও যাত্রাপালা এখনও প্রকাশিত হয়নি। গীতাত্মক যাত্রাদলে এসকল পালা অভিনীত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পালাকারের নাম উহ্য রাখা হয়। অন্যের নামেও পালাগুলো অভিনীত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণকারী পালাকার ও নাট্যকার মন্মথ রায় (১৮৯৯-১৯৮৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ‘মুক্তির ডাক’ (১৯২৩) নামে যে নাটক রচনা করেন তা বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক একাঙ্ক নাটক হিসেবে অভিহিত হয়েছে। ছোটবেলায় মথুর সাহা, প্রসন্ন নিয়োগী, মুকুন্দ দাস প্রমুখ অধিকারীর দলের যাত্রা দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। তাঁর রচিত পালার নাম ‘দিগি¦জয়’, ‘বউঠাকুরানীর হাট’ ও ‘সুরথ উদ্ধার’। সত্যম্বর অপেরায় ‘দিগি¦জয়’ (১৯৬৯) পালাটি খ্যাতিলাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘বউঠাকুরাণীর হাট’কে তিনি নাট্যভারতী দলের জন্যে যাত্রারূপ দিয়েছিলেন। তাঁর ‘চাঁদসদাগর’ (১৯২৭), ‘দেবাসুর’ (১৯২৮), ‘কারাগার’ (১৯৩০), ‘মীরকাশিম’ (১৯৩৮), ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ (১৯৫৮) প্রভৃতি নাটক যাত্রামঞ্চে অভিনীত হয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি রচনা করেন ‘আমি মুজিব নই’ নামে নাটক, যা যাত্রামঞ্চেও অভিনয় হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা শিল্পী সংঘের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লোকনাট্য যাত্রাগান’ শীর্ষক ‘ডিএল রায় রিডারশিপ বক্তৃতা ১৯৭০’ প্রদান করেন। বক্তৃতগুলো ১৯৭৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নাট্যকার হয়েও যাঁরা যাত্রাপালা লিখেছেন এবং যাত্রাশিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, মন্মথ রায় তাঁদের অগ্রসারির একজন।

ব্রজেন্দ্রকুমার দে (১৯০৭-১৯৭৬) : পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র জন্ম ১৯০৭ সালের ১ ফেব্র“য়ারি গয়ঘর গঙ্গানগর গ্রামে। এটি তখন ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছিল। পরে এটি মাদারীপুর জেলার এবং বর্তমানে শরিয়তপুর জেলার অন্তর্গত। তাঁর পিতার নাম হরিকিশোর দে এবং মাতার নাম ক্ষীরোদাসুন্দরী দেবী। ১৯২৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। ১৯৩০ সালে ওরিয়েন্টাল ট্রেনিং একাডেমির সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার ইছাপুর নর্থল্যান্ড হাইস্কুল। তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬৯ সালে অবসরগ্রহণ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯১৯ সালে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের পালারূপ দিয়েছিলেন। তবে পরের বছর ‘সুপর্ণ শতদল’ (১৯২০) নামে একটি পালা তিনি রচনা করেন বলে জানা যায় । এটি যোগেশ চৌধুরী সংশোধন করে দিলেও প্রকাশিত হয়নি। এটির অভিনয়-তথ্যও অজানা। তাই আঠারো বছর বয়সে রচিত ‘স্বর্ণলঙ্কা’ (১৯২৫) তাঁর প্রথম মৌলিক পালা বলে স্বীকৃত। এরপরে আর ব্রজেন্দ্রকুমারকে থেমে থাকতে হয়নি। একে একে প্রায় দুইশত পালা রচনা করে। ১৯৭৩ সালে নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে তিনি ‘শ্রেষ্ঠ নাট্যকার’ হিসেবে পুস্কৃত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘লোকনাট্যগুরু’ উপাধি অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালের ১২ মার্চ কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশের মঞ্চে অভিনীত তাঁর পালাগুলো হল ‘চাঁদের মেয়ে’ (১৯৩৬), ‘সমাজের বলি’ (১৯৪৪), ‘বাঙালি’ (১৯৪৬), ‘রাজ সন্ন্যাসী’ (১৯৪৭), ‘ধর্মের বলি’ (১৯৫২), ‘গাঁয়ের মেয়ে’ (১৯৫২), ‘বিচারক’ (১৯৫৩), লোহার জাল’ (১৯৫৯), ‘বর্গী এলো দেশে’ (১৯৬০), ‘সোনাইদিঘি’ (১৯৬০), ‘সোহরাব রুস্তম’(১৯৬১), ‘সম্রাট জাহান্দার শাহ’্ (১৯৬১) ‘যাদের দেখে না কেউ’ (১৯৬২), ‘সুলতানা রিজিয়া’(১৯৬৭), ‘করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর’ (১৯৬৮), ‘নটী বিনোদিনী’ (১৯৭৩), ‘পাহাড়ের চোখে জল’(১৯৭৩), ‘বিদ্রোহী নজরুল’ (১৯৭৪), ‘সীতার বনবাস’(১৯৭৫), ‘নন্দকুমারের ফাঁসি’(১৯৭৫), ‘আঁধারের মুসাফির’ (১৯৭৫), ‘কাজীর বিচার’ (১৯৭৫), ‘কোহিনূর’, ‘রক্ততিলক’, ‘কলিঙ্গ বিজয়’ প্রভৃতি।

যাত্রাগানে ব্রজেন্দ্রকুমারের অবদান বহুমুখী। একজন শ্রেষ্ঠ পালাকার হিসেবেই নন, যাত্রার নবপ্রাণসঞ্চারক হিসেবেও তিনি সম্মানিত হওয়ার যোগ্য। যাত্রায় তাঁর বহুমাত্রিক অবদানকে সমন্বিত সূত্রাকারে উপস্থাপন করা যেতে পারে-
১. ১৯৩৬ সালে তিনি ‘চাঁদের মেয়ে’ পালার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত সংলাপের প্রবর্তন করেন।
২. অহীভূষণ ভট্টাচার্য যাত্রাপালায় ‘বিবেক’ চরিত্র সৃষ্টি করেন। কিন্তু সে বিবেক ছিল অশরীরী। ব্রজেন্দ্রকুমার ১৯৩৬ সালে ‘বঙ্গবীর’ পালার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চরিত্র হিসেবে বিবেককে প্রথম উপস্থাপন করেন।
৩. ১৯৩৭ সালে ‘রাজর্ষি’ পালার মাধ্যমে তিনি যাত্রা-পরিবেশনের সময় তিন ঘণ্টায় কমিয়ে আনেন। এর আগে যাত্রার ব্যপ্তি ছিল ৬/৭ ঘণ্টা।
৪. ১৯৪২ সালে ‘রাজনন্দিনী’ পালার মাধ্যমে তিনি পৌরাণিক পালার পাশাপাশি কাল্পনিক পালার প্রবর্তন করেন।
৫. ১৯৪৫ সালে তিনি ‘দেবতার গ্রাস’ পালার মাধ্যমে পৌরাণিক পালার অমিত্রাক্ষর ছন্দ ত্যাগ করে টানা গদ্যের অর্থাৎ মুখের ভাষার সংলাপ প্রচলন করেন।
‘সোনাই দীঘি’ পালায় হোসেন শাহ, ‘সম্রাট জাহান্দার শাহ’ পালায় জাহান্দার, ‘বিচারক’ পালায় বিক্রমাদিত্য, ‘বাঙালি’ পালায় মোবারক, ‘যাদের দেখে না কেউ’ পালায় গৌতম প্রমুখ।

৬. তিনি অনেক পালায় ছদ্মবেশী চরিত্র সৃষ্টি করেন। যেমন
৭. তিনি প্রতি পালায় গানের সংখ্যা ৩০ থেকে ১৫টিতে নামিয়ে আনেন। অর্থাৎ গীতিপ্রধান থেকে সংলাপপ্রধান পালা সৃষ্টির কৃতিত্ব তাঁর। এখন যাত্রাপালায় ৫/৬টির বেশি গান শোনা যায় না।
ব্রজেন্দ্রকুমারের বড় গুণ এই যে, সামাজিক পালায় তো বটেই, তিনি পৌরাণিক কিংবা কাল্পনিক পালায়ও শিক্ষণীয় বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাঁর পালার বক্তব্যে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তিনি ‘মায়া’ (১৯২৭) পালার মাধ্যমে পণপ্রথার প্রতিবাদ করেছেন। পালাটি এখনও প্রকাশিত কিংবা অভিনীত হয়নি। ‘প্রবীরার্জ্জুন’ (১৯৩২) পালাটি পৌরাণিক হলেও পাণ্ডবদের সাম্রাজ্যবাদী বলার মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

‘লীলাবসান’ (১৯৩৪) পালায় তিনি শ্রীকৃষ্ণকে শোষণশ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে অঙ্কন করে শ্রেণীচেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘রাজনন্দিনী’ (১৯৪২) এবং ‘সমাজের বলি’ (১৯৪৪) পালায় অস্পৃশ্যতাবিরোধী বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে। ‘শেষ নামাজ’ (১৯৪৫), ‘বাঙালি’ (১৯৪৫), ‘ধর্মের বলি’ (১৯৫২) প্রভৃতি পালায় সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। ‘জনতার মুকুট’ (১৯৬৫) পালায় গণসংগ্রামের কাহিনী বিধৃত হয়েছে। ‘মায়ের ডাক’ (১৯৪৫) পালায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের (১৮৯৭-১৯৪৫), ‘করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর’ (১৯৬৮) পালায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১), ‘মৃত্যুঞ্জয় সূর্য সেন’ (১৯৬৯) পালা মাস্টারদা সূর্য সেনের (১৮৯৩-১৯৩৪), ‘বিদ্রোহী নজরুল’ (১৯৭৪) পালায় কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬), ‘নদে ভেসে যায়’ (১৯৭৪) পালায় শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩), ‘ভারতপথিক রামমোহন’ (১৯৭৪) পালায় রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) আদর্শ ও বাণী প্রচার করেছেন। ‘নটী বিনোদিনী’ (১৯৭৩) পালায় ঊনবিংশ শতাব্দীর রঙ্গমঞ্চের খ্যাতিমান অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর (১৮৬৩-১৮৪১) জীবনকাহিনীর বলার সুযোগে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯২২) এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের (১৮৩৬-১৮৮৬) আদর্শ ও শিক্ষা প্রচার করেছেন। যাত্রার ইতিহাসে ব্রজেন্দ্রকুমার দে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

‘মানুষ’, ‘বিদ্রোহী বাঙ্গালী’, ‘কাজলগড়’, ‘জয়যাত্রা’, ‘ফরিয়াদ’, ‘লালবাঈ’ ‘মুঘল-এ-আযম’, ‘বাগদত্তা’, ‘আমি সিরাজের বেগম’, ‘দ্বিতীয় পানিপথ’, ‘ডাকিনীর চর’, ‘সিপাহী বিদ্রোহ’, ‘সম্রাট অশোক’, ‘লালবাঈ’, ‘কৃষ্ণকালিন্দী’, ‘মীরাবাঈ’, ‘কংস’, ‘সূর্যলগ্ন’, ‘জীবন জ্ঞিাসা’, ‘সোনার হরিণ’, ‘জানোয়ার’, ‘বাগদত্তা’ প্রভৃতি। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ও ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পালারূপ দিয়েও কৃতিত্বে পরিচয় দেন। তাঁর ঐতিহাসিক পালাগুলোতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সংহতির আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। দেশের নামী-অনামী সকল দলেই তাঁর পালা সমাদৃত হয়েছে। জিতেন্দ্রনাথ বসাক (জ. ১৯১৭): পালাকার জিতেন্দ্রনাথ বসাকের জন্ম ১৯১৭ সালে জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কোচবিহার কলেজে ভর্তি হন। পড়ালেখার খরচ মেটানোর জন্যে তিনি এখানে ফতে মামুদ বেসিক স্কুলে চাকরি নেন। চাকরি ও পড়ালেখা একসঙ্গে চালিয়ে তিনি আইএ এবং বিটি পাস করেন। পাশাপশি তিনি সখের যাত্রাদলে অভিনয় করেন। তাঁর প্রথম রচিত পালার নাম ‘মানুষ’। এটি পরে নবরঞ্জন অপেরায় অভিনীত হয়। সবমিলিয়ে তাঁর পালার সংখ্যা ৫০। যাত্রাপালায় অবদানের জন্য তিনি ‘সাহিত্য-সরস্বতী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর উলে­খযোগ্য পালাগুলো হল-
মাস্টার সেকেন্দার আলী (জ. ১৯২৩) : পটুয়াখালী জেলার দুধল গ্রামের সেকেন্দার আলীর সিকদারের ‘রূপবান’, ‘গুনাইবিবি’, ‘জরিনাসুন্দরী’, ‘সাগরভাসা’ পালাগুলো বেশ জনপ্রিয়। কারবালার করুণ কাহিনীকে তিনি যাত্রারূপ দিয়েছেন ‘হাসানের বিষপান’, ‘হোসেনের অন্তিম শয্যা’ ও ‘এজিদবধ বা জয়নালউদ্ধার’ নামে। তাঁর ‘সাতভাই চম্পা’ পালাটিও জনপ্রিয় হয়। তবে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় পালা হল ‘বেদকন্যা’। এছাড়া ‘গৌড় সুলতান’, ‘নৌকাবিলাস’, ‘শ্যামারূপ’ পালা লিখেও তিনি যাত্রাদলের চাহিদা পূরণ করেন।

মতিউর রহমান (জ. ১৯২৪) : নরসিংদির মতিউর রহমান ১৪টি পালা রচনা করেছেন। এর মধ্যে ৬টি পালা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত পালা ‘রাজসিংহাসন’ (১৯৭৫), দ্বিতীয় পালা ‘গরিবের আর্তনাদ’ (১৯৭৮) এবং তৃতীয় পালা ‘যৌতুক হলো অভিশাপ’ (১৯৮২)। প্রকাশের আগেই এটি বিভিন্ন দলে অভিনীত হয়। পরে নরসিংদীর বুক মার্ট গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। একই প্রকাশনী প্রকাশ করে ‘মানুষ অমানুষ’ (১৯৮৯), ‘ঘুমন্ত সমাজ’ (১৯৯৩), ‘শাহী ফরমান’ (১৯৯৬), ‘মধুমালতী রূপকুমার’ (১৯৯৭) প্রভৃতি। তাঁর প্রায় সকল পালাই কাল্পনিক এবং ঐতিহাসিক।

আসিরউদ্দিন আহমদ (জ. ১৯২৫) : সালে তিনি ঢাকায় আসেন। দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৭ সালে ‘মিনার্ভা থিয়াটার’ গঠন করেন। যাত্রাশিল্পের দুর্দশা লাঘবে তিনি ‘যাত্রা শিল্পী কুশলী ইউনিয়ন’ নামের একটি সংগঠন করেন এবং এর সভাপতি মনোনীত হন। তিনি ‘ঝিনুক’ নামে একটি চলচ্চিত্র পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় যাত্রানুষ্ঠানের সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হত। তাঁর ‘ঈশা খাঁ’ নামের যাত্রাপালাটি দেশের অনেক বড় দলে অভিনীত হয়েছে।

সত্যপ্রকাশ দত্ত (জ. ১৯২৬) : পালাকার সত্যপ্রকাশ দত্তের জন্ম খুলনা জেলায় ১৯২৬ সালে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি ভাগ্যান্বেষণের কলকাতায় গমন করেন। সেখানে তিনি অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর রচিত প্রথম পালার নাম ‘অগ্নিবাসর’ (১৯৬৫)। তরুণ অপেরার ‘পঞ্চনদীর তীরে’ (১৯৬৬) পালার মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। জনতা অপেরার ‘তামসী’ (১৯৬৬) ও ‘অঙ্গার’ (১৯৬৭) পালাদুটি বেশ জনপ্রিয়া হয়। বাংলাদেশের যুদ্ধের কাহিনী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে তিনি ১৯৭১ সালে রচনা করেন ‘বঙ্গবন্ধু মুজিবুর’ নামের যাত্রাপালা। পশ্চিমবঙ্গের আর্য অপেরা মুক্তিযুদ্ধর সময় পালাটি পরিবেশন করে। সত্যপ্রকাশ দত্তের শ্রেষ্ঠ পালা হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরার কারণেও পালাটি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ‘বধূ কেন কাঁদে’, ‘দুই টুকরো বৌমা’ পালাও সামাজিক পালা হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সত্যপ্রকাশ দত্ত পশ্চিমবঙ্গের মসলন্দপুরে বাস করেন। বাংলাদেশের সকল দলেই তাঁর পালা সগৌরবে অভিনীত হয়।

বাগেরহাট জেলার সন্তোষপুর গ্রামের নির্মল মুখোপাধ্যায়ের (জ. ১৯৩২) প্রথম পালা ‘কান্নার কূলে’ কলকাতার ভারতী অপেরায় অভিনীত হয়। নির্মল মুখোপাধ্যায়ের ‘এক মুঠো অন্ন’, ‘সোনাডাঙ্গার বউ’, ‘নিশিপুরের বউ’, ‘প্রেমের সমাধি তীরে’, ‘পথের ছেলে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘আজকের বাঙালি’, ‘মমতাময়ী মা’, ‘গরিব কেন মরে’, ‘জুয়াড়ি’, ‘মা যদি মন্দ হয়’, ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’, ‘অমানুষ’, ‘কলঙ্কিনী কেন কঙ্কাবতী’, ‘মানবী দেবী’, ‘দ্বারকায় এলেন শ্রীকৃষ্ণ’, ‘রক্ত দিল কারা’, ‘রণভেরী’, ‘কবরের নীচে’, ‘মরমী বধূ’ প্রভৃতি পালা মঞ্চসফল হয়। তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ এবং নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘লালুভুলু’-র পালারূপ দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। নির্মল মুখোপাধ্যায়ের প্রতিভা কলকাতায় বিকশিত হলেও তাঁর প্রতিটি পালায় বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজচিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এমন কোনও যাত্রাদল খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দলে নির্মল মুখোপাধ্যায়ের একাধিক সামাজিক যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়নি।

‘ফকির লালন সাঁই’, ‘ভাঙা গড়া’, ‘বিষের বাসর’, ‘শেখ পরিবার’, ‘দানবীর মহসিন’ প্রভৃতি। তিনি ২০০৩ সালে মানিকগঞ্জ শহরে নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। যাত্রাভিনেতা, নির্দেশক ও পালাকার চিত্তরঞ্জন পাল (১৯৩২-২০০৩)-র জন্ম ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার বাগুয়ান গ্রামে। স্কুলের গণ্ডি পার করার আগেই ১৯৪৯ সালে তিনি যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পালিয়ে কোলকাতা চলে যান। বর্ধমান জেলার জীবনকৃষ্ণ দাসের নবরঞ্জন অপেরায় তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান। পশ্চিমবঙ্গে থাকার সময় তিনি শরৎ মুখার্জি, পঞ্চু সেন, ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, ছোট ফণী, মতিলাল ও রামবাবুর মতো গুণী যাত্রাশিল্পী এবং পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র সান্নিধ্যে আসেন। কিন্তু সেখানে অভ্যন্তরীণ রেষারেষি সহ্য করতে না পেরে তিনি দল ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। সহনায়ক হিসেবে তিনি যোগ দেন ব্রহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জয়দুর্গা অপেরায়। এরপর ভোলানাথ অপেরা, মহাশক্তি অপেরা ও ভাগ্যল²ী অপেরায় তিনি কাজ করেন। স্বাধীনতার পরে তিনি চারণিক নাট্যগোষ্ঠী, গণেশ অপেরা, নবপ্রভাত অপেরা, প্রগতি অপেরা, বলাকা অপেরা প্রভৃতি যাত্রাদলে অভিনেতা ও নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পালাকার হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। তাঁর রচিত পালাগুলো হল  পালাকার-অভিনেতা আরশাদ আলী (জ. ১৯৩৪) মুন্সিগঞ্জ জেলার খালপাড়ের অধিবাসী। তাঁর বড়ভাই ছেরু মিয়ার ছিল রূপবান যাত্রার দল। এই ছেরুমিয়ার দল ‘খালপাড়ের দল’ নামেই সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই দলে রূপবানের ভূমিকায় অভিনয় করতেন আরশাদ আলী। খালপাড়ের দলের রূপবানের সুনাম এমন ছিল যে, যাত্রামঞ্চে বাঁশের যে খুঁটি ধরে রূপবান গান করত, অভিনয় শেষে সেই খুঁটির দাম নিলামে উঠত। রূপবান যাত্রার পাশাপশি দলে অন্য পালাও মানুষ শুনতে চাইত। অভিনেতা আরশাদ আলী দলের প্রয়োজনে লিখলেন ‘গৌরী মালা’, ‘সতী কলঙ্কিনী’ প্রভৃতি যাত্রাপালা। গীতিধর্মী এই পালাগুলো এখনও অভিনীত হয়ে চলছে।

জালাল উদ্দিন (জ. ১৯৪২) নরসিংদি জেলার রায়পুরা থানার হাইরমারা গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম লেখা যাত্রাপালা ‘গাঁয়ের বুকে’ প্রকাশিত হয়। এর পর প্রকাশিত হয় ‘দুই ভাই’ (১৯৬৫)। গ্রন্থিত হওয়ার আগে বিভিন্ন সৌখিন দল পালা দুখানা মঞ্চস্থ করে। ১৯৬৩ সালে ‘গাঁয়ের বুকে’ পালা বিক্রমপুরের খাল পাড়ের ছেরু মিয়ার রুপবান দলেও অভিনীত হয়েছিল। এরপর তাঁর ‘কুসুম-তারা’ (১৯৬৭), ‘ভিখারীর মেয়ে’ (১৯৬৭), ‘ভিখারীর ছেলে’ (১৯৬৭), ‘রাজ্যহারা’ (১৯৬৮), ‘মালীর ছেলে’ (১৯৬৮), ‘রক্তরাঙা বাংলাদেশ’ (১৯৭২), ‘কিছু খেতে দাও’ (১৯৯৫), ‘রঙিলা একটি মেয়ের নাম’ (১৯৯৬), ‘মাঝির মেয়ে’ (১৯৯৬) প্র্র্র্র্রভৃতি পালা প্রাকাশিত হয়। তাঁর রচিত সর্বশেষ পালা ‘লুণ্ঠিত দেবমন্দির’ বিভিন্ন যাত্রাদলে অভিনীত। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। জালাল উদ্দিন বর্তমানে যাত্রা পালাকার পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

পরিতোষ ব্রহ্মচারীর (১৯৪৩-২০০০) জন্ম বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার শিবপুর গ্রামের ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারীর পুত্র। তিনি খুলনা জেলার দাকোপ থানার বাজুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এই গ্রামেই তিনি স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। ২০০০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পোশাদার যাত্রা দলের জন্য ১৬ খানা যাত্রাপালা রচনা করেন। এ ছাড়া মঞ্চনাটক, বেতারনাটক, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। ১৯৮২ সালে জাতীয় যাত্রা উৎসবে শিরিন অপেরা তাঁর ‘ক্লিওপেট্রা’ পালার অভিনয় করে। এটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। পরে তা তুষার অপেরার ব্যানারে বিটিভি-তে স¤প্রচারিত হয়। পালাকার পরিতোষ ব্রহ্মচারীও পাশ্চাত্য কাহিনীর সার্থক পালারূপ দিয়ে যাত্রা আসরকে সতেজ করেছেন। তাঁর পালা ‘নদীর নাম মধুমতি’ খুলনার শিরিন অপেরায় অভিনীত হয়। দ্বিতীয় জাতীয় যাত্রা উৎসবের সময় শিল্পকলা একাডেমী শুধু দেশীয় পালাকারের পালা নিয়ে উৎসব উদ্যাপনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু পরিতোষ ব্রহ্মচারীর পালা বাদে মানসম্পন্ন আর কোনও পালা পাওয়া যায়নি।

‘বনবাসে রাম’ আর ‘আবার দরিয়া ডাকে’ এই দুটি পালা বাদে সকল পালার মঞ্চায়ন তিনি দেখে যেতে পেরেছেন। তার মৃত্যুর পর ‘ফেরারী নায়ক’ পালাখানা পেশাদার দলে মঞ্চায়ন শুরু হয়েছে। জীবদ্দশায় বাজুয়া এ্যামেচার ক্লাব পালাখানা মঞ্চায়ন করে। তাঁর রচিত উলে­খযোগ্য পালা হচ্ছে ‘নাগিনী নুরজাহান’, ‘এক যুবতী হাজার প্রেমিক’, ‘আবার দরিয়া ডাকে’, ‘দস্যু ফুলনদেবী’, ‘মহুয়া’, শিরি-ফরহাদ’, ‘লাইলি-মজনু’, ‘বেদের মেয়ে জ্যোছনা’, ‘মহানায়ক শ্রীকৃষ্ণ’, ‘আলীবাবা চলি­শ চোর’, ‘চণ্ডীদাস-রজকিনী’, ‘ডিসকো কুইন’, ‘ছোটমা’ ও ‘বিরাজবৌ’ (শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে), ‘রিক্তের বেদন’ (কৃষ্ণগোপাল বসাকের উপন্যাস অবলম্বনে), ‘বর্ণমালা মা আমার’ প্রভৃতি। তাঁর কোনও পালা এখনও প্রকাশিত হয়নি।

পালাকার মোহাম্মদ সাহেব আলী (জ. ১৯৪৩) যশোর জেলার ঝিকরগাছার মানিখালী গ্রামের মনসেফ আলি মণ্ডলের পুত্র। একানী চরিত্রের মাধ্যমে যাত্রার প্রবেশ ঘটেছিল মোহাম্মদ সাহেব আলীর। পরবর্তীতে তিনি ‘বিবেক’ চরিত্রে গান ও অভিনয়ের জন্যে খ্যাতি অর্জন করেন। পেশাদার দলের জন্যে অনেকগুলে পালা লিখেছেন তিনি। নাটোরের মজিবুর রহমানের বিশ্ববাণী অপেরায় তাঁর দুটি পালা ‘আমি সাদ্দাম বলছি’ এবং ‘জংলি মেয়ে’ প্রথম অভিনীত হয়। তাঁর অন্য পালাগুলো হচ্ছে, ‘কাফের’, ‘সন্ত্রাস’, ‘লাখো শহীদের এক কবর’, ‘একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়’, ‘জজ আসামী, ‘দাঁড়াও যমরাজ আমি বেহুলা’, ‘রক্তে রাঙানো বাসর’, ‘অন্ধ সমাজ’ প্রভৃতি। উপসাগরীয় যুদ্ধ কিংবা একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের মতো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে যাত্রা লিখে তিনি সময়চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ঘূর্ণিঝড়’, ‘রক্তসিন্ধু’, ‘অশ্র“নদী’, ‘মহামিলন’, ‘বাঙালির মেয়ে’, ‘অস্তমিত’, ‘মহাকালের চাকা’, ‘রক্তরাঙা গ্লোব’, ‘মহামানব’, ‘যোগফল’, ‘ফরিয়াদ’, ‘বাতাস’ প্রভৃতি। স্থানীয় সৌখিন দলে ছাড়াও পেশাদার যাত্রাদলে তাঁর পালা সুনামের সঙ্গে অভিনীত হয়েছে। পালাকার আকছারুল ইসলাম (জ. ১৯৪৫)-র বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পালাকার। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে পূর্বআবদালপুরে তাঁর বাড়ি। ১৯৬২ সালে তাঁর প্রথম নাটক ‘ভাবী’ প্রকাশিত হয় কুষ্টিয়ার জাগ্রত প্রকাশনী থেকে। একই প্রকাশনী থেকে তাঁর আরও দুটি নাটক ‘রাজদণ্ড’ (১৯৬৫) ও ‘প্রতিজ্ঞাভঙ্গ’ (১৯৬৬) প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি যাত্রাদালের জন্যে পালারচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম যাত্রাপালা ‘রাহুমুক্তি’ প্রকাশিত হয় কুষ্টিয়ার জাগ্রত প্রকাশনী থেকেই। আকছারুল ইসলামের পালা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলে অভিনীত হলেও সকল পালা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর উলে­খযোগ্য পালা হল সাধনকুমার মুখার্জী (জ. ১৯৫০) : যশোরের সাধনকুমার মুখার্জীর ‘চণ্ডী অপেরা’ (১৯৮৬) অধিকারী হিসেবে সমধিক পরিচিত। ‘চণ্ডালের মেয়ে’, ‘পৃথিবীর আত্মহত্যা’ নামে দুটি পালা রচনা করে নিজের যাত্রাদল চণ্ডী অপেরার মাধ্যমে আসরস্থ করান। পালা দুটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এরপর অন্য দলেও তাঁর পালা অভিনীত হয়।

‘হাসানের বিষপান’, ‘রমজানের চাঁদ’, ‘দুর্গা নয় দেবী’, ‘বেঈমান রুশদী’, ‘বাপের বেটা সদ্দাম’, ‘নায়িকার শেষ জীবন’ প্রভৃতি।¾মাগুরার গীতিকার-পালাকার ও অধিকারী অতুলপ্রসাদ সরকার ‘(জ. ১৯৫৩) বিষাদ-সিন্ধু’র কাহিনী নিয়ে রচনা করেন ‘কারবালা আজও কাঁদে’ নামের যাত্রাপালা। এটি তাঁর চৈতালী অপেরায় যশের সঙ্গে অভিনীত হয়েছে। তাঁর অন্য পালা হচ্ছে, বিক্রমপুরের পালাকার ননী চক্রবর্তী (জ. ১৯৫৩) অভিনেতা ও নির্দেশক হিসেবে পরিচিত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) ‘মেজদিদি’ (১৯১৫) ও ‘দেবদাস’ (১৯১৭) উপন্যাসের যাত্রারূপ দিয়ে তিনি আশির দশকে যাত্রাঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন। চলমান সমাজের বিষয় নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘ডিসকো ড্যন্সার (১৯৮৪)। এটি যাত্রামঞ্চে পেশাগত যাত্রাদলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ‘কলিকালের মেয়ে’ নামে এটি সংশোধিত ও নামান্তরিত হয়। একই বছরে রচিত তাঁর পালা ‘যৌতুক’ (১৯৮৪) এবং ‘সকাল-সন্ধ্যা’ (১৯৮৪)-ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

‘সকাল-সন্ধ্যা’ পালাটি বিভিন্ন অপেরায় ‘দস্যুরানী’ নামে অভিনীত হয়। দীর্ঘ সময় ব্যবধানে তিনি মীর মশাররফ হোসেনের (১৯৪৭-১০১২) উপন্যাস ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (১৮৮৫-৯১) অবলম্বনে রচনা করেন ‘কারবালা আজও কাঁদে’ (১৯৯৬)। ‘নীলকরের ছায়ামূর্তি’, ‘স›দ্বীপরাজা দিলওয়ার খাঁ’, ‘সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ’, ‘মিরজাফরের আর্তনাদ’ ও ‘অমর প্রেম’। তাঁর ‘হার্মাদের প্রেম’ ও ‘বিধ্বস্ত নবাব মির কাশিম’ নাটকদুটি যাত্রামঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী। উলে­খ্য তাঁর সবকটি পালাই ঐতিহাসিক। নড়াইল জেলার পালাকার মহসিন হোসাইন (জ. ১৯৫৪) কবিয়াল বিজয় সরকারের সান্নিধ্যে এসে তিনি কবিয়াল হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। সত্তর দশকের অন্যতম কবি মহসিন হোসাইন ফোকলোরচর্চায় অবদান রেখেছেন। জগদানন্দ ঠাকুরের নরনারায়ণ অপেরা এবং নিরঞ্জন রায়ের জোনাকী অপেরার জন্যে তিনি মোট পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ যাত্রাপালা রচনা করেন। এগুলো হল- ‘মোগল হাটে সন্ধ্যা’ (১৯৭৯), ‘ঘুনে ধরা সমাজ’ (১৯৭৯), ‘কমলা সুন্দরী’ (১৯৮১), ‘মানিক পিরের দরগা’ (১৯৮৮), ‘বেদের মেয়ে মহুয়া’ (১৯৯৪), ‘ঘুমাও তুমি প্রিয়া’ (১৯৯৪), ‘সোনার বাংলা’ (১৯৯৫) এবং ‘সুন্দরবনের ডাকাত’ (১৯৯৭)। খুলনার পালাকার এমএ মজিদ (জ. ১৯৫৪) যাত্রা পালাকার পরিষদের তিনি সাধারণ সম্পাদক। এ-যাবৎ ৫০টি পালা লিখেছেন বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর উলে­খযোগ্য যাত্রাপালা হল নারায়ণগঞ্জের পালাকার প্রদীপ চক্রবর্তী (জ. ১৯৫৮)-র ‘চৌধুরী বাড়ির কান্না’, ‘মা কেন কাঁদে’, ‘জামশেদ ডাকু’, ‘চা বাগানের মেয়ে’, ‘অমাবশ্যার চাঁদ’ প্রভৃতি পালা লিখে প্রশংসা অর্জন করে। তাঁর কোনও পালা এখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হলেও যাত্রাদলের কাছে কদর রয়েছে। কেরানীগঞ্জের রফিকুল ইসলাম রানা (জ. ১৯৫৯)-র প্রথম প্রকাশিত গীতিধর্মী পালা ‘গরিবের কান্না’। তাঁর অন্যান্য পালা হচ্ছে রানার ‘রক্তাক্ত মসনদ’, ‘রাজার ছেলে ভিখারী’, ‘সুজন মালা’, ‘কলঙ্কিনী মালা’, ‘মা কেন কাঁদে’, ‘দস্যু জাফরান’, ‘গরিবের কান্না’ প্রভৃতি।

সিরাজগঞ্জ জেলার আবদুস সামাদ (জ. ১৯৫৯) রচিত পালার সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে ‘বেকার কেন কাঁদে’ (১৯৯০), ‘এ সমাজ ভাঙলো যারা’ (১৯৯৩), ‘ভাঙে নদী কাঁদে মানুষ’ (১৯৯৩), ‘মানুষ কেন কাঁদে’ (১৯৯৩), ‘ঘুমন্ত পৃথিবী’ (১৯৯৩), ‘জীবন নিয়ে খেলা’ (১৯৯৩), ‘কালো টাকার মানুষূ’ (১৯৯৫), ‘বেকারের আর্তনাদ’ (১৯৯৫), ‘বীর বাঙ্গালী’ (১৯৯৬), ‘একাত্তরের জল­াদ’ (১৯৯৬), ‘বস্তি থেকে প্রাসাদ’ (১৯৯৬), ‘বাইশ গাঁয়ের মোড়ল’ (১৯৯৭), ‘এরই নাম সংসার’ (১৯৯৮), ‘রক্তে রোয়া বাংলা’ (১৯৯৮) উলে­খযোগ্য।

‘আপন দুলাল’, ‘সৎমা’, ‘পিতা-পুত্র’, ‘স্বামী-স্ত্রী’, ‘নদের নিমাই’, ‘লায়লা মজনু’, ‘শিরি ফরহাদ’, ‘সাত ভাই চম্পা’ প্রভৃতি। নরসিংদি পালাকার মো. আমান উল­াহ (১৯৪০) ‘কমলার বনবাস’ পালা লিখে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর লেখেন ‘কমলার সংসার’ ও ‘সাগর রাজা’ নামে আরও দুটি পালা। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানার এম আশরাফ আলী (১৯৩৫) ‘মীরাবাঈ’ নামে একটি যাত্রাপালা রচনা করেন। বাংলাবাজারের মফিজ বুক হাউসের স্বত্বাধিকারী জসীমউদ্দিন আহমেদ (১৯৩৬-১৯৯৮) ‘গুনাই বিবি’, ‘রহিম বাদশা ও রূপবান কন্যা’, ‘আলোমতি ও প্রেমকুমার’, ‘অরুণ শান্তি’, ‘ভিখারীর ছেলে সুজন’, ‘সাগর ভাসা’, ‘আপন দুলাল’, ‘কাজল-রেখা’, গহর বাদশা বানেছাপরী’, ‘ছয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল’ প্রভৃতি লোককাহিনী ভিত্তি করে রচিত যাত্রাপালা রচনা করেন। ময়মনসিংহের পালাকার কফিলউদ্দিন আহম্মদ (১৯২৭-১৯৮৭) ‘নিজাম খুনী’ পালা লিখে আলোচিত হন। তাঁর অন্য পালা হল- মানিকগঞ্জ জেলার সমীরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৯৪০) পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে পালাকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর ‘পূজারিণী বধূ’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘ঘরের লক্ষী বড় বৌ’ এবং ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ পালাগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কাজী আবুবকর সিদ্দিকের (১৯৪০) ‘সাপুড়িয়ার মেয়ে’ গীতিযাত্রাপালাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

নেত্রকোণা জেলার পালাকার রাখাল বিশ্বাসের (১৯৬১) ‘দুঃখিনী বধূ’, ‘প্রেয়সী পতিতা’, ‘রক্তাক্ত সমাজ’, ‘কেল­া তাজপুর, ‘একাত্তরের সৈনিক’, ‘মহুয়া’, ‘দস্যুরানীর ফাঁসি’, ‘বেহুলা সুন্দরী’, ‘ডাইনি বেগম’ বা ‘পুষ্পচন্দন’, ‘কালো বাদশাহ’, ‘ঘূর্ণিঝড়’, ‘খুনি সম্রাট’ প্রভৃতি পালা বেশ জনপ্রিয় হয়। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার বান্দা তেতুলতলায় পালাকার দেবদাস ঢালীর জন্ম ১৯৬১ সালে। তাঁর প্রথম পালা ‘রীতিমতো অভিনয়’ (১৯৮৮)। ‘শ্রীকৃষ্ণ শকুনি’, ‘ভক্তের ভগবান’, ‘বাংলার মসনদ’ প্রভৃতি পালা রচনা করেন।

এছাড়া ‘জৈগুন বিবি’, ‘হিংসার পরিণাম’, ‘জামালযাত্রা’, ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’, ‘চৌদ্দ উজীর ও বেগম জরনেগার’ প্রভৃতির রচয়িতা বরিশালের কেএম. বশিরউদ্দিন; ‘শাহে এমরান ও চন্দ্রবান’, ‘জরিনাসুন্দরী’ প্রভৃতির রচয়িতা এম. মকবুল হোসেন; ‘মেহের নেগার রাজকন্যা’ পালার রচয়িতা ডা. আবেদ হোসেন; ‘কমলা সুন্দরী’, ‘দস্যু পাঞ্জা’, ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’, ‘নৌকাবিলাস’, ‘রাবনবধ, ‘রামপ্রসাদ’, ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘সোনার বাংলা’, ‘ভাওয়াল সন্ন্যাস’, ‘শ্যামারূপ’, ‘নিমাই সন্ন্যাসী’ প্রভৃতির রচয়িতা কালীপদ দাস; ‘কালো রক্ত’, ‘নেকড়ের থাবা’, ‘যে মন নীরবে কাঁদে’, ‘শেষ সাক্ষাৎ’ প্রভৃতির রচয়িতা চৈতন্যকুমার দেবনাথ প্রমুখ পালাকার পেশাদার যাত্রাদলের জন্যে পালা লিখেছেন।

‘ফাঁসির মঞ্চে দস্যু বিদ্যুত’ পালার রচয়িতা মাদারীপুরের ভূপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ‘বাসনার সমাধি’ পালার রচয়িতা গোপালগঞ্জের মনোরঞ্জন বিশ্বাস; ‘ভুখানাঙ্গা’ (১৯৯৩), ‘কাঙ্গাল’ (১৯৯৫), ‘সেতুবন্ধন’ পালার রচয়িতা চাঁদপুরের ইদ্রিস রায়হান প্রমুখ পালাকার সৌখিন যাত্রাদলের জন্যে পালা লিখেছেন। এদের সম্মিলিত অবদানের ফলে বাংলাদেশের পালার অভাব কিছুটা হলেও দূর হয়েছে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত