| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

ঈদ সংখ্যার গল্প: নষ্ট চাঁদের আলো  । যুগান্তর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

সেজো কাকার বিলাসিতা তেমন কিছু ছিল না। যেটুকু ছিল, তার মধ্যে একটা হল বইপড়া। এছাড়া নানা ধরনের মানুষকে দেখাও একটা নেশা ছিল। তবে সেটা বিলাসিতা কিনা কে জানে! ছোটবেলা থেকে যত স্মৃতি আছে সেজো কাকাকে নিয়ে, বেশিরভাগই অবশ্য বইপড়া সংক্রান্ত। না, আরও কিছু অবশ্যই আছে। তবে সেসব গৌণ মনে হয়। 

একি! তুমি এটা পরে যাবে নাকি? ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল সীমন্তী। 

তার কথায় সেজো কাকার স্মৃতিভাবনা হারিয়ে গেল। একেবারে সীমন্তীর সামনে এসে পড়ল দেবায়ন। চোখে বিস্ময় ঝুলিয়ে রেখে বলল, হ্যাঁ এটাই। খারাপ কী?  

খারাপ-ভালোর ব্যাপার নয়। যেখানে যাচ্ছ তার সঙ্গে মানানসই হতে হবে তো! এইরকম গোলাপি জামা পরে যেও না। ইস্‌, কেমন যেন কুঁচকে আছে! ইস্ত্রি করা নেই মনে হচ্ছে। দাঁড়াও, আমি অন্য পোশাক দিচ্ছি। 

কথাটা বলেই দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে আলমারি খুলল সীমন্তী। এই জিনিসটা দেখে বরাবরই বিস্মিত হয় দেবায়ন। অত্যন্ত দ্রুত আলমারি খোলে সীমন্তী। অথচ দেবায়ন নিজে যতবারই আলমারি খুলতে গেছে, দেখেছে ঠিকমতো চাবি ঢোকাতে পারে না। যদিও-বা ঢোকানো গেল, খুলতে গেলেও অসুবিধা হয়। ল্যাচ ঘুরিয়ে চাপ দিতে বেশ শক্তি ব্যবহার করতে হয় তাকে। তাছাড়া সীমন্তী যেভাবে অজস্র শাড়ি ভর্তি করে রাখে আলমারিতে, তাতে খুললেই ঝুরঝুর করে পড়ে যায়। কিন্তু সীমন্তীর বেলায় সেসব হয় না। এই কারণেও আলমারি খুলতে ভয় পায় দেবায়ন। 

এটা পরো। পাটভাঙা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি বের করে দিল সীমন্তী। পাঞ্জাবিটা চেনা লাগছে না। নতুন নাকি? কবে কেনা হল কে জানে! প্রশ্নটা মুছে ফেলে জিজ্ঞাসা করল, এরকম নতুন জামাকাপড় পরে যাব সেজো কাকার ওখানে! 

তোমার পিঙ্ক টি-শার্টের থেকে তো ভালো। একজনের শ্রাদ্ধে যাচ্ছ, সেখানে সাদা জামাকাপড়ই ঠিকঠাক। 

আচ্ছা বেশ। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলে দেবায়ন। তারপর পাজামা-পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয় পাশের ঘরে। মনে মনে কিছুটা বিরক্তও থাকে সে। 

অ্যাই শোনো। 

সীমন্তীর ডাকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় দেবায়ন। 

বাবাকে বোলো আমি ধুতি আর পাঞ্জাবি বের করে দিচ্ছি। উনি যেন আবার নীল ফতুয়াটা পরে না যান। মাকে শাড়ি দিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরাও হয়ে গেছে। 

দেবায়ন কোনও জবাব না-দিয়ে হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আবার সেজো কাকার স্মৃতি চলে আসে মনে। 

বছর চারেক আগে সেজো কাকা এসে দিনকয়েক ছিলেন ওদের বাড়িতে। তখনও দেবায়নের বিয়ে হয়নি। একদিন ফোন করে বলেছিলেন, আমি ভাবছি তোদের ওখানে গিয়ে উঠব কদিনের জন্য। 

বেশ তো। চলে এসো। কবে আসবে বলো। আমি গিয়ে স্টেশন থেকে তোমাকে নিয়ে আসব বাইকে। 

না না, তার দরকার হবে না। আমি নিজেই চলে যাব রিকশায়। এখন তো টুকটুকিও চলে তোদের ওখানে। 

সেজো কাকার মুখে টোটো গাড়িকে টুকটুকি শুনে হাসি পেয়ে গিয়েছিল দেবায়নের। হাসি চেপেই বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তা চলে। তবু আমিই নিয়ে আসব তোমাকে। কবে আসছ বলো। 

যাব সামনের রবিবার। ওখান থেকে তোদের এলাকাটা একটু ঘুরে দেখব। ব্যারাকপুরে অনেক ঐতিহাসিক চিহ্ন আছে। গান্ধিঘাট, সেনা ব্যারাক, লাটবাগান, মঙ্গল পান্ডের স্মৃতি, আরও কত কী! আগে কতবার গেছি তোদের ওখানে। এসব কিছুই দেখাই হয়নি! রিটায়ারমেন্টের পরে এখন তো ঝাড়া হাত-পা। 

গান্ধিঘাটে যায়নি দেবায়ন কখনও। তবে একবার মঙ্গল পান্ডে পার্কে গিয়েছিল। সেখানে প্রেমিক-প্রেমিকার ভিড় আর উদ্দাম মেলামেশা দেখেছিল। সেসব কথা আর সেজো কাকাকে বলেনি সে। বরং বেশ উৎসাহ নিয়ে বলেছিল, চলে এসো কাকা। সব ঘুরিয়ে দেখাব। 

যদিও দেবায়ন নির্দিষ্ট দিনে বাইকে বসিয়েই নিয়ে এসেছিল। তবে নানা জায়গায় একা একাই ঘুরেছেন তার সেজো কাকা। দেবায়নকে সঙ্গী করতে চাননি। 

সেবার যে কদিন ছিলেন সেজো কাকা, তার মধ্যেই ছোটপিসির মেয়ে তন্বীর বিয়ের নিমন্ত্রণ ছিল। যে হালকা গোলাপি রঙের ফতুয়াটা পরে এসেছিলেন, সেটা পরেই গিয়েছিলেন। বাবা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হ্যাঁ রে বুড়ো, এই একটাই জামা এনেছিস? 

দেবায়নের সেজো কাকার ডাকনাম বুড়ো। ভালো নাম মহীতোষ। আর বাবার নাম মনোতোষ। 

হ্যাঁ বড়দা। এটাতেই চলে যাব। 

না না, আমি দিচ্ছি তোকে আমার জামা। তুই ওটা পরে যাস না। 

না বড়দা, লাগবে না। আমাকেই তো দেখবে ওরা, আমার পোশাক দেখবে না! 

তা হয় নাকি? মানুষের পরিচয় তার পোশাক আর ব্যবহার দিয়ে। বাবা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। 

আমাকে ওরা সবাই চেনে তো বড়দা! অসুবিধা কী? একটার পর একটা যুক্তি দিয়ে গেছেন সেজো কাকা। তবু পোশাক পাল্টানো যায়নি। 

কে আসছে সেটার থেকেও কী পরে আসছে, সেটা যদি বড় হয়ে ওঠে, তাহলে বরং তোরা যা দেবু। আমি একাই বাড়িতে থেকে যাচ্ছি। খানিকটা বিরক্ত হয়েই দেবায়নকে বলেছিলেন সেজো কাকা। ফলে এরপর আর কথা এগোয়নি। বাবা-মা চলে গিয়েছিলেন আগের দিনই। দেবায়ন সেজো কাকাকে নিয়ে বিয়ের দিন গিয়েছিল। ঐ পোশাকেই গিয়েছিলেন। নানা ভাবনা মাথায় নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে সীমন্তীর সামনে এসে দাঁড়াল দেবায়ন। 

বাহ্। এইবার একদম ঠিকঠাক মনে হচ্ছে। সীমন্তীর মুখে হাসির রেখা। দেবায়ন চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। তারপর মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে, সেজো কাকার পোশাক-আশাকের গল্প তো বলেছি তোমাকে। এইরকম একজনের শ্রাদ্ধকাজে যাওয়ার পোশাক নিয়ে এত ভাবলে কেন কী জানি! 

একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবে না! তোমার সেজো কাকা যেমন-তেমন পোশাক পরে যেতে পারেন বলে তুমিও যাবে ওনার কাজে? ওখানে কত লোক আসবে! তারা দেখলে কী ভাববে ভেবে দেখেছ? দেবায়নের কথা উড়িয়ে দিল সীমন্তী। শুনে চুপসে গেলেও সেজো কাকার স্মৃতি এসে ধাক্কা মারায় দ্রুতই মনখারাপটা উধাও হয়ে গেল। বরং তার মাথায় এল গোলাপি রঙের ব্যাপারটা। অদ্ভুত সমাপতন! সেজো কাকাও সেদিন গোলাপি ফতুয়া পরে বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন! আর আজ সেও… 

এর মধ্যেই বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। সীমন্তী জানালা দিয়ে উঁকি মেরেই বলে উঠল, ঐ যে, এসে গেছে গাড়ি। বাবা আর মাকে ডেকে দাও। 

দেবায়নকে অবশ্য ডাকতে হয়নি। বাবা সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মাও পিছন পিছন এসে হাজির। দুজনকে দেখে দেবায়ন অবাক হয়। একজনের নিজেরই ভাইয়ের শ্রাদ্ধকাজ। তিনি পরেছেন ধবধবে সাদা ধুতি আর গিলে-করা সাদা পাঞ্জাবি। আর-একজন প্রিয় ঠাকুরপোর মৃত্যুপরবর্তী কাজে যাচ্ছেন নীল রঙের চওড়া পাড়ের সাদা খোলের শাড়ি পরে। এটাও নতুন মনে হল দেবায়নের। 

আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটা একবার দেখে নেয় দেবায়ন। খারাপ লাগছে না। তবে মোটেই শ্রাদ্ধবাড়ি যাচ্ছে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন কোনও আনন্দ-উৎসবে চলেছে। 

সীমন্তী হালকা ছাই রঙের একটা শিফন পরেছে। বেশ অন্যরকম লাগছে ওকে। 

(২)

পৃথিবীর এমন কোনও ইজম দেখাতে পারবে বড়দা, যা নিরঙ্কুশ? যার মধ্যে সামান্যতমও বিরুদ্ধতা নেই। যা সমালোচনার ঊর্ধ্বে! আসলে সব ইজমই কমবেশি সত্য ও সম্ভাব্যতার মিশেলে তৈরি। এই দুটোকে মাথায় রেখেই চলা উচিত। কেন যে এর মধ্যে এত ভুল আছে, তার মধ্যে তত ভুল আছে বলে সবাই চেঁচামেচি করে, বুঝি না! সব ইজমের মধ্যে যেটা তুলনামূলক সেরা বা জনহিতকর, সেটাকেই গ্রহণ করা উচিত। যদিও কে, কীভাবে জনহিতকর ভাববে সেটা তার ওপর নির্ভর করে। 

একবার বাবার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনার সময় বলেছিলেন সেজো কাকা। বাবা বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দেবায়নের ধারণা ছিল সেজো কাকারও একই রাজনৈতিক বিশ্বাস। কিন্তু কথাটা শুনে চমকে গিয়েছিল দেবায়ন। বেশ মনে ধরেছিল তার। বাবা সব শুনে বলেছিলেন, এই কথাটাই আসল। জনহিতকর কিনা। আমার মনে হয় বামপন্থাতেই জনহিতকর ভাবনা বেশি। 

দেখো বড়দা, তর্ক করলে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু আমি তর্ক করতে চাইছি না। তুমি তোমার যুক্তি নিয়ে থাকো। তবে এটা বলতে পারি, তুল্যমূল্য বিচারে বামপন্থা একটু বেশি এগিয়ে থাকা। অবশ্য যদি ভুল ভাবে ব্যবহার হয়, তাহলে আর কী বলবে তুমি? থাক এসব আলোচনা। আমি বরং ‘বাংলার স্থাননাম’ বইটা নিয়ে ভাবি এখন। সেটাই পড়ছি কিনা! মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলেছিলেন সেজো কাকা। বাবাও রাজনৈতিক আলোচনায় ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। 

এসব স্মৃতি আবার দেবায়নের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছুটে-চলা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে তার মনে হল, বাবারও কি সেইসব দিনগুলো মনে পড়ছে? 

মেজো কাকা বিদেশে সেটলড। সেই কবে এদেশে এসেছেন মনে পড়ে না কারওই। ছোট কাকাও ব্যাঙ্গালুরুতে থাকেন। ওখানেই চাকরি করতেন। বছরে একবার আসেন পুজোর সময়। তাও প্রতিবছর আসেন না। ভাই বলতে এই সেজো কাকাই কাছাকাছি থাকেন। অবশ্য খুব কাছে নয়। শান্তিপুরের পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে বহু আগে। শরিকি বাড়ি নিয়ে ঝামেলা-ঝঞ্জাট মিটছিল না। তাই বাড়ি বিক্রি করে নিজেদের পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে যে-যাঁর মতো চলে গেছেন। দেবায়নের বাবা সেই সময় এক কলিগের থেকে খবর পেয়ে ব্যারাকপুরের জমিটা কিনেছিলেন। তারপর বাড়ি করে চলেও আসেন। স্টেট ব্যাঙ্কের ব্যারাকপুর ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর থেকে খুব দূরের কোনও ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি। সেজো কাকা শান্তিপুর ছেড়ে চলে আসেন রানাঘাটে। কাছাকাছিই চাকরি করতেন। প্রথমে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। পরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। বিয়েও করেছেন নিজে পছন্দ করে। 

সেজো কাকার বিয়ের আগে থেকেই তাঁর বাড়িতে কাজ করেন বুলির মা। যদিও বুলির মা বলেই সবাই জানে। কিন্তু বুলিকে কোনওদিনই দেখেননি দেবায়নের বাবা-মা, এমনকি সেজো কাকাও। তাঁকে এবাড়িতে কাজে ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় সেজো কাকার বন্ধু বিলাস সান্যাল বলেছিলেন, স্বামী-পরিত্যক্তা পুষ্পর একটি মেয়ে ছিল। তারই নাম ছিল বুলি। সেই ছোট্ট মেয়েটি মারা যায়। মেয়ে হয়েছিল বলে পুষ্পর উপর রাগ ছিল তাঁর বর ও পরিবারের। সেই রাগ বেড়েই চলেছিল। বুলি মারা যাওয়ার পর পুষ্পকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির পুরনো ইট-কাঠ-চেয়ার-টেবিলের মতোই পুষ্পও পুরনো এবং সেজো কাকার সংসারে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। পুরনো জিনিসের মতোই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে জানান দেন তাঁর উপস্থিতি। এমনিতে বুলির মা চুপচাপ এবং নির্বিরোধী। কিন্তু সেজো কাকার বাজারহাট বা কোনও কাজ অপছন্দ হলেই মৃদু শব্দে উষ্মা প্রকাশ করেন। 

দেবায়ন অবশ্য সেই অর্থে সেজো কাকিমাকেও দেখেনি। সেজো কাকার বিয়ের সময় তার বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর। এত অল্প বয়সের কথা মনে পড়ে না। তারপর তো বছর দেড়েকের মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। পুষ্পকে নিয়ে সেজো কাকিমা সন্দেহ করতেন স্বামীকে। এই নিয়ে তুমুল ঝামেলা হত প্রায়ই। পুষ্প সব শুনেও চুপচাপ থাকতেন। তাঁর আসলে কিছুই করার ছিল না। পুষ্পর নিজের বলতে তেমন কেউ ছিল না যার কাছে গিয়ে থাকতে পারতেন। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে সব শুনেও মুখ বুজে থাকতে হত তাঁকে। পুষ্পকে নিয়ে দিন কয়েক একটানা কথা কাটাকাটি চলার পর একদিন কাকিমা সব ছেড়েছুড়ে চলে গিয়েছিলেন। নিজে রেলে চাকরি করতেন। নিজের মতোই থাকতেন। কাকার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি। মায়ের থেকে এসব কথা শুনেছে দেবায়ন। 

দেবায়ন একবার সেজো কাকাকে সাহস করে জিজ্ঞাসা করেছিল কাকিমার ব্যাপারে। এড়িয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের আসলে নষ্ট সংসার। দেখবি চাঁদের গায়ে কালো কালো দাগ থাকে। আলো কিন্তু ঠিকই দেয় চাঁদ। সেইরকম আর কি! নষ্টচাঁদের স্নিগ্ধ আলো।’ দেবায়ন যা জানতে চেয়েছিল তার ধারপাশ দিয়েও উত্তরটা ছিল না। 

সত্যিই কি বুলির মার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল সেজো কাকার? মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল দেবায়ন অনেকদিন আগে। 

না না। বুলির মা তো ঠাকুরপোকে ভাইফোঁটাও দেয় প্রতিবার। 

তাহলে কী নিয়ে সন্দেহ করতেন কাকিমা? 

তা জানি না। তবে আমার মনে হয় বুলির মাকে সন্দেহ করা আসল কারণ নয়। আসলে ঠাকুরপো ভীষণ একরোখা। নিজের মতামত ছাড়া আর কারও মতামতের গুরুত্ব দেয় না। সুপ্রীতির কোনও কথাতেই আমল দিত না। সেজন্যই হয়তো বনিবনা হয়নি। 

চলে যাওয়ার পরে আর কোনওদিন আসেননি কাকিমা? 

না, আর যোগাযোগ রাখত না। ঠাকুরপোও আর সম্পর্ক রাখতে চাইল না। এমনকি উকিল দিয়ে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল, সেটাতেও সই করেনি সুপ্রীতি। 

তার মানে আর বিয়েও করেননি? 

দুজনের কেউই আর বিয়ে করল না। ঠাকুরপোকে অনেক বলেছিলাম। তোর বাবাও কত বললেন আইনি ব্যবস্থা নিয়ে বিয়ে করতে। ও শুনলই না কারও কথা! মার গলায় ছিল চাপা হতাশা। 

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই মায়ের দিকে চোখ গেল দেবায়নের। চশমার পুরু কাচের ভেতর দিয়ে জানালার বাইরের চলমান দৃশ্য দেখছেন। 

ড্রাইভারকে নিয়ে পাঁচজন গাড়িতে। অথচ ভেতরটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মনোতোষ ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আছেন। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছেন। একপাশে দেবায়নের মা আর অন্যপাশে দেবায়ন বসেছে। মাঝখানে সীমন্তী বসে একমনে নেল পালিশ লাগাচ্ছে নখে। মুখ নীচু। 

‘সুপ্রীতি জানে কিনা কে জানে!’ এই প্রথম মনোতোষ কথা বললেন। গাড়ি চলতে শুরু করার পর ইতিমধ্যে মিনিট চল্লিশ কেটে গেছে। আর বড়জোর আধ ঘণ্টা লাগবে সেজো কাকার বাড়িতে পৌঁছতে। এর মধ্যে দেবায়ন বা সীমন্তী দু-একটা কথা বলেছে মাত্র। তার মা তাও বলেননি। মনোতোষ যেন কথা নয়, হাওয়ায় কয়েকটা শব্দ ভাসিয়ে দিলেন। চোখ ছিল না কারও দিকেই। পেছন ফিরেছেন শুধু। 

মুখটা ঘুরিয়ে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেবায়নের মা ঠোঁট উলটে বুঝিয়ে দিলেন, জানেন না সুপ্রীতি খবরটা পেয়েছে কিনা। ততক্ষণে তাঁর স্বামীর চোখ আবার ফিরে গেছে কাচ ভেদ করে সামনের ছুটন্ত রাস্তায়। 

(৩)

বুলির মা এটা-সেটা নানা কাজে ছুটে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে মৃতের ফটোর সামনে থমকে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। সেজো কাকা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখতে চাইতেন না বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে। তাঁরাও মোটামুটি যোগাযোগ-বিছিন্নই ছিলেন। ফলে আনুষঙ্গিক কাজগুলো বুলির মাকেই বেশি করতে হচ্ছে বেশি। শ্রাদ্ধকাজ করছে দেবায়নের এক জ্ঞাতি ভাই বাপ্পা। পড়াশোনা তেমন করেনি। একটা ছোটখাটো প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। সেজো কাকা বাপ্পাকে নানাভাবে সাহায্য করতেন, দেবায়নরা জানত। বাপ্পা মন্ত্রোচ্চারণের ফাঁকে ফাঁকে এদিক-ওদিকে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে আর মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে ইশারায় বসতে বলছে কাছাকাছি সাজিয়ে রাখা চেয়ারে। যেন ওভাবেই আপ্যায়ন করাটা ওর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর-একটা ব্যাপারও জানা হয়ে গেছে সবার। সেজো কাকা তাঁর বাড়িঘর ও টাকাপয়সার একটা বিরাট অংশের হেফাজত বাপ্পাকে দিয়ে গেছেন। আসলে শেষদিকে বাপ্পাই তাঁকে দেখাশোনা করত। বাকি টাকা দিয়েছেন এক অনাথ আশ্রমে। 

যেখানে শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে, তার থেকে খানিকটা দূরে মনোতোষ বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ারে বসেছেন। দেবায়ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্রাদ্ধের কাজকর্ম দেখছিল আর চেনা-পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল একজন মহিলা সেজো কাকার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। গলায় কাপড়ের আঁচল জড়িয়ে একটু দূর থেকে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে বাবাকে প্রণাম করলেন তিনি। বাবা অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। স্পষ্টতই বিহ্বল চোখমুখ। চিনতে পারেননি, বোঝা যাচ্ছিল মুখ দেখে। দেবায়নের মা এগিয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন। দেবায়নও এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে। সেই মহিলার চোখের কোণে টলটলে জল। 

সুপ্রীতি! 

হ্যাঁ দিদি। কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেবায়নের মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন সুপ্রীতি। দেবায়নের মাও সম্ভবত কাঁদার সঙ্গী পেয়ে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। ধরা গলায় বললেন, সেই এলি, বেঁচে থাকতে এলি না! 

কোনও জবাব ফুটে উঠল না সুপ্রীতির মুখে। তাঁর থুঁতনির কালো তিল কেঁপে উঠল যেন। তারপর একবার বড় জায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। থমথমে মুখে নীচু গলায় বললেন, বুলির মাকে আমার কাছে নিয়ে যাব ভাবছি দিদি। আগে একদিন এসে কথা বলে গিয়েছিলাম। তখনও রাজি হয়নি। দেখি ও আজ রাজি হয় কিনা যেতে! 

আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে নিয়মভঙ্গের পরে বুলির মাকে দেবায়নরা নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। তিনিও রাজি হয়েছেন। দেবায়নের মা সেকথা উচ্চারণ করলেন না। সুপ্রীতি কথাটা বলেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন যেখানে স্বামীর ফটো রাখা আছে, তার কাছে। তারপর যে চেয়ারের ওপর ছবিটা রাখা, তার কাছাকাছি মেঝেয় বসে পড়লেন। অনেক কৌতূহলী দৃষ্টিকে তিনি উপেক্ষা করে চুপ করে বসে থাকলেন নতমুখে। 

কাজকর্ম ও খাওয়া-দাওয়ার পাট মিটে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। বাপ্পা পোশাক পালটে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে ইতিউতি। যেন এতক্ষণ বসে থেকে আপ্যায়নের যেটুকু পারেনি, সেটুকু পুষিয়ে নিচ্ছে। সুপ্রীতি তখনও বসেই আছেন এক জায়গায়। অনেকের শত অনুরোধেও সেখান থেকে ওঠানো যায়নি তাঁকে। 

দেবায়ন উদাস মনে উঠোন পেরিয়ে চলে গেল রাস্তার দিকে। খানিকটা এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছিল আকাশে নষ্ট চাঁদের উপস্থিতি। অনিবার্যভাবে সেজো কাকার স্মৃতি ভেসে উঠল মনে। 

একবার সেজো কাকা মাস দুয়েকের জন্য কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন কাউকে কিছু না-জানিয়ে। তারও মাসখানেক আগেই সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছেন কাকিমা। বুলির মাকে বলেছিলেন, ‘আমি বেশ কিছুদিন থাকব না। বেড়াতে যাচ্ছি। টাকাপয়সা রেখে গেলাম। কোনও অসুবিধা হবে না। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’ বুলির মা কিছু যে বলবেন, তারও কোনও উপায় ছিল না। কোথায় গেছেন সেকথা তাঁকেও বলে যাননি সেজো কাকা। পরে জানা গিয়েছিল তিনি রাজস্থানে গিয়েছিলেন। ওখানকার ইতিহাস খুঁটে খুঁটে নাকি জানতে চেয়েছিলেন। ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস অব রাজস্থান’ বইটি পড়ে তাঁর রাজস্থান দেখার ইচ্ছেটা বেড়ে গিয়েছিল। 

দেবায়ন শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল যে কাকিমা এর মধ্যে একদিন সত্যিই এসেছিলেন। মারা যাওয়ার দিন তিনেক পরে। বাপ্পাই নাকি খবরটা দিয়েছিল দেরি করে। অথচ এসব কথা দেবায়নরা জানতেও পারেনি। অবাক করা আর-একটি খবর হল, সেজো কাকার সমস্ত বইপত্র কাকিমাকে দিয়ে গেছেন, বইয়ের আলমারি সমেত। আর নিজের বিয়ের আংটিটা। সেইরকমই লেখা ছিল ডাইরির পাতায়। তার মানে কি ওঁদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল? কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি! নাকি সেজো কাকার অন্দরমহলে কাকিমার জন্য আলো জ্বালানো ছিলই। কিংবা নষ্ট চাঁদের আলো পড়ত দুজনের মাঝখানে? 

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে বলে আলো জ্বালানো হয়েছে ঘরে ও বাইরে। আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেল। জেনারেটর চালু করার লোকের খোঁজ পড়ল তখন। দেবায়ন ফিরে এল বাড়ির উঠোনে। 

নষ্ট চাঁদের মায়াবী আলোয় ভেসে যাচ্ছে উঠোন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে পড়ছে দেবায়নের সেজো কাকিমার মুখে। ছড়িয়ে পড়ছে তার বাবা, মা, সীমন্তী বা উপস্থিত আত্মীয়পরিজনের শরীরেও। 

দেবায়নের মনে হল, সেজো কাকা হয়তো আবার বেড়াতে গেছেন কোথায়, কাউকে কিছু না-জানিয়ে। ফিরে আসবেন কিছুদিন পরে। তখন কি সেজো কাকিমা তাঁর সঙ্গেই থাকবেন ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে? নষ্টচাঁদের আলোয় নিশ্চয়ই ভরে যাবে ঘরদোর, উঠোন! 

দেবায়নের এই ভাবনার মধ্যেই জেনারেটরের ঢিক ঢিক শব্দ শোনা গেল। শেষ হয়ে যাওয়া শ্রাদ্ধবাসরে জ্বলে উঠল আলো। 

নষ্টচাঁদ তখন আকাশে ম্রিয়মাণ। 

 

 

6 thoughts on “ঈদ সংখ্যার গল্প: নষ্ট চাঁদের আলো  । যুগান্তর মিত্র

  1. নষ্ট চাঁদের আলো। এমন কতো নষ্ট চাঁদের আলো খেলা করে যায় কত কত সম্পর্কের উঠোনে। যুগান্তর মিত্রের কলমে সেই আলোর একক্ণা অক্ষরশরীরে বদলে গেল।

  2. সম্পর্কের মধ্যে একটা চাঁদ থাকে। তবে সেটা কখন কিভাবে আলো দেবে বোঝা মুস্কিল। ভালো লাগলো গল্পটা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত