ঈদ সংখ্যার গল্প: মারী । রাজীব কুমার ঘোষ
(এক)
খেয়াল করে দেখলাম এতক্ষণ আমি একটা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। লাশের পেশা: প্রাক্তন ডক শ্রমিক। মৃত্যুর সময় বেকার। চোলাই মদ বিক্রী করে সংসার চালাতেন। বয়স: ৪২ বছর। বাড়ি: চুঁচুড়া থানার কেওটা শ্যামসুন্দরপুরে। পারিবারিক ভিটেয় ভাই ও অন্যান্যদের সঙ্গে থাকতেন। নিজস্ব ঘর আনুমানিক দশ ফুট বাই দশ ফুট। টালির চাল দেওয়া ছেঁচা বেড়ার মাটির দেওয়ালের ঘর।
ক্লাব লাগোয়া যে ঘরটার সামনে আমি দাঁড়িয়ে সেটা কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট হবে। বন্ধ দরজার তালাটা আরেকবার অধৈর্য হয়ে টানলাম। ভ্যানওয়ালা আর তার শাগরেদ আওয়াজ ছাড়ল, “আর কতক্ষণ?” আমি শূন্যে এমনভাবে হাত নাড়লাম যার মানে অনেক কিছু হতে পারে। তারপর পায়ের তলা থেকে উইপোকায় খাওয়া লাশের অংশ তুলে নিলাম।
এতক্ষণ পায়ের তলায় চাপা পড়া একটা অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম। ভয়াবহভাবে উইপোকায় খাওয়া পাতাগুলো তুলে নেবার পর নজর আসল ‘এ পি ডি আর’ নামটা আর ‘চুঁচুড়া পুলিশ হেফাজতে’ এইটুকু অংশ। পাতাটা ওল্টাতেই ‘দেবু প্রামাণিক’ নামটা পাওয়া গেল আর ঝট করে মনে পড়ে গেল কেসটা। মনে পড়ে গেল ভিক্টোরিয়া জুট মিলের ভিখারি পাসোয়ানের কেসটাও। দুটোই চুঁচুড়া থানায় পুলিশের পিটিয়ে মারার অভিযোগ। তার মানে এটা এ পি ডি আর-এর প্রচার পুস্তিকার একটা পাতা। আমি আবার নিচের দিকে দেখলাম শুধু দেবু প্রামাণিক নয় অজস্র উই খাওয়া বইয়ের পাতায় পাতায় রাস্তার ধার আর নর্দমাটা সাদা হয়ে আছে। এগুলোও লাশ- বইদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। অনাদর, অবহেলার অত্যাচারে খুন হয়ে যাওয়া বইদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
হাতের উই খাওয়া দেবু প্রামাণিকের লাশ ভাসিয়ে দিলাম হাওয়ায়। মনে পড়ল শাহরুখ খান আর পূজা ভাট। চুঁচুড়া থানা ঘেরাও চলছিল, কাতারে কাতারে লোক আর প্রবল বিক্ষোভ। আমরা বন্ধুরা সযত্নে থানার রাস্তা এড়িয়ে ‘রূপালী’ বা ‘কৈরী’ সিনেমাহলে ‘চাহত’ দেখেছিলাম। হলে গম গম করছিল কুমার শানুর গান ‘দিল কি তনহাই কো আওয়াজ বানা লেতে হ্যায়…’ আমাদের দায় পড়েছিল পুলিশের ক্যালানি খেয়ে কোন দেবু প্রামাণিক মরে গেছে তাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে। আমাদের চাহত ছিল শাহ্রুখ।
এ পি ডি আর-এর কোনো সদস্য লাইব্রেরিতে দিয়েছিল নিশ্চয়ই প্রচার পুস্তিকাটা। ভেবেছিলেন লাইব্রেরির পাঠকরা টেবিলে রাখা পুস্তিকা পড়ে গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন হবেন। তিনি কি ভেবেছিলেন লাইব্রেরিটার-ই একদিন এনকাউন্টার হয়ে যাবে। লাইব্রেরিটা একদিন লাশ হয়ে যাবে। মনে হয় ভাবেননি। আমি কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট সেই লাশের দিকে তাকালাম। ওপরে একটা চৌকো শূন্যস্থান সুনিশ্চিত করছে দীর্ঘকাল ঝুলে থাকা টিনের সাইনবোর্ড। ওটা যেন এনকাউন্টারের গুলির দাগ। দীর্ঘকাল ধরে দেখে দেখে সাইনবোর্ডটা এখনো মাথার মধ্যে আছে। মাথার মধ্যে থাকা সাইনবোর্ডটা খাপে খাপে বসে গেল শূন্যস্থানে। যার বুকে অর্ধবৃত্তে লেখা ‘দেশবন্ধু পাঠাগার’।
সাইকেল নিয়ে হুস করে এসে, ক্রিড়িং করে বেল মেরে নামলেন সুধন্য কাকু। করোনার ডামাডোলে অনেকদিন কাকুকে দেখিনি। মাথায় পাকা চুল, মোটা চশমার ফ্রেম বাদে বাকিটা সার্জিকাল মাস্কের তলায়। কপালের দাগটা এখনো স্পষ্ট। কাকু আর আমার বাবাকেও, দুই বন্ধুকে পুলিশ কেলিয়েছিল একসঙ্গে। আমার দাদুর জন্য কাকু আর বাবা বেঁচে গিয়েছিল। না হলে ড্রেনে ভেসে থাকা ওই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বইয়ের পাতাগুলোর মতোই বাবা আর কাকুর লাশ পড়ে থাকত কোনো হাইড্রেনে। দাদু বরাবর কংগ্রেসি, সেই সুবাদে প্রভাব খাটিয়ে বাঁচিয়েছিলেন দু’ই যুবককে। বাবা, সুধন্য কাকু ছিল নকশাল। এখন বাবা দেখি মাওবাদীদের হয়ে কথা বলে। কয়েক বছর চাকরির পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করে এখন আমি পুরো কামাওবাদী। যেখানে কামানো যাবে সেখানে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। চুঁচুড়ায় টাকা ওড়ে, আমি তাকালেই দেখতে পাই সেইসব ওড়া টাকাদের। শুধু টাকাদের টেক অফের জায়গাটা বার করে নিতে হয় তারপর নিজেকেও ভাসিয়ে দিতে হয়। নিজের জায়গাটা ভালোই করে নিয়েছিলাম হঠাৎ এই করোনা এসে ঘা দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিল। তবে এখন টাকাগুলো আবার উড়তে শুরু করেছে। টেক অফের জায়গাগুলো শুধু বদলেছে। আমিও আবার পৌঁছে যাচ্ছি সেইসব এয়ারোড্রামে। আমার ছড়ানো হাতে আবার হাওয়ার টান টের পাচ্ছি।
(দুই)
আমি এখন লাশের পেটে, যে লাশের নাম ‘দেশবন্ধু পাঠাগার’। ছোটোবেলা থেকে এই লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসতাম। ফাঁকা কাঠের আলমারিগুলো আলো আঁধারিতে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। বই ঠাসা থাকত আলমারিগুলোয়। প্রতিটি বই বাঁধানো, স্পাইনের কাপড়ে সাদা কালি দিয়ে বাংলায় নম্বর লেখা থাকত। এই লাইব্রেরির তিন হাজার, সাড়ে তিন হাজার নম্বর অবধি সব বইতে আমার হাতের ছাপ ছিল। ছিল, এখন আর নেই, বইগুলোই নেই। কালকেই দেবানন্দপুরের দিকে কোন লাইব্রেরির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বইগুলো। তাদের বাছাবাছির পর পড়ে থাকা বইগুলো ওজনদরে বিদেয় হয়েছে। এখন ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে উই ধরা বইগুলো যেগুলো কাবাড়িওয়ালারাও নেয়নি। আজ সব ঝেঁটিয়ে সাফ করা হবে।
আমার মতো ঘোরতরো কামাওবাদীর বুকেও কাঁপন ধরল। ওই তিন হাজার, সাড়ে তিন হাজার বইয়ের পর ধীরে ধীরে আমার লাইব্রেরিতে আসা বন্ধ হয়ে গেছিল। জীবন ঘুরে গেল অন্য খাতে। শুধু আমার জীবন নয় চুঁচুড়ার জীবনও বোধহয় ঘুরে যাচ্ছিল। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় খান পঞ্চাশ বই দেওয়া নেওয়া হতে আমি দেখেছি, পরের দিকে তা নেমে এসেছিল খান দশে। সেই সময় ফেরত দেওয়া বই জমে ছোটো পাহাড় হয়ে যেত। বন্ধ হবার আগে সব বই হাতে হাতে তুলে যার যার নম্বরের জায়গায় রাখতে মিনিট দশেক লেগে যেত। আমিও কতবার হাত মিলিয়েছি। লাইব্রেরির একটা বড় পাঠক ছিলেন বয়স্করা। বয়স্ক পুরুষ এমনকি মহিলাদের ভিড় থাকত। অনেকেই আসতে অক্ষম হলে বাড়ির কোনো সদস্যকে পাঠাতেন বই পাল্টে নিয়ে যেতে। সময়ের নিয়মেই তারা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হলেন। আর আমাদের সময় থেকেই তো ঘরে ঘরে টিভি, তারপর সুপার হিট মুকাবিলা, তারপর কেবল টিভি, তারপর শনিবার রাতের ন্যাংটো ছবি, তারপর সলমন, শাহরুখ, তারপর মেগা সিরিয়াল, তারপর কম্পিউটার গেমস, আর এখন এই মোবাইল! যে মোবাইলে অযথা কোনো কারণ ছাড়াই একটা ছবি তুললাম শূন্য আলমারিগুলোর। যদিও জানি ভার্চুয়াল এন্টারটেনমেন্টের বাইটে বাইটে, বহু তলায় চলে যাবে ছবিটা।
ভ্যানওয়ালা আর তার শাগরেদ ঢুকে এসেছে। মুখের মাস্কগুলো নাকের নিচে, এই শালাদের জন্যই ফুটে যাব আমরা। গোটা চুঁচুড়া মাস্ক পড়ব না প্রতিজ্ঞা করেছে বলে মনে হচ্ছে।
“কোনটা?”
আমি হাত তুলে কোণার কাঠের আলমারিটা দেখালাম। ওরা দুজনে সেটা টেনে, হেলিয়ে বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকল। আমি বলে উঠলাম, “সাবধানে।” বলার কোনো মানে হয় না। কয়েক দশক পুরনো আলমারি। নেহাত পুরনো যুগের মাল তাই এখনো টিঁকে আছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে টিঁকে আছে মাথায় লেখা নামটা ‘গোপালচন্দ্র আঢ্য’। দাদুর বাবা, আমার প্রপিতামহ। আমার দাদু লাইব্রেরিকে তার বাবার স্মৃতিতে দিয়েছিলেন এই আলমারিটা। তখন যে কোনো লাইব্রেরিতে গেলে এইরকম আলমারি চোখে পড়ত। এখানেই সবকটা আলমারিতেই নাম লেখা, সবই কারো না কারো স্মৃতিতে দান করা।
ভ্যানওয়ালা বলে উঠল, “হাত লাগাতে হবে।”
আমি বুঝতেই পারছিলাম হাত লাগাতে হবে, সেকালের ভারি আলমারি। দু’জনে একেবারে হিমসিম খাচ্ছে। হাত লাগালাম, মুখের কাছেই দু’জন ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে। আমার সার্জিকাল মাস্ক কতটা করোনা আটকায় জানি না। এই শালা আলমারি কেসের জন্য কোভিড লাশ না বনে যাই। বহুত হুজ্জুতি, যে পার্টি ওপর থেকে নিচে টাকা খাওয়াতে পারবে সে লাশ পাবে, যে পার্টি পারবে না তাদের প্রিয়জনের কোন রাতে কোথায় যে গতি হবে কেউ জানে না। দাহ করতে নিয়ে যাবার সময় অনেকেই ফোন-টোনে খবর পায়না। পরে বলে দেওয়া হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে বলছে সব বকওয়াস, লাশগুলো কঙ্কাল হয়ে টাকা হয়ে যাচ্ছে। আরো নানা ধরণের কথা ভাসে। সত্যি মিথ্যে কেউ জানে না। আর বেশিক্ষণ এদের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওতায় থাকলে আমার জানা হয়ে যাবে।
সাইকেল ভ্যানে আলমারিটা রাখা হল। বললাম, “বেঁধে ফ্যালো।”
হাঁপাচ্ছি। বেশ ভারি আলমারি। কোমর টন্ টন্ করছে। ভাগ্য ভালো বাড়িতে একতলাতেই রাখা হবে এটা। ওপরে তুলতে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। আমি আবার ঢুকলাম ঘরের মধ্যে। সুধন্য কাকু তাকিয়ে আছে অন্য আলমারিগুলোর দিকে। আমার দিকে ফিরে বলল, “লেনিন বলতেন সফলতার তিনটি সূত্র- পড়ো, পড়ো এবং পড়ো। লাইব্রেরিগুলো উঠে যাচ্ছে। লোকে তাহলে কী এখন আর বই পড়ে না? নাকি লাইব্রেরির বইগুলো সব ব্যাকডেটেড, বাতিল?”
আমি মাথা নাড়লাম, যার অনেক রকম অর্থ হয়। সুধন্য কাকুকে ই-বুক, অডিও বুক, ওয়েবপেজ, ব্লগ এইসব বোঝানোর ঝামেলার মধ্যে আমি যেতে চাই না। সুধন্যকাকুদের সফলতা অর্থ ছিল দুনিয়া বদলানো। আমাদের যুগে সফলতার অর্থ নিজেকে বদলানো। তারও তিনটে সূত্র — মানিয়ে নাও, কামিয়ে নাও এবং জমিয়ে নাও। আর এর জন্য লাইব্রেরি কোনো কাজে দেয় না, পার্টি অফিস দেয়।
(তিন)
“একশো বছরের ওপরের হুগলি পাবলিক লাইব্রেরি সেও বন্ধ হয়ে গেছে কবে। এরপর তো একের পর এক লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই চুঁচুড়াতেই একসময় পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল, এখন অধিকাংশই উঠে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটা আছে, তাও পাঠক নেই। ভালো ভালো লাইব্রেরি — ফাঁকা, কয়েকজন আমাদের মতো সাদা চুলের বুড়ো যায়। এই দেশবন্ধু পাঠাগার কত পুরোনো রাখতে পারলাম কই। এবছরেও এই নিয়ে চারটে লাইব্রেরি উঠে গেল।”
বলতে বলতে সুধন্য কাকু আনমনা হয়ে গেলেন। এই লাইব্রেরি এতদিন যে বেঁচে ছিল সে শুধু কাকুর জন্য। এখন আর লোক হয় না তাই ক্লাব কমিটি থেকেই সিদ্ধান্ত হয়েছে লাইব্রেরি বন্ধ করে দেবার। জায়গাটা ক্লাবেরই, ক্লাবেরই থাকবে। বইগুলো সব লেখাপড়া করে দিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য এক লাইব্রেরিকে। সিদ্ধান্ত হয়েছে যারা যারা আলমারিগুলো দান করেছিলেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কেউ ফেরত নিতে চাননি। পরিবারগুলো থেকে বলা হয়েছে ক্লাবের কাজে লাগিয়ে দিতে বা বেচে ক্লাবের উদ্যোগে সারা বছর যে নানারকম বস্ত্রদান ইত্যাদি কাজকর্ম হয় তাতে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু ক্লাব রাজি নয়। ক্লাব বলেছে ক্লাবের খরচাতেই আলমারিগুলোকে ফেরত পাঠানো হবে। ক্লাব পুরোনো আলমারি বেচাবুচির হাঙ্গামায় যেতে চায়নি। আর ফার্নিচার হিসাবেও এগুলো ব্যাকডেটেড।
একমাত্র ব্যতিক্রম আমার বাবা। বাবা প্রথম থেকেই আলমারিটা নিয়ে আসার জন্য রাজি ছিল। আজ বাবাই বলল, “আলমারিটা নিয়ে আয়, ক্লাবের পয়সায় আনতে হবে না। একটা ভ্যান রিকশা আর লোক নিয়ে যা। বাবা দাদুর স্মৃতিতে দিয়েছিল। ঐ আলমারিতে দাদুর নাম লেখা আছে। ওটা নিয়ে আয়। আমি সুধন্যকে বলে রেখেছি।”
কোনো মানে হয় না এই সেন্টিমেন্টের। মাঝখান থেকে আনতে কিছু টাকা গচ্চা। কিন্তু বাবার বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভালো নয়। এই করোনা-টরোনায় যদি কিছু হয়ে যায় আফশোষ থেকে যাবে ইচ্ছেটা পূর্ণ করতে পারলাম না। আমিও আর কিছু বলিনি। আজ তাই এসেছি আলমারিটা নিতে। আলমারিটা এখন শুয়ে আছে সাইকেল ভ্যানে চটের বস্তার ওপর, দড়ি দিয়ে বাঁধা। ভ্যানওয়ালা রেডি রওনা দিতে। আমি বাইকে স্টার্ট দিলাম, সুধন্য কাকার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আসি কাকা।” সুধন্য কাকা হাতটা একটু তুললেন। কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট। এত বড় জায়গা শহরের বুকে ক্লাব ঠিক কাজে লাগিয়ে নেবে। সুধন্য কাকাদের যুগ কবেই শেষ। তবু সুধন্য কাকার সান্ত্বনা থাকবে ঘরটা ক্লাবের কাজে লাগবে। বিদ্যাসাগর পাঠাগার উঠে গিয়ে তো এফ এল শপ হয়েছে, বিলিতি মদের দোকান।
ভ্যান রিকশা টানতে ভ্যানওয়ালার দম বেরিয়ে যাচ্ছে, বাম্পার আসলেই নেমে যেতে হচ্ছে। আমি সিওর বেশি টাকা চাইবে। বেলা বারোটা, মাথার ওপর রোদ নেমে আসছে সোজা। গোটা চুঁচুড়ায় কোনো ছায়া নেই। আমি বাইকে ব্রেক মারতে মারতে ভ্যানটার পিছনে যাচ্ছি। ভ্যানের ওপর দুপুর রোদে শুয়ে আছে গোপালচন্দ্র আঢ্য নামটা। স্বাধীনতা সংগ্রামী, তাম্রপত্র পাওয়া প্রপিতামহের নাম। আমাদের বাড়ি ছাড়া এই আলমারিটার ওপরেই নামটা টিঁকে আছে এতকাল। ছোটোবেলায় এই আলমারিটা যখন ঘাঁটতাম বেশ গর্ব হতো। সেই গর্ব দড়ি বাঁধা অবস্থায় চটের বস্তার ওপর চলেছে। পিছন থেকে আমার মনে হল আমি আলমারি নয় যেন একটা বড় কফিন নিয়ে চলেছি। শূন্য কফিন। ওই আলমারির মধ্যে অনেককাল ধরে থাকা বইগুলো আর নেই।
আমার দাদু কি ভেবেছিলেন তার বিপ্লবী বাবার স্মৃতিতে দান করা আলমারিটি কয়েক যুগ পার করে বইবিহীন হয়ে যাবে। ফাঁকা হয়ে যাবে। আমার প্রপিতামহের লুকিয়ে রাখা গোপন নথীগুলোর মতন বা আমার বাবার সেই লিফলেটগুলোর মতন বইয়ের ফাঁকা আলমারিও কি বিপজ্জনক? তাই ওরা আলমারিগুলোকেও আর রাখতে চায় না?
এই মহামারীর সময় শহর চুঁচুড়ার রাস্তায় নেমে পড়ে চলতে থাকা এক ফাঁকা আলমারিকে আমি ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে দেখতে থাকলাম। শহরবাসীরাও কি এই বিপদ বুঝতে পেরেছে? তাই কি সবাই এইরকমভাবে তাকিয়ে দেখছে? মাস্কের আড়ালে ওদের মুখগুলো কি হিংস্র হয়ে উঠছে? ওরা কি তাহলে ঝাঁপিয়ে পড়বে আলমারিটার ওপর? এতজনকে আমি কি আটকাতে পারব? তার চেয়েও বড় কথা আলমারিটা কি আমার পক্ষেও বিপজ্জনক?
আমি টের পেলাম আমার হাতের মুঠোয় বাইকের একসিলেটর আর ব্রেক একসঙ্গে ঘেমে উঠছে।

জন্ম ১৯৭৭, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া, হুগলি, চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘সাইন্যাপস্ পত্রিকা’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই ‘৩৫৮ বড়বাজার’, ‘চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হস্পিটাল’, ‘বিরাশি মাইল’, ‘অপূর্ব্ব কবিতাগুচ্ছ’ ও আরো কয়েকটি। এখনো পর্যন্ত গল্প সংকলন দুটি ‘ঘর ও দরজার গল্প’ (২০১৬) ও ‘অনেক জলের শব্দ’ (২০১৮)। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’, ‘শুভঙ্কর বলে কেউ নেই’। পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশযাপন পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো। উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি চন্দননগর গল্পমেলা কর্তৃক ‘অনাদি স্মারক সম্মান ২০১৯’।
যুগান্তর মিত্র says:
দারুণ গল্প। আলমারি একটি প্রতীক হয়ে ওঠে নানা ঘটনাপ্রবাহের কিংবা সময়ের ওঠাপড়ার। রাজনৈতিক বীক্ষণও চমৎকার ভাবে ধরা দেয়। অতিমারি, মাস্ক ইত্যাকার বিষয়ও গল্পের বুননের সঙ্গে জুড়ে যায় অনিবার্য ভাবেই।
ভজন দত্ত says:
খুব ভালো লাগলো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্প বলার ধরণটি গল্পটি পাঠককে পড়ার ভেতরে নিয়ে যায়।
গল্পের শুরুতেই যে চমক গল্পকার উপস্থাপন করেছেন তাতে পাঠক কাত হবেনই।
সর্বোপরি গল্পের বিষয়বস্তু অভিনব, এই সময়ের নিরিখে একটি ভালো গল্প পাঠের আনন্দ পেলাম।
SahanaLahiri says:
বেশ মনে হলো যেনো বাস্তব ঘটনা পড়েছি |
Manasi Ganguli says:
বাহ্ বেশ ভাল গল্প, বিষয়বস্তু অভিনব
বিশ্বদীপ দে says:
অদ্ভুত গল্প! এই গল্পের মধ্যে দগদগে একটা ক্ষত জেগে উঠেছে। সে ক্ষত সময়ের। মারণ ভাইরাসের প্রকোপের মতোই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সময়ের সেই নিজস্ব কামড়। সেই কামড়ের বিষ, যুগের নিজস্ব গরলের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় বইশূন্য আলমারিটা।
Sujoy Chakraborty says:
কি বলবো বলুনতো! প্রথমে যেভাবে গল্পটা শুরু হল, আর পরে যে দিকে টার্ন নিল, সেটা যে আপনার বয়ন-দক্ষতা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরনোকে নতুনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার যে কায়দা, তা অবর্ণনীয়। সাম্প্রতিক সময়ে অসাধারণ এক মেসেজ দিয়েছেন গল্পের মধ্যে। এমনই লেখা আপনি আরও লিখুন। ভালো থাকুন।