| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

ঈদ সংখ্যার গল্প: রাধারানীর স্থাবর অস্থাবর । শ্যামলী রক্ষিত

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

রাধারানী যতটা পারল কোমরটা সোজা করে দেখার চেষ্টা করল সূয্যি পাটে বসেছে কিনা। নারকেল গাছের মাথায় ঠিকরে পড়া আলোর দিকে চেয়ে দেখে। সূর্য থাকলে ওখানে আলো ঝিক মিক করে, সেটা দেখে বুঝতে পারে সূর্যি আছে না নেই। তার তো দিন রাত্রির বোধ চলে গেছে সেই কবেই। সূর্যের মুখ দেখেনি কত কাল। চারি দিকে এই ঝোপ জঙ্গল, বড়ো বড়ো গাছ ভেদ করে সূর্যের আলো এসে প্রবেশ করতে পারে না রাধারাণীর নুবজ চোখের দৃষ্টিতে। তবে দিন রাত্রি স্পর্শ সে পায় তার এককালে বাঁশির মত সুন্দর নাকের ভাঙা চোরা অবয়ব দিয়ে।

হ্যাঁ দিনের প্রতিটা মুহুর্তের গন্ধ সে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে এই ভিজে আওতায় থেকে থেকে কুকুরের মত ঘ্রাণ শক্তি অর্জন করেছে রাধারানী। যখন খুব অন্ধকার ঠেকে চোখে ,তখন একটা কুপী জ্বালিয়ে রাখে দাওয়ায়। তার পর খুঁটি নাটি কাজ সারতে থাকে আপন মনে । নারকেল পাতা চেঁচে কাঠি বার করে। ঝাঁ টা বাঁধে। কাট কেটে কুটে সাইজ করে সাজিয়ে রাখে। অন্ধকারেই দিব্যি কাজ করতে পারে রাধারানী। রান্না চালায় সেই বাস্তু দুজন এসে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে। তার পায়ের শব্দ পেলে সাঁ করে চলে যায়। এসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে কবেই। ভয় পায় না আর। অন্ধকারে ঘাটে পথে যেতে যেতে তালি দেয় আর বলে, কে কোতায় আছিস বাবা মায়েরা, পথ আগলে থাকিস না। রাস্তা থেকে সরে যা, আমায় যেতে দে বাপ। যেদিন দুধ কেনে সে, অর্ধেক দুধ ওদের জন্যে সবোরি কলা দিয়ে পাথর বাটিতে করে রেখে দিয়ে আসে। কখন এসে খেয়ে নেয়, টেরও পায় না। এরাই তো তার আপন জন। এই সব নিয়েই তার সংসার। এদের নিয়ে ভালোই আছে রাধারানী।

ছেলে মেয়েদের মুখ তার মনে পড়ে না কারুর। কেবল বড় খোকার জন্যে বুকের ভেতরটা ধু ধু প্রান্তরের মত খাঁ খাঁ শূন্যতায় চলকে ওঠে। চোখের পাতা ডিঙিয়ে নেমে আসে নোনা স্রোত। তার রিক্ত জীবনের এই বাঁধন তো তাকে নিয়েই সম্ভব পর হয়েছিল। কত স্মৃতি এসে ময়াল সাপের মত জড়িয়ে ধরে তাকে। ছট্ফট্ করতে থাকে অশীতিপর বৃদ্ধ রাধারানী। বুকের মধ্যে ফুলে ফুলে ওঠে তরঙ্গ। অভিমানের? ক্রোধের? না কি ভালোবাসার সে বুঝতে পারে না।

যখন অনেক খুঁজে পেতে কুলীন ব্রাহ্মণ ঘরের ছেলে মিলল ,তখন আর কিছু দেখার প্রয়োজন ছিল না কারুর। কেননা বিয়ে মানে তো আর কোনো স্বপ্ন পূরণ নয়। বিয়ে শুধু গোত্রান্তর। পর গোত্র হলেই মোক্ষ লাভ। কাজেই হদ্দ মাতলই হোক আর চুয়ার চন্ডালই হোক, পুরুষ মানুষ হলেই হল। অন্যকিছু দেখার দরকার হয়নি। ছোট বেলা থেকে শিক্ষা দীক্ষা বলতে তো একটাই। কী ভাবে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মানিয়ে নিতে হয়, মুখ বুঝে ভালো মানুষের পোয়ের মত কাজ করে যেতে হয়, হাজার লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনেও মুখে কিছু না বলে চুপ করে থেকে স্বামী সেবা করতে হয় এইসব। কাজেই শ্বশুর বাড়ি মানেই হাজার অপ্রাপ্তি, হাজার বেদনা তবু শ্বশুর বাড়ি নাকি যেতেই হবে। এবং কোনো প্রত্যাশা না নিয়েই থাকতে হবে সেখানে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে যাওয়া শুধু।

তবু নতুন বিয়ের পর, গায়ে হলুদ মাখা গন্ধ নিয়ে কেমন একটা ভর ভরন্ত অনুভবে জীবনটা কিছু দিনের জন্যে হলেও, কি এক জাদুতে ঘুর পাক খাচ্ছিল যেন। তার পর কিছু দিনের মধ্যেই মায়ার কাজল গেল মুছে। তখন লম্পট মাতাল চরিত্রের বরটাকে দেখে যেন বমি পেত তার। তার পাশে এক বিছানায় শুতে হবে ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠত রাধারাণীর। কিন্তু সে সব বেশি দিন টিকল না। মুখ ভর্তি দাড়ি নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করত যখন, তখন কেমন যেন উবে যেত দূরত্ব। খুব অবাক হয়ে ভাবে রাধারানী, কী করে যে ওই নোংরা লোকটাকে ভালোবেসে ফেলল কে জানে! তার রিক্ত জীর্ণ জীবনের প্রাপ্তির ভান্ডার পূর্ণ করে দিল তো ঐ মানুষটাই। সাত রাজার ধন মানিক এনে দিল এই শত ছিন্ন আঁচল পূর্ণ করে। তখন বুঝেছিল সে, কেন মেয়েদের এই রিক্ত জীবনের দিকে ঠেলে পাঠানো হয়। তার পর সারা উঠোন ভরে ছড়িয়ে পড়ে থাকত স্বপ্ন কুসুম। আনন্দে খুশিতে হুহু করে বয়ে যাচ্ছিল সময়। নীলমোহন মানে তার নীলু একাই ভরিয়ে দিল জীবনটা। তার পর বছরে বছরে দলে দলে এলো ওরা। রাধারানী আট সন্তানের জননী। তার সেই ছেলে মেয়ে একে একে চলে গেল সবাই। মেয়েদের বিয়ে হল এখানে সেখানে। ছেলেরা চাকরি পেলে দূর দূরান্তে। যার যেখানে সুবিধে হয়ছে চলে গেছে। রাধারানী কোনোদিন কাউকে ধরে রাখেনি। কারুর প্রতি সে তীব্র অধিকারবোধ দেখাতে পারে না কখনো। ভাবে নিজের স্বামীই যখন নিজের বসে থাকেনি কোনোদিন , তখন আর কার উপর জোর খাটাবে? সবাই এখন প্রত্যাশা করে আছে কবে তার মরণ হবে। কিন্তু সব চেয়ে বেশি অবাক হয়ে যায় হীরুর ব্যবহারে। মা কেমন আছে একবার উকি মেরে দেখে না কোনোদিন। হঠাৎ করে এসে বলে কিনা তুমি আমাকে আমার মালিকানা বুঝিয়ে দাও। আমার ভাগের ভিটে নিয়ে আমি যা খুশি হয় করব। রাগে ক্ষোভে বাকরুদ্ধ রাধারানীর। নিজের পেটের ছেলে বলে ভাবতেই ঘৃণা হয় তার। যে ছেলেটা তার সঙ্গে মুখে রক্ত তুলে খেটেছে, সে বললে তাও তার একটা মানে থাকত। তবু তার দাবির যুক্তি আছে।

সেবার নীলু যখন বলেছিল, জায়গার অনেক দাম উঠেছে মা। পারলে বিক্রি করে ফেলো। যার যার ভাগেরটা তাকে বুঝিয়ে দাও। ব্যথায় যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা কন কন করে উঠেছিল তার। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেছিল নীলুর দিকে। চোখের পাতায় জল ভরে গিয়েছিল। তার পর টুপ টাপ করে গড়িয়ে নেমে গিয়েছিল সে জল। হতবাক হয়ে জলভরা চোখে তাকিয়েছিল নীলুর দিকে। নীলুও নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ করে গিয়েছিল। তাই নিয়ে আর কোনোদিন কোনো কথা বলেনি। হীরু কিন্তু ছাড়েনি । মাঝে মাঝেই অাসে আর উৎপীড়ন করে। দালাল লেলিয়ে দিয়েছে আবার। রাধারানী রাগে,ক্ষোভে, অভিমানে দিন দিন নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে ওদের উপর। শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেবে তা নিজেই জানে না সে। তবে আজ সকালে সেই সুবলের ওই পাতকো কাঁটাবেন নাকি? হাঁক তাকে নাড়া দিয়ে গেছে ।

অদ্ভূত সুর করে হেঁকে যায় ছেলেটা। রাধারানী বিড় বিড় করতে থাকে নিজের মনেই। আহা! বেচারা। সারা দিনে একটাও কাজ মেলে কিনা কে জানে। অথচ রোজ এই ভোরবেলায় শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সাইকেল চেপে হেঁকে চলে যায়। পাতকো কাটাবে নাকি? শীত বর্ষা গৃষ্ম কোনো দিন কামাই নেই। কোন ছোট বেলা থেকে আসছে ছেলেটা। কচি মুখে দাড়ি গোঁফ গজাল। কার্তিক কুমোরের ভাইপো। নীলপুরে বাড়ি। চার পুরুষ ধরে জাত ব্যবসা করে খাচ্ছে। গোলা ভরা ধান, পুকুরভরা মাছ , অভাব ছিল না কিছু। কিন্তু মনে শান্তি ছিল না, দু’ মানুষের কারুর। একটা ছেলে ছেলে করে পাগল। এখানে ঠাকুর বাড়ি ,সেখানে রোজা বাড়ি । মাদুলি তাবিজ ডাক্তার কিছু বাদ দেয়নি। কিন্তু ছেলে পিলে আর একটা হলো না। কার্তিক কুমোর এসে মানুষটার কাছে কী কান্নাকাটি। শেষে সেই নির্বোধ ছাপোষা ভবঘুরে মানুষটাই বেশ বুদ্ধিমানের মত একটা সু-পরামর্শ দিলে। শুনেও শান্তি হয়েছিল রাধারাণী র সেদিন। উড়নচণ্ডী ভবঘুরে মানুষ । তার উপর মাতাল। বন্ধু বান্ধব বলতে তেমন কেউ ছিল না। কিন্তু কার্তিক ঠাকুরপো কেন জানি খুব ভালোবাসত তাকে। তো সে বললে, তোর হয় নি তো কি হবে। তুই তোর ওই ভাইপোটাকে দত্তক নে না । সে তো খুব জ্যাঠা ন্যাওটা দেখেছি । ভাইকে বলে রাজি করা। মানুষটার কথা শুনে তাই করলে কার্তিক ঠাকুরপো। প্রথম যেদিন দেখেছিল ছেলেটাকে, বুকটা ধ্বক করে উঠেছিল রাধারানীর। অবিকল বিলের মত দেখতে। বাঁকানো ঠোঁট, নধর চোখ আর কোকরানো এক মাথা চুল। তের চোদ্দ বছর বয়সের বিলে। সাক্ষাৎ কেষ্ট ঠাকুর।

কোথায় যে আছে ছেলেটা কে জানে। জাহাজের খালাসির চাকরি নিয়ে কোন দেশে যেন গেছে। খুব ছোটো থেকেই সে তার ভবঘুরে বাপের সমস্ত গুন গুলো আয়ত্ত করে ফেলেছিল। আশ্চর্য! কোনো দিন তেমনি করে বাপের সঙ্গ বলতে যা বোঝায় তা পায়নি। তবু কী অদ্ভূত ভাবে বাপের গুনগুলো পেয়েছে ছেলেটা। এ গ্রাম সে গ্রাম করে ঘুরে বেড়াত। ইস্কুল পাঠশাল যেত না। ওর দাদারা কত লেখা পড়া শিখলে কষ্ট করে। আর ও থাকল গন্ড মুখ্যু হয়ে। বাড়িতে একটা দিন তার মন টিকত না। এখান সেখান করে ঘুরে বেড়াত। শেষে একদিন ওই জাহাজের চাকরি পেয়ে চলে গেল। তার পর দেশে ফেরে নি আর কোনোদিন। কোথায় আছে , কেমন আছে সে এখন কে জানে। দেখলেও আর চিন্তেই পারবে না তাকে। দেখতে দেখতে সেই সুবলের চুলেই পাক ধরে গেল। কার্তিক ঠাকুরপো কবেই চলে গেছে। দিন কালও পাল্টেছে। এখন আর কেউ মাঠে যেতে চায় না পাইখানা করতে। কুয়ো পাইখানা করছে সবাই। তাকেও কত অনুরোধ করেছে ছেলেটা। ও ঠাকুমা এত কষ্ট করে পুকুরের পাড়ে যাবার কী দরকার তোমার? হাজার দুয়েক টাকা খরচ করো না। অনেক তো কষ্ট করেছো জীবনে। এখন এই বৃদ্ধ বয়েসে আর কেন এত কষ্ট করবে। আমার চেনা মিস্ত্রি আছে গো। গরুর গাড়ি করে পাট নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়ে যাব আমি। আর রাজমিস্ত্রি এসে তোমার ঘর বানিয়ে, প্যান বসিয়ে ফিনিস করে দেবে। এই পরশু দিনও এসে কত করে বলল, কদিন ধরে একটাও কাজ পাচ্ছি না ঠাকুমা। সংসার চলছে না গো। বুঝতেই তো পারছো দিন কাল কী পড়েছে?

রাধারানী ভাবতে থাকে, এই বাড়ি বাগান, পুকুর ঘাট সব কিভাবে তিল তিল করে করেছে এসব। কী অপরিসীম দুঃখ আর কী কঠিন বেঁচে থাকা! সেই হত দারিদ্রের সংসারে বুকে বল, চোখে স্বপ্ন, মনে সাহস আর শরীরে শক্তি নিয়ে রাধারাণী ঝাঁপিয়ে পড়ত কাজে। ছেলে মেয়েদের কথা মনে করে প্রতিটা ইট গেঁথেছে সে একদিন। অথচ সেই বাড়ি নিয়ে ভূতের মত সে একা বসে আছে এখন । ভাগ্যিস এই গাছ পালা আজিয়ে ছিল তখন! না হলে থাকত কী করে? এই গাছ মনে রেখেছে তার সেই রিক্ত জীবনের চালচিত্র। এই পাখি ওই বেজি আর সেই দুটো বাস্তু সাপ তাকে ছেড়ে চলে যায়নি কোথাও। ছেলে- মেয়েরা কাজের দোহাই দিয়ে , একে একে চলে গেছে নিজের নিজের সুবিধে মত। বউ ছেলে নিয়ে নতুন বাড়িতে সুখে শান্তিতে ঘর করছে তারা। একবার উকি মেরেও দেখে না কোনোদিন মা কেমন আছে। শুধু অপেক্ষা করে বসে আছে, মা মরে গেলে, তখন আসবে সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে। রাধারানী এই ভিটে ছেড়ে একদিনও কোথায় যেতে পারে না। ঘুম হয় না তার। খিদে পায় না। এমন অস্বস্তি হয়, মনে হয় পেট ফুলে মরেই যাবে। এখানে জন প্রাণী নেই। দুটো কথা বলতে পায় না। তবু এই বাড়িই তার কাছে মন্দির। এই গাছ পালা পুকুর ঘাটই তার সন্তান। আর কাউকে চাই না তার। কাউকে ডাকবে না কোনো দিন।

হঠাৎ করেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সুবলকে ডাকল আজ। এবার সে সত্যিই একটা পাতকুয়ো কাটাবে। মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিল। তার পর বাগানে ঘাটের কাছেই জায়গা দেখিয়ে দিল। মনের আনন্দে সুবল গর্ত কাটতে লাগল। তিন দিন ধরে কুয়ো কেটে সিমেন্টের পাট বসিয়ে কাজ ফিনিস করে টাকা নিয়ে বাড়ি চলে গেল সুবল।

রাধারানী ঝাঁটা নিয়ে পাতা জড়ো করতে শুরু করল তারপর। এই পাতার জ্বালেই তার সারাদিন চা দুধ গরম হয়ে যায়। গাছের শুকনো ডাল পালার আগুনে রান্না থেকে মুড়ি ভাজা সবই হয়। গুল কয়লা ঘুঁটে কিছুই কেনেনি জীবনে। লোকালয়ে থেকেও পুরোপুরি আরণ্যক জীবন তার। গাছের নারকেল আর কলা বিক্রি করেই সারা বছরের পোশাক আসাক, বিছানার চাদর কিনে ফেলে। শাক সবজি কিছুই কেনেনি কোনো দিন। এসবের মূল্য বুঝবে কী করে, ওই মাকুন্দরা? তাই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে গেছে শহরের খুপরিতে। যাক গে, যার যা মন চেয়েছে করেছে। মরলে মুখে আগুন দিতেও যেন না আসে পিশাচের দল। সম্পত্তি নেবে! দিচ্ছি তোদের। আমার পড়ে থাকুক সব। যুগ যুগ ধরে জানুক লোকে রাধারানীর ভিটে বলে। কাউকে আসতে হবে না। আমার সম্পত্তি আমিই আগলাব। গজ গজ করতে থাকে রাধারানী। আর বিছানায় শুয়ে অস্থির ভাবে এপাশ ওপাশ করে। নানান স্মৃতি এসে চোখের পাতা থেকে বুকের গভীরে প্রবেশ করছিল হামাগুড়ি দিয়ে। তারপর ক্রমশ ময়াল সাপের মত জড়িয়ে ধরছিল তাকে। খুব অসস্তি হচ্ছিল তার। বিছানায় উঠে বসল রাধারানী। তার পর কুপী জ্বেলে চৌকির তলা থেকে সমস্ত পেতল কাঁসার জিনিস বার করল। তরঙ্গ খুলে সোনা দানা গহনা যেখানে যা ছিল সব নিয়ে এলো। তার স্থাবর অস্থাবর সমস্থ সম্পত্তি এক এক করে নিয়ে গিয়ে কুয়োর মধ্যে ফেলতে লাগল সে। সব কিছু রাখার পর, বাড়ির দলিলটা রাখলো সব শেষে। আট দশটা পলিথিন পেপারে জড়িয়ে রাখল দলিলটা। কোনো ভাবেই যেন নষ্ট না হয়। তার পর সিমেন্টের চাকতিটা ঠেলে ঠেলে চাপা দিল ভালো করে। তার উপর মাটি চাপা দিয়ে দিল। অন্ধকারেই সমস্ত কাজ সেরে ফেলল সে একা। তার পর পুকুরের পশ্চিম পারের নারকেল গাছের দিকে চোখ রাখল, ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে। বুঝতে পারল, দিন শুরু হয়েছে কখন!

রাধারানী উবু হয়ে উঠুন ঝাঁট দিতে শুরু করে। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে প্রচণ্ড একটা ব্যথা করতে থাকে। ভাবে সারা রাত ঘুম হয়নি। গ্যাস অম্বল কিছু হয়েছে বোধহয়। ঘাটটা ঝাঁট দিয়ে, ঝাঁটা ধুয়ে নিয়ে এসে একটু গরম জল করে খেলেই ভালো হয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু ব্যথা প্রচণ্ড বাড়ছে ক্রমশ। কল কল করে ঘাম হচ্ছে তার। মনে করেছিল কাজটা শেষ করতে পারবে। কিন্তু হল না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল পাত কুয়োর ধারে। সঙ্গে সঙ্গে গভীর চট চটে একটা অন্ধকার সমুদ্রে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল তার সমস্ত চেতনা। ঠিক যেমন করে প্রতিদিন বিকেলে গভীর থেকে আরো গভীরে প্রবেশ করে টক টকে লাল সূর্যটা। তেমনি করে একটা পরিক্রমা শেষ হয়ে গেল নিশব্দে নীরবে। কেউ জানলো না। উপুড় হয়ে পড়ে থাকল রাধারানীর নির্জীব নিথর দেহ। ভগ্ন প্রাগৈতিহাসিক স্তম্ভের মত পড়ে থাকল নব নির্মিত পাতকুয়োর ধারে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত