| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

রাম কাহিনী 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
রাম, এই নামটাতে ছোটবেলা থেকে একটা এলার্জি ছিল। রাম, যে লোকটা সীতার দুঃখের কারণ। যে লোকটা সীতাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এমন একটা সময়ে, যখন সীতা অন্তঃসত্ত্বা। এই লোকটার মত খারাপ লোক এই বিশ্বভুবনে আর হয় না, হতে পারে না।
তারপর বড় হলাম। সংসার দেখলাম। বুঝলাম সবটাই এত সহজ নয়। কাউকেই ওর সবটা ভালো, ওর সবটা খারাপ তো বলা যায়ই না; এমনকী খারাপটাও যে সবসময় খারাপই, তাও বলে দেওয়া সহজ নয়! একপেশে মনোভাব থেকে বেরোনো রীতিমতো শক্ত কিন্তু…!
তবে যখন পুরো রামায়ণের অনুবাদ পড়লাম, তখন দেখলাম সীতাকেও, নতুন করে। রীতিমতো মুখরা! মানে মুখরা হতেই পারেন, আমি বা কেউ আপত্তি করার কে! কিন্তু সীতা মানে তো জানতাম শান্তবিনীতচিত এক কন্যা, যে শুধু স্মিত হেসে মুখটি নিচু করে থাকে। মোটেও তা নয়। একাধিকবার সীতা রামকে যাচ্ছেতাই কথা শুনিয়েছেন। লক্ষ্মণকে যা বলেছেন, শুনলে আপনার পিলে চমকে যাবে। সেটুকু অন্তত বলি এখানে। কেমন? 
যখন রাম গেছেন সোনার হরিণের পেছনে, লক্ষ্মণকে সীতার জন্যে রেখে; তারপরে মারীচের রামকন্ঠে আর্তনাদ শুনে সীতা ব্যাকুল হয়ে লক্ষ্মণকেও যেতে বললেন, মনে আছে সেইখানটা? লক্ষ্মণ প্রথমে আপত্তি করলেন, কারণ তিনি তো জানতেনই সোনার হরিণ হয় না, হতে পারে না। কিন্তু সীতা তো না শোনার পাত্রী নন। তিনি কি বললেন জানেন? বললেন, তুমি মিত্র রূপে শত্রু আসলে। তোমার উদ্দেশ্য হল যেনতেন প্রকারেণ আমাকে পাওয়া। তাই তুমি রাম মরুক, সেটাই চাইছ। ভ্রাতৃ স্নেহ-টেহ সব অজুহাত। আসলে তুমি চাও তিনি বিপদে পড়ুন আর মরুন আর তুমি হয়ত এই কারণে ভরতের সঙ্গেও যোগসাজশ করেছো।
ভাবতে পারছেন, সীতা বলছেন! এবং এই একবার না, এইভাবে কথা তিনি বলেছেন; আগেও পরেও! আবার বলছি, বলেছেন, বেশ করেছেন। সীতাও তো দেবী নন, ঠিকে-ভুলে ভরা একজন মানুষ।
হ্যাঁ,  রামেরও রাজ্য লোভ ছিল। শুরু থেকে তার প্রমাণ আছে, যদিও পিতৃভক্তি তার ওপরে তবু অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রামের উচিত ছিল প্রজারা যখন সীতার দিকে আঙুল তুলছে, তখন সীতার সঙ্গে বেরিয়ে আসা কিন্তু দুটো কারণে সেটা করতে পারেন নি। এক তো অবশ্যই রাজ্য লোভ, যদিও এই লোভ এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের মত শুষে খাওয়ার বদলে সুশাসনের লোভ! যে কোনো কাজের মানুষ এটা মানবেন, যে ভালোভাবে কাজ করার একটা লোভ থাকে। যেমন আমি পড়াতে ভালোবাসি, আমি চাইব যেভাবে হোক আমার পড়ানোর কাজটা বজায় থাকুক। 
দ্বিতীয় কারণটা সেই পিতা দশরথ। কেন জিজ্ঞাসা করছেন? আচ্ছা, ভাবুন তো, দশরথকে আমরা কি ভাবি? একটা কামুক স্ত্রৈণ বুড়ো! মজা কি বলুন তো, কোনো পুরুষ যদি তার স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে, তাকে আমরা স্ত্রৈণ বলে বিশ্রী হাসি, আমরা মেয়েরাও।
তা বাবার সেই স্ত্রৈণ তকমা যেন কখনো তাঁর গায়েও না এসে পড়ে, তা দেখার জন্য সীতার প্রতি অকারণ নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন রাম। কিন্তু তার মধ্যেই খেয়াল রেখেছেন যে স্ত্রীকে এমন জায়গায় পাঠাতে হবে, যেখানে আর এই সব ইতর লোকের প্রভাব না পড়ে, যেখানে তিনি নিরাপদ থাকেন। তাই বাল্মীকি মুনির আশ্রম।
রাজা দশরথের কথায় আসি একটু বিস্তৃতভাবে। বেদ-বেদাঙ্গ পারঙ্গম, পরম ধার্মিক, দূরদর্শী, তেজস্বী ইত্যাদি ইত্যাদি এবং পরম কামুক, পরম লম্পট। কৌশল্যা, সুমিত্রা এবং কৈকেয়ী ছাড়াও আরো তিনশ পঞ্চাশ জন স্ত্রী অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে তিনশ তিপান্ন জন স্ত্রী। দাসী প্রভৃতির হিসেবে আর গেলাম না। রাম বনবাসে যাওয়ার পর মৃত্যুশয্যায় দশরথ ডেকে পাঠাচ্ছেন সব স্ত্রীদের তখনই এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। কেকয়রাজ অশ্বপতির কন্যা অপরূপ লাবণ্যময়ী কৈকেয়ীকে বিবাহ করার জন্য যখন তিনি উতলা হলেন, তখনই মেঘে মেঘে বেলা ভালোই হয়েছে। তবু কামের নিবৃত্তি হয়নি। ধরে নেওয়াই যায়, যে শর্ত সত্যবতীর ক্ষেত্রে দাসরাজা রেখেছিলেন, রাজকন্যা কৈকেয়ীর ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় আরোই হবে না।  তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রামের রাজ্যাভিষেকের মত এতখানি  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন কখন? যখন ভরত শত্রুঘ্ন মামারবাড়ি গেলেন। আজ সিদ্ধান্ত নিলেন, পরের দিনই অভিষেকের দিন স্থির করা হল। বশিষ্ঠকে বললেন অভিষেকের উপকরণ আজই সংগ্রহের আদেশ দিন। রামকে বলছেন, যে সময়ে ভরত এই রাজধানী ছেড়ে প্রবাসে আছে, সেই সময়ই অভিষেকের উপযুক্ত, এই আমার মত (অযোধ্যা কাণ্ড, বাল্মীকি রামায়ণ, সারানুবাদ, রাজশেখর বসু, পৃঃ ৬৯)। আরোও মজা হল এই অভিষেকের নিমন্ত্রণ পাঠানো হল নানা নগর ও জনপদের প্রধান প্রধান ব্যক্তিদের। বাদ গেলেন দুজন। সীতার বাবা জনক, যিনি ব্রহ্মজ্ঞ ছিলেন, যিনি মিথ্যা সহ্য করতে পারতেন না। আর কৈকেয়ীর বাবা কেকয়রাজ অশ্বপতি। রাজপ্রাসাদেও দেখি, সবাই রামের রাজ্যাভিষেকের  খবর পেয়ে আনন্দে উতলা। কৈকেয়ীর কাছে কিন্তু এই খবর পৌঁছোয় নি।
কৈকেয়ী যখন গোঁসাঘরে, তখন তিনি মান ভাঙাতে বলছেন, বলো কোন অপরাধীকে মুক্তি দিতে হবে বা কোন নিরপরাধকে হত্যা করতে হবে? যে সময় বিনা বিচারে চোরকে চোর বললে নিন্দা হত, সেই সময় এমন উক্তি! সেই বলে না বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা! তা দোষটা বেশি কার? তরুণী ভার্যার? না কামাসক্ত বৃদ্ধ পতির?
ভরতকে দেখি  মামার বাড়ি থেকে ফিরে মায়ের ঘরেই বাবার খোঁজ করছেন, কারণ তিনিও জানেন তাঁর মায়ের কাছেই দশরথ বেশি থাকেন। 
রামের বনবাস যাত্রার সংকল্প শুনে কৌশল্যা বিলাপ করতে করতে বলছেন যে তিনি তো বহুদিনই স্বামীর অনুরাগের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত। এখনই তিনি কৈকেয়ীর দাসীর চেয়েও হীন অবস্থায় দিন কাটান, পরে কী হবে? কৈকেয়ী মান করেছেন শুনে  কৈকেয়ীর কাছে দশরথ যখন তাঁর মান ভাঙাতে এসেছেন, তখন স্বয়ং রচয়িতা তাঁকে কখনো  কামী, কখনো কামার্ত, কখনো কামোন্মত্ত বলে বিশেষায়িত করেছেন।
সত্যি বলতে কি, দশরথ যদি এমন কামুক না হতেন, রাম-সীতা লক্ষ্মণ-ঊর্মিলা, সত্যি বলতে কি পুরো পরিবারের এই দুর্দশা হতোই না। তাই রাম কখনো চান নি, তাঁকে কেউ দশরথের মতো বলুক। যদিও তার জন্য সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হল সীতাকে এবং রামকেও।
হ্যাঁ, রাম খানিক মেরুদণ্ডহীন। তাই বারবার অন্যের চোখে ঠিক থাকতে গিয়ে সীতাকে অপমান করেছেন। তবু ভাবুন তো, রাম তো অনায়াসে সীতাকে প্রথমেই ত্যাগ করতে পারতেন। করেন নি। অনায়াসে অন্য বিয়ে করতে পারতেন। করেন নি। যজ্ঞ স্ত্রী ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে জেনেও সোনার সীতা বানিয়েছেন, তবু বিয়ে করেন নি অন্য কোনো মেয়েকে।
আর নিজের সমস্ত ভুল আচরণের জন্য হতাশার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে শেষে সরযূর জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন!
কোনো অবতার কি আত্মহত্যা করতে পারে? মানুষ পারে। তাই রাম এখন আমার কাছে দোষে-গুণে প্রেমে-অপ্রেমে একটা মানুষ, যে শেষটায়  ভেঙেচুরে গেছিল একেবারে!
দিনের শেষে তাই রাম একজন মানুষ শুধু । 
আর রামায়ণ আর মহাভারত মহাকাব্য আরোও বেশি করে এই জন্য যে রামায়ণ ভগবানের অবতারকে আর মহাভারত স্বয়ং ভগবানকে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ রূপে দেখাতে সক্ষম হয়েছে ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত