| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

প্রোডাক্ট

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

১.

এইমাত্র এই ক্লিনিকে একটি বাচ্চা মারা গেছে। এই মৃত্যুর পূর্বপ্রস্তুতি ছিল অনুতাপহীন। বিস্ময়করভাবে মৃত্যুশোকও হলো অশ্রুহীন। বাচ্চাটির মায়ের জরায়ুতে যখন লম্বা নল ঢুকিয়ে মাংস পিণ্ডটি ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছিল তখন কাঁদার জন্য কেউ পাশে থাকেনি। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তে এই শহরের শত শত ক্লিনিকে ভূমিষ্ট হওয়া উত্তরপুরুষদের গর্বিত পরিজনেরা পরম আনন্দে চোখের জল মুছেছে আর গোটা দশেক অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকেরা অবৈধ গর্ভপাতের পেছনের গল্পগুলো নিয়ে রগরগে খবর পরিবেশন করেছে।

জীবনের হিসাব খুব অদ্ভুত। সেই হিসাবের পরোয়া না করে ‘নিউ লাইফ অ্যান্ড মাদারহুড’ নামের এই ক্লিনিকে একজন নার্স অপটু হাতে ভ্যাকুয়াম সাকারের মাধ্যমে মৃত শিশুটির রক্ত, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মাংস টেনে এনেছে। শেষ পর্যন্ত কাজটি মোটামুটি সফলভাবে সমাধা হয়েছে।

মায়ের অব্যক্ত বেদনা উপেক্ষা করে নার্সটি তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘আমি ভাই ইনকমপ্লিট অ্যাবরশন করি না, এমনভাবে করছি যে ভিতরে কোনো প্রোডাক্টই নাই। এক ঘন্টা রেস্ট নিয়া নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরা যান আর পিল খাইতে শুরু করেন, কোনো ঝামেলা হইব না।’

মেয়েটি যখন নিশ্চিন্তে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে তখন মেঘের ঢেউ ওর পায়ের কাছে নেমে এসেছে। মেঘের আর্দ্রতায় ওর পায়ের পাতাজোড়া ভিজে অচলপ্রায়। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে শিরশিরে অনুভূতিতে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে মেয়েটির, চোখ বন্ধ হয়ে আসে অদ্ভুত এক ইশারায়। ওর নাক-মুখ-চোখ তুষারের মতোন পেলব মেঘ আঁকড়ে ধরে। একসময় মেঘের ভাঁজ ভারি হয়ে অশ্রুবিন্দু হয়ে খসে পড়ে।

অশ্রুর রং এখন লাল। লাল অশ্রুতে সফেদ ওড়নার খুঁট রঙিন হয়। মেয়েটি ওড়নাতে সেই লাল জড়িয়ে নিয়ে রিকশায় ওঠে। রিকশায় বসতে বসতে শরীরী যন্ত্রণায় ওর মুখ-চোখ কুঁকড়ে আসে। আচমকা আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টির ঢল নামে। রিকশাওয়ালা দ্রুতগতিতে প্লাস্টিকের পর্দা এগিয়ে দিয়ে যাত্রীকে ডাকে, ‘বইন, পদ্দা জড়ান। ভিজ্যা যাইবেন।’

রিকশার যাত্রী শ্রবণশক্তিহীন। হাত বাড়িয়ে সে পর্দাটা নিজের কোলের ওপর রেখে নিশ্চল বসে থাকে। ঝুপ করে বাড়ে বৃষ্টির বেগ। মেয়েটি ভিজতেই থাকে। যাত্রীর নির্বুদ্ধিতায় রিকশাওয়ালা নিজেই পর্দা ছড়াতে ছড়াতে বিড়বিড় করে, ‘কোনো দিশা নাই। হসপিটালের রোগীরে ক্যান যে একলা ছাড়ে!’

মেয়েটি নির্বাক বসে থাকে। বৃষ্টির ছাঁটে ওকে অশ্রুহীন দেখায়। ওর চোখের দৃষ্টি লক্ষ্যহীনও। যেন গন্তব্য জানা নেই। রিকশা চলে, পঙ্খীরাজের গতিতে। মেয়েটি কী ভাবছে তা বোঝা যায় না। মনের নিভৃতে থাকা ভাবনাগুলো দেখা যায় না বলেই আকাশজোড়া মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামে। হঠাৎ অস্থির চোখে মেয়েটি তাকায়। ইশারা করে। রিকশাওয়ালা সেই ইশারা দেখে না, রিকশা ছুটে চলে। প্রথমবারের মতো যাত্রীর আর্তস্বর শোনা যায়, ‘এখানেই।’

এটাই ওর গন্তব্যস্থল। এখানে কেউ নেই। কোনো আলো নেই। এ যেন মানুষহীন বাড়ি। বাড়িটির গ্রিল ঘেরা লম্বা বারান্দায় টবের সারি। জলহীন টবের ফুল-ফলহীন গাছগুলো মৃত্যুর জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছে। মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে সন্ধ্যামালতীর গাছ দুটি উসখুস করে ফুলের ন্যাতানো পাপড়ি মেলে সময়ের আভাস দেয়, সন্ধ্যা নেমেছে। এই বাড়ির দক্ষিণপাশের একটা ঘরে মেয়েটি সাব-লেট থাকে। বাড়িওয়ালার অংশ উত্তরদিকে। মেয়েটি যে ঘরে থাকে সেই ঘরের আরেকজন সদস্য আজ অনুপস্থিত। টলোমলো পায়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিতে দিতে মেয়েটি মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়।

এই ঘরটি টিনশেডের। তপ্ত টিনের চাল দিনশেষে শরীর জুড়াচ্ছে বলে ঘরে ভ্যাপসা গরম। ঘরের ভেতরকার একমাত্র সচল বস্তু সিলিং ফ্যান বনবন করে ঘুরছে। আচমকা দমবন্ধ লাগে ওর। উঠে দাঁড়ায়। শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক অবসাদে মেয়েটির পা টলে যায়, আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই একটা মফস্বলী শৈশব ওর সামনে চলে আসে। পুরনো বইয়ের গন্ধ শোঁকার মতো নির্মল আরামে মাথার ভেতর চনমন করে ওঠে। আহা, ফেলে আসা শহরের সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যগুলো ওর চোখের সামনে ভাসে।

মেয়েটির মাকে মনে পড়ে। রোজ দুপুরে মা সব কাজ শেষে উঠানে পিড়ি পেতে বসে চুল শুকাতো। সামনে থাকতো সর্ষে তেলে ডুবানো আচারের মুখ খোলা বৈয়াম আর ডালা-কুলাতে মেলে দেওয়া ডালের বড়ি। কোনো কোনো দিন মা ওর সঙ্গে অনেক গল্প করতো; আবার কোনো কোনো মন খারাপের দিনে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, হয়তো হঠাৎ উধাও হওয়া বাড়ির বখে যাওয়া নেশাগ্রস্ত বড় সন্তানের গৃহ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় থাকতো। মাকে আনমনা দেখে দুষ্টু ছেলের দল প্রাচীর টপকে ওদের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়তো। পেয়ারার কচি কুঁড়ি ছিঁড়তো, কাঁচা আম পেড়ে জানালার গ্রিলে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে ডাকতো, ‘এই কণা আপা কাসুন্দি আছে? সাথে একটু মরিচগুঁড়োও দিও।’

কণা নামের মেয়েটি কান খাড়া করে। আবার যদি সেই ডাক শোনা যায়। মানুষ মাত্রই কি এমন? পিছুডাকে বিচলিত হয়? সময়ের ফ্রেমে বন্দি থেকে থেকে বারবার অতীত স্মৃতির জন্য উচাটন হয়ে ওঠে? পেছনে ফেলা আসা দিনের জন্য তার মনের ভেতরে অদ্ভুত এক টানাপোড়ন কাজ করে, তাই সময়-অসময়ে চোখ আটকে যায় স্মৃতির রঙিন ফিতের বায়োস্কোপে?

ওর দমবন্ধ লাগে। এ ঘরে এক ফোঁটা বাতাস নেই। বিছানা থেকে কোনোরকমে শরীর তুলে মেয়েটি ঘরের একমাত্র জানালার সামনে দাঁড়ায়। জানালা খুলে দিতেই মিশমিশে কালো অন্ধকার ঘরের ভেতর হামলে পড়ে। বাতাসের কম্পন গায়ে লাগতেই বোঝা যায় দিনভর বৃষ্টির জেরে আকাশের অমন মুখ ভার। নিরবচ্ছিন্নভাবে যানবাহনের বুনো শব্দ শোনা যায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ব্যস্ততা বাড়ে। বড় বড় মালবোঝাই ট্রাক, গাড়ি ছুটে চলে গন্তব্যে। বাসের অপেক্ষায় জট পাকানো মানুষেরা একটা বাস থামলেই প্রতিযোগিতা করে দৌড়ে যায়। একসময় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে একে একে ত্রস্তপায়ে সব গাড়ি থেমে যায়। সিগন্যাল অমান্য করে একটা মোটরসাইকেল বেরিয়ে যেতেই ট্রাফিক পুলিশ সতর্ক বাঁশি ফোঁকে। অদূরে ওয়ান স্টপ শপিং মলের ক্রমবর্ধমান ভবনের সামনের অন্ধকার রাস্তায় ব্যস্ত পথিকেরা হেঁটে যায়। কেউ কারো জন্য থামবার নয়। রাতের ব্যস্ততার পাঠ মস্তিষ্কে নাচন তোলে, এই শহর রাতের নির্জনতায়ও শব্দমুখর।

অন্ধকারে ধীর পায়ে হেঁটে এসে মেয়েটি বিছানায় বসে। চোখে অন্ধকার সয়ে এলে ঘরের জিনিসপত্র আবছায়ার মতো দৃশ্যমান হয়। শরীর বিছানায় ছাড়তে ছাড়তে ওর বুক নিঙড়ে একটি শব্দ হাহাকার হয়ে বেরিয়ে আসে। অন্ধকার ঘরে সেই শব্দ চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়, আহ! আহ! বেখাপ্পা শব্দেরা স্ফীত মাতাল বেলুনের সঙ্গে উড়ে বিলীন হয়ে যায় অন্ধকার আকাশে।

এবার মেয়েটি হাসে। এ হাসি এক দুর্বোধ্য ধাঁধা। ওর পিঙ্গল চোখের তারায় আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে যায়। মরা হলো না! গতকাল রাতেও মরে যাওয়ার ইচ্ছাটা অর্থবহ ছিল। পেটের ভেতর পাক খেতে খেতে যখন বারবার বমির বেগ গলা অবধি উঠে আসছিল তখন মুঠোভর্তি স্লিপিং পিল নিয়ে মেয়েটি মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েছিল।

মৃত্যু ওকে সুখময় শৈশব স্মৃতির মতো হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু ও মরতে পারেনি।

মেয়েটি ফিতের গিঁট খুলে পায়জামা টেনে নামায়। তলপেটের ভাঁজের কাছে পায়জামা আটকে থাকে। সেই বাঁধ ডিঙিয়ে ও কাঁপা কাঁপা হাতে তলপেট স্পর্শ করতে করতে ওপরে ওঠে। খোলা পেট ধুধু বালুচর। শূন্য সেই ভূমি খাঁ খাঁ করে। ফাঁপা, ভারহীন পেট। অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণায় মেয়েটি পেটের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। শ্রান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে এলে নার্সের ফিসফিসে কণ্ঠস্বর ওর কানের কাছে বাজতে থাকে, ‘ভিতরে আর কোনো প্রোডাক্ট নাই। সব পরিষ্কার।’

২.

রাস্তার ধারের শতবর্ষী মন্দিরের সংস্কার কাজ চলছে। এই পাড়া হিন্দু-অধ্যুষিত। এখানকার দুই শতবর্ষী মন্দিরের তবু বেহাল দশা। এখন অবশ্য পূজাকে সামনে রেখে মন্দির কমিটির কাজের খুব তোড়জোড় চলছে। এই ভাদ্রের মাঝামাঝি কাজ শেষ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষত রাস্তার ধারের এই মন্দিরটি সংস্কারের কাজ মহাসমারোহে চলছে। রাস্তার অর্ধেকটা বাঁচিয়ে বাকি অংশের ওপরে বালু আর ইট জড়ো করা হয়েছে।

ইট-সুরকির ওপর দিয়ে রিকশা যাওয়ার চেষ্টা করতেই এর আরোহীর শরীরে ঝাঁকুনি লাগে। তলপেটের যন্ত্রণায় শরীর কুঁকড়ে যায় মেয়েটির। যাত্রীর দিকে অপরোধবোধে তাকিয়ে রিকশাওয়ালা অদৃশ্য কাউকে দোষারোপ করে বিড়বিড় করতে থাকে। মেয়েটি শক্ত করে রিকশা ধরে বসে। আরেকটু এগোলেই ওর বাড়ির পথ। রিকশা যতো সামনে এগোয় রাস্তা জুড়ে মানুষের দিনযাপনের নিত্যকার চিত্রিলিপি ফুটে ওঠে। মফস্বল শহরের বিনুনি রাস্তাগুলো এতোই সরু যে একটা রিকশা যাতায়াত করলে পাশ দিয়ে পথচারীর হাঁটার জন্য খুব বেশি জায়গা থাকে না, তবু কত মানুষ হেঁটে যায় আর তাদের পাশাপাশি রিকশা, মোটর-সাইকেল, সাইকেলও চলাচল করে। মাঝে মাঝে হাঁক দিয়ে লোকজন পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে, কেউ কেউ দুদ- দাঁড়িয়ে গল্প করে।

মেয়েটির বাবার বাড়ি ইটের প্রাচীর ঘেরা হাফ-বিল্ডিং। দেখে বোঝা যায় কোনো মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের গ্রাচ্যুইটি আর পেনশনের টাকায় এই জমিতে অতি-কাক্সিক্ষত এই অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এই বাড়ির ডানে বামে সব পুরনো আধভাঙা একতলা দোতলা বড়জোর একটা-দুটো তিনতলা দালান বাড়ি, যেগুলোর কোনোটাই হাফ বিল্ডিংয়ের সমসাময়িক না। কোনো কোনো তিনতলা বনেদি বাড়ির তৃতীয় তলার বর্ধিতাংশ মূলত চিলেকোঠা। সংস্কারের অভাবে এসব বাড়ির দেয়াল পলেস্তরা খসা, জায়গায় জায়গায় নোনা ধরা আর গাঢ় সবুজ শ্যাঁওলা। বেশিরভাগ বাড়ির ছাদের দিককার দেয়াল ফুঁড়ে বটের বনসাই আর আগাছার ঝাড় লকলকিয়ে নিচে নেমে এসেছে।

মেয়েটি যে বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামে সেটির উল্টোদিকে সাহাদের বাড়ি। সাহা বাড়ির নাম ‘পূজা ভিলা।’ নাম খোদাই করা ‘পূজা ভিলা’র সামনের অংশের ফুল, লতা, পাতার বাহারী নকশা দেখলেই বোঝা যায় এর কারিগর দায়সারা কাজ সারেনি। খুব যত্নে তৈরি ‘পূজা ভিলা’ আজ অশীতিপর বৃদ্ধের মতো ধুঁকছে। রিকশা ভাড়া মেটাতে মেটাতে মেয়েটি চকিতে সাহাদের বাড়ির ছাদের দিকে তাকায়। ওই বাড়ির চিলেকোঠায় থাকা ছেলেটির নাম সে কোনোদিন জানতে চায়নি।

বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েটি পিছু ফেরে। ওই চিলেকোঠার জানালা, দরজা দুটোই বন্ধ। দেখে মনে হয় কেউ কোনোকালে বাস করেনি ওখানে। মামলা-মোকদ্দমায় জৌলুস হারানো ‘পূজা ভিলা’র জীবনযাপনের চিত্র ম্লান, ধূসর। এই বাড়ির যুবকেরা শহরমুখী। কেবলমাত্র সাহা কর্তা আর গিন্নি বাস্তুসাপ হয়ে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি পাহারা দিচ্ছেন।

মেয়েটি হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, এরপর চোখ বন্ধ করতেই ‘পূজা ভিলা’র ছাদে নিবিষ্ট মনে দাঁড়ানো এক যুবক আর এই বাড়ির বিশাল উঠানে দাঁড়ানো এক কিশোরীকে দেখতে পায়। এই দৃশ্যপটে কাপড় মেলবার ছলে বারবার কিশোরীটি দৌড়ে দৌড়ে উঠানে আসে। মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে কাউকে দেখার প্রজাপতি মন নিয়ে অনেকটা সময় খরচ করে সে বাবার লুঙ্গি, মায়ের শাড়ি-গামছাখানা পর্যন্ত টান টান করে মেলে দেয়।

শীতল বাতাসের ঝটকা এসে লাগে শরীরে, চোখ মেলে মেয়েটি চমকে ওঠে। মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়ে যায়, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে; মনে হয় এখনো ক্লিনিকের বেডে শোয়া আর দুটো হাত সাঁড়াশির মতো ওর নিম্নাঙ্গ চেপে ধরেছে, তলপেট ফুটো হয়ে তরল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, সেই সঙ্গে কেউ অনবরত সূঁচের খোঁচা দিয়ে চলেছে ওর সমস্ত শরীরে। আহ! উদভ্রান্ত মেয়েটি হাতের ব্যাগ ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। ধূসরনীল মেঘদল ওর পিছুপিছু এখানেও চলে এসেছে। ওর দেখভালের ঠিকেদারি নিয়েছে আকাশ, যদিও বোঝা যায় এই বাড়িতে ওর গৃহপ্রবেশ নিয়ে কারো মাঝে কোনো আদিখ্যেতা নেই।

এই বাড়ির নাম ‘স্নেহনীড়।’ বহুদিন আগে একমাত্র বংশপ্রদীপের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়ির সব স্নেহ আর আনন্দচিহ্ন মুছে গেছে। বাড়ির উঠানের এখানে-সেখানে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা সন্ধ্যামালতী, নয়নতারার ঝোপ আর পাথরকুচির অবিন্যস্ত গাছ ‘স্নেহনীড়’ নামকরণের ব্যর্থতা জানান দিচ্ছে। চারপাশের নীরবতা ছিন্ন করে একটা পুরুষকণ্ঠ শোনা যায়, ‘কণা আসছিস? কহন আসলি? মোটে জানতে পারলাম না! ভাত খাবি? তোর ভাত তোর নিজেরই ফুটানি লাগব।’

শুনশান বাড়িতে পুরুষকণ্ঠটি গমগমে শোনায়। যদিও কণ্ঠের ভীরুতা আর কাতরতা পরিমাপে বোঝা যায় সে কারো পথ চেয়ে ছিল। ভাতের জন্য পুনঃপুন আহ্বান উপেক্ষা করে মেয়েটি ব্যাগ হাতড়ে চাবি বের করে তালা খুলে ঘরের ভেতর ঢোকে। ঘরের অবস্থা দেখে বোঝা যায় এই ঘরে অনেকদিন কোনো নারীর পদচিহ্ন পড়েনি। এক ঝটকায় ধূলোয় ধূসরিত বিছানায় শরীর ছুঁড়ে ফেলে মেয়েটি, যেন শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে জীবন।

শহরের কোলাহল ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়েছে। দিনের আকাশে রাতের আঁধার নেমে আসে, যে আঁধারে সব হারিয়ে যায়। হঠাৎ মেঘের ঝলকানিতে আলোর রশ্মি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। পুরুষকণ্ঠটি উদগ্রীব হয়ে ডাকে, ‘কণা, ঝড় আসতেছে রে। দরজা দে।’

কারো কথা ওর কানে যায় না। ওর চোখের পাতায় ঘুম নামে। ঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে মেয়েটি কখনো জেগে ওঠে, কখনো ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখে। কখনো বা শরীরী যন্ত্রণার ঘেরাটোপে বন্দি হয়। একটা উত্তরহীন প্রশ্ন ওর মাথার ভেতর গুঞ্জন তোলে, যন্ত্রণার এই কক্ষপথের পরিক্রমা আর কত দীর্ঘ হবে?

আচমকা ঘরের ফিকে অন্ধকারে কে যেন এসে দাঁড়ায়। পেছন থেকে দেখা যায়, একটা ছায়াশরীর দাঁড়িয়ে আছে। ছায়াশরীরটি ভাসতে ভাসতে মেয়েটির কাছে এসে ওর মাথায় আলগোছে হাত রাখে।

অনাকাক্সিক্ষত আদর পেয়ে মেয়েটি ডুকরে কেঁদে ওঠে।

‘মা, ও মা…তুমি এসেছো?’

‘পেটে পিত্তি পড়ব। এক চড়ুইয়ের রক্ত পানি হইব। ভাত খাইলি না!’

‘ক্ষিদে নেই মা। ব্যথা খুব, আর রক্ত…।’

‘ওহ, এইসব কিছু না। প্রোডাক্ট তোর শরীল থেইকা যায় নাই।’

‘তুমিও প্রোডাক্ট বলছো মা!’

‘ওরা যে কইল!’

‘তুমি কি তখন ছিলে?’

‘হুম। তোর মতো অপেক্ষা করতেছিলাম, ওর বাবা হইতে কেউ যদি আসে! কেউ আইলো না। ভালো করছোস, প্রোডাক্টটা হাসপাতালের ডাস্টবিনে কাইটাকুইটা ফালায় আইছোস।’

‘আহ্, অমন করে বলো না মা! কষ্ট লাগে মা…কষ্ট!’

‘অমন প্রোডাক্টের লেইগা কষ্ট কীসের রে! ন্যাকামি করিস না, রাগ লাগে।’

‘কিন্তু ও তো মেনে নিতো না।’

‘আগে বুঝছ নাই! কত সহজে মিথ্যাটা ধইরা ফেলছিলি, সত্যটা ধরতে পারছ নাই।’

‘ধরলেও কী হতো মা? আমি কি একা একা টেনে বেড়াতাম?’

‘ক্যান বেড়াবি? যা করছোস করছোস। এহন কান্দস ক্যান? দুনিয়ার আর কেউ তো কান্দে না। কান পাত, একটা নেড়ি কুত্তাও কান্দে না। কেউই আফসোস করে না। তুইও ভাব, শরীল থেইকা একটা তারা খইসা গেল।’

‘হুম।’

‘কান্দস ক্যান?’

‘কাঁদবো না? তুমি কাঁদো না আমার জন্য? ভাইয়ের জন্য?’

‘বাবলুর জন্য কান্দি না। দুইজনে এক লগে তারা হইয়া ফুইটা থাকি।’

‘আমার জন্য কাঁদো?’

‘কান্দার তো জায়গাই রাখলি না, কান্দুম কই! যাই রে, মেঘের ডাকে বাবলু ভয় পাইব।’

‘থাকো না মা! আমিও তো ভয় পাই!’

ছায়াশরীর ঝরনার মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে।

‘তাই তো তোরে নিতে আইছি। চল, যাবি চল।’

ক্লান্তিতে মেয়েটির শরীর ভেঙে আসে। টের পায় ওর তলপেটে রক্তের কল্লোল, শরীর থেকে আরেকটা শরীর বেরিয়ে আসছে। কষ্ট! আহা কষ্ট! মেয়েটির চোখের কোণের অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ে না, বরফের মতো জমে থাকে। ওর কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে, ‘ভিতরে আর কোনো প্রোডাক্ট নাই, সব পরিষ্কার!’

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত