অভিনেতা, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনীকার, নাট্যকার এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুতে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
।।উসামা ইবন মিজান।।
আমরা যারা আশি নব্বইয়ের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে মোটামুটি পরিচিত, তাদের কাছে তিনি একজন অতিপরিচিত মুখ। কখনো তিনি মূল চরিত্রের দূরসম্পর্কের কোনো আত্নীয়, যে অন্যায় ভাবে লুটেপুটে নিতে চায় সমস্ত সম্পত্তি, আবার কখনো তিনি সুযোগসন্ধানী এক মোড়ল, যে নায়িকাকে বিয়ে করে হাসিল করতে চায় নিজের অসদুদ্দেশ্য। কখনো তার ঠান্ডা মাথার কূটপরিকল্পনা শুনে গায়ের রক্ত হিম হয়ে ওঠে আসে, আবার কখনো তার উদ্ধত সংলাপ শুনে রক্ত গরম হয়ে উঠে যায় মাথায়।
হ্যা পাঠক, বিগত তিন দশক ধরে যে মানুষটি নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে আমাদের ক্রমাগত বিস্মিত ও মুগ্ধ করে চলেছেন, বলছিলাম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই প্রবাদপুরুষ এটিএম শামসুজ্জামানের কথা। আসুন জানা যাক তার জীবনের কথা।
আরো পড়ুন: সেলুলয়েডের কবি
১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়ি জন্মেছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন পেশায় নামকরা এক উকিল, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন তিনি। মায়ের নাম নুরুন্নেসা বেগম। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুর জেলার ভোলাকোটের বড় বাড়ি। ঢাকায় থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে।
তার রুপালী পর্দায় অভিষেক ঘটে ১৯৬১ সালে, পরিচালক উদয়ন চৌধূরির বিষকন্যা চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। কিছুদিন খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তদের মতো গুণী নির্মাতাদের সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি।
এরপর তিনি জলছবি চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্য নির্মাণ করেন। ছবিটির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ। মূলত জলচিত্র চলচ্চিত্রটির মাধ্যমেই চিত্রনায়ক ফারুকের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে। এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনী লিখেছেন এটিএম।
তবে অভিনয় জগতে শামসুজ্জামানের পথচলা শুরু হয় ১৯৬৫ সালের দিকে, কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। জলছবি, যাদুর বাঁশি, রামের সুমতি, ম্যাডাম ফুলি, চুড়িওয়ালা, মন বসে না পড়ার টেবিলে চলচ্চিত্রে তাকে কৌতুক চরিত্রে দেখা যায়।
১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের নয়নমণি চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনা আসেন তিনি। চলচ্চিত্রটি তার অভিনয় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি শামসুজ্জামানকে।
অশিক্ষিত, গোলাপী এখন ট্রেনে, পদ্মা মেঘনা যমুনা, স্বপ্নের নায়ক – চলচ্চিত্রগুলো যেমন তাকে খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি জলছবি, যাদুর বাঁশি, রামের সুমতি, ম্যাডাম ফুলি, চুড়িওয়ালা, মন বসে না পড়ার টেবিলে – ইত্যাদি চলচ্চিত্র এনে দেয় দর্শকদের প্রশংসা।
২০০৫ সালে ‘মোল্লা বাড়ি বউ’ চলচ্চিত্রটি তাঁর আলোচিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। চিত্রনায়ক রিয়াজের বাবার চরিত্রে শামসুজ্জমানের বলিষ্ঠ অভিনয় দেখে দর্শকদের বুকেঁ কাঁপন ধরে গিয়েছিলো বলা চলে। এই চরিত্রটির জন্য সবাইকে পেছনে ফেলে শামসুজ্জামান জিতে নেন মেরিল-প্রথম আলো সেরা অভিনেতার পুরস্কার।
২০০৯ সালে তিনি এককভাবে পরিচালনা করেন রিয়াজ-শাবনূর অভিনীত ‘এবাদত’। ২০১৫ সালে তিনি শিল্পকলায় একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি রেদওয়ান রনি পরিচালিত চোরাবালিতে অভিনয় করেন ও শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
নিঁখুত অভিনয় দক্ষতা তাকে এনে দিয়েছে কিংবদন্তীর মর্যাদা। তাইতো জীবদ্দশায় অসংখ্যবার রটেছে এটিএম এর মৃত্যুর গুজব। তবে যেটাই হোক না কেন, নিন্দুকদের মুখে চুনকালি দিয়ে এটিএম বেঁচে থাকুন অনন্তকাল, এটিই প্রত্যাশা।
একনজরে এটিএম শামসুজ্জামান
নাম: আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান
জন্মকাল: ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯
জন্মস্থান: নোয়াখালী
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: জগন্নাথ কলেজ
পেশা: অভিনেতা, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, কাহিনীকার, নাট্যকার
সন্তান: ৬ ছেলে
অভিনীত চলচ্চিত্র:লাঠিয়াল, নয়নমনি, গোলাপী এখন ট্রেনে, অশিক্ষিত, সূর্যদীঘল বাড়ি, ছুটির ঘন্টা, লাল কাজল, পুরস্কার, রামের সুমতি, ঢাকা ৮৬, দাযী কে?, দোলনা, পদ্মা মেঘনা যমুনা অজান্তে, স্বপ্নের নায়ক, তোমার জন্য পাগল, চুড়িওয়ালা, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, জামাই শ্বশুর, আধিযা, শাস্তি, মোল্লা বাড়ির বউ, হাজার বছর ধরে, আমার স্বপ্ন তুমি, চাঁদের মতো বউ, মন বসেনা পড়ার টেবিল, এবাদত, পরান যায় জ্বলিয়ারে, কুসুম কুসুম প্রেম, গেরিলা, লাল টিপ, চোরাবালি, দুটি মনের পাগলামি, দ্য স্টোরি অব সামারা, পাংকু জামাই।
অভিনীত নাটক: রঙের মানুষ, ভবের হাট, ঘর কুটুম, বউ চুরি, নোয়াশাল, শতবর্ষে দাদাজান।
পুরস্কার: একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (৫ বার)