ফাঁদ

Reading Time: 3 minutes

বাসে উঠে একবার সিটগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিল উপালি। নাহ্, লেডিস জেন্টস – সব সিটই ভর্তি। তাছাড়া কিন্তু বাসটা মোটামুটি খালি। দরজা দিয়ে উঠে ডানদিকে বেঁকে লেডিস সিটের সামনে রড ধরে দাঁড়াল উপালি।

মিনিট পাঁচেক বাদেই সামনের সিটে বসা কেউ একজন বলে উঠল, ‘ এক্সকিউজ মি, তুই উপালি না? ‘

উপালি সামান্য চমকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কে? আমাকে চিনল কি করে?

– তুই উপালি তো? 

– হ্যাঁ… কিন্তু…

– আমি অদ্বিতীয়া। তোর সঙ্গে স্কুলে পড়তাম। মনে আছে কিনা জানিনা।

হঠাৎ নামা বৃষ্টির মতো একরাশ স্মৃতি ঝাঁপিয়ে এল উপালির মাথায়। অদ্বিতীয়া!  মনে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ওর টিফিন খেয়ে নিত। শেষে উপালির মা এসে ক্লাস টিচারের কাছে নালিশ করতে বাধ্য হয়েছিল। খুব বিরক্ত করত উপালিকে। তখন অদ্বিতীয়া মোটাসোটা আর টুকটুকে ফর্সা ছিল। এখন কেমন যেন…।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুই এত রোগা হয়ে গেলি কী করে?  রঙটাও চেপে গেছে। সেজন্যই চিনতে পারিনি। কেমন আছিস? কি করছিস এখন?

– তুইও তো কত বদলে গেছিস। আগে তো কথাই বলতিস না, এখন তো বেশ কথা বলছিস। দেখতেও সুন্দর হয়ে গেছিস। তুই কী করছিস এখন?

– আমি একটা গার্লস স্কুলে পড়াই।

– বাহ! খুব ভালো। আমি একটা কলেজে ঢুকেছিলাম পার্ট টাইম লেকচারার হিসেবে। মাস ছয়েক বাকি ছিল পারমানেন্ট হতে। তারপর সেটা আর হল না।

– কেন? হলনা কেন?

– আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ছমাসের মধ্যে শেষ দুমাস আর কলেজে গিয়ে উঠতে পারিনি।

– কি অসুখ করেছিল তোর যে এত কাবু হয়ে পড়েছিলি?

কন্ডাকটর ফিলিপ্স মোড় ফিলিপ্স মোড় বলে চেঁচাতেই অদ্বিতীয়া উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ এবার নামতে হবে। আসিস একদিন আমার বাড়ি। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই। ‘

অদ্বিতীয়ার খালি হওয়া সিটে বসেই উপালি বলে, ‘ চটপট তোর নম্বর টা দে। ফোনে কথা বলব। ‘

নম্বর বলতে বলতে নেমে যায় অদ্বিতীয়া। উপালি ভাবে, কি অসুখ করেছিল যার জন্য লেকচারারের চাকরি ছেড়ে দিল, সেটা জানাই হল না। আমার বাড়ি কথাটাও কানে লাগল। বিয়ে করেছে মনে হয়। সিঁদুর তো দেখতে পেলাম না। আজকাল আর ওসব পরে কে! অনেক কথাই চক্কর কাটতে লাগল উপালির মাথায়।

ছোটবেলার বন্ধুর সঙ্গে এতদিন পর দেখা হবার ফলে কেবল ওর কথাই মন জুড়ে রইল উপালির। তখন অবোধ ছিল তাই দুষ্টুমি করত, উপালিও বাড়ি এসে নালিশ করত। এখন কেমন নিজে যেচে কথা বলল। মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল।  সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে অদ্বিতীয়ার নম্বরে ফোন করল।

– উপালি বলছি।

– বল, বল। কত্তদিন বাদে দেখা হল তোর সঙ্গে।তুই তো চিনতেও পারিসনি আমাকে। আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি তোকে…

– তুই এত রোগা হয়ে গেলি কী করে? চাকরিটাই বা ছাড়লি কেন?

খানিক চুপ করে থেকে অদ্বিতীয়া বলে, ‘ আমার তো ক্যান্সার! মাঝে বাড়াবাড়ি হওয়াতে চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হই। রোগা হবার কারণও এটাই। ‘

বোবা হয়ে যায় উপালি। এই কথা শোনার পর আর কি বলার থাকতে পারে। ঢোঁক গিলে উপালি বলে, ‘ এখন কেমন আছিস? একদিন তোর বাড়ি আসব অদ্বিতীয়া। অনেক গল্প করব। ঠিকানা দিস। ‘

– এখনো ট্রিটমেন্ট চলছে। প্রচুর খরচ জানিসই তো। তাই বাড়িতে একটা হাতের কাজ শেখানোর স্কুল করেছি। বিভিন্ন বুটিকের থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ করাই। অবশ্যই আসিস।

সারা রাত ঘুমোতে পারেনা উপালি। অদ্বিতীয়ার ক্যান্সার! রোগটা এখন কোন পর্যায়ে আছে, অসুস্থ শরীরে বাসে করে ঘুরছেই বা কেন…  নাহ্, যেতে হবে ওর বাড়ি। যতটা সম্ভব সাহায্য করব।

বছর দুয়েক পার হয়ে গেছে। অদ্বিতীয়ার বাড়ি উপালির ঘনঘন যাতায়াত। সেই বাড়িতে অদ্বিতীয়ার বাবা, মা, ভাই কেউ থাকেনা। কজন অল্পবয়সী, মাঝবয়সী মেয়ের আনাগোনা সেখানে। নানা ধরণের হাতের কাজ শেখানো হয়। সেসব কিনতে আসে পুরুষ ব্যবসায়ীরা। সারা রাত ধরে কেনাবেচা চলে।

প্রথম প্রথম অদ্বিতীয়ার চিকিৎসার জন্য নিজের সঞ্চয় থেকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছিল উপালি। এখন আর দিতে হয়না, উলটে টাকা আসে। একটাই ভারী দায়িত্ব পড়েছে ওর ওপর, নতুন পাখি জোগাড় করার।

পৃথা ফোন করেছিল সেদিন।

– কিরে উপালি, পাত্তাই তো নেই তোর!  খবর কি?

– শরীরটা ভালো নেই রে পৃথা। রক্তবমি হচ্ছে। মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু।

– সে কী? আচ্ছা, আমি আসব তোর কাছে খুব শিগগির। চিন্তা করিস না, সেরে যাবি।

– প্লিজ আসিস। ফোন রেখে মুচকি হাসে উপালি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>