| 11 মার্চ 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: চুল । ফাহ্‌মিদা বারী 

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট

 এক

বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় থেকে দুটো বড় মানকচু কেটে নিয়ে এলো মফিজ মিয়া। মানকচুর ভর্তা খেতে খুব ভালোবাসে সে। তার স্ত্রী ফুলবানু ভর্তাটা বানায়ও দারুণ! সর্ষে বাটার সঙ্গে কী সব ফোড়ন টোড়ন দিয়ে একেবারে জন্মেশ ভর্তা বানিয়ে ফেলে।

 

মেজাজটা ভালো নেই মফিজ মিয়ার। আর এই মেজাজ খারাপের উৎপত্তিও ফুলবানুর থেকেই। অবশ্য ফুলবানু নিজে কিছু করেনি। করেছে তার চুল! কী যে এক ফ্যাঁকড়া বেঁধেছে ফুলবানুর এই চুল নিয়ে!

 

অথচ কোনো এক শ্রাবণের ঘোর লাগা বাদলা দিনে মফিজ মিয়ার চোখে তো ঐ ঘনকালো চুলের ঢেউই ঘোর লাগিয়েছিল। রাণীরঙ্গা বেনারসি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মাথায় এক মস্ত খোপা বেঁধে ফুলবানুর মা তাকে এনে বসিয়ে দিয়েছিল পাত্রপক্ষের সামনে।

ফুলবানু পাশের গাঁয়ের মেয়ে। ছোটবেলাতেই বাপকে হারিয়েছে। ওদিকে মফিজ মিয়ারও বাপ নেই। এ যেন একেবারে জোড়ঘটক।

ঘটক বাড়িতে এসে ফুলবানুর রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশেষভাবে বলেছে এই চুলের কথা। এমন ঘনকালো দীঘল চুল বড় একটা চোখে পড়ে না আজকাল।

মফিজ মিয়ার মা তার এক হালি আত্মীয় পরিজন নিয়ে পাত্রী দেখতে যায়। পাত্রীকে চাক্ষুষ দেখে কেউই দ্বিমত করে না ঘটকের কথার সাথে। মেয়ে যথেষ্ট রূপবতী। আপত্তি করার প্রশ্নই নেই। তবু চুলের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে যখন, সেই চুল তো দেখতেই হয়! মফিজ মিয়ার মা আমেনা বেগম তাই সোজাসাপ্টাই বলে ফেলল, ‘মাইয়ার চুলের ম্যালা গপ শুনছি। এট্টু দ্যাখতাম কেমুন চুল!’

 

ফুলবানুর মায়ের মুখে ছায়া ঘনায়। হয়ত কথাটা তার আঁতে লেগেছে। এক ঘর পরপুরুষের সামনে তার মেয়ের মাথার চুল দেখতে চাওয়া হচ্ছে। এটা তো কম অপমানের কথা না! মফিজ মিয়াও তার মায়ের কথায় মৃদু আপত্তি জানায়।

‘চুল পরে দেইখো! অখনই দ্যাখতে হইব ক্যা?’ মফিজ মিয়ার মা ছেলের কথা কানেই তোলে না। গোঁ ধরে থাকে। চুল দেখার পরেই পাকা কথা হবে!

ফুলবানু অবশ্য লাজলজ্জার তেমন ধার ধারে না। হবু শাশুড়ির খায়েশ মেটাতেই এক টান মেরে নিজের খোঁপার বাধন আলগা করে দেয় সে। এক রাশ ঘনকালো চুল কুচকুচে মিহি ঝর্ণাধারার মতোই যেন তরতরিয়ে নেমে আসে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে। সেই চুলের থমথমে সৌন্দর্য দেখে কেমন জানি অদ্ভুত এক বিভ্রম জাগে। বিশ্বাস হতে চায় না, এ বাস্তবের কোনও নারীর মাথার চুল! 

 

ঘরভর্তি  মানুষের কৌতূহলী সূক্ষ্ণ সমালোচনার চোখ দুটোতে নিমেষেই ফুটে ওঠে ঘোর মুগ্ধতা। চোখের ভাষার এই মুগ্ধতায় বদলে যাওয়া দেখতে খুব ভালো লাগে ফুলবানুর। নিজেকে মনে হয় সম্রাজ্ঞীর মতো!

মায়ের কাছে লাজুক মুখে নিজের সম্মতির কথা বলে ফেলতে আর দেরি করেনি মফিজ মিয়া। বিয়ে করলে এই মেয়েকেই। নইলে আর কাউকে নয়!

 

 

বিয়ে করে আনার পরে বেশকিছু দিন ঠিকঠাকই চলছিল সবকিছু। প্রথম যৌবনের উন্মত্ত মাতাল সেইসব দিনে পাশে যদি থাকে সুন্দরী একখানা মনের মতো বউ… আর কিছু কি লাগে?

আজীবন বহির্মূখী মফিজ মিয়ার গায়েও তাই ‘বউপাগলা’ ‘ঘরকুনো’ এসব উপাধি জুটতে সময় লাগল না!

পাত্তা দেয় না সে। যার বিয়া তার খোঁজ নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই! সে বাইরে বাইরে ঘুরলেই বা মানুষের কোন উপকারটা হবে? বরং ঘরে থেকে ঘরসংসারের দুটো কাজ করে দিলে তো তার নিজের সংসারেরই বাড় বাড়ন্তি হয়। মানুষের তো আর খেয়েদেয়ে কাজকর্ম নাই! দিনরাত শুধু পরের সংসারের ফুটোফাটাতে চোখ লাগিয়ে রাখা!

 

পরের মুখকে না হয় পাত্তা না দিয়েও দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজের মা যখন ছেলের এভাবে বদলে যাওয়ার জন্য দিনরাত আড়ালে বসে মাথা কুটে মরতে লাগল, তখন তো আর পাত্তা না দিয়ে উপায় নেই! ছেলে আর ছেলে বউকে সম্বোধন না করে আমেনা বেগম গাছের সাথে প্যাঁচাল জুড়ে দিলো,

‘সজ্ঞলই আমার কপাল বুঝলি রে! পোলারে প্যাটে ধরছি বইলা কি পোলা আমার হইছে নাকি? পোলারে খাওয়াইছি, পিন্ধাইছি, যা যা করন লাগে করছি। অহন ঘরে নতুন মানুষ আইছে! পোলা কি আর মনে রাখব কার প্যাটের মইধ্যে সান্ধায় আছিল…’

ফুলবানু শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফিক ফিক করে হাসে। সেই হাসি দেখে মফিজ মিয়া আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। যে যা বলে বলুক! নিজের বউয়ের সাথে সোহাগ করলে কার বাপের কী! ঘরেই থাকবে সে!

 

মায়ের বাতাসে ছুঁড়ে দেওয়া কথার রেশ টেনে মফিজ মিয়া উত্তর দেয়, ‘কী কও মা! তুমার পোলা তুমার থাকব না তো কার হইব? আমি এট্টু বাড়িত আছি বইলা তুমি এত বেজার হইছ? আচ্ছা! ঠিক আছে! নিজের মায়েই যদি না চায় বাড়িত থাকি, তাইলে আর কী কওনের আছে!’

এই কথায় কাজ হয় ভোজবাজির মতো। নিমেষেই সুড়ুত করে উল্টে যায় সবকিছু। আমেনা বেগম হায় হায় করে ওঠে, ‘ওহ আল্লাহ পোলায় আমার কী কয়! পোলা আমার ঘরেত থাকলে আমার মন ক্যান বেজার হইব! ওহ আমার আল্লাহ…’

ফুলবানু এবারে আড়ালে গিয়ে খিল খিল করে হেসে ওঠে। মাথার ঘোমটা একটু টেনে সরিয়ে বিশেষ ভ্রু ভঙ্গিমা করে পুকুরপাড়ের দিকে যেতে যেতে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে, ‘মায়ে পোলায় কম নাটক জানেন না আপনেরা!’

মফিজ মিয়ার তখনই আচমকা পুকুরপাড়ে কী একটা জরুরি কাজ পড়ে যায়! বউয়ের পিছু পিছু সেদিকে যেতে যেতে শুনতে পায় মা বলছে, ‘ঐ যে, যেই লাউ হেই কদু! কারে যে কী কইতাছি!’

 

 

দুই

সমস্যা এটুকু থাকলে কথা ছিল না! কিন্তু ঘাপলা শুরু হলো সেইদিন, যেদিন তাদের প্রতিবেশী মতিমিয়ার কিশোর ছেলেটা পুকুরের পানিতে ডুবে মরল।

গাঁয়ের কিশোর, পানিতে দাপাদাপি করেই বড় হয়েছে। ভেলায় চড়ে, সাঁতরে কত ভাবে ইছামতী আড়াআড়ি এপার ওপার হয়েছে। সেই ছেলে কী না অল্প পানির পুকুরে ডুবে মরে গেল! মতিমিয়ার বউ বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে পুরো গ্রামকে শুনিয়ে বলল, ‘আমার হাসু ডুইবা মরেনি! ঐ হাভাইত্যা মফিজের হারামজাদি ডাইনি বউ আমার হাসুরে পানিতে চুবাইয়া মারছে! আল্লাহ তুমি আমার হাসুরে বিচার দাও! ওই হারামজাদিরে তুমি এমুন মরণ দাও…এমুন মরণ দাও য্যান মরণও ওর কাছে যাইবার সাহস না পায়!’

 

এইসব শাপশাপান্ত যখন চলছে, তখন মফিজ মিয়া ছিল বাজারে। দোকানে ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত তখন সে। এক ছেলে তাকে গিয়ে সব খুলে বলতেই দোকানপাট বন্ধ করে ছুটে এসেছে মফিজ। মতিমিয়ার ছেলেটাকে অমন নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ভাষা হারিয়ে গেল মফিজের। আহারে অমন টগবগে ছেলেটা! সবে দাড়িগোঁফ গজাতে শুরু করেছে। দিনমান দাপাদাপি করে বেড়ায়। অমন তাগড়া ছেলেটার এমন মৃত্যু মা-বাবা কীভাবে সহ্য করে?

মফিজ গিয়ে ছেলেটার কাছে দাঁড়াতেই মতিমিয়ার বউ হিস হিস করে উঠল, ‘ঐ খবরদার! আমার পোলার লাশ ছুঁইবি না তুই! তুই জানোস আমার পোলারে কেডায় মারছে? তর ডাইনি বউ পানির মইদ্যে চুবাইয়া মারছে আমার পোলারে! খানকি মাগি জিন্দেগিতে মা হইবার পারব না! আমার অভিশাপ লাগব হারামজাদির…’

 

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মফিজ। কোনোমতে বলে, ‘খালা এইগুলান কী কইতাছ তুমি? আমার বউ তুমার পুলারে ক্যান পানিত চুবাইয়া মারব? এমুন কথা তুমি ক্যামনে কইলা? কাউরে দোষ দেওনের আগে এট্টু ভাইবা দ্যাখবা না তুমি খালা? জানি ওহন তুমার মাথা ঠিক থাকোনের কথা না… ‘

‘ঐ চুপ কর বউয়ের গুলাম! একডা কথা কইবি না তুই! আমার পুলার গলায় তর বউয়ের চুল প্যাঁচাইয়া আছিল সজ্ঞলে দ্যাখছে!’

 

এই পর্যায়ে আশেপাশের আরও দুই চারজন সম্মতি জানিয়ে বলে ওঠে, ‘হ হ! আমিও দ্যাখছি! হাসুর গলায় ফুলবানুর চুলই প্যাঁচাইয়া আছিল। হাসু যহন পানির মইদ্দে ছটফট করতাছে ফুলবানু তহন পুকুর থেইকা পাড়ের দিকে যাইতাছিল! আমি নিজের চক্ষে দ্যাখছি!’

‘ঐ চুপ শালা… পাড়ের দিকে গ্যালে চুল প্যাচাইয়া থাকে ক্যামনে? এ্যাহ আমি নিজের চক্ষে দ্যাখছি! মিছা কথা কওনের আর জায়গা পাস না তুই? শালা মদ ভান খাইয়া দিনরাত ভং হইয়া পইড়া থাকোশ, তুই আইছস সাক্ষী হইয়া!’

‘অই মফিজ অত বাড় বাড়িস না বুজছস! অত বাড় বাড়িস না! গেরামে খালি আমি দ্যাখছি মনে করছস তুই?  আরও মাইনষে দ্যাখছে! অই সুরুজ কস না ক্যা? এট্টু আগেই না কইতছিলি!’

যাকে বলা হলো, সেই সুরুজ ‘আ… হ্যাঁ… হ…’ এসব বলে তালগোল পাকিয়ে চুপ করে থাকাই ভালো মনে করল। মফিজের রক্তচোখের দিকে তাকিয়ে সে আর বেশি উচ্চবাচ্য করার সাহস পেল না। মফিজ মুখ ভেংচিয়ে টিপ্পনী কাটল, ‘এ্যাহ আইছে চোরের সাক্ষী গাঁইটকাটা!’

 

দুই পক্ষে এবারে বেশ একটা হৈ চৈ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হতেই গাঁয়ের দুই একজন ময়মুরুব্বি এসে তখনকার মতো তাদেরকে শান্ত করল। ওদিকে মৃত সন্তানের মাথা কোলে নিয়ে হাসু বিবি তখন বেহুঁশের মতো পড়ে আছে। তবু থেকে থেকে হিঁচকি তোলার মতো করে সে স্বগতোক্তি করছে, ‘আল্লাহয় ছাড়ব না! আমার পুলারে খাইছে! রক্তবমি কইরা মরব হারামজাদি… আ… আ… আমার পুলা কী করছে হারামজাদির? আ… আ…’

 

 

তিন

ঘটনা সেদিনের মতো থামল বটে, কিন্তু পুরো গাঁয়ে রটে গেল মফিজের বউটা ভালো না। ওর মধ্যে ডাইনির বীজ আছে। হাসুকে যে সেই মেরেছে এই ব্যাপারে অবশ্য দুই একজন বাদে কেউই তেমন জোরালো গলায় কিছু বলতে পারল না। মফিজের বউ ফুলবানু যখন পুকুরে নেমেছিল, তার একটু বাদেই হাসুও গোসল করতে পুকুরে নামে। সাধারণত বউ ঝিরা যখন গোসল করতে নামে, তখন পুরুষমানুষের ঘাটের কাছে আসা বারণ। হাসুর সবে দাড়ি গোঁফ গজাচ্ছে দেখে ওকে কেউ তেমন একটা গোণায় ধরত না।

 

ফুলবানু তখন পানিতে উপুড় হয়ে ভেসে ভেসে আকাশ দেখছে। তার লম্বা চুলের গোছাগুলো মুক্তি পেয়ে পানিতে কিলবিল করে নেচে বেড়াচ্ছে… ঠিক যেন অনেকগুলো ফণা তোলা কালো কেউটে! হাসু পানিতে নেমেই ফুলবানুর দিকে সাঁতার কাটতে থাকে। আশেপাশে দেখতে দেখতে যায় কেউ তাকে লক্ষ করছে কী না! ফুলবানুর কাছাকাছি আসার পরেই তার হুঁশ আসে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

 

উত্তরপাড়ার দুই বয়স্কা খালা তখন নিজেদের মধ্যে তুমুল গল্প করতে করতে বাসন বাজছিল। হঠাৎ একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ তাদের কানে এসেছিল বটে, কিন্তু শব্দটা যে কোথা থেকে আসছে এটা তারা বুঝতে পারেনি। ফুলবানুকেও জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ও ফুলবানু, একডা আওয়াজ আইল মনে কয়। তুমি কিছু হুনছোনি?’

ফুলবানু জবাব দেয়, ‘কই না তো খালা! আমি তো কিছু হুনি নাই!’

ফুলবানুর কথা শুনে তারা আবার নিশ্চিন্তমনে গল্প করতে বসে। সেই সময় আরও দুইজন বউ পানিতে নামে। বসন আলগা করে সবে তারা পানিতে ডুব দিতে যাবে তখনই তাদের একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওহ আল্লাহ্‌ ওহ আল্লাহ্‌! ঐডা কেডায় গো? হাসু নি? কী হইছে ওর? ওর গলায় ঐডা কী?’

 

সেইসময়ই তারা সবাই একযোগে হাসুর ছটফট করতে থাকা দেহটা দেখতে পায়। কিন্তু কতক্ষণ ধরে ছটফট করছিল কে জানে! শরীরের শক্তি তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে তার। গলার কাছে কালো রঙের সুতার মতো কিছু জিনিসকে সে তখন প্রাণপনে দুই হাত দিয়ে সরাতে চেষ্টা করছে।

চেঁচামেচি শুনে দুই তিনজন পুরুষ মানুষও তখন দৌড়াতে দৌড়াতে পুকুরঘাটে চলে এসেছে। হাসুর গলার কাছে শক্ত হয়ে চেপে থাকা তার দুই হাতের দিকে তাদেরও নজর পড়েছে। কিন্তু কালো সুতার মতো কোনও কিছু তারা দেখতে পায়নি। সাথে সাথে তাদেরই একজন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হাসুর নিস্তেজ হয়ে আসা শরীরটাকে টানতে টানতে পাড়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে!

 

ফুলবানুও তখন অবাক হয়ে ঘটনা দেখছে। এতক্ষণ অব্দি কিছুই তার নজরে পড়েনি। কোনও শব্দও তার কানে আসেনি। গোসলে নামলে নিজের চুল ধুতেই তার সব মনোযোগ ঢেলে দিতে হয়। হাঁটু ছাপিয়ে নেমে আসা চুলের ভারী গোছা নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ চলে তার তখন। আশেপাশের অন্য কোনোকিছুই সে দেখতে পায় না। হাসুর গলার কাছে কিছু আছে কী না এটা সেও দেখতে পায়নি। কিন্তু সেদিনের পর থেকেই এক কান দুই কান করে করে কীভাবে জানি রাষ্ট্র হয়ে যায় যে, তার চুলের গোছাই হাসুর গলা চেপে ধরেছিল।

 

ফুলবানু ভেবে পায় না, মানুষ এত মিথ্যা কথা কীভাবে বলে! সে গোছল করতে নেমেছিল ঘাটের একবারে কাছের এক কোনায়। ভালো সাঁতার জানে না ফুলবানু, তাই দূরে সে কখনওই যায় না। ওদিকে হাসু হচ্ছে পাকা সাঁতারু। সে ঝপ করে পানিতে নেমেই এক সাঁতারে চলে গিয়েছিল একেবারে মাঝপুকুরে! যেতে যেতে ফুলবানুর দিকে একটা নোংরা দৃষ্টি হানতে ভুল করেনি সে!

মাত্র চৌদ্দ কী পনের বছর বয়স হয়েছে ছেলের, অথচ এই বয়সেই চোখের নজর দিতে ভুল হয় না তার। রাস্তাঘাটে ফুলবানুকে দেখলেই শিষ বাজাত ছোড়া! ফুলবানুর ইচ্ছে করত চড় মেরে গাল তোবড়া বানায়ে দেয়। স্বামীকে বলি বলি করেও কথাটা আর বলা হয়নি তার। কিন্তু হাসুকে একদিন বলেছিল সেই কথা।

‘ঐ হুন ছ্যাড়া! অহনো ঠিকমত দাঁড়িগোঁফ গজায়নি, সিনা খুব ফুইলা গ্যাছে তোর তাই না? হারামজাদা আর যুদি কিছু কইছস আমারে চোখ গালাইয়া দিমু! থাপ্পড় মাইরা দাঁত ফ্যালাইয়া দিমু!

 

ভাগ্যিস সেই কথা আর কেউ শুনতে পায়নি! শুনতে পেলে তো ফুলবানুর ওপরে সন্দেহের ছুঁড়ে দেওয়া তীর খুব ভালোভাবেই জায়গামত গেঁথে যেত!

ফুলবানুর সেই কথা শুনে হাসু বিশ্রী ভঙ্গিতে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসেছিল। গা গুলিয়ে উঠেছিল ফুলবানুর। এই ছেলে আরেকটু বড় হলে কী করবে কে জানে!

 

অকাট্য প্রমাণ কেউই দাঁড় করাতে পারে না, কাজেই ফুলবানুর ওপরে আনা অভিযোগও প্রমাণিত হয় না। তবু  পুরো গাঁয়ের মানুষ ফুলবানুকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করে। তার দীঘল কালো চুলের গোছা দেখতে কেউ এখন আর তার বাড়ি আসে না। একসময়ের অনেক প্রশংসা কুড়ানো চুলই হুট করে মানুষের চক্ষুশূল হয়ে যায়।

 

 

চার

মানকচু দুটো রান্নাঘরের মেঝেতে নামিয়ে রেখে মফিজ পিড়া টেনে বসে। আমেনা বেগম মুখ কালো করে হাঁসের ফোঁড় বাছছিল। মফিজকে আসতে দেখে একটু মুখ তুলে তাকিয়েই আবার নিজের কাজে মন দেয়। মায়ের মুখের গাম্ভীর্য মফিজের নজর এড়ায় না। টেনে টেনে বলে, ‘মায়ে কী ব্যাজার কুনো কারণে? ফুলবানু কই? ওরে দেহি না!’

সাথে সাথে মুখ ঝ্যামটা দিয়ে আমেনা বেগম বলে উঠল, ‘তর বউরে তুইই কোলেত কইরা নিয়া বইয়া থাগ! এমুন দেমাগী মাইয়া! চুলের দেমাগে মাটিত পা পড়ে না! ঘরের কুটা বাইছা দুইটা করোনের নাম নাই। আছে দিনরাত খালি ঐ চুল লইয়া। কিছু করবার কইলেই কয়, ‘আম্মা চুলডা এট্টু বাইন্ধা আসি! এ্যাহ পাড়াগাঁয়ের মাইয়া। এত দিনরাত চুল বান্ধনের কী হইছে? কাম না করনের এইডা হইতাছে উছিলা… বুঝি না আমি?’

 

মফিজ চুপ করে থাকে। একদিক দিয়ে আমেনা বেগমের এই ক্ষোভ একেবারে অমূলকও নয়। ফুলবানু তার চুলের যত্নআত্তিটা একটু বেশিই করে! মফিজ দিনরাত বউকে চোখে হারায়, কিন্তু ফুলবানুর তাতে তেমন গা নেই। স্বামী দশবার তাকে ডাকলে সে একবার তাতে সাড়া দেয় কী না সন্দেহ! অথচ চুলে একদিন তেল না দিলেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। তেল শেষ হলেই মফিজের খোঁজ পড়ে। তখন মুখে তার কত সোহাগ! ‘হুনছ… আমার লাইগা হাটবারে একডা বাসনা ত্যাল নিয়া আইসো। আনবা তো?’

‘ক্যা আগের হাটবারেই না লইয়া আইলাম! এ্যার মইধ্যেই ফুরাইছে?’

‘কদ্দিন হয় আনছ! অহনো ফুরাইব না? তুমি এত কিপটা ক্যান? বউয়ের এক ত্যাল কিনতেই এত হিসাব করতাছ? মুখে তো দিনরাত সোহাগ দেখাইয়া বাঁচ না!! মিছামিছি সোহাগ তোমার!’

মফিজ মিয়া আর কথা খুঁজে পায় না। কিন্তু সে শত হিসাব করেও কূল পায় না, এক সপ্তাহেই একটা এত বড় তেলের ডিব্বা খালি হয় কেমন করে? চুল লম্বা হলেই কি তাই বলে এত তেল লাগে?’

 

আমেনা বেগম ছেলের নীরবতা লক্ষ করে এবারে একটু সুর খাটো করে বলে, ‘পাড়ায় কইলাম আবার ফিসফাস শুরু হইছে!’

‘কিয়ের ফিসফাস?’

‘তর বউয়ের লগে নাকি জীন আছে। বেবাকেই দ্যাখছে!’

মফিজ মিয়া একটু বিরক্তির সুরে বলে, ‘মা তুমিও খালি খালি ফুলবানুরে দোষ দিতাছ। কেডায় কী দ্যাখছে না দ্যাখছে আউলফাউল কইয়া ব্যাড়াইতাছে।’

‘হ বেবাকের কথাই তো তর কাছে আউলফাউল লাগব অখন! দুইন্যার সজ্ঞলেই অহন খারাপ, ভালা খালি তর বউ! আর হাসুর পানিত ডুইবা মরার কথাটা ভুইলা গেলি এত জলদি! হাসুর মায়ে দিনরাত তর বউরে শাপশাপান্ত করে। না জানি এই বাড়ির উপরেও কত শাপ আইসা জড়ো হইছে! আল্লাহ্‌ গো বেবাকই আমার কপাল!’

 

মফিজ মিয়া আর কথা না বাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুলবানুকে খুঁজতে বের হয়।

দিনকে দিন এই অশান্তি অসহ্য হয়ে উঠছে। সে গ্রামের ছেলে হলেও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। করলে আজ এতদিনে মহা হুলুস্থুল শুরু হয়ে যেত। কিন্তু গ্রামের মানুষের কথা আলাদা। তারা একটা কিছু পেলেই হলো। সেটাকে চিবিয়ে চিবিয়ে একেবারে ছোবড়া বানিয়ে ছাড়ে! সাঁতারে দক্ষ ছেলে কি অল্প পানিতে ডুবতে পারে না? এটা নিয়ে এত গালগল্প বানানোর কী হয়েছে? যেহেতু কাছেই ফুলবানু ছিল, কাজেই দায় এখন তার ঘাড়েই এসে পড়েছে!

 

এ ঘর ও ঘর খুঁজতে খুঁজতে ফুলবানুকে পাওয়া গেল বাড়ির পেছনের পেয়ারা গাছের নিচে। গাছের চিকন একটা ডাল টেনে নিজের কাছে এনে সে পেয়ারা পাড়ছে। কোছায় কায়দা করে বেশ কয়েকটি পেয়ারা বেধে নিয়েছে। চোখেমুখে তৃপ্তি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। মফিজের একটু আগের বিরক্তি এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে ফুলবানু বলল, ‘ওইখানে খাড়াইয়া না থাইকা একটা পেয়ারা পাইড়া দাও না! দাঁত কেলাইয়া হাসতাছ ক্যান?’

‘কোছা ভইরা তো নিছই! আরও নিয়া কী করবা?’

ফুলবানু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। সে গাছের ডাল ছেড়ে মফিজের দিকে অপরূপ ভ্রু ভঙ্গিমা ছুঁড়ে দিয়ে পেয়ারা পেড়ে দিতে ইশারা করে। মফিজ বউয়ের রঙ ঢঙএ প্রায় অর্ধেক বশ হয়ে যায়। তারপরও প্রেমের খেলায় এত জলদি হার মানতে হয় না। এতদিনে এটুকু রঙ ঢং সেও শিখেছে। হাসতে হাসতে বলে, ‘পাইড়া দিবার পারি এক শর্তে। মজা কইরা মানকচু ভর্তা বানাইয়া দেওন লাগব!’

‘আগে পেয়ারা পাইড়া দ্যান, পরে ভর্তা!’

‘তাইলে দিমু না!’ বলতে বলতে সত্যই ফুলবানুকে অবাক করে দিয়ে মফিজ একটা নকল পিছটান দেয়। কৌতূহলী হয়ে একবার পেছনে তাকায় মজা দেখার জন্য। কিন্তু যা দেখে তাতে সে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

 

ফুলবানু তার লম্বা চুলের রাশিকে দড়ির মতো গাছের ডালে ছুঁড়ে মারে। সেই চুল কীভাবে জানি ডালের সঙ্গে পেঁচিয়ে যায়! তারপর চুলের আরেক প্রান্ত ধরে টান দিতেই সুড়সুড় করে গাছের ডাল নিচে নেমে আসে। ফুলবানু মনের আনন্দে সেই নেমে আসা ডাল থেকে পেয়ারা টেনে টেনে ছিঁড়ে আনে।

 

মফিজের দিকে চোখ পড়তেই ফুলবানু ফিক করে একটা হাসি দেয়। সেই হাসি ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ। মফিজ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

 

 

পাঁচ

 

ফুলবানু পোয়াতি হয়েছে। তার হাতেপায়ে পানি এসেছে। নড়তে চড়তে ভালোই কষ্ট  হয়। আমেনা বেগম কিছুদিন ধরেই ছেলের সাথে ঘ্যান ঘ্যান করছে।

‘ও মফিজ, তর বউরে হ্যার বাপের বাড়িত থুইয়া আয়! এ্যামনেই তর বউয়ে কামকাইজ করে না। অহন তো দিনরাত ঠ্যাংয়ের ওপরে ঠ্যাং তুইলা বইয়া থাগে। আমি বুইড়া মানুষ, দিনরাত খাইটা চাইরজনের খানাপিনার ব্যবস্থা করবার পারুম না!’

‘মা চাইরজন কনে পাইলা?’

‘ক্যা প্যাডেরডা? ঐডা কি কম খায় নাকি?’

মফিজের মুখে আঁধার ঘনায়। মায়ের মুখে কিছুই যেন আটকায় না। ঐ কয়েকমাসের তালগোল পাকানো একটা মাংশের পিণ্ড, সেটা নাকি অনেক খায়!

 

মফিজ অসন্তুষ্ট গলায় বলে, ‘মা কয়দিন পরে থুইয়া আসি? এরপর তো এক্কেরে বাচ্চা হওনের পর লইয়া আইতে হইব। এদ্দিন আগে লইয়া গ্যালে যদি ফুলবানুর মায়ে বেজার হয়?’

শাশুড়ি মুখ ভেংচিয়ে বলে, ‘এ্যাহ! কী আমার সোহাগ রে! শাশুড়ির বেজার হনের চিন্তায় ঘুম হইতাছে না! আর তর মায়ে যে কাম করতে করতে কোমর সিধা কইরা খাড়াইবার পারতাছে না, হেইডা দ্যাখছ না তুই?’

 

মফিজ কিছু বলে না। তার মনে ঝড় বইতে থাকে। সবে তার বউয়ের চার মাস চলছে। এখনই বাপের বাড়িতে রেখে আসার অর্থ হলো, আরও অন্তত এক বছর বউকে চোখের আড়ালে রাখতে হবে। এতদিন ফুলবানুকে না দেখে সে থাকবে কেমন করে?

কিন্তু মায়ের ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যানানির কারণেই মফিজ মিয়া শেষমেশ বউকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসতে বাধ্য হলো।

এক বর্ষায় মেয়ে দেখতে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। এবারে আরেক বর্ষায় বউকে গরুর গাড়িতে বসিয়ে মফিজ মিয়া দুরু দুরু বুকে পাশের গাঁয়ে রওয়ানা দিলো। বউয়ের পাঁচ মাস এখন। এমন সময়েই নাকি অঘটন ঘটে যায়। বৃষ্টির পানি জমে রাস্তার যে অবস্থা হয়েছে! মফিজ মিয়া গাড়ির সামনে গিয়ে বসে। দুই হাতে গাড়ির দুই কোনা ধরে বসে থাকে সে। মাঝে মাঝে পেছন ঘুরে ফুলবানুর দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঠিক আছে কী না।

তার ভাব দেখে ফুলবানু হেসেই বাঁচে না! হাসতে হাসতে বলে, ‘সিধা হইয়া বইসা থাগেন। আমার কিছু হইব না!’

 

ফুলবানুর মা কিন্তু মেয়েকে দেখে খুব বেশি আহ্লাদ করে না। মেয়ের শরীরের এই অবস্থার কথা তার জানা ছিল না। মেয়েকে ভালোভাবে দেখে কয় মাস চলছে আন্দাজ করে বলে, ‘এত জলদি জলদি আইছস ক্যা? সাত মাসে আইলেই তো হইত! জামাই একলা থাকব এতদিন! খাওন দাওনের অসুবিধা হইব না?’

ফুলবানু অম্লান বদনে বলে, ‘আমি অহন চুলার পাড়ে বইয়া থাগবার পারি না! কেমুন জানি ফাঁপর লাগে। বেবাক রান্না আমার শাওড়েই করে!’

ফুলবানু তার মায়ের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরের মধ্যে যেতে যেতে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘বেলা গ্যাছে… তুমি বাড়িত যাও অহন! আইজ সারাদিন চুলেত ত্যাল দেইনি!’

মফিজের ইচ্ছে করছিল আরও কিছুটা সময় ফুলবানুর সামনে বসে থেকে তাকে দেখে। কিন্তু ফুলবানু তো সেই চুল নিয়েই ব্যস্ত এখনো! শাশুড়ি তাকে ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করে। কিন্তু মফিজ মিয়া চলে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাশুড়িকে সালাম করে সে ছেঁড়া মন নিয়ে বাড়ির পথে ধরে।

 

জামাইয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ফুলবানুর মা মেয়েকে কিছু কথা শোনাতে ঘরে ঢোকে। গিয়ে দেখে ফুলবানু মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে খোঁপার বাধন আলগা করে গুনগুন করে গান গাইছে। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল এলিয়ে পড়েছে পুরো ঘরময়। ফণাতোলা সাপের মতো সেই চুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বারবার শিউরে উঠতে থাকে ফুলবানুর মা। মনে পড়ে যায় অনেক আগের একটা কথা।

 

ছোটবেলায় মেয়ের দ্রুত বর্ধিষ্ণু চুল সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো ফুলবানুর মাকে। মেয়ে কিছুতেই চুল কাটতে চাইত না। একা একা সামলাতে পারত না, তবু চুল কাঁটার নাম শুনলেই খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিত। চুলের সঙ্গে ছিল তার ঘোর সখ্য। যখন তখন নাকের কাছে চুল টেনে এনে গন্ধ শুঁকে বলত, ‘ও মা দ্যাখো, আমার চুলের বাসনা কী সুন্দর!’

একদিন ফুলবানু ঘুমিয়ে পড়ার পরে তার মা একটা কাঁচি নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল। মেয়ের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ঘন করে পড়ছে বুঝতে পেরে খুব তাড়াতাড়ি কাঁচিটা আড়াআড়ি বসিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে চুলগুলো কেটে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু চুলের এক কোণা ধরে কাঁচি বসাতে যেতেই ফুলবানুর মা টের পেল তার হাত কেমন যেন অসার হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই সেই হাত কাঁচিটাকে টেনে সরাতে পারছে না।

কোনোমতে সেদিন নিজের হাতটাকে তিনি সরিয়ে আনতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু হাত থেকে কাঁচিটা পড়ে গিয়েছিল।

 

প্রায় অসার হয়ে যাওয়া সেই হাত এক সপ্তাহ ধরে অচল ছিল। হাতে কী হয়েছিল এটা তিনি কাউকেই বলতে পারেননি। মজার ব্যাপার হচ্ছে কাঁচিটাকেও সেদিনের পর আর কোথাও দেখতে পাননি!

এরপর থেকে নিজের মেয়ের চুলের দিকে তাকাতেও ভয় লাগত তার। কী একটা যেন অশুভ জিনিস আছে ঐ চুলের মধ্যে।

 

আজ এতদিন পরে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ফুলবানুর চুলগুলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন তিনি। কী আশ্চর্য! মানুষের চুল এলিয়ে দিলে মাটি ছুঁয়ে পড়ে থাকে। অথচ ফুলবানুর চুলের আগাগুলো কেমন দাঁড়িয়ে আছে। যেন ছোট ছোট কিছু বাচ্চা সাপ। সবে ঘাড় উঁচু করতে শিখেছে। ঘাড় উঁচু করে গভীর মনোযোগের সাথে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।

 

ফুলবানুর মা ভেবে পায় না, তাদের এত সতর্কতা কীসের জন্য?

 

 

ছয়

 

মায়ের বাড়িতে এসেও ফুলবানুর কিছুই ভালো লাগে না। তার ভেতরে কীসের যেন অসহ্য যন্ত্রণা। সারাটা সময় বুক ধড়ফড় করে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। ঘুমাতে গেলেই কেমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। অবিকল মানুষের মতো মুখ ওয়ালা কিছু বাচ্চাসাপ কীভাবে যেন তার মশারির মধ্যে ঢুকে পড়ে।

 

চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসতে গিয়েও বসতে পারে না ফুলবানু। মানুষের মতো মুখওয়ালা সাপের বাচ্চাগুলো ওকে টেনে বিছানাতেই নামিয়ে রাখে। একটা অস্পষ্ট কথোপকথন হয় তাদের মধ্যে। সাপের বাচ্চাগুলো ফুলবানুর কানের কাছে মুখ এনে বলে, ‘তুমি শোও। শুইয়া থাগো! বসো ক্যান?’

ফুলবানু জড়ানো গলায় বলে, ‘ও আমারে শুইতে দেয় না। প্যাটের মধ্যে ছটফট করে!’

‘ওরে তাইলে প্যাটে নিয়া বইসা আছ ক্যা? প্যাট থেইকা খালাস কইরা দাও!’

‘ও তাইলে কষ্ট পাইব অনেক!’

‘পাউক গা! পাইলে তুমার কী? তুমি কি কষ্ট পাইবা?’

‘আমি? কী জানি!’

‘আচ্ছা তাইলে আর চিন্তা কী?’

 

সাপের বাচ্চাগুলো স্নেহভরা চোখে ফুলবানুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুলবানু আবার জড়ানো গলায় বলে, ‘তুমরা কারা? আমার কাছে আইছ ক্যান?’

‘আমরা তো তোমার লগেই থাকি! তুমি জানো না?’

‘না তো! তুমরা আমার লগে থাগলে আমি দ্যাখবার পাই না ক্যান?’

‘কে কইলো দ্যাখবার পাও না? তুমি আমাগো কত ভালাবাসো। আমরাও তুমারে ভালাবাসি। ঐ যে ওই জায়গায় থাগি আমরা…’

 

কথাটা বলেই তারা ফুলবানুর মাথার কাছে কোনো এক জায়গাকে নির্দেশ করে। ফুলবানু ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝতে পারে না।

 

পরদিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙে তার। ঘুম ভাঙতেই ফুলবানুর মা ছুটে আসে তার কাছে, ‘ক্যারে ফুলবানু? তুই রাইতে বিড়বিড় কইরা কী কইতাছিলি? চোখমুখ ফুলছে ক্যা? কী হইছে তোর?’

ফুলবানু কিছু মনে করতে পারে না। রাতে তার কাদের সঙ্গে যেন দেখা হয়েছিল। অস্পষ্টভাবে কিছু একটা মনে পড়তে গিয়েও পড়ে না।

ফুলবানু অন্যমনস্কভাবে নিজের পেটে হাত বুলায়। এখনো তিন মাস বাকি। অথচ ওর বাচ্চা যেন আর ভেতরে থাকতে চাইছে না। এখনই ছুটে বের হয়ে আসতে চায় সে। পেটে হাত দিতেই আবার একটা অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় ফুলবানুর। এই যন্ত্রণা যখন তখন হয়। যতক্ষণ এটা চলে ফুলবানু কিছুই করতে পারে না। মনে হয় তক্ষুনি মরে যাবে!

ফুলবানুর মা চিন্তিত মুখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখনো তো অনেকদিন দেরি আছে! এখনই তো এমন ব্যথা হওয়ার কথা না!

 

সেদিনের এক সপ্তাহ পরেই ফুলবানুর বাচ্চাটা মরে গেল।

ফুলবানু ঠিক বুঝতে পেরেছিল, কিছু একটা ঠিক নেই। আর সেই অসহ্য ব্যথাটা আর হচ্ছে না। পেটের মধ্যে যে সারাক্ষণ একটা ঝড়ের মাতম চলত, তা যেন আচমকাই থেমে গেছে। সবকিছু কেমন জানি শুনশান নিস্তব্ধ মনে হয়। ফুলবানু পেটে হাত দিয়ে অদেখা সন্তানের হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে চায়। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে ওঠে ওর। কিছু হলো না তো? কিন্তু কিছু হলে তো, রক্তে ভেসে যেত সবকিছু। সেসব তো কিছুই হয়নি!

 

মনের মধ্যে সন্দেহ নিয়েই সে তার মাকে বলে, ‘ওহ মা, প্যাটের মইধ্যে কিছু তো নড়ন চড়ন করে না আর!

ফুলবানুর মা বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলে, ‘আজিব মাইয়া! একবার কয় প্যাটের যন্ত্রণায় জান বাড়াইয়া যাইতাছে। আরেকবার কয়, কিচ্ছু নড়েচড়ে না! এই মাইয়ারে লইয়া কী করি! বাচ্চা কি বেবাক সময়ে নড়ব নাকি?’

 

ফুলবানুর সন্দেহ তবু দূর হয় না। সে তার স্বামীকে খবর পাঠাতে বলে। গাঁয়ের এক ছেলেকে দিয়ে পাশের গাঁয়ে ফুলবানুর স্বামীর কাছে খবর পাঠানো হয়। ফুলবানু যেতে বলেছে শুনেই মফিজ মিয়া একরকম ছুটতে ছুটতেই চলে আসে। বাচ্চা হওয়ার এখনও তো তিনমাস বাকী আছে। এর মধ্যেই ফুলবানু খবর পাঠাল কেন?

 

মফিজ মিয়া সব কথা শুনে ফুলবানুকে গঞ্জে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। মহিলা ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে সবকিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থমথমে মুখে বলে, ‘কতদিন ধরে এরকম হয়েছে… মানে বাচ্চা নড়ছে না এটা কবে টের পেয়েছেন?’

ফুলবানু দ্বিধা নিয়ে বলে, ‘কাল থেইকা… না না… মনে হয় তার আগের দিন থেইকা!’

‘আগে আসেননি কেন?’

ফুলবানু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মফিজ মিয়ার চোখের দৃষ্টিতে অসহায়ত্বের ছায়া। ডাক্তার আপা কী খবর শোনাতে চাইছে তাদের? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেলে, ‘কী হইছে ডাক্তার আপা?’

ডাক্তার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আগে একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করতে হবে। তারপর দেখে জানাই।’

 

আলট্রাসোনোগ্রাম করার সময় ডাক্তার অবাক হয়ে লক্ষ করে, পেটের মধ্যে শিশুটি একেবারে স্থির অবস্থায় আছে আর তার গলার আশেপাশে অসংখ্য শিরার মতো কী যেন ঝুলছে। জিনিসটা এতটাই অদ্ভুত এবং নতুন যে তিনি কিছু সময় বুঝতেই পারেন না যে কী দেখছেন!

রিপোর্ট হাতে নিয়ে ফুলবানু আর মফিজকে নির্মম সত্যটা তাকে জানাতেই হয়। বাচ্চাটা মরে গেছে! ফুলবানু হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। মফিজ মিয়ার দুই চোখে নির্বাক দৃষ্টি। কোনোমতে শুধু বলে, ‘ক্যান মইরা গেল ডাক্তার আপা?’

ডাক্তার স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে, ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না!’

 

মফিজ মিয়া আর ফুলবানু চলে যাওয়ার পরে ডাক্তার আল্ট্রাসোনোগ্রামের প্লেটের স্ক্যানড কপিসহ রিপোর্টটা তার সিনিয়র একজন ডাক্তারের কাছে মেইলে পাঠায়।

মেইলে লেখে, ‘স্যার কাইণ্ডলি এই আল্ট্রাসোনো প্লেটটা একটু দেখবেন। আমি এরকম কেস আগে কখনও পাইনি। এই শিশুটির মৃত্যুর কারণ আমি বুঝতে পারছি না স্যার। আর তার গলার আশেপাশে এসব শিরার মতো জিনিসগুলোই বা কী? এগুলো কোথা থেকে এলো? হতে পারে এটা মেডিক্যাল সায়েন্সের একেবারে অনাবিষ্কৃত কোনও অধ্যায়… ’

 

 

সাত

 

ফুলবানু তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসেছে।

 

তার জগতটা এখন অনেক বদলে গেছে। সে আর আগের মতো দিনরাত চুলের যত্নআত্তি করে না। দিনের পর দিন চুলে তেল না দিতে দিতে জট পাকিয়ে গেছে। তবু সে আর স্বামীকে আহ্লাদি গলায় সুগন্ধি তেল কিনে আনতে বলে না।

আগে চড়ুই পাখির মতো ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগত। গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খাওয়া, যখন তখন পুকুরের পানিতে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি করা, টকটকে লাল করে পা দুটোকে আলতায় রাঙিয়ে নেচে নেচে পুরো বাড়িতে দাপিয়ে বেড়ানো… কিছুই করতে ভালো লাগে না আর! চুলার পাড়ে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। শাশুড়ি কিছু করতে বলে না। গনগনে আগুন দৃষ্টিতে তাকে দেখে। সেই দৃষ্টির আঁচ ফুলবানুকে ছুঁতেও পারে না। সে যেন আর নিজের জগতেই নেই!

মফিজ মিয়াও কথায় কথায় বউকে চোখে হারায় না আজকাল। দোকানের কাজে তার মন নাই। মাঝে মাঝেই হিসাবনিকাশে ভুল হয়ে যায়। বাসায় ফিরে ইচ্ছে করে ধম মেরে নিজের ঘরে শুয়ে থাকতে। খেতে মন চায় না। ফুলবানুর উপস্থিতিও সে যেন আজকাল আর টের পায় না।

 

ফুলবানুর শাশুড়ি আমেনা বেগম অবশ্য নীরব থাকতে পারে না। তার সমস্ত ক্ষোভ আর যন্ত্রণা দগদগে ক্ষতের মতো চুলকাতে থাকে সারাক্ষণ।

থেকে থেকেই তার ফোঁসফাঁস শুনতে পাওয়া যায়, ‘ভ্যান্দামারা পোলা আমার! আগেই কইছিলাম, এই বউ ভালা না! এই বউ ডাইনি! জীন আছে এর লগে! গেরামের বেবাক মাইনষে ভুল কইতাছে? হারামজাদা… বউয়ের রূপে মইজা গিয়া বেবাক কিছু হারাইলি! একটা বাচ্চারেও ডাইনি মাগি বাঁচবার দিলো না! অহন আইসা আবার আমার পোলার ঘাড়ে চাপছে! এ্যাহ ঢঙ ধরছে! ভাব দ্যাখাইতাছে বাচ্চা মইরা গ্যাছে দেইখা নাওন খাওন ভুইলা গ্যাছে! হারামজাদি কিছুই ভোলে নাই! অত যদি কষ্ট পাইছস তাইলে পুকুরের পানিত গিয়া ডুইবা মরছ না ক্যা? বাঁইচা থাকছ কোন হাউশে?’

 

ডুবে মরতে যে ফুলবানু যায়নি কখনও… তা নয়। কিন্তু যতবার মাঝ পুকুরের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে ততবারই কী একটা জানি ওর পায়ের গোছায় পেঁচিয়ে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে ওকে পাড়ে এনে তুলেছে। পাড়ে এসে ফুলবানু আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে, কী পেঁচিয়েছিল তার পায়ের গোছায়। কিন্তু খুঁজে পায়নি কোনও কিছুই। একবার দুইবার না… পরপর তিনবার সে একই অবস্থার শিকার হয়ে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। কী একটা জানি তাকে মরতে বাঁধা দিচ্ছে! কিন্তু কী সেটা?

 

গাঁয়ের যে মানুষটা ফুলবানুর এই দুর্দশায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে সে হলো হাসুর মা। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে মধ্যবয়স্কা এই নারী ফুলবানুকে অভিসম্পাত করে… ‘দ্যাখ ডাইনি ওহন দ্যাখ! আমার কইলজার টুকরারে মাইরা ফ্যালছিলি না? অহন দ্যাখ কইলজা ছিড়া গ্যালে কেমুন লাগে! তর প্যাটের বাচ্চা মরছে না? করছে না আল্লাহয় তর বিচার? করবই তো! আল্লাহ্‌র মাইর… দুইনার বাইর! দ্যাখ ডাইনি মাগি দ্যাখ এইবার!… ‘

 

হাসুর মায়ের এইসব শাপশাপান্তি ফুলবানুকে স্পর্শ করে না। তার সন্তান পানিতে ডুবে মরেছে। সেইসময় ফুলবানু ছিল তার কাছাকাছি। তাই সে ধরে নিয়েছে, ফুলবানু তাকে পানিতে চুবিয়ে মেরেছে। এটা হাসুর মা বুঝতে পারে না, ওরকম তাগড়া জোয়ান একটা ছেলেকে পানিতে চুবিয়ে মারার মতো শক্তি ফুলবানু কোথা থেকে পাবে? তবু মায়ের মন বলে কথা! গাঁয়ের লোকের মিথ্যা অপবাদে সে ভুলভাল বকছে। ফুলবানু তার কথায় কষ্ট পায় না। সে নিজেও তো এখন সন্তান হারানো এক মা। হয়ত তার সন্তানটা দুনিয়ার আলো দেখেনি, তবু কতগুলো দিন সে তার এই জঠরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল। হাত পা নাড়িয়ে সে দুনিয়ায় আসার আকুতি জানাত তাকে।

সন্তানকে হারিয়ে ফুলবানু বুঝতে পারে, পৃথিবীর সব মায়া বুঝি ওই ছোট্ট প্রাণটাতেই আটকে ছিল। সেটা চলে যেতেই তার জগতটা কেমন এক নিমেষেই মায়াশূন্য হয়ে গেছে।

হাসুর মায়ের কষ্টটা সে এখন উপলব্ধি করতে পারে। তার শাপশাপান্ত ফুলবানুকে তাই কষ্ট দেয় না। আহারে মানুষটা না জেনেবুঝেই তাকে দোষ দিচ্ছে!

 

কিন্তু শাশুড়ির কথাগুলো ফুলবানুর ভেতরটাকে মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দেয়। শাশুড়ি এখন কথায় কথায় তাকে ডাইনি বলে গালি দেয়। সে নাকি নিজের সন্তানকেও খেয়ে ফেলেছে! এই কথা সহ্য করতে পারে না ফুলবানু। তার স্বামীও আর আগের মতো নেই। আগে ফুলবানুকে উদ্দেশ্য করে নিজের মা উল্টাপাল্টা কিছু বললে মফিজ প্রতিবাদ করত। এখন সে চুপচাপ সবকিছু শোনে, কিছুই বলে না। ভাষাহীন চোখে তাকায়, সেই চোখের নিঃস্পৃহতা ফুলবানুর বুকে শেলের মতো বেঁধে!

 

সেদিন রাতে তো একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল। সারাদিন শেষে মফিজ মিয়া বাড়িতে আসার পর থেকেই শাশুড়ি কানের কাছে মন্ত্রপড়ার মতো আওড়াতে লাগল, ‘ওহ মফিজ… আমি তরে প্যাটে ধরছি না বাবা? ধরছি কী না ক?’

মফিজ বিরক্ত গলায় বলে, ‘মা ভালা লাগতাছে না। কী হইছে কও তো!’

‘ওহ বাবা! আমার কি খুব ভালা লাগতাছে বাবা? তুই আমারে এই ডাইনির লগে হারাদিন একা থুইয়া চইলা যাস! তর মায়ের জুদি কিছু হইয়া যায় বাপ? তহন তুই মা পাইবি কই? এইডা একবারও তোর মাথায় আসে না বাপ?’

‘মা, আবার সেই প্যাঁচাল জুড়লা? হেয় কি তোমারে কিছু কইছে? তুমি কিছু করতে দ্যাখছ?’

‘হেই করা পর্যন্ত বইসা থাকবি তুই? তোর মায়ের গায়ে হাত তোলনের পর তুই হ্যারে খেদাইবি? আল্লাহ… তুমি আমারে মরণই দাও! আমার নিজের পোলায় আমার কষ্ট বুঝে না! হের কাছে বউই সব! তুই তোর বউরে লইয়াই বইয়া থাগ! মায়ে মরলেও তর কিছু যাব আইব না!’

‘মা নাই কথারে কথা বানাইতাছ ক্যা? আমি বিনাদোষে হ্যারে খেদাইমু ক্যা?’

‘ওহনও তুই ওর দোষ দেখছ না? হাসু মরল, প্যাটের বাচ্চাডারেও বাঁচবার দিলো না! গাঁয়ের লোক দিনেদুপুরে ওর কাছে ভিড়ে না। কয় ওর লগে জীন থাগে। তুই ওহনও কিছু দ্যাখবার পাস না?’

সেদিন অনেক বাড়াবাড়ি হলো। মফিজ মিয়া রাত দুপুরে ভাত না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। আমেনা বেগম বুক চাপড়ে কাঁদতে বসল।

 

স্বামী অনেক রাতেও বাড়িতে না ফিরলে ফুলবানুও ভাত না খেয়ে ঘরের দোর আটকে শুয়ে পড়ে। আজ হয়ত তার স্বামী দোকান ঘরেই শুয়ে পড়েছে। শাশুড়ির হৈ চৈ, কান্নাকাটি, তার প্রতি করা অশ্রাব্য গালিগালাজ… সবকিছুকেই উপেক্ষা করে ফুলবানু নিজের ঘরে অসাড় হয়ে পড়ে থাকে।

মনে মনে ভাবতে থাকে, কী করবে সে? চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে? কিন্তু কই যাবে? বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলে মাও যদি ঘুরেফিরে তাকে দোষ দেয়? গাঁয়ের লোকে অপবাদ দেয়? তাহলে কি গলায় দড়ি দিবে? পানিতে ডুবে তো মরতে পারেনি। গলায় দড়ি দিলে কে তাকে বাঁচাতে আসে দেখবে সে!

 

ভাবতে ভাবতে চোখের পাতাদুটো সবে একটু ধরে এসেছিল। সেদিন রাতে ফুলবানু আবার সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখল।

দেখল, তার বিছানা জুড়ে বসে আছে ছোট ছোট ফণা তোলা বাচ্চা সাপ। আজ তাদের দেখতে কেমন জানি কুৎসিত দেখাচ্ছে। রুক্ষ শুষ্ক চেহারা হয়েছে তাদের। ফুলবানুর শরীর ঘিনঘিন করতে লাগল। আজকেও কিছু অস্পষ্ট কথা হলো তাদের সঙ্গে… ‘তোমরা? তোমরা আবার আইছ? কেডা তোমরা? কী চাও আমার কাছে?’

 

ফণা তোলা বাচ্চা সাপগুলো একসাথে যেন খলবলিয়ে উঠল, ‘আমরা কী চামু তোমার কাছে? তুমি কী চাও সেইটা কও? কে তোমারে যন্ত্রণা দেয় আমাগো কও?’

 

‘ক্যা? সেইডা তোমাগো কমু ক্যা? তোমরা আমার কাছে আসো ক্যা? আর আইবা না কুনোদিন!’

 

‘তুমি না কইলে কি আমরা জানবার পারুম না মনে করছ? আমরা বেবাক কিছু জাইনা ফেলি! আমরা তো তুমার লগেই থাগি। তুমারে কেউ যন্ত্রণা দিলে হ্যারে ছাড়ন যাইব না!’

 

ফুলবানু তাদের কথা শুনে আগামাথা কিছুই বোঝে না। এদের তাকে ভালো রাখার এত দায় কীসের? সে আচমকা জিজ্ঞেস করে, ‘তুমাগো কী হইছে? এমুন শুকনা চেহারা হইছে ক্যা?’

 

‘তুমি তো ভালা নাই! আমাগো দিকে আর তাকাও না! খাইবার দাও না! তাই আমরা শুকাইয়া গেছি। তুমি ভালা থাকলে আমরা আবার সুন্দর হমু!’

 

ফুলবানু বিরক্ত গলায় বলে, ‘যাও এনে থিকা। দুনিয়ার আগডুম বাগডুম বকতাছ! আমি তোমাগো খাইবার দিমু কুন দুঃখে?’

 

 

পরদিন সকালেও অনেক বেলা করে ফুলবানুর ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙল চিৎকার করে কান্নার শব্দ শুনে। ধড়মড় করে ঘরের বাইরে এসে সে দেখতে পেল, শাশুড়ি চিত হয়ে নিজের ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। তার কোলের কাছে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে মফিজ মিয়া।

আমেনা বেগমের হাত পা অস্বাভাবিকভাবে ছড়ানো। চোখদুটো কোঠর ছেড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। গলার কাছে লাল দাগ ঘন হয়ে চেপে আছে। দেখে মনে হয় কিছু একটা বুঝি তার গলা শক্ত করে চেপে ধরেছিল।

 

ফুলবানু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মফিজ মিয়া তাকে দেখেই অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। এই দৃষ্টিতে সে কোনোদিন তার স্ত্রীর দিকে তাকায়নি। আজ তার দুই চোখে সীমাহীন রাগ আর ঘৃণা।

ঐ একটি দৃষ্টিতেই ফুলবানুর ভেতরটা যেন শুকিয়ে যায়। বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। দুনিয়ার সবাই তাকে খারাপ ভাবলেও তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু স্বামীর ঘৃণা নিয়ে সে বাঁচবে কেমন করে? চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমি কিছু করি নাই! বিশ্বাস করো তুমি… আমি কিছু করি নাই!’

 

কিছু বলা হয় না ফুলবানুর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের বাড়িতে গাঁয়ের মানুষ ভেঙে পড়ে। একেকজন একেক কথা বলতে থাকে। কিছু কিছু কানে আসে ফুলবানুর, ‘আহারে… শাশুড়িডারেও বাঁচবার দিলো না!’

‘সত্যই জীন আছে হারামজাদির লগে! মফিজ রূপ দেইখা গইলা গেছিল… ‘

‘এরে না খেদাইলে দুইদিন পরে মফিজও মরব!’

 

ফুলবানু কারো দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। এসব কথা সে শুনতে চায় না। ঘরে ঢুকতে গিয়ে কী একটা মনে করে ধাক্কা লাগে তার। গতকাল রাতে সে যখন নিজের ঘরে ঢুকেছিল, তখন তো  সে ঘরের দোর বন্ধ করে দিয়েছিল। আড়াআড়ি মোটা লাঠিটা তুলে দেওয়া ছিল দরজার সঙ্গে। অথচ আজ যখন সে ঘর থেকে বের হয়ে শাশুড়ির ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল, তখন ঘরের দোর আলগা ছিল। কোনও লাঠি দরজার সঙ্গে লাগানো ছিল না। লাঠিটাকে এক কোনায় অবহেলার সঙ্গে পড়ে থাকতে দেখল সে। আশ্চর্য! ওটা ওখানে গেল কীভাবে?

 

মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে ভাবতে সে আরেকটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল। গত রাতে সে চুলগুলো কোনোমতে আঁচড়ে একটা বেণি গেঁথেছিল। খোঁপা বেঁধে শুতে পারে না ফুলবানু। মস্ত বড় খোঁপা বালিশের ওপরে শক্ত হয়ে চেপে থাকে। তার ঘাড় ব্যথা করে সেই খোপার ভারে। তাই সে বাধ্য হয়েই চুলে বেণি গাঁথে।

 

চুলে হাত দিয়েই ফুলবানু দেখতে পেল, তার চুলে কোনও বেণি গাঁথা হয়নি। এক ঢাল চুল আলগা হয়ে এলিয়ে আছে পিঠময়। অথচ ফুলবানুর পরিষ্কার মনে আছে গতরাতে সে বেণি গেঁথেছিল। কোথায় গেল বেণি? কে এসে বেণি খুলে দিয়ে গেল?

ফুলবানু চুলগুলো হাতে নিয়ে নাড়তে থাকে। কেমন শক্ত হয়ে আছে চুলগুলো। রুক্ষ্ণ জটপাকানো… তবু তারা যেন কী কারণে খুব খুশি আজ। ফুলবানু তাদেরকে হাতে নিয়ে ধরতেই সবগুলো যেন খলবলিয়ে কথা বলে উঠল।

 

গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল ফুলবানুর। চুলগুলোর সাথে কীসের একটা যেন সাদৃশ্য মনে পড়তে গিয়েও পড়ে না! কী একটা যেন হয়েছিল গত রাতে! কী যেন. একটা..

 

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত