শাড়ি

Reading Time: 3 minutes

ফেসবুকে শাড়ি নিয়ে এত পোস্ট দেখতে দেখতে জীবনানন্দ দাশের ‘শাড়ি’ গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল।তেমন কিছুই তো নেই গল্পটার মধ্যে তবু কেমন যেন মর্মভেদী। হৃদয় এফোড় ওফোড় করে দেয়।১৯৩২ – এ লেখা গল্পটি মূলত একটি স্বামী-স্ত্রীর গল্প।কেমন স্বামী রণজিৎ?যে কার্যত স্বীকার করে নেয় ‘অমানুষ’-এর বংশ তার, ‘রাবনের বংশও এমন নচ্ছার ছিল না’।সকাল থেকে ‘জীবন যুদ্ধে হারতে বসা’ রণজিৎ জরুরি কিছু চিঠি লিখতে বসেছে, যদিও জানে, লিখে কী হবে, প্রতিটি অক্ষর লেখা হবার পরই মৃত্যু এসে যেন তাকে গিলে খাচ্ছে। আর কেমন স্ত্রী ঊষা? এই মুহুর্তে তার আব্দার, বাপের বাড়ির ছোটো ছেলেটা পরীক্ষা শেষে মুঙ্গের থেকে এসে ক’দিন ঘুরে যাক। আর এই নিয়েই তাদের মনোমালিন্য, মান-অভিমান ও তর্কবিতর্ক। এবাড়িতে রণজিৎ কাউকে আনতে চায় না কারণ নিজেই সে প্রায় বহিরাগত।এবং টাকা কোথায় যে তারা আলাদা সংসার পাতবে।ঊষা রাগে অপমানে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।এই নিয়েই গল্পের শুরু।

এরপর জীবনানন্দ লিখছেন,’রক্ষা যারা করবে তাদের জাত আলাদা’।তো তাদের এই মলিন দাম্পত্য কলহ থেকে রক্ষাকর্তাটি কে? বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড়ের মস্ত গাঁটরি নিয়ে শাড়ি বিক্রি করা যার পেশা সেই বুড়ো কাপড় ফেরিওয়ালা বিরেশ্বরবাবু। ‘বউমা কাপড় এনেছি, বউমা, কোথায় গো বউমা!’ বিরেশ্বরবাবুর ডাক যাতে ঊষার কানে পৌঁছায় তার জন্য রণজিৎ ঊষার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘গাঁটরি খুলবেন, তাতে আবার এত কথা, কচি কলাপাতা রঙের একরকম শাড়ি বেরিয়েছে বাজারে, উঃ কি ফাইন, কল্পনা করতে পারা যায় না যে মানুষ বুনেছে’।

অতঃপর যা হবার তাই হল।ঊষা বাইরে এল এবং শাড়ি নিয়ে বিরেশ্বরবাবুর সঙ্গে সংলাপে মেতে উঠল।মুখে তার বিরক্তি, হতাশা ও নিষ্কিয়তার বিন্দুমাত্র নেই। বাপের বাড়ির সেই ছেলেটির জন্য দুঃখ কখন যেন উবে গেছে।শাড়ির গাঁটরির প্রতি লোলুপতায় ঊষার মন ভরে ছিল।বেনারসী ও মুর্শিদাবাদী সিল্কের দরদামে এবার সে মেতে উঠল।

রণজিতের মধ্যে আমরা যেন জীবনানন্দর কন্ঠস্বর শুনতে পাই।মেয়েদের এই দারুণ স্পৃহা, জীবনের যে কোনও কামনার জিনিসের জন্য, যেমন করে বাঘিনী সন্তানের সঞ্চার গর্ভে গ্রহণ করে।ঊষার হিংস্র লিপ্সার সামনে নিজের ধীরস্থির ঠাণ্ডা কল্পনার জীবনকে অলীক মনে হচ্ছে লেখকের।নিজেকে মানুষ বলেই মনে হচ্ছে না।ঊষা যেমন গভীরভাবে মানুষ।

গল্পটা এখানেই শেষ।প্রশ্ন জাগে, জীবনানন্দ কেন ‘কামনার জিনিস’ হিসেবে শাড়িকেই বেছে নিলেন।আসলে শাড়ির সঙ্গে মহিলাদের দীর্ঘ সারে চার হাজার বছরের সম্পর্ক।গাঙ্গেয় উপত্যকায় গড়ে ওঠা সভ্যতার সঙ্গে শাড়ির প্রথমদিন থেকেই সম্পর্ক ছিল।মহেঞ্জোদারোর পুরোহিতের তিন পাট্টা পোশাক ইঙ্গিত করে সেই যুগে সুতো কাটা ও বোনার চল ছিল।শাড়ি শব্দটিই তো এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শাটী’ থেকে যার অর্থ টুকরো কাপড়। বৈদিক সাহিত্যে আমরা দুই টুকরোর পরিধান লক্ষ করি। অন্তরীয় ও উত্তরীয়।বৌদ্ধ সাহিত্যে তিন টুকরো কাপড়ের উল্লেখ পাই। সাত্তিক বা শাড়ি, উত্তরিয়া ও স্তনপাট্টা।

রামায়ন ও মহাভারতে বারবার শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। মুক্তো খচিত বর্ডারের শাড়িকে বলা হত মিনিচিড়ি শাড়ি।জনক রাজা সীতা সহ দুই মেয়েকে শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন।সেলাই বিহীন প্রথম বক্ষবন্ধনী কাঞ্চুকী মহাভারতেই পাওয়া যায়।দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ও শাড়ি কীভাবে তাকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করল সে গল্প তো পরিচিত।মহাভারত ও রামায়নে নারীরা শাড়ি পড়ত গোড়ালি অবধি।মগধ(৬৮৪-৩২০ খ্রি.পূর্ব), মৌর্য(৩২০-১৮৫ খ্রি.পূর্ব) ও কুষাণ(১৩০ খ্রি.পূর্ব -১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) যুগে বারবার আমরা শাড়ির উল্লেখ পাই।

গুপ্তযুগে(২৪০-৬০০) অজন্তার ২৮টি গুহার বেশিরভাগ তৈরি হয়েছে।সমসাময়িক কবি কালিদাসের রচনায় শাড়ি রীতিমতো একটি বিষয়। ‘বিক্রমোর্বশীয়ম’ নাটকে রাজপুত্র ও রাজকন্যা দুইয়েরই কাপড় পরিধানের উল্লেখ আছে।

তারপর শাড়ি আর ব্যক্তিগত খেয়াল ও মর্জির ওপর নির্ভর করে রইলো না।’আইন-ই-আকবর’ গ্রন্থে আমরা কারখানার উল্লেখ পাই যেখানে বিভিন্ন ধরনের কাপড় তাঁতীরা বুনছে।বাংলার জামদানী শাড়ি মুঘল সম্রাটদের বরাবরই আকৃষ্ট করেছে।বাবর,আকবর ও শাহাজাহান কেউ-ই এর ব্যতিক্রম নয়।

টিপু সুলতান এক নতুন ধরনের বুনন প্রচলন করেন।কটন ও সিল্কের জটিল মিশ্রনে তৈরি ‘হিম্রু’।তাঁর সময়ে দক্ষিণ উত্তর ও পূর্ব ভারতে অনেক পারদর্শী তাঁতি তৈরি হয়েছিল।কবিরের(জন্ম ১৩৯৮) কথা তো আমরা জানি।এই ভক্ত কবি বেনারসের একজন তাঁতি ছিলেন।তিনি তাঁর দোঁহায় তাঁত বুননের সঙ্গে ঈশ্বর সাধনার তুলনা করেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) সময় বস্ত্রের অভাব ঘটাতে ভারতীয়রা হ্যাণ্ডলুম শাড়ি ও ধুতির কাছে ফিরে গেল।১৮৯৬-তে এডগার থার্সটন হ্যাণ্ডলুমের শাড়ির ডিজাইন নকল করে মিলে সস্তার কাপড় উৎপাদন শুরু করেছিলেন।মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনও ভারতীয় মহিলাদের শাড়ির কাছে নিয়ে গেছে।শাড়িকে তারা নিজেদের ‘স্থায়ী পরিচয়ের প্রতীক’ হিসেবে ভাবতে শুরু করল।

যুগ ও কাল বদলের সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি পরিধানের ধরনও পালটেছ।প্রাচীন যুগে শুধু কোমরবন্ধে শাড়িকে আটকে পরিধান করা হত।তারপর এল নাভি গোপন করবার বিধান।পেটিকোট ও ব্লাউজ তো সাম্প্রতিক কালের ঘটনা।ব্লাউজ ছাড়াও দৃষ্টিনন্দন ভাবে কীভাবে শাড়ি পরিধান করা যায়,আমাদের আগের যুগের মানুষেরা দেখে থাকবেন।আবার শাড়ি বিবর্তন হয়ে অন্য রূপ নিয়েছে তাও দেখা যায়।

ভালো মন্দ দোষ গুণের বিচার করবার জায়গা এটি নয়।আমি শুধু বলতে চাইছি এই শাড়িরও একটি নিজস্ব যাত্রাপথ আছে।আছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক এক ইতিহাস।আছে শিল্প ও শিল্পীর ইতিহাস। জীবনানন্দর এই ‘কামনা’ নিয়ে ভলটার বেনিয়ামিনও ভেবেছিলেন।তাঁর প্রবাদপ্রতিম গ্রন্থ ‘দ্য আর্কেড প্রজেক্ট ‘ এককথায় মানুষের এই বস্তুকামের পথে যাত্রার ইতিহাস।জীবনানন্দ ‘হিংস্র লিপ্সা’ শব্দটি খুব ভেবেই লিখেছিলেন।একটা ডিসকোর্স তিনি তৈরি করতে চেয়েছেন।

শাড়ি নিয়ে আমার আগ্রহ বহুদিনের।রাজস্থানে যখন ছিলাম ঘুরেঘুরে কাপড় বানানো দেখেছি।ইচ্ছে করে বাংলাদেশের কোনও গ্রামে চলে যাই যেখানে মাকড়সার জালের মতো প্রায় অদৃশ্য সুতোয় হাতে বোনা মসলিন তৈরি হচ্ছে।হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও শাড়ির এই রূপকথা ফুরবে না।কারও আগ্রহ থাকলে আবার লিখব।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>