উৎসব সংখ্যা ভ্রমণ: যানযিবারের তস্য গলি । ফাতিমা জাহান
ততক্ষণে জেটিতে ভীড় বেড়েছে। দার এস সালামের মানুষ দেখার সময় নেই এখন। আমি যে জাহাজে করে যানযিবার যাব সে জাহাজ খুঁজে ভেতরে জানালার ধারের সিটে বসে পড়লাম। বাইরে ঐশ্বরিক নীল দেখে চোখ আটকে গেল। এই অপার সৌন্দর্য আমি সামনের কয়েকদিন মন ভরে দেখব।
আমার পাশের সিটে যিনি বসেছেন তাঁকে দেখে ভারতীয় মনে হল। স্থানীয় ভারতীয় হতে পারে৷ জাহাজ ছাড়ার সাথে সাথে এক অদ্ভুত নীল জগতে ডুব দিল জাহাজ। গাঢ় নীল আকাশ আর তার সাথে বয়ে চলছে নীল সমুদ্র। অপার রহস্য তার। পাশের সিটের ভদ্রলোকের সাথে যেচে পড়ে আমিই কথা বলা শুরু করলাম। ভদ্রলোক আসলেই ভারতীয় বংশদ্ভূত তানযানিয়ান, নাম ইসমাইল। তাঁর প্রপিতামহ ভারত থেকে এসেছিলেন এদেশে বানিজ্য করতে। পরে তাঁরা এখানেই থেকে গিয়েছেন। তিনি একসময় এয়ারলাইনস কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এখন অবসরগ্রহণ করেছেন। তিনি বিভিন্ন টিপস দিলেন কিভাবে কোথায় যাব, আদৌ কোথাও কোন বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা ইত্যাদি। এক সময় খেয়াল করলাম তাঁর কথায় আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। অবিরত এত কথা মানুষ বলতে পারে! এদিকে সমুদ্র আমায় ডেকে যাচ্ছে আর আমি সেই নীল নিধুর ডাক অগ্রাহ্য করছি। এটা ঠিক হচ্ছেনা। আমি উঠে জাহাজের ডেকে চলে গেলাম। আরও অনেকেই এসেছে। বাতাস এবং রোদ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আমি জাহাজে একটা চক্কর দিলাম। স্থানীয়, বিদেশী সব যাত্রীর দখলে আছে জাহাজ। ঘুরে আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। আকাশ আর সাগরে এখন কোন পার্থক্য করা যাচ্ছেনা। এরা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। দু’ ঘন্টার মধ্যে যানযিবারের জেটিতে পৌঁছে গেলাম। বের হতে হতে গরমে গা পুড়ে যেতে যেতে মনে পড়ল, এ ভূমি তানযানিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে উষ্ণ।

যানযিবার আধা সায়ত্তশাসিত ভূমি। এখানে প্রবেশ করতে হলে পাসপোর্টে আলাদা স্ট্যাম্প বা সিল দিয়ে যেতে হয়। যানযিবারের রাজধানীর নাম যানযিবার টাউন, এটাই একমাত্র শহর। আর পুরনো টাউনকে বলা হয় স্টোন টাউন। আমার হোটেল জেটির কাছেই স্টোন টাউনে। বাড়িঘরগুলো পাথরে নির্মিত তাই এই নামকরণ। অবশ্য প্রথম দিকে সোয়াহিলি মানুষের বাড়ি ছিল কাঠের তৈরি। পরে তারা বাড়ি তৈরি করত সাগরের প্রবাল দিয়ে। প্রবালে নির্মিত বাড়ি টেকসই না হবার কারণে পাথরখন্ড জোড়া দিয়ে দিয়ে বাড়ি বানানো শুরু করে এরা আনুমানিক সপ্তদশ শতক থেকে। আর সে কারণেই এ শহরের নাম স্টোন টাউন।

আমার হোটেল জেটি থেকে খুব কাছেই। হেঁটে হেঁটে চলে এলাম। হেরিটেজ হোটেলটি সমুদ্র মুখী। আমার রুমের বারান্দা থেকে সামনের নীল সমুদ্র আর সাদা বালির তট, মাঝে সারি সারি নারকেল গাছ দেখা যায়। আমি হোটেলটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পেছনের দিকে লোকালয়। বাড়িগুলোর মূল আকর্ষণ কাঠের ঝুল বারান্দা। বারান্দার রেলিং এ কারুকাজ। এটা স্টোন টাউনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। তবে মূল বৈশিষ্ট্য হল খোদাই করা কাঠের বড় বড় সদর দরজা। বলা হয়ে থাকে, বাড়ি নির্মাণের আগে নাকি দরজা নির্মাণ করা হত এখানে, তারপর খাপে খাপ মিলিয়ে নির্মিত হত একতলা বা দোতলা বাড়ি। এই দরজাকে বলা হয় ওমানি দরজা। ওমানের সুলতানের ভারতীয় কারুকাজ করা কাঠের দরজা খুব পছন্দ ছিল। নিজেদের অবস্থান শক্তপোক্ত হবার পর ওমানের সুলতানরা এই কারুকাজ করা দরজার প্রচলন করেন যানযিবারে৷
বিকেল হতে চলছে। আজকের দিন বৃথা যেতে দেয়া যায়না৷ বেরিয়ে পড়লাম জেটির দিকে। ওদিক থেকে ঘুরে আবার এদিকে আসব। জেটির সামনে মানুষের ভীড় থাকেই। নানা রঙের ম্যাক্সি ড্রেস আর মাথায় কাপড় দেয়া নারী, বিভিন্ন পোশাকের পুরুষ। সাধারণত যে কোন দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর পোষাকে বৈচিত্র্য থাকে বেশি কিন্তু এখানে তার উল্টো। পুরুষের পোশাকেই বেশ বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। কেউ সাধারণ শার্ট প্যান্ট পরিহিত, কেউ ডেনিম, কেউ শর্টস, কেউ বা আরবদের মতো থোয়াব পরিহিত। কারো মাথায় লম্বা গোল টুপি, কারো শির উন্মুক্ত। যানযিবারের অধিবাসীদের মাঝে ৯৯% মুসলমান। বাকিরা খ্রিস্টান, ভারতীয় হিন্দু এবং আফ্রিকায় প্রাচীণ ধর্মাবলম্বী।

জেটি পার হলে প্রথমেই পড়ে বৃটিশ আমলে নির্মিত ডিসপেনসারি বা হাসপাতাল। দেখতে অবশ্য রাজপ্রাসাদের মতো। আর খানিকটা সোয়াহিলি, আরব নকশার মিশেল।। তিনতলা এ হাসপাতালের পুরোটাই সি গ্রিন বা হালকা সমুদ্রাভ সবুজ রঙ করা। ভবনের মাঝখানে চৌকো নকশা করা। বারান্দার রেলিংএ সোয়াহিলি নকশা করা যাকে বলা হয় ব্যালাস্টার। আর বারান্দার ছাদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে সূক্ষ্ম নকশা। এ হাসপাতালটি নির্মাণ করেছিলেন ভারতীয় বংশদ্ভূত তানযানিয়ান সম্প্রদায়। এরা সবসময়ই ধনী বণিক ছিল। তানযানিয়ায় এখন যত ভারতীয় বংশদ্ভূত আছেন তারাও ধনীদের কাতারে পড়েন। পাঁচটা বেজে গিয়েছে বলে হাসপাতাল এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাল সকালে আবার খুলবে।

ডিসপেনসারি পার হলে রাজার প্রাসাদ বা সুলতানের প্রাসাদ। ওমান থেকে আসা সুলতানরা একটা লম্বা সময় যানযিবার শাসন করেছে। আঠারো শতকে নির্মিত এ প্রাসাদটি ১৮৯৬ সালে অ্যাংলো যানযিবার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরে আবার নতুন রূপে নির্মাণ করা হয়। সাদা রঙের সাধারণ ভবন স্বরূপ তিনতলা এ প্রাসাদটি সংস্কারের জন্য এখন বন্ধ রয়েছে। এ ভবনের পাশের এক্সটেনশন ভবনের নাম হাউস অফ ওয়ান্ডারস। এটিও সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ পেলাম। ১৮৮৩ সালে তিন তলা বিশিষ্ট এ প্রাসাদটি যানযিবারের দ্বিতীয় সুলতানের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল।
এর পাশে যানযিবার ফোর্ট।

বিকেলের আলো নিভে যাচ্ছে প্রায়। আজ আর কোন স্থাপনা দেখা যাবেনা। আমি উল্টো পাশের ফোরোধানি পার্কের দিকে চললাম। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়েই পার্কটি গাছপালা নিয়ে জুড়ে আছে। পার্কের মুখে হাজার হাজার আলো জ্বালিয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে অজস্র অমলতাসের পাপড়ি। এত রঙ, এত ফুল আমার চোখে ঘোর এনে দিয়েছে। থোকায় থোকায় এরা বিপ্লবীর মতো আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। যেন আমায় নিয়ে যাবে তাদের দেশে, সন্ধ্যা প্রদীপ করে। আর তাদের জগৎ পার হলে দেখা যায় এখন সূর্যের সাথে পাল্লা দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার লাল আভা। এত লাল কোথা থেকে ছিনিয়ে এনেছে কে জানে! এরা খুব ছিনিয়ে নিতে জানে। কখনো রঙ, কারো মন, কোন এক ক্ষণ। চোখ ফেরানো যায়না। ফেলে রেখে চলে আসা যায়না। জানি কারো জন্যই ফোটেনা তবুও পাশে থেকে যেতে ইচ্ছে করে। অদৃশ্য হয়ে, কখনো খুব জানান দিয়ে।

ফোরোধানি পার্ক এখন জমজমাট। খানিক আগেও একদম খালি ছিল। নানান খাবারের অস্থায়ী স্টল নিয়ে বসেছে দোকানিরা। এরা এতক্ষণ কোথায় ছিল? কম করে হলেও খোলা আকাশের নীচে শ’ খানেক স্টল তো হবেই। সবই সি ফুড এবং মাংসের আইটেম। সব থরে থরে সাজানো – বিভিন্ন মাছ বা মাংসের শাসলিক, তাজা স্কুইড, ছোট অক্টোপাস, নানা ধরনের আস্ত মাছ, সমুসা, পাকোড়া, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পরোটা ইত্যাদি। বললেই অস্থায়ী চুলায় বা গ্রিল চুলায় রান্না করে পরিবেশন করবে। কয়েক জায়গায় হরেক ফলের জুস আর ডাবের পানি বিক্রি হচ্ছে। দেশী-বিদেশী সব ধরনের মানুষের ভীড় এখন। আমি ধীরে ধীরে সাগরপাড়ে চলে গেলাম। এই পার্কের এক ধারে সাগর। তীর ঘেঁষে পাকা পেভমেন্ট পার্কের শেষ অবধি চলে গিয়েছে। এক কোনায় ছোটখাটো জটলা দেখে সেদিকে গেলাম। সেখানে সবাই স্থানীয়। পেভমেন্টের এ পাশটা বেশ উঁচু। নীচে ঝুঁকলে দেয়ালে আঁচড়ে পড়ে ঢেউ। কয়েকটা টিন এজ ছেলে একে একে সেই উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে সাগরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একেকজন লাফ দিচ্ছে আর উল্লাসিত জনতা হাততালি দিয়ে আনন্দ করছে। এ এক স্থানীয় খেলা। আমাকে দেখে একজন একদম কাছ থেকে দেখার জন্য জায়গা করে দিল। এই জনতার মাঝে একমাত্র বিদেশী বলে বুঝিয়ে বলল, ‘এই ছেলেরা প্রতি সন্ধ্যায় এরকম করে সাগরের সাথে খেলায় মেতে ওঠে। এতে স্থানীয়রাও আনন্দ পায়।’ নির্ভেজাল বিনোদনে কে না অংশ নিতে চায়।

হঠাৎ দেখি পাড়ের দেয়াল ধরে সাগরে ভাসতে থাকা দু একটা ছেলে বেয়ে বেয়ে পেভমেন্টে উঠছে। কী সাহস এদের! অবশ্য পা পিছলে পড়লে তো সেই সাগরের জলেই পড়বে হাত পা বা মাথা ভাঙ্গার কোনো ভয় নেই।
ততক্ষণে আকাশ ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ছে সাগরের গায়ে। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে আর এই আনন্দঘন ক্ষণ পেছনে ফেলে আমি চললাম রেস্তোরাঁর খোঁজে। সামনে সাগরপাড়ে একটা সি ফুড রেস্তোরাঁ, নাম কেপ টাউন। ইসমাইল আঙ্কেল এই রেস্তোরাঁর কথা বলেছিলেন। আমি ছাড়া বোধহয় কেউই একা খেতে আসেনি। আসলে সোলো ট্রাভেলার খুব কম আসে যানযিবারে। আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আরুশায় আমার গেস্ট হাউসে যারা ছিল তারা প্রায় সবাই সোলো ট্রাভেলার। আমি ছাড়া বাকি সবাই ইউরোপীয় ছিল।
কেপ টাউন রেস্তোরাঁয় আমি ফিস ফ্রাই খেলাম। আর সাগরের দুলে দুলে সূর্যকে নিজের চাদরের ভেতরে গুটিয়ে নেয়া দেখলাম। এরকম সাগর পাড়ে আস্ত একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া খুব কঠিন কিছু নয়। আমি তো জীবন এভাবেই পার করে দিচ্ছি।
পরদিন সকালে হোটেলের ডাইনিং হলে গিয়ে দেখি ইংলিশ ব্রেকফাস্টের সাথে স্থানীয় নাশতাও সাজানো থরে থরে। আমি স্থানীয় খাবার তুলে নিলাম প্লেটে। ভারতীয়দের হাত ধরে আসা পরোটা এদের খাবারের অংশ হয়ে গিয়েছে এখানে। এরা বলে চাপাতি, অবশ্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষও রুটিকে চাপাতি বলে। স্থানীয় একটা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলাম। নাম – দিযি তামু, পাকা কলার শাহী টুকরা। মানে আমাদের দেশে পাউরুটিকে ভেজে ঘন দুধে ডুবিয়ে এক অমৃত তৈরি করা হয় তেমনি এরা পাকা কলাকে দুধ, নারকেল, চিনিতে সেদ্ধ করে খুব ঘন এক মিষ্টান্ন তৈরি করেছে। খেতে অন্যরকম হলেও সুস্বাদু। নাশতা করে আমি বেরিয়ে পড়লাম দুর্গ দেখতে।
পথে সাগরের ধার ধরে সারি সারি নারকেল গাছ, সাগরে নানান আকারের নৌকা দুলছে, ফোরোধানি পার্ক এখন নীরব, জনমানবহীন। কে বলবে সন্ধ্যায় এখানে উৎসব বসে!

পর্তুগিজদের যুদ্ধে পরাজিত করার পর এই দুর্গটি নির্মাণ করেছিল ওমান সুলতান ১৬৯৯ সালে। এর আগে যানযিবারে শত্রু মোকাবেলা করার জন্য কোনো দুর্গ ছিলোনা। দুর্গের বাহির দেয়ালে শ্যাওলা ধরে গিয়েছে। বাইরে থেকে দেখে খুব একটা বড় দুর্গ বলে মনে হলোনা। প্রবেশদ্বারে ঐতিহ্যবাহী ওমানি নকশা করা। দরজার ধার ধরে ফুল লতাপাতা খোদাই করা। দুর্গটি আসলেই বেশ ছোট। মাঝখানে দাঁড়িয়ে পুরো প্রাঙ্গণ দেখা যায়। হালে দুর্গের মাঝের খোলা আকাশের নীচের একটি মঞ্চ তৈরি হয়েছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বিভিন্ন স্যুভেনিয়র শপ। আগেও অবশ্য এই স্যুভেনিয়রগুলো আরুশা, দার এস সালামে দেখে এসেছি। তবে যানযিবারের মুখোশ অন্যান্য স্থানের চেয়ে আলাদা। একটা অস্থায়ী দোকানে শুধুই মুখোশ সাজানো ওপর থেকে নীচে অবধি। কাঠের এই মুখোশের রঙ গাঢ় বাদামী বা চকোলেট। একেক মুখোশের ভঙ্গিমা একেক রকম, অভিব্যক্তি একেক রকম। আশ্চর্যজনকভাবে জড় পদার্থ হয়েও কত কথাই না বলে ফেলছে এরা। কারো মাথায় নারকেলের ছোবড়া দিয়ে চুল ড্রেডলক করা, কারো মাথায় পাখির পালকের মুকুট, কারো মুখে আদি মানবের মতো সাদা ফোঁটা ফোঁটা নকশা করা। মুখোশ দেখলেই তানযানিয়ার অনেক ইতিহাস পড়ে ফেলা যায়।

আরেকটা স্যুভেনিয়র শপে দেখি বব মারলের কিশোর বেলা বসে বসে তাঁত বুনছে। কি মিষ্টি হাসি ছেলেটার! আমি তো জিজ্ঞেস করেই বসলাম, ‘তুমি কি বব মারলের জ্ঞাতিগুষ্টির কেউ হও নাকি হে?’ ছেলেটি শুধু হেসেই গেল। ও যে কাপড় বুনছিল তা ভারতে মোটা খাদি কাপড় নামে পরিচিত, আমাদের দেশে বলে খদ্দর কাপড় অবশ্য আজকাল আমাদের দেশে খদ্দর কাপড়ের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে।
স্যুভেনিয়র শপগুলোর মাঝখানে ছোট একটা মাঠের মতো। দুর্গের চারধারে চারটা উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। দেয়াল ছাড়া আর কিছু দেখার নেই বলে আমি স্টোন টাউন দুর্গ থেকে সোজা গলি ধরে হাঁটা দিলাম। স্টোন টাউন ঘুরে দেখার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হল হন্টন। একধারে নীল সাগর বয়ে যাচ্ছে আরেক ধারে স্টোন টাউনের দোতলা সাদা মুখোমুখি ভবনগুলো দাঁড়িয়ে শুভ্রতা ছড়াচ্ছে।
প্রথম দিকের ভবনগুলো ব্যাংক বা অফিস তবে প্রত্যেক ভবনেই চকলেট কালারের ওমানি দরজা ভবনের মাঝ বরাবর শোভা পাচ্ছে। একেক দরজার আকার বিশাল এবং উঁচু, প্রায় দেড় তলা সমান। আর কারুকাজের ভিন্নতা তো আছেই।
গাছপালাও ফাঁকে ফাঁকে বেশ জায়গা করে নিয়েছে। সাদা সবুজের সমন্বয়ে পুরনো পর্তুগিজ টাউনের মতো লাগছে। বড় গলি ছেড়ে আমি এবার ছোট গলির দিকে এগুলাম। ব্যাংক, দপ্তর পেরিয়ে এখন সরু সরু গলিগুলোয় মানুষের আবাসন। এখানেও প্রত্যেক বাড়ির নীচতলায় স্যুভেনিয়র শপ, ক্যাফে, মসলার দোকান ইত্যাদি। যানযিবারে বেশ কয়েকটি মসলার বাগান আছে। এখানে মসলার বাগান ঘুরে দেখার ওয়াকিং ট্যুরের আয়োজন করে। আমার মসলাদার বৃক্ষ, গুল্ম দেখার চেয়ে পুরনো ঘরবাড়ি আর সাগর দেখার আগ্রহই বেশি।

অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে এখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাপন। প্রতিটি দোতলা বাড়িতেই মানুষ বসবাস করে। আবার প্রায় সব বাড়ির নীচতলায় স্যুভেনিয়র শপ। কোনো বাড়ি গেস্ট হাউস হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। আমি যে হোটেলে উঠেছি সেটির মালিক একজন ভারতীয় বংশদ্ভূত তানযানিয়ান। একসময় নিজেরা থাকতেন, এখন হেরিটেজ হোটেল বানিয়েছেন। বাড়ির বয়স একশত বছরের বেশি৷

স্টোন টাউনের প্রতি গলিতে আছে এখানকার ঐতিহ্য মেশানো তানযানিয়ান কফির মতো সুগন্ধি ইতিহাস, এখানকার সংস্কৃতির মতো উজ্জ্বল লোকগাঁথা। একেক গলি যেন একেক রূপকথার বইয়ের একেক পৃষ্ঠা। শুরু তো করাই যায় কিন্তু এর শেষ নেই কোথাও।

পর্যটক, কথাসাহিত্যিক
জন্ম ঢাকায়। বেড়ে উঠা ব্যাঙ্গালোরে, পড়াশোনা ব্যাঙ্গালোর ও সিঙ্গাপুরে।
পেশায় ফিন্যানশিয়াল অ্যানালিস্ট।